Risingbd:
2025-02-28@12:42:57 GMT

কলকাতায় ঐতিহ্যের সন্ধানে

Published: 28th, February 2025 GMT

কলকাতায় ঐতিহ্যের সন্ধানে

কলকাতার পথ-ঘাট আমাদের অজানা। সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ডুব দেওয়ার আগেই ট্যাক্সি ক্যাবে আমরা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে পৌঁছালাম। প্রথমেই চোখে পড়ল বিশাল গেইট। সাদা রঙের সুউচ্চ গেইটের ওপাশে ঘোড়ায় বসা সৈন্যের স্ট্যাচু। জড়ো হয়েছে ছোট-বড় অনেক দর্শনার্থী। আমরা বিদেশি কোটায় টিকিট কেটে নিলাম। 

ভেতরে ৬৫ একর জমির উপর সাদা মার্বেলের স্থাপত্যকে ঘিরে রয়েছে অপূর্ব সুন্দর বাগান। নানা ধরনের দেশি-বিদেশি গাছের সঙ্গে ছড়িয়ে আছে ভাস্করদের শিল্পকর্ম। পাখির কলতানে মুখরিত হয়ে উঠেছে উদ্যান চত্বর। ফুলের শোভা, সবুজের সমারহ আর নুড়ি পাথরের তৈরি রাস্তা। কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর দাঁড়িয়ে স্মৃতিসৌধের দিকে তাকালাম। স্মৃতিসৌধটির মধ্য ভাগে রয়েছে মসজিদের মতো একটি বিশালাকার গম্বুজ। চার ধারে রয়েছে আরও চারটি ছোট গম্বুজ। বড় গম্বুজটির চূড়ায় রয়েছে পিতলে মোড়া পরী। মনে হচ্ছে আকাশের দিকে মুখ করে পরীটা মেঘেদের গান শোনাচ্ছে।  

কলকাতার এমন অনেক ভবন আছে যেগুলো কয়েকশো বছরের পুরোনো। এই শহরের এই ভবনগুলো ব্রিটিশদের সময়ে তৈরি। ইতিহাসের পাতা ছাড়া এদের বয়স নির্ণয় করার উপায় নেই। মহারানী ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধটি তাজমহলের আদলে আগাগোড়া শ্বেত পাথরের তৈরি। এটি হঠাৎ কেউ দেখলে তাজমহল মনে করে গোলকধাঁধায় পড়ে যাবে।স্থাপত্যটির ইতিহাস যারা জানে না তাদের কাছে মেমোরিয়ালের জৌলুশ দেখে মনে হবে কয়েক বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছে। 

মেমোরিয়ালের বাইরে মানুষ ছবি তুলতে হুড়োহুড়ি শুরু করে দিয়েছে। আমিও লোভ সামলাতে পারলাম না। ছবি তোলার আগে ভুঁড়ি পেটের ভেতরের দিকে চেপে ধরে, বুকটা এমন ভঙ্গিমায় উঁচু করে রাখলাম যেন ভুঁড়ি বোঝা না যায়। সুন্দর  ছবির জন্য পুরো এক মিনিট ধরে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া বন্ধ রাখলাম। বিশেষ ভঙ্গিতে ক্যামেরা বন্দী করার সময় উল্লাসে ফেটে পড়ল সঞ্জয়দা। বললেন, দাদা, কালজয়ী একটা চিত্র নিয়েছি।

মেমোরিয়ালের ভেতরের দৃশ্যপট দেখতে পথ চলছি। চলতি পথে সময়ের উল্টো স্রোত বইয়ে, ইতিহাসের পিছনে গিয়ে কলকাতাকে স্মরণ করতে থাকলাম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির  সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ সিরাজউদ্দৌলাকে গদিচ্যুত করতে সেনাপতি মীর জাফরকে ঘুষ দিয়েছিল, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পরবর্তী নবাব করার। মাকড়সার জালে পোকামাকড় আটকে পড়ার মতো লোভের ফাঁদে আটকে গিয়েছিল মীর জাফর। তার বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পলাশীর যুদ্ধে ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাজিত হন সিরাজউদ্দৌলা। ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

