যাত্রী ওঠানোর জন্য বাস দাঁড় করিয়ে রাখার প্রতিবাদ, ঢাবি শিক্ষককে মারধরের অভিযোগ
Published: 28th, February 2025 GMT
যাত্রী ওঠানোর জন্য দীর্ঘক্ষণ বাস দাঁড় করিয়ে রাখার প্রতিবাদ করায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষককে মারধরের অভিযোগ উঠেছে বাসের চালক ও সহকারীর বিরুদ্ধে। ওই শিক্ষকের নাম আদীব শাহরিয়ার জামান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রভাষক। আজ শুক্রবার বেলা তিনটার পর রাজধানীর মিরপুর ১১ নম্বর এলাকায় বাংলা স্কুলের বিপরীত পাশের সড়কে এ ঘটনা ঘটে।
আদীব শাহরিয়ার জামান ফেসবুকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ঘটনার বর্ণনা তুলে ধরেছেন। পরে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে প্রথম আলোকে হামলার বিষয়ে বিস্তারিত জানান তিনি। এই শিক্ষক বলেন, মিরপুর সুপার লিংক (৩৬ নম্বর) পরিবহনের বাসের চালক ও সহকারী মিলে লোকজনের সামনেই তাঁকে মারধর করেছেন।
এদিকে এ ঘটনার পর আজ বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা মিরপুর সুপার লিংকের অন্তত পাঁচটি বাস ক্যাম্পাসে নিয়ে গেছেন। অভিযুক্ত চালক ও তাঁর সহকারীকে শনাক্ত করার পর বাসগুলো ছাড়া হবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খালিদ মনসুর বলেন, ‘শিক্ষককে হেনস্তার ঘটনার পর শিক্ষার্থীরা বাসগুলো নিয়ে গেছে বলে শুনেছি।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী রায়হান ফেরদৌস সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে প্রথম আলোকে বলেন, ‘অভিযুক্ত চালককে শনাক্ত করার জন্য বাসগুলো আটকে রাখা হয়েছে। বাসের মালিকপক্ষকে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। প্রকৃত অপরাধীকে শনাক্ত করতে পারলেই আমরা বাসগুলো ছেড়ে দেব।’
শিক্ষক আদীব শাহরিয়ার জামান প্রথম আলোকে বলেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বি’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে দায়িত্ব পালন শেষে দুপুরে মিরপুরে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। পথে নিউমার্কেট থেকে স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ৩৬ নম্বর বাসে ওঠেন। বাসটি মিরপুর ১০ নম্বরে ২০ মিনিটের মতো সিগন্যালে আটকে ছিল। তখন বেশির ভাগ যাত্রী নেমে যাওয়ায় অনেক আসন ফাঁকা হয়ে যায়। এর মধ্যে সিগন্যাল ছাড়লেও চালকের সহকারী যাত্রী ডাকতে থাকেন এবং বাসটি থেমে থেমে চলতে থাকে। এতে আবার বাসটি সিগন্যালে পড়ার উপক্রম হয়।
আদীব শাহরিয়ার জামান আরও বলেন, আরেকটি সিগন্যালে আটকানো এড়াতে যাত্রীরা চালককে দ্রুত বাসটি চালাতে বলেন। বাসের অর্ধেকের মতো যাত্রীই ছিলেন ভর্তি পরীক্ষার্থী। তাঁরাও সিগন্যালটি পার হওয়ার জন্য অনুনয় করতে থাকেন। কিন্তু চালক কথা শোনেননি। শেষ পর্যন্ত পরীক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করে এ ঘটনার প্রতিবাদ করেন তিনি। এর জেরে চালক ও সহকারীর সঙ্গে তাঁর তর্ক শুরু হয়।
ভুক্তভোগী শিক্ষক বলেন, মিরপুর সুপার লিংক বাসটির সর্বশেষ স্টপেজ মিরপুর ১২ নম্বর। তাঁর নামার কথা ছিল ১১ নম্বরে। কিন্তু চালক ও তাঁর সহকারীর আচরণের প্রতিবাদ করায় চালক হুমকি দেন, মিরপুর ১১ নম্বরে তাঁকে নামতে দেবেন না। পরের স্টপেজ মিরপুর ১২ নম্বরে নিয়ে তাঁকে মারধর করবেন। তখন আট থেকে ১০ জন যাত্রী বাসের ভেতরে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন বাস থেকে নামতে চাইলেও তাঁদের নামতে দেওয়া হয়নি। তখন প্রতিবাদ করে ১১ নম্বরের কাছাকাছি একটি জায়গায় বাসটি থামাতে বাধ্য করেন তিনি।
বাস থামার পর প্রথমে স্ত্রীকে নামিয়ে দেন বলে জানান আদীব শাহরিয়ার জামান। তিনি বলেন, স্ত্রীর পর তিনি বাস থেকে নামেন। তাঁর পেছনে বাস থেকে নামেন চালক ও তাঁর সহকারী। তাঁরা একটি বাঁশ নিয়ে তাঁর মাথায় আঘাত করেন। পেটে লাথি দেন চালক। টেনে ছিঁড়ে ফেলা হয় পোশাক। এই সময় সাধারণ লোকজন তাঁদের ঘিরে দেখতে থাকেন। বাসে থাকা পরীক্ষার্থীরাও পুরো ঘটনা দেখেন। এরপর চালক ও তাঁর সহকারী দ্রুত বাসে উঠে চলে যান।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ক ষ র র সহক র র জন য প রথম ঘটন র ম রধর
এছাড়াও পড়ুন:
নাগরিক পার্টি রাজনীতিতে ‘প্যারাডাইম শিফট’ ঘটাবে?
