‘এই বয়সে আমাকে অপমান করলে আমি নিতে পারব না’
Published: 28th, February 2025 GMT
২৯ বছর পর কোনো বৈশ্বিক ক্রিকেট টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে গিয়ে ছয় দিনেই বিদায়—আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে পাকিস্তানের গল্পটা এমনই।
যেখানে পান থেকে চুন খসলেই ক্রিকেটারদের দিকে সমালোচনার তির ছোঁড়া হয়, সেখানে ঘরের মাঠে এত বড় টুর্নামেন্টে রিজওয়ান–বাবর–আফ্রিদিদের বিবর্ণ পারফরম্যান্সের পর সাবেকদের ক্ষুব্ধ হওয়াটাই স্বাভাবিক।
ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনিস, শোয়েব আখতারের মতো কিংবদন্তিরা টেলিভিশন চ্যানেলের আলোচনা অনুষ্ঠানগুলোতে পাকিস্তান দলের সমালোচনা করছেনও। এমনকি দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিশ্বকাপ জয়ী অধিনায়ক ইমরান খান জেলে থেকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফির গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছে স্বাগতিক পাকিস্তান.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
জাতীয় আয় বৃদ্ধি টেকসই হবে তো?
সংবাদটি খুব ছোট্ট করে এসেছে। কেউ হয়তো খেয়াল করেছেন, কেউ আমলেই নেননি। সংবাদটি হচ্ছে, আগামী বছর বাংলাদেশের জাতীয় আয় সম্ভবত ৫০০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করে যাবে। এই প্রথম দেশটির ইতিহাসে তার জাতীয় আয় ৫০০ বিলিয়ন ডলার পার হয়ে যাবে। বেশ কিছুদিন আগেই আমাদের জাতীয় আয় ৪০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গিয়েছিল, কিন্তু কখনও তা ৫০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়নি।
কোনো সন্দেহ নেই, এ অর্জন আমাদের জন্য বিপুল গর্বের এবং যখন আমরা ৫০০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলকে পৌঁছতে পারব, সেটা উদযাপিত হবে। কিন্তু এই অর্জনের সঙ্গে কিছু কথা থেকে যায়। বিশেষত বাংলাদেশ যখন একটি বৈষম্যহীন সমাজ গড়তে চায়, একটি কর্মচালিত প্রবৃদ্ধি চায় এবং একটি বজায়ক্ষম(টেকসই) উন্নয়ন পথযাত্রা চায়। সে পরিপ্রেক্ষিতে তিনটি প্রশ্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এক. এই ৫০০ বিলিয়ন জাতীয় আয়ের বণ্টন কি সমতাবান্ধব হবে, নাকি তা অসমতাকে আরও বাড়িয়ে দেবে? দুই. জাতীয় আয়ের এ প্রবৃদ্ধি কি কর্মনিয়োজন বাড়াবে, নাকি এটি এক কর্মশূন্য প্রবৃদ্ধি হবে এবং তিন. জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি কি পরিবেশবান্ধব হবে, নাকি জাতীয় আয়ের এ প্রসারণ অর্জিত হবে পরিবেশকে নষ্ট করে? এর মানে, জাতীয় আয়ের পরিমাণগত বৃদ্ধির দিকে নজর দিলেই হবে না, সেই বৃদ্ধির গুণগত দিকও বিবেচনায় আনতে হবে।
এটা স্বীকৃত যে, বাংলাদেশে অনপেক্ষ দারিদ্র্য কমে এসেছে এবং বর্তমানে এ দেশের ১৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের দেশে চরম দারিদ্র্যও ৮ শতাংশের মতো। কিন্তু অনপেক্ষ দারিদ্র্য কমে এলেও এ দেশে আপেক্ষিক দারিদ্র্য বা অসমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অঙ্গনে আয় ও সম্পদের অসমতা সর্বজনবিদিত। সত্যিকার অর্থে এ অসমতা বোঝার জন্য উপাত্তের প্রয়োজন হয় না; ঢাকা শহরের পথঘাটে বের হলেই চোখে পড়ে। সেই সঙ্গে হাজার হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ কিংবা অর্থ পাচারের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, অর্থ ও বিত্ত কয়েকটি মানুষ এবং পরিবারের কুক্ষিগত। মোটা দাগে উপাত্তের দিকে যদি তাকাই, তাহলে আয়ের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের মোট আয়ের মাত্র ১৩ শতাংশ যেখানে দেশের নিম্নতম ৪০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর, সেখানে সমাজের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মানুষ ভোগ করে দেশজ আয়ের ৩৮ শতাংশ। ভোগের ক্ষেত্রে যেখানে নিম্নতম ১০ শতাংশ গৃহস্থালিতে মাসিক মাথাপিছু ব্যয় ২ হাজার ১২২ টাকা, সেখানে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ গৃহস্থালিতে সংখ্যাটি হচ্ছে ৯ হাজার ১৩৭ টাকা।