ব্রিটিশ শাসন চলাকালীন কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী। যার কারণে কলকাতা পেয়েছিল ইউরোপীয় সংস্কৃতির ছোঁয়া। পৃথিবীর ইতিহাসে যে কজন নারী শাসক দীর্ঘ সময় শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন, তাদের মধ্যে রানী ভিক্টোরিয়া অন্যতম। নারী হয়েও ৬৪ বছর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে একহাতে শাসন করেন তিনি। ১৮৭৬ সাল থেকে ১৯০১ সাল অবধি ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অঞ্চলের সম্রাজ্ঞীর দায়িত্ব পালন করেন রানী। এজন্য ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে রানী ভিক্টোরিয়াই ভারতবর্ষে বেশি পরিচিত। ১৯০১ সালে রানী মৃত্যুবরণ করেন। ব্রিটিশ শাসকরা রানীর স্মৃতি ধরে রাখতে ভারতীয় উপনিবেশে নির্মাণ করেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। চোখ ধাঁধানো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল স্মৃতিসৌধটির প্রধান স্থাপতি স্যার উইলিয়াম এমারসন।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ভেতরে প্রবেশ করলাম। প্রথমেই চোখে পড়ল গর্বিত ভঙ্গিতে ভাস্কর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মহারানী ভিক্টোরিয়া। নিখুঁত প্রতিমা দেখে মনে হচ্ছে এ যেন জীবন্ত! প্রসাধনচর্চিত রানীর এক হাতে রাজদণ্ড, অন্য হাতে গোলাকার কোন বস্তু। কংক্রিটের তৈরি অভিজাত পোশাকে সেজেছেন রানী। একটা মুকুট মহারানীর মস্তকে শোভাবর্ধন করছে। তীক্ষ্ণ সাদা চোখ, সুন্দর ঠোঁট জোড়ার উপর উঁচু নাক। বেনি বাঁধা কোঁকড়ানো চুল। মেমোরিয়াল প্রাঙ্গণে দৃষ্টি বুলিয়ে রানী যেন পর্যটকদের দেখছেন। অত্যন্ত সুদর্শনা দেখাচ্ছে ব্রোঞ্জ দিয়ে নির্মিত রানীকে! রানী ভিক্টোরিয়ার চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলাম! 

ইতিহাসের অতীত সময়ে কত মানুষ জীবন্ত রানীর সেবায় নিয়োজিত রেখেছিল। তার ক্ষমতার পরিধি ছিল দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। ভারতবর্ষের অনেক রাজা বাদশা প্রজাদের কাছ থেকে লুন্ঠন করা ধনসম্পদ রানীকে খুশি করতে বখরা দিত। সময়ের স্রোতে হারিয়ে রানী আজ ভাস্কর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সত্যি, মহাবিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী যদি কিছু থেকে থাকে, তা হচ্ছে সময়! সময়ের স্রোতের পাকে তলিয়ে রাজা-প্রজা সবাই বাধ্য হয় মৃত্যুর স্বাদ নিতে। সময়ের কাছে রানী থেকে দাসী সবাইকে কুপোকাত হতে হয়!

ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধটি বর্তমানে জাতীয় সংগ্রহশালা। এই মেমোরিয়ালে ছোট-বড় অনেকগুলো গ্যালারি রয়েছে। এখানে ভিন্ন ভিন্ন গ্যালারিতে রয়েছে আলাদা সংগ্রহশালা। রাজকীয় গ্যালারিতে রয়েছে মহারানী এবং তার পরিবারের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে পুরোনো সাম্রাজ্যের ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র। এখানে সংরক্ষিত আছে ইতিহাসের  প্রতাপশালী ব্যক্তিদের পদক, অস্ত্র, ভাস্কর্য, কস্টিউমস এবং ব্যক্তিগত স্মৃতিচিহ্ন। বিশেষ করে পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত কামান ও কামানের গোলা, অস্ত্র রাখা আছে গ্যালারিতে। আছে টিপু সুলতানের যুদ্ধে ব্যবহৃত তলোয়ার, বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের অস্ত্রসহ চারশ বছরের পুরনো ঢাল-তলোয়ার। 