মার্কিন পদার্থবিদ ও দার্শনিক টমাস কুন (১৯২২-১৯৯৬) তাঁর ‘দ্য স্ট্রাকচার অব সায়েন্টিফিক রেভলিউশন’ (১৯৬২) বইয়ে প্রথম ‘প্যারাডাইম শিফট’-এর ধারণা দেন। কুনের মতে, বিশেষ ঐতিহাসিক অবস্থায় একটি আদিকল্পকে আশ্রয় করে বিজ্ঞানের নানা শাখায় মৌলিক অগ্রগতি হয়। কিন্তু এক পর্যায়ে জ্ঞানকাণ্ডে নতুন কিছু প্রশ্ন ওঠে, যা সেই আদিকল্প সুরাহা দিতে পারে না। এ অবস্থায় নতুন আদিকল্পের দরকার পড়ে। প্রগতির দাবি মেটাতে পারে না বলেই পুরোনো আদিকল্পের প্রভাব ক্ষীণ হয়ে আসে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ‘নতুন আদিকল্প তার অগ্রজকে হটিয়ে দিয়ে নেতৃত্বের ভূমিকাতে নামে’ (রণজিৎ গুহ, দেখুন: গৌতম ভদ্র সম্পাদিত নিম্নবর্গের ইতিহাস, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৮)।
টমাস কুন তাঁর ধারণাটি বিজ্ঞানের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখলেও অনেকে তা বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। যেমন মশহুর ঐতিহাসিক রণজিৎ গুহ (১৯২৩-২০২৩) ভারতবর্ষের ইতিহাসচর্চায় কুনের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। একইভাবে রাজনীতি শাস্ত্র কিংবা রাজনীতির মাঠে এমন কিছু মৌলিক পরিবর্তন কিংবা জিজ্ঞাসার উদ্রেক হয়, যা বিদ্যমান আদিকল্পকে চ্যালেঞ্জ করে। সম্প্রতি বাংলাদেশে ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা’ উপড়ে ফেলার যে ডাক উঠেছে, তা রাষ্ট্রবিজ্ঞানে একটি ‘প্যারাডাইম শিফট’, যা নতুন একটি আদিকল্প হিসেবে হাজির হয়েছে।
ইতিহাসবিদ জোসেফ কনবিটজ মনে করেন, বিশেষ কোনো ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ‘এক শতাব্দীতে একবার বা দু’বার একটি বড় সংকট পরিবর্তনকে উস্কে দেয়।’ জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার মতোই বিভিন্ন ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। জ্ঞানকাণ্ডের মতোই রাজনীতিতে পুরোনো ব্যবস্থা ভেঙে নতুন কোনো কাঠামো গড়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয় কিংবা যুগ যুগ ধরে ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখা বিশেষ কোনো পরিবার, বংশ কিংবা গোষ্ঠীর পতন ঘটতে পারে। জোসেফের মতে, একটি প্যারাডাইম শিফট ঘটতে অন্তত বিশ-ত্রিশ বছরের একটি বিপর্যয়কর প্রক্রিয়া হাজির থাকে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে কিংবা বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমরা সে রকমই একটি প্যারাডাইম শিফট দেখছি। অন্তত গত পাঁচ দশকের রাষ্ট্র কাঠামো কিংবা গণতন্ত্রের মিথ্যা বুলি বা আদিকল্প ব্যর্থ হওয়ায় নতুন করে এই দাবি উঠেছে।
টমাস কুনের কয়েকশ বছর আগে ইবনে খালদুন (১৩৩২-১৪০৬) তাঁর মুকাদ্দিমা (১৩৭৭) গ্রন্থে প্যারাডাইম শিফটের মতোই আসাবিয়ার ধারণা দিয়েছিলেন। খালদুন দেখিয়েছেন, ইতিহাসের চক্রে আসাবিয়া বা সামাজিক সংহতি গড়ে ওঠে এবং ধীরে ধীরে তার শক্তি হারিয়ে পতনও ঘটে। এই প্রক্রিয়ায় বিপুল সাম্রাজ্যের অধিকারী রাজবংশ ক্ষমতা হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। একটি আদিকল্প উদ্ভবের মধ্য দিয়ে পুরোনো আদিকল্প ক্ষীণ হয়ে পড়ে। জ্ঞানবিদ্যায় যেভাবে পুরোনো ধারণা সেকেলে হয়ে পড়ে, তেমনিভাবে রাজনীতিতেও পুরোনো বন্দোবস্ত কিংবা ব্যবস্থা আকর্ষণ হারায়।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাষ্ট্র কাঠামো গুটিকয়েক মানুষের সংহতি নিয়ে গড়ে ওঠে, যেখানে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি। গত অর্ধশত বছরের সামাজিক বঞ্চনা ও বৈষম্য তারই পরিণতি। ফলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে আদিকল্প ঘিরে সংহতি গড়ে উঠেছিল, তা সম্প্রতি ভয়াবহভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের অনেকেই এই রাষ্ট্র কাঠামোতে কেবল ক্ষমতার হাতবদল ঘটে বলে চিহ্নিত করেছেন। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতেও নতুন আদিকল্পের উত্থান ঘটেছে, যার চূড়ান্ত প্রকাশ জাতীয় নাগরিক পার্টি।