মানব উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকেও এমন বৈষম্য বিদ্যমান। অনূর্ধ্ব ৫ বছরের শিশুমৃত্যুর হার সর্বনিম্ন ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে যেখানে প্রতি হাজারে ৪৯, সেখানে সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ জনগোষ্ঠীর মধ্যে তা প্রতি হাজারে ২৫। তেমনিভাবে দেশের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ গৃহস্থালির ৮৫ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় প্রশিক্ষিত সেবিকার হাতে। অন্যদিকে নিম্নতম ২০ শতাংশ গৃহস্থালির মাত্র ৩২ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত সেবিকা দ্বারা। আঞ্চলিক বৈষম্যের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখা যায়, বরিশালে সাক্ষরতার হার যেখানে ৭৫ শতাংশ, সিলেটে তা ৬০ শতাংশ। তেমনিভাবে পরিবেশ-নাজুক জেলাগুলোতে বিভিন্ন পীড়ার প্রাদুর্ভাব অন্যান্য জেলার তুলনায় বেশি। এসব অঞ্চলে মোট গৃহস্থালির ৪৫ শতাংশই নানা পীড়ার শিকার।
শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য সুযোগে বৈষম্য অত্যন্ত প্রকট। শিক্ষায় সরকারি ও বেসরকারি ধারা, বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম, বিত্তবান ও বিত্তহীনদের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি প্রবণতার মাধ্যমে শিক্ষার সুযোগে বিশাল বৈষম্যের সৃষ্টি করা হয়েছে। দিনের পর দিন কোনো কোনো বিশেষ গোষ্ঠীকে শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থা বজায় রেখে শিক্ষার সুযোগের ক্ষেত্রে অসমতা আরও বাড়িয়ে তোলা হয়েছে। এসবের প্রতিফলন ঘটেছে শিক্ষা অর্জনের ফলাফলে, তারপর কর্মনিয়োজনে। একইভাবে স্বাস্থ্য খাতে ত্রিধারা ব্যবস্থা বজায় রেখে স্বাস্থ্য সুযোগের ক্ষেত্রেও একটি বিশাল বৈষম্যের দেয়াল নির্মাণ করা হয়েছে। ফলে সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সেবার পরিমাণ যেমন অপ্রতুল, তেমনি মানও খুব নিম্ন। সাধারণ মানুষই সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যায় এবং স্বাভাবিকভাবেই তারা ন্যূনতম স্বাস্থ্য সুবিধা পায় না। অন্যদিকে বিত্তবানরা স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের জন্য বিদেশে পাড়ি জমায়। শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের মতো মানবিক অধিকার এবং মৌলিক মানবিক চাহিদা বলয়ে এ জাতীয় বৈষম্য অগ্রহণযোগ্য।
তথ্যপ্রযুক্তি সেবায় সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ গৃহস্থালির তিন-চতুর্থাংশের যেখানে আন্তর্যোগ (ইন্টারনেট) সেবা পাচ্ছে, সেখানে নিম্নতম ২০ শতাংশ গৃহস্থালির ক্ষেত্রে তুলনামূলক সংখ্যাটি হচ্ছে মাত্র ৯ শতাংশ। শহরাঞ্চলের ৫৫ শতাংশ মানুষ আন্তর্যোগ ব্যবহার করে, গ্রামাঞ্চলে তেমন মানুষের অনুপাত হচ্ছে ৩৫ শতাংশ। গ্রামাঞ্চলের মাত্র ৩ শতাংশ ঘরে কম্পিউটার আছে এবং ৭৮ শতাংশ গ্রামীণ মানুষ এ যন্ত্র ব্যবহার করতে জানে না।
বাংলাদেশে নারী-পুরুষের মধ্যেও ফলাফল ও সুযোগের অসমতা রয়েছে। যেমন– উচ্চতম শিক্ষাস্তরে নারীর অন্তর্ভুক্তির হার যেখানে ১৭ শতাংশ, সেখানে পুরুষদের মধ্যে সংখ্যাটি হচ্ছে ২৪ শতাংশ। দেশের শ্রমশক্তিতে পুরুষের অংশগ্রহণের হার যেখানে ৮১ শতাংশ, নারীদের মাঝে তা হচ্ছে মাত্র ৩৬ শতাংশ। জ্যেষ্ঠ এবং মধ্যম স্তরের নির্বাহীদের মাঝে নারীর অনুপাত মাত্র ১২ শতাংশ। বাংলাদেশে মুঠোফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে পুরুষ-নারীর মাঝে ফারাক হচ্ছে ২৯ শতাংশ। আন্তর্যোগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে দেশের ৩৩ শতাংশ পুরুষ আন্তর্যোগ ব্যবহার করেন; নারীদের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সংখ্যাটি হচ্ছে ১৭ শতাংশ।