সাহিত্য গ্যালারিতে ভারতবর্ষের বিখ্যাত সাহিত্যিক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেকের ছবি রয়েছে। বায়োগ্রাফিতে লেখা রয়েছে তাদের আদ্যোপান্ত। তাছাড়া বিখ্যাত সাহিত্যিকদের অমূল্য পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত রয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। রয়েছে বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর আকা চিত্রকর্ম। যাদুঘরের সংগ্রহশালার সামগ্রীগুলো বহন করে চলেছে সময়ের ইতিহাস। একটা গ্যালারিতে খাপ থেকে তরবারি খুলে দাঁড়িয়ে আছেন ভারতবর্ষ দখলের মূল পরিকল্পনাকারী লর্ড ক্লাইড। ক্লাইভের চোখে খুনে দৃষ্টি। তলোয়ারের বাটে ধরা হাত সাদা হয়ে আছে । ক্লাইভের কূটবুদ্ধির কাছে হার মেনে ভারতবর্ষকে প্রায় দুইশ বছর পরাধীনতার গ্লানির স্বাদ নিতে হয়েছে। 

আমরা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে বিদায় নিয়ে হেঁটে সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রালের দিকে চললাম। চোখে পড়ছে রাস্তার দুইপাশের সবুজ ঘাসের প্রান্তর। বাতাস থেমে আছে, কুয়াশায় ছেয়ে আছে আকাশ। গোধূলির শেষ আলো মরে যায়নি, পশ্চিম আকাশে সামান্য ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছে। তেজহীন সূর্যটা দিগন্ত থেকে বিদায়ের আগে অন্ধকারের কাছে যেন বিদায় চেয়ে নিচ্ছে। 

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালেল খুব কাছে অবস্থিত সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল। এটি কলকাতার বৃহত্তম ক্যাথিড্রাল বা গির্জা।  গির্জাটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ১৮৩৯ সালে এবং নির্মাণকার্য সমাপ্ত হয় ১৮৪৭ সালে। পায়ে হেঁটে মিনিট দশেকের মধ্যে আমরা যখন পৌঁছালাম, তখন সূর্য পশ্চিম দিগন্তের বাঁকে তলিয়ে গেলেও শেষ আভা মিলিয়ে যায়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবছা অন্ধকারে ছেয়ে গিয়ে চারপাশে সন্ধ্যা নেমে এলো। সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রালে সকল ধর্মের মানুষের প্রবেশাধিকার রয়েছে। যে কোন ধর্মীয় উপাসনালয় মনকে অন্য রকম প্রশান্তিতে ভরে দেয়। গির্জায় উপাসনাকার্য চলছে। আমরা টিকেট কেটে ক্যাথিড্রালের ভেতরে প্রবেশ করলাম। প্রথমে চোখে পড়ল যিশুর একটা ভাস্কর্য। প্রবেশ পথের ডানদিকে আছে একটি বড় গ্রন্থাগার, পাশে রয়েছে স্মারক দ্রব্যের একটি প্রদর্শনশালা।