নতুন আদিকল্পের মূল ভিত্তি ‘ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা’র বিলোপ ঘটানো। অর্থাৎ বিশেষ কোনো পরিবার কিংবা গোষ্ঠীর হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত থাকতে পারে না। অতীতে রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্র উপড়ে ফেলতে এত শক্তিশালী আওয়াজ কখনও দেখা যায়নি। এরই মধ্য দিয়ে প্রজন্মগত ফারাকের ব্যাপারটিও পরিষ্কার হয়েছে। কুন যেভাবে বলেছেন, ‘নতুন আদিকল্প তার অগ্রজকে হটিয়ে দিয়ে নেতৃত্বের ভূমিকাতে নামে।’ এই অভ্যুত্থান শুধু বাংলাদেশে নয়, দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশে তার প্রভাব পড়বে।
লুটেরাতন্ত্র থেকে পুরোপুরি শ্রেণিগত রূপান্তর না ঘটায় নতুন আদিকল্পের সম্ভাবনা নিয়ে আশঙ্কাও কম নয়। তবে আদিকল্পটি যতটা আশঙ্কার, তার চেয়ে বেশি সম্ভাবনার। নতুন আদিকল্পে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যমান শ্রেণি-গোষ্ঠীর স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবেই এবং নতুন শ্রেণি-গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। ফলে এখানে অর্থনৈতিক, আদর্শিক দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এ কারণে নিকট ভবিষ্যতে শ্রেণিস্বার্থের দ্বন্দ্বে সংঘাত, খুনোখুনি বাড়তে পারে। বিশেষত নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসবে ততই সংঘাতের আশঙ্কা বাড়বে। তবে এসব ঘটনায় নতুন সম্ভাবনাকে পুরোপুরি নাকচ করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। জ্ঞানকাণ্ডে যেমন একটি আদিকল্প জায়গা নেওয়ার আগে বহু তর্ক-বিতর্ক ও আলোচনার ঝড় ওঠে; তেমনি রাজনৈতিক মাঠে বিদ্যমান ব্যবস্থা উপড়ে ফেলতে বহু সংঘাত, সহিংসতা ও বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। নতুন আদিকল্প যতটা সামাজিক সংহতি গড়ে তুলতে পারবে, ততটাই সংঘাত ও সহিংসতার মাত্রা কমে আসবে। সম্প্রতি রাজনৈতিক বন্দোবস্তের প্রবক্তা অধ্যাপক মুসতাক খান নতুন বন্দোবস্ত কায়েমে সামাজিক আন্দোলন ও রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়ে তরুণদের মাঠে হাজির থাকা জরুরি বলে মন্তব্য করেছেন।
আদিকল্পের শক্তি যেমন তার পাটাতনের ওপর নির্ভর করে– যা বিভিন্ন প্রতিকল্প, ধারণা ও বয়ানের মধ্য দিয়ে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়; তেমনি রাজনীতিতে আদিকল্পের শক্তি নির্ভর করে সামাজিক সংহতির প্রশ্নে তা কতটা শক্তিশালী। ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ সামনে রেখে যে অভ্যুত্থান ঘটেছে, সেই আদিকল্পের শক্তির ওপরই নির্ভর করছে আগামী দিনের রাজনীতি। সামাজিক সুবিচার তথা ইনসাফ কায়েম, বৈষম্য নিরসন এবং জনগণকে ক্ষমতায়িত করার মধ্য দিয়ে একমাত্র ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ সম্ভব। সেই লক্ষ্যে অটুট থাকলে নতুন আদিকল্প শক্তিশালী হবে। আর বাংলাদেশের মানুষ দীর্ঘদিনের পরিবারতন্ত্র, বণিকতন্ত্র ও সব ধরনের গোলামি থেকে বেরিয়ে এসে একটি নতুন রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে হাজির হবে।
ইফতেখারুল ইসলাম: সহসম্পাদক, সমকাল
Iftekarulbd@gmail.com