বাংলাদেশের জাতীয় আয় ৫০০ বিলিয়ন ছাড়িয়ে গেলে অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক নিয়মে দারিদ্র্য কিছুটা কমে আসবে সত্য, কিন্তু সে বৃদ্ধি দেশের দারিদ্র্যের ওপরে উল্লেখযোগ্য প্রভাব তখনই ফেলবে, যখন জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি দরিদ্রবান্ধব হয়। অন্যদিকে জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি কিন্তু অসমতা বাড়িয়ে দিতে পারে। অর্থাৎ জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি দারিদ্র্য কিছুটা কমিয়ে আনতে পারে, কিন্তু সেই সঙ্গে অসমতা বেড়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশের জাতীয় আয় ৫০০ বিলিয়নে বৃদ্ধি দারিদ্র্য এবং অসমতা দুটোই কমিয়ে আনতে পারে, যদি জাতীয় আয়ের বৃদ্ধি দারিদ্র্য এবং অসমতা হ্রাস অভিমুখীন হয়। এমন দরিদ্রবান্ধব ও সমতাবান্ধব প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে হলে জাতীয় আয় বৃদ্ধির কিছু বৈশিষ্ট্য অপরিহার্য। যেমন– আয় বৃদ্ধির ক্ষেত্র হিসেবে সেগুলোকে বেছে নিতে হবে, যেখানে দরিদ্র মানুষ বাস করে; উৎপাদন প্রক্রিয়ায় পুঁজিঘন নয়, বরং শ্রমঘন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে; শিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে বিশেষত মৌলিক এবং স্বাস্থ্য কাঠামোতে; উৎপাদন সম্পদ যেমন– ভূমি, উৎপাদন উপকরণ, ঋণ সুবিধা দরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষের কাছে লভ্য করে দিতে হবে। সেই সঙ্গে সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার।
জাতীয় আয়ের বৃদ্ধিকে কর্মনিয়োজনের নিরিখেও দেখা দরকার। কারণ, সেই মূল্যায়নও জাতীয় আয়ের গুণগত দিকের জন্য মূল্যবান। বাংলাদেশে শ্রমশক্তি হচ্ছে সাত কোটির মতো। তার প্রায় আড়াই কোটিই কর্মহীন।
তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার প্রায় ১৮ শতাংশ। শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে কর্মহীনতার হার ২০১০ সাল থেকে হয়েছে আড়াই গুণ। গত বছর প্রায় ১ লাখ তরুণ চাকরির বাজারে যোগ দিয়েছে কাজ খোঁজার উদ্দেশ্যে। বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতম সনদ নিয়েও ৯ লাখ তরুণ চাকরি খুঁজছে। দেশে বিশ্ববিদ্যালয় বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে শ্রম জোগান, যা অর্থনীতি আত্মস্থ করতে পারছে না। সুতরাং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির যে বড়াই আমরা করেছি, তা যে ছিল এক কর্মহীন প্রবৃদ্ধি, সে ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
এ ক্ষেত্রে তাহলে করণীয় কী? জাতীয় আয় বৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করা হচ্ছে, তাকে অবশ্যই কর্মবান্ধব হতে হবে। কর্মনিয়োজন বৃদ্ধি এবং গুণগত কর্ম সৃষ্টি নিশ্চিত করতে চাহিদা এবং জোগান দুই দিকেই ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চাহিদার দিক থেকে প্রবৃদ্ধিচালিত কর্ম সৃষ্টির বদলে কর্মচালিত প্রবৃদ্ধি সৃষ্টির জন্য নীতি কৌশল গ্রহণ করতে হবে। কর্মসৃষ্টির জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ বাড়ানো দরকার। বেসরকারি খাতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার দ্বারা সে খাতে কর্মনিয়োজনের চাহিদা বাড়ানো যেতে পারে। বাংলাদেশের শ্রমশক্তির ৪৪ শতাংশ এখনও কৃষি খাতে নিয়োজিত। কৃষির আধুনিকীকরণ এবং সেই সঙ্গে গ্রামীণ অর্থনীতিতে অ-কৃষি খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে শ্রম চাহিদা সৃষ্টি সম্ভব।
দেশের বাইরে কোথায় এবং কোন খাতে তরুণদের কর্মনিয়োজনের সুযোগ আছে, সেটা নিরীক্ষিত হওয়া প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার, তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে বাংলাদেশের তরুণরা বৈশ্বিক বলয়ে প্রতিযোগিতা করবে।