ক্যাথিড্রালটির বাম পাশে যেতেই চোখে পড়ল অডিটরিয়ামের মতো বিশাল উপাসনার স্থান। উপাসনার স্থানটিতে লোকজন কম, বিরাজ করছে সুনশান নীরবতা। যারা আছে, তারা চেয়ারে বসে ধ্যানী বকের মতো কেউ অর্ধেক বুজে, কেউ অর্ধেক চোখ খুলে প্রার্থনামগ্ন। ওদের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, কেউ গির্জায় এসেছে ভোগান্তির অবসান চাইতে, কেউ ফিরে পেতে চাইছে শারীরিক সুস্থতা, কেউবা এসেছে পাপের শাস্তি মওকুফের আবেদন নিয়ে। কেউবা মগ্ন নিজের পরিবার পরিজনের মৃত আত্না শান্তি পাক এই প্রার্থনায়। মানুষের প্রতিটি নীরব প্রার্থনায় মিশে থাকে আহাজারি ও গোঙানির শব্দ, যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ক্যাথিড্রাল থেকে বেরিয়ে এলাম। ক্যাথিড্রালে প্রবেশের আগে প্রকৃতি চারদিকে অন্ধকারের যে প্রাচীর টেনে দিয়েছিল, বের হয়ে দেখছি, বিদ্যুতের আলো সে অন্ধকারের স্থান বেদখল করে হাসছে। সত্যি, চারপাশের আলো আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। আরও কিছুদূর এগিয়ে এসে দেখতে পাচ্ছি সাদা আর রঙ্গিন আলো পুরো শহরকে  ছেয়ে ফেলেছে। দিনের ঘুমন্ত জীর্ণ-শীর্ণ কলকাতা যেন রাতে জেগে উঠছে আলোর ঝলকানিতে। সত্যি, রাতের ধবধবে আলোয় বয়োজ্যেষ্ঠা কলকাতা যেন সদ্য যৌবনে পদার্পণ করা ষোড়শী কিশোরীর যৌবন পেয়েছে। এ শহরকে সাজাতে সবই যেন আলোর কৃতিত্ব!  

আমরা সামনের দিকে  আসতেই চোখে পড়ল বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়াম। এটি ক্যাথেড্রালের ঠিক সামনেই অবস্থিত। বিড়লা এশিয়ার বৃহত্তম প্ল্যানেটেরিয়াম এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্ল্যানেটোরিয়াম। টেলিস্কোপে চোখ রেখে মহাকাশের বিস্ময়কর দারুণ সব গ্রহ নক্ষত্র দেখা যায় এই সেন্টার থেকে । আধুনিক এই প্ল্যানেটোরিয়াম রাতের আকাশে ভার্চুয়াল ভ্রমণ এবং মহাজাগতিক শো প্রদর্শন করে। মানুষ এই প্লাটরিয়াম থেকে জ্যোর্তিবিজ্ঞান, মহাকাশবিজ্ঞান এবং গ্রহণক্ষত্র সংক্রান্ত মহাবিশ্বের তথ্য জানতে পারে। ভারতের মহান শিল্পপতি বিএম বিড়লার স্মৃতিতে 1988 সালে নির্মিত এই প্লাটরিয়ামটি। মহাকাশ বিজ্ঞান সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্য আমাদের অনেকেরই অজানা। গ্রহ নক্ষত্র, সৌর জগৎ, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি সংক্রান্ত মহাবিশ্বের তথ্য শুনলে তা অনেকের কাছে গাঁজাখুরি গল্প  মনে হবে।  

আমরা আটশ পঞ্চাশ কোটি মানুষ বসবাস করছি পৃথিবী নামক এই গ্রহে। আমাদের ৫১ কোটি বর্গ কিলোমিটারের পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। সূর্যটা পৃথিবী থেকে ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সূর্যের সাইজ বা আকারটা হচ্ছে  আমাদের পৃথিবী থেকে তেলো লাখ গুন বড়। সূর্যের বাহিরের তাপমাত্রা ৬ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস আর ভেতরের তাপমাত্রা দেড়কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের ২৩ কোটি ভাগের একভাগ তাপ পৃথিবী পৌঁছে। 

শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন ও পৃথিবীসহ যে ৮টি গ্রহ সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, আমরা একেই বলছি সৌর জগৎ। সূর্যটা অবস্থান করছে আবার মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে। মনে করা হয় একশো থেকে চারশ বিলিয়ন সূর্যের মতো নক্ষত্র মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির চারপাশে চক্রাকারে ঘুরছে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত আলো পৌঁছাতে এক লাখ বছর প্রয়োজন। যেখানে আলোর গতি সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার। এবারের যে অসম্ভব তথ্যটি তা শুনে অনেকের অবিশ্বাস্য মনে হবে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সবচেয়ে বড় নক্ষত্রের নাম স্কুটি। স্কুটি নক্ষত্রটা সূর্যের চেয়ে পাঁচশ কোটি গুন বড়। মহাকাশে দুই লাখ কোটি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি আছে যা আমরা রাতের আকাশে তারা হিসাবে দেখি। 

মহা সাগরের জলের কাছে এক বালতি জল যেমন তুচ্ছ তেমনি মহাবিশ্বের তুলনায় ক্ষদ্র আমাদের এ পৃথিবী! মহাকাশের এসব গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি মহান স্রষ্টার সৃষ্টি।  তাহলে স্রষ্টা কত বড় আর তার শক্তি কতুটুকু! এটা মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব। সৃষ্টির বিশালত্বের কথা যদি কোন মানুষ ঠান্ডা মস্তিস্কে চিন্তা করতে পারে তবে সে কখনো অন্য মানুষের সাথে ঠগবাজী, হানাহানি খুনোখুনিতে জড়ানোর কথা চিন্তাও করবে না। ইচ্ছে ছিল বিড়লা প্লানেটরিয়ামে প্রবেশ করে  টেলিস্কোপে চোখ রেখে মহাবিশ্ব দেখার। রাতে বিড়লা প্লানেটরিয়ামের টিকেট কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা সময় নষ্ট না করে ট্যাক্সিতে রওনা হলাম ঐতিহাসিক স্থান প্রিন্সেপ ঘাটের দিকে। 

কলকাতা শহর নিজেকে সজ্জিত করেছে ঐতিহাসিক সব  স্থান দ্বারা। এই শহরে ঐতিহাসিক যত স্থাপনা আছে ইন্ডিয়ার অন্য কোনো প্রদেশে তা নেই। কলকাতা নিজস্ব কিছু ঐতিহ্য সংস্কৃতির সৌন্দর্য মুগ্ধ করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ভ্রমণপিপাসুদের। প্রিন্সেপ ঘাট কলকাতার পুরনো দর্শনীয় স্থানের মধ্যে একটি। এই ঘাটকে কলকাতার ঐতিহ্যপূর্ণ পর্যটক কেন্দ্র মনে করা হয়। জেমস প্রিন্সেপের স্মৃতিতে নির্মিত হয় এই ঘাট। প্রিন্সেপ ঘাট ব্রিটিশ আমলে ১৮৪১ সালে নির্মিত হয়েছে কলকাতার হুগলি নদীর তীরে। ব্রিটিশদের সব যাত্রীবাহী জাহাজের যাত্রী ওঠানামার কাজে ব্যবহার করা হতো এই ঘাট। বৃটিশরা ভারতবর্ষের দামী প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ লুট করে নিয়ে যেত এই ঘাট দিয়ে। আবার এখান থেকেই অনেকে নৌকায় প্রমোদভ্রমণে যেত।

