আওয়ামী লীগের সঙ্গে পথচলার দুই দশকে সাম্যবাদী দলের একমাত্র পাওয়া দিলীপ বড়ুয়ার মন্ত্রিত্ব। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় এসে ১৪ দলের শরিক এই দলটির প্রধানকে মন্ত্রী করেছিলেন জোটনেত্রী শেখ হাসিনা। এরপর আন্দোলন-সংগ্রাম ও ত্যাগের কোনো পুরস্কারই মেলেনি দলটির। উল্টো এই সময়কালে অন্তত দু’দফা ভাঙনের কবলে পড়ে। বুর্জোয়া সংগঠন ও সরকারের লেজুড়বৃত্তির তকমা দিয়ে নেতারা সাম্যবাদী দল থেকে বেরিয়ে আলাদা দল গড়েন।
গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সাম্যবাদী দলের রাজনৈতিক অস্তিত্বই হুমকির মুখে। কর্মসূচি দূরে থাক, প্রকাশ্যে দলের নেতাদের দেখা মেলাই ভার। সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া অজানা স্থানে ঘাপটি মেরে আছেন। মোবাইল ফোনে অসংখ্যবার কল দিয়েও তাঁর সাড়া মেলেনি।
প্রায় একই অবস্থা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের বাকি শরিকদের। প্রভাবশালী দুই শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জাসদ) কার্যক্রম হয়েছে সংকুচিত। ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একাধিক হত্যা মামলার আসামি হয়ে কারাগারে গেছেন। দু’দলের সাধারণ সম্পাদকের মধ্যে ওয়ার্কার্স পার্টির ফজলে হোসেন বাদশা ও জাসদের শিরীন আখতার আত্মগোপনে। এ পরিস্থিতিতে ওয়ার্কার্স পার্টি ভারপ্রাপ্ত দিয়ে এবং জাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির মাধ্যমে দলীয় কার্যক্রম চালাচ্ছে।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২০০৫ সালের ১৫ জুলাই আত্মপ্রকাশ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দল। একসঙ্গে আন্দোলনের পর ২০০৮ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে এ জোট। সে সময় জোটের শরিক দল ছিল ১০টি। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর জাতীয় পার্টি-জেপি, তরীকত ফেডারেশন ও বাসদ (রেজাউর) জোটে যুক্ত হওয়ায় শরিক দল দাঁড়ায় ১৩।
তবে প্রায় ২০ বছরের ঐক্যবদ্ধ পথচলায় ১৪ দলীয় জোটের বড় দুই শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ ভেঙে নেতারা আলাদা দল গঠন করেন। এর পর আরও তিন দফা ভেঙেছে ওয়ার্কার্স পার্টি। একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতা দল ছেড়ে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি কিংবা বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ নামে নতুন দল গঠন করেন। কেউ কেউ সিপিবিতে যোগ দেন। একইভাবে ভাঙে জাসদও। দলটির গুরুত্বপূর্ণ কয়েকজন নেতাসহ একটি বড় অংশ বেরিয়ে গিয়ে বাংলাদেশ জাসদ নামে নতুন দল গঠন করে।
১৪ দলের আরেক শরিক সাম্যবাদী দল ভেঙেছে দু’দফা, ন্যাপ ভেঙেছে এক দফা। গণতন্ত্রী পার্টি ভাঙলেও দলটির ব্রাকেটবন্দি দুই অংশ শেষ পর্যন্ত ১৪ দলেই ছিল। তরীকত ফেডারেশন থেকে বহিষ্কৃত কিছু নেতা আলাদা দল গড়েছেন।
জোটের বাকি শরিক দল জাতীয় পার্টি (জেপি), কমিউনিস্ট কেন্দ্র, গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি এবং বাসদ (রেজাউর) অবহেলা, অবমূল্যায়ন ও বঞ্চনার ক্ষোভ চেপে রেখেই ১৫ বছর ধরে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী হিসেবে পথ চলেছে।
এদিকে ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদী শাসন অবসানের পর ক্ষমতাচ্যুত দলটির সঙ্গে ফ্যাসিবাদের দোসর তকমা পাওয়া ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলের ওপরও নেমে আসে বিপর্যয়। রাজনীতির মাঠে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায় অধিকাংশ দল। নেতাকর্মী চলে যান আত্মগোপনে। তবে দুই দলের শীর্ষ নেতা মেনন-ইনু গ্রেপ্তারের পরও ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ দলীয় কার্যালয়ে ঘরোয়া বৈঠক, বিভিন্ন দিবস পালন এবং বিবৃতি দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। তরীকত ফেডারেশন গণঅভ্যুত্থানের পরের সময়ে দু-একটা বিবৃতি দিয়ে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দেওয়ার চেষ্টা করলেও এখন নিশ্চুপ। অন্য শরিক দলগুলো ছয় মাস ধরেই নিষ্ক্রিয়।