জোগানের ক্ষেত্রে শিক্ষা পাঠক্রমকে শ্রমবাজারের চাহিদা পূরণের উপযোগী করে সাজানো দরকার। শুধু বর্তমান শ্রম চাহিদা নয়, ভবিষ্যৎ শ্রম চাহিদাও সেই পুনর্বিন্যাসের অংশ হওয়া প্রয়োজন। শুধু দেশের অভ্যন্তরে নয়, বৈশ্বিকভাবেও যাতে বাংলাদেশ শ্রমের জোগান নিশ্চিত করতে পারে, তার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এ জন্য দরকার হবে প্রয়োজনীয় মানব সম্পদ সৃষ্টি। যথাযথ শিক্ষা সে ব্যাপারে বিরাট ভূমিকা পালন করতে পারে, সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই সঙ্গে প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তাও অনস্বীকার্য। শ্রমশক্তির পরিমাণগত বৃদ্ধিই যথেষ্ট নয়, তাদের গুণগত দক্ষতা না বাড়াতে পারলে আজকের প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে তারা টিকে থাকতে পারবে না।
আমাদের জাতীয় আয় ৫০০ বিলিয়ন বেড়ে যাবে, তা বাংলাদেশের জন্য একটি আনন্দের সংবাদ। কিন্তু নিশ্চিত করতে হবে সেই বৃদ্ধি যেন পরিবেশ-সংবেদনশীল ও পরিবেশবান্ধব হয়। আমাদের উৎপাদন কাঠামো ও উৎপাদন ব্যবস্থা প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহারে কুণ্ঠাহীন, নানা রকমের দূষণ সৃষ্টির ব্যাপারে বেপরোয়া এবং শিল্পবর্জ্য আমাদের নদী ও জলাশয়ে ফেলে দিতে লজ্জাহীন। সেই সঙ্গে বৃক্ষনিধন, জলাশয় ভরাট আমাদের নির্মাণ খাত ও নগরায়ণের এক বিরাট মাত্রিকতা।
জলবায়ু পরিবর্তন আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার জন্য একটি হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন কৃষির ওপরে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে, যা কৃষকের আয়, জীবনযাত্রার মান এবং কুশলতাকে ক্ষুণ্ন করছে। সেই সঙ্গে লবণাক্ততা, ভূমির ক্ষয়, ভূমিশুষ্কতাও কৃষির উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিচ্ছে। জাতীয় আয় বাড়ল, কিন্তু সে বৃদ্ধি যদি উপর্যুক্ত বিষয়গুলোর প্রতি সংবেদনশীল না হয়, তাহলে আমরা একটি অবজায়ক্ষম (অটেকসই) প্রবৃদ্ধিতে উপনীত হবো।
এ ক্ষেত্রে যা প্রথমেই করতে হবে তা হচ্ছে, পরিবেশগত সমস্যাকে উন্নয়ন সমস্যা হিসেবে দেখতে হবে এবং পরিবেশ ও উন্নয়নকে সম্পৃক্ত করতে হবে। পরিবেশের উন্নয়নগত সমস্যা সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে পারলেই এই সম্পৃক্তকরণ সম্ভব। অর্থনৈতিক উপাত্তে পরিবেশগত তথ্যের অন্তর্ভুক্তি এর জন্য বড় প্রয়োজন। সামষ্টিক পর্যায়ে উন্নয়ন কৌশল প্রণয়নের সময়ে পরিবেশ বিষয়গুলো বিবেচনায় আনা প্রয়োজন।
জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের আয় এবং প্রবৃদ্ধিকে প্রভাবিত করবে, তা সুচিহ্নিত করা দরকার। সেই সঙ্গে মূল্যায়িত হতে হবে জলবায়ুর প্রভাব বাংলাদেশের কৃষি, শিল্পোৎপাদন, সেবা খাত; যেমন শিক্ষা ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে। উন্নয়ন কৌশল নির্ধারণে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনকে প্রতিফলিত করা দরকার। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে বর্ধিত জাতীয় আয়কে পরিবেশবান্ধব করা সম্ভব।
শেষের কথা বলি। জাতীয় আয় বৃদ্ধির গুণগত দিকটি তার পরিমাণগত দিকের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয়। সেই গুণগত মাত্রিকতায় রয়েছে সমতা, বর্ধিত কর্মনিয়োজন এবং পরিবেশ-বন্ধুত্ব। তাই ২০২৬ সাল নাগাদ বাংলাদেশের জাতীয় আয় ৫০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে, তাতে আমরা গর্বিত। কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা সন্তুষ্ট হবো যখন সেই বৃদ্ধি সমতাসম্পন্ন, কর্মনিয়োজনমুখী ও পরিবেশবান্ধব হয়।
সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন
কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র