বিড়লা প্লানেটরিয়াম থেকে রওনা হয়ে ৩০-৪০ মিনিটে আমরা পৌঁছালাম প্রিন্সেপ ঘটে। কলকাতার ঘিঞ্জি শহর থেকে দূরে নির্জনে অবস্থিত প্রিন্সেপ ঘাট। ঘাটে প্রবেশের আগে একটি সুন্দর মনুমেন্ট নির্মাণ করা হয়েছে ,যা বিশেষ আকর্ষণীয়। রাতের অন্ধকার আর বাহারি লাইট মিলিয়ে এক অপরূপ দৃশ্য ধারণ করেছে প্রিন্সেপ ঘাট। মনুমেন্টের পেছন দিকটায় ছায়া পড়ে আবছা অন্ধকারে ছেয়ে আছে। পেছনে তাকাতেই দেখা গেল জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকারা ভালোবাসার আবহে জড়িয়ে ধরে গল্পে মগ্ন! দৃশ্য দেখে মনে হলো, শান্তিপূর্ণভাবে বিশেষ মুহূর্ত কাটানোর জন্য প্রিন্সেপ ঘাট আদর্শ স্থান। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা মূল ঘাটে এসে পৌঁছালাম। ঘাটের চারপাশের পরিবেশ বেশ মনোরম ও খোলামেলা। ঘাটের ডানদিকে একটি পার্ক। পার্কটিতে আছে বিভিন্ন গাছের সুসজ্জিত বাগান। ঘাট ঘিরে পর্যটক কেন্দ্র ভালোই গড়ে উঠেছে। আশেপাশে  বাহারি খাবারের দোকান বিক্রি হচ্ছে পাউ ভাজি, ফুচকা। সত্যিই, ব্রিটিশ নির্মিত ঘাটির সৌন্দর্য্যের তুলনা হয় না।

আমরা সিঁড়ি বেয়ে ঘাটের নিচে নামলাম। আমাদের দাঁড়ানো সিঁড়ির বেশ উপরেও জলের দাগ লেগে আছে। হুগলি নদীতে ভাটা চলছে। জলের উপর কয়েকটি জাহাজ নোঙর করা আছে। নদীর জলের উপর আলোর ঝাঁপটা পড়ে অন্য রকম এক আবহ সৃষ্টি হয়েছে। আলো যেন তার অফুরন্ত সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে নদীর বুকে। ইচ্ছে হলো, নৌকা নিয়ে খোলা নদীর বুকে চষে বেড়াতে। ঘাটে মাঝিমাল্লা না থাকায় জলের বুকে ঘুরে স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। 

দিনের শেষ ভ্রমণ হিসেবে রাত্রির যাত্রী হয়ে বাসে চেপে রওনা হয়েছি হাওড়া ব্রিজের দিকে। কলকাতা ও হাওড়া শহরের মধ্যে সংযোগকারী ব্রিজ হচ্ছে হাওড়া। সেতুটার মূল আকর্ষণ হলো এতে কোনো পিলার নেই। বিশাল বিশাল স্টিলের পাত একটার সঙ্গে আরেকটা জুড়ে বানানো হয়েছে। হাওড়া ব্রিজ আমাদের রাঙ্গামাটির ঝুলন্ত সেতুর মতো তবে আকারে অনেক বড়। ব্রিজটি দেড়শ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী দাঁড়িয়ে আছে হুগলী নদীর উপর। নিজেদের বাণিজ্যের সুবিধার কারণে নাট-বোল্টু ছাড়াই ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশরা হাওড়া সেতু নির্মাণ করেছিলেন। হাওড়া না কি এখনও বর্তমান বিশ্বের ষষ্ঠ দীর্ঘতম সেতু। হাওড়া সেতু কলকাতার গর্ব। সরকারিভাবে হাওড়া ব্রিজের নাম  পরিবর্তন করে রবীন্দ্র সেতু রাখা হলেও মানুষ হাওড়া নামেই চেনে। 