১৪ দলের কয়েকজন নেতা জানান, পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তাদের মারাত্মক রাজনৈতিক সংকটে ফেলেছে। প্রকাশ্যে কোনো ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি নিতে পারছেন না তারা।
বিভিন্ন এলাকায় নেতাকর্মীর ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যক্তিজীবন বিপর্যস্ত। গণঅভ্যুত্থানের প্রায় সাত মাস পার হলেও দলগুলোর নেতাকর্মীর আতঙ্ক কাটছে না। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল– সবখানে একই অবস্থা চলছে। এ অবস্থার অবসান কবে, কীভাবে হবে, সেটি নিয়েও তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই। তারা আরও বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশ ও দেশের বাইরে পালিয়ে থাকা আওয়ামী লীগের কোনো নেতা এখন পর্যন্ত শরিক দলের কারও সঙ্গে যোগাযোগ করেননি। তবে শরিক দলগুলো একে অন্যের সঙ্গে ব্যক্তিগত যোগাযোগ রক্ষা করছে। এর মাধ্যমে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের চেষ্টা করছে তারা।
সম্প্রতি যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে ১৪ দলের শরিক নেতাকর্মীর মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়েছে। সারাদেশে মূলত আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা গ্রেপ্তার হলেও শরিক দলের নেতাকর্মীরাও নজরদারিতে রয়েছেন। ঢাকাসহ কয়েকটি জেলায় শরিক দলের নেতাকর্মীকে হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া যেসব মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে, ১৪ দলের নেতাকর্মীকে সেসব মামলায় গ্রেপ্তার করা হতে পারে– এমন ভয়ও কাজ করছে। এ পরিস্থিতিতে গা-ঢাকা দিয়ে নিজেকে রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
জানতে চাইলে ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা সমকালকে বলেন, ‘সংকটের মধ্যেও আমরা দলীয় আদর্শ ও নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে দলকে সক্রিয় রাখার চেষ্টা করছি। দলকে যেমন বাঁচিয়ে রাখতে হবে, তেমনি নেতাকর্মীকেও টিকিয়ে রাখতে হবে। আমরা সেই চেষ্টাই করছি।’
একই কথা বলেন তরীকত ফেডারেশনের মহাসচিব সৈয়দ রেজাউল হক চাঁদপুরী। তাঁর ভাষায়, বিপর্যয়ের মধ্যে দলকে যতটুকু গুছিয়ে থাকা যায়, সেই চেষ্টা করছি।
বাসদের (রেজাউর) আহ্বায়ক রেজাউর রশীদ খান বলেন, নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে দল গুছিয়ে আনার চেষ্টা করছি। আগামী মার্চে জেলা-উপজেলা সম্মেলনের মাধ্যমে প্রকাশ্যে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করা হবে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: আওয় ম ল গ গণঅভ য ত থ ন ল র ন ত কর ম ন ত কর ম র দল র ন ত র ক দল র র জন ত ক ন র পর দলট র আওয় ম ক ষমত গঠন ক
এছাড়াও পড়ুন:
হাদিকে হত্যার চেষ্টায় নিন্দা ও উদ্বেগ এনসিপির
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদির ওপর রাজধানীর বিজয়নগরে প্রকাশ্য দিবালোকে চালানো ন্যক্কারজনক সন্ত্রাসী হামলার ঘটনায় জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তীব্র নিন্দা ও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করছে।
শুক্রবার (১২ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় এনসিপির মিডিয়া সেলের সম্পাদক মুশফিক উস সালেহীন স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
আরো পড়ুন:
ওসমান হাদিকে গুলির বিষয়ে তদন্ত করবে ইসি
কুমিল্লায় নিজের পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন অপসারণ করলেন জামায়াতের প্রার্থী
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, এ হামলা শুধু একজন প্রার্থীর ওপর নয়, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পুনরুদ্ধার হওয়া গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার ওপরও সরাসরি আঘাত। এনসিপি গুরুতর আহত শরিফ ওসমান হাদির দ্রুত সুস্থতা কামনা করছে এবং দেশবাসীর কাছে তার জন্য দোয়া প্রার্থনা করছে।
এই হামলা দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ও নির্বাচনি পরিবেশের ভঙ্গুরতা সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন তুলে দেয়। বিশেষভাবে উদ্বেগজনক বিষয় হলো, শরিফ ওসমান হাদি হামলার আগে হুমকির কথা প্রকাশ্যে জানানোর পরও তার নিরাপত্তা নিশ্চিতে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। এর আগে জাতীয় নাগরিক পার্টির কার্যালয়ের সামনে বারংবার ককটেল হামলা এবং একজন প্রার্থী হুমকি পাওয়ার পরেও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকারের চরম ব্যর্থতা দায়িত্বহীনতা, অদক্ষতা ও উদাসীনতার নগ্ন উদাহরণ, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
একই সঙ্গে আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, দীর্ঘদিন ধরে নিষিদ্ধ ঘোষিত সন্ত্রাসী সংগঠন আওয়ামী লীগ জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালিয়েছে, সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছে, এবং তাদের অবশিষ্ট সন্ত্রাসী বাহিনী এখনো সক্রিয়ভাবে দেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। সরকার যদি অবিলম্বে আওয়ামী লীগের এই সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা না করে, তবে তারা আবারও গণতান্ত্রিক উত্তরণকে বাধাগ্রস্ত করবে এবং দেশকে সহিংস অরাজকতার দিকে ঠেলে দেবে।
আমরা দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, এখন গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তিগুলোর একে অপরকে দোষারোপ করে রাজনৈতিক লাভ তোলার সময় নয়; এখন সময় প্রকৃত অপরাধী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকদের খুঁজে বের করে বিচারের মুখোমুখি আনার। গণঅভ্যুত্থানের শক্তি যদি বিভক্ত হয়, তাহলে সুযোগ নেবে পতিত ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ ও দেশবিরোধী চক্র, যারা অতীতেও হত্যা ও সহিংসতার মাধ্যমে রাজনীতিকে কলুষিত করেছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টি দেশের নাগরিক সমাজ, তরুণ প্রজন্ম, পরিবর্তনের পথযাত্রায় থাকা সকল গণতান্ত্রিক শক্তি এবং সর্বোপরি দেশের আপামর জনগণকে সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। আমরা দৃঢ়ভাবে জানাতে চাই, যেকোনো হুমকি, ভয়ভীতি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড উপেক্ষা করে নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক উত্তরণ নিশ্চিত করতে এনসিপি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
অবিলম্বে এই হামলার বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত, হামলাকারীদের গ্রেপ্তার, হুমকির উৎস শনাক্ত করাসহ আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী নেটওয়ার্কের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান পরিচালনা এবং সকল প্রার্থী ও নাগরিকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানাচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। শান্তি, নিরাপত্তা ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যৎ রক্ষায় আমরা দৃঢ়ভাবে দেশবাসীর সাথে আছি এবং থাকব।
ঢাকা/রায়হান/রফিক