আমরা যখন বাসে হাওড়া এসে পৌঁছালাম তখন রাত্রি আটটা।  সফরসঙ্গী লিটু ভাই আর সঞ্জয়দাসহ বাসস্ট্যান্ড থেকে  ব্রিজের দিকে যাচ্ছি। ব্রিজের দুই পাশের আলো জলের উপর পড়ে এক অন্য রকম আবহ সৃষ্টি করেছে। দূর থেকে জল আর আলোর মিলনমেলা দেখে সৌন্দর্যের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে আমার চোখ। মানুষের কলরবে হাওড়া ব্রিজে রাত্রির নিস্তব্ধতা  নেমে আসতে পারে নি। কিছু কিছু বিরল সৌন্দর্য দাঁড়িয়ে দেখতে মন চায়। আমি হাওড়ার সৌন্দর্য দেখতে হঠাৎ   ব্রিজের গোড়ায় দাঁড়িয়ে গেলাম। ব্রিজের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য দুইদিকে সুসজ্জিত করে লাগানো হয়েছে রংবেরঙের শতশত এলইডি লাইট। ব্রিজের দুইপাশে মায়াবি আলোয় ঝলমল করছে। রাতের হাওড়া ব্রিজে চলছে আলোর ছন্দে ছন্দে রং বদলানোর দৃশ্যপট! আমি রীতিমতো উপভোগ করছি এই মনোরম আলো আঁধারের খেলা। একবার ভাবছি, আঠারো শতকে সেতু প্রকৌশল ও তাদের প্রযুক্তি জ্ঞানের কথা। দেড়শ বছর আগে কীভাবে নকশা প্রনয়ণ করে, নাট-বোণ্টু ছাড়াই  ব্রিজ নির্মাণ করল তারা? আবার ভাবছি, ইংরেজরা শুধু  ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবী শাসন করতো বুদ্ধির জোরে। এজন্যই  ওদের তৈরি অনেক স্থাপনা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। 

হঠাৎ দেখি ভ্রমণসঙ্গী লিটু ভাই আর সঞ্জয়দা সামনে নেই। তাদের দেখতে না পেয়ে আমি ভড়কে গেলাম। এতটা ভয় পেলাম, যা কলকাতা ভ্রমণকালে পাইনি। কারণ জনস্রোতের মধ্যে দলছুট হলে যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়ব। তাছাড়া  আমার সঙ্গে ইন্ডিয়ার সিম নেই। আমি অনেকটা দৌড়ের গতিতে হেঁটে হেঁটে সফরসঙ্গীদের খুঁজতে লাগলাম। (চলবে) 

তারা//

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর র স ন দর য ন র ম ণ কর ভ স কর য কলক ত র ব যবহ ত অবস থ ত অন ক র আম দ র এই ঘ ট সময় র র উপর

এছাড়াও পড়ুন:

কলকাতায় ঐতিহ্যের সন্ধানে

কলকাতার পথ-ঘাট আমাদের অজানা। সূর্য পশ্চিম দিগন্তে ডুব দেওয়ার আগেই ট্যাক্সি ক্যাবে আমরা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে পৌঁছালাম। প্রথমেই চোখে পড়ল বিশাল গেইট। সাদা রঙের সুউচ্চ গেইটের ওপাশে ঘোড়ায় বসা সৈন্যের স্ট্যাচু। জড়ো হয়েছে ছোট-বড় অনেক দর্শনার্থী। আমরা বিদেশি কোটায় টিকিট কেটে নিলাম। 

ভেতরে ৬৫ একর জমির উপর সাদা মার্বেলের স্থাপত্যকে ঘিরে রয়েছে অপূর্ব সুন্দর বাগান। নানা ধরনের দেশি-বিদেশি গাছের সঙ্গে ছড়িয়ে আছে ভাস্করদের শিল্পকর্ম। পাখির কলতানে মুখরিত হয়ে উঠেছে উদ্যান চত্বর। ফুলের শোভা, সবুজের সমারহ আর নুড়ি পাথরের তৈরি রাস্তা। কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর দাঁড়িয়ে স্মৃতিসৌধের দিকে তাকালাম। স্মৃতিসৌধটির মধ্য ভাগে রয়েছে মসজিদের মতো একটি বিশালাকার গম্বুজ। চার ধারে রয়েছে আরও চারটি ছোট গম্বুজ। বড় গম্বুজটির চূড়ায় রয়েছে পিতলে মোড়া পরী। মনে হচ্ছে আকাশের দিকে মুখ করে পরীটা মেঘেদের গান শোনাচ্ছে।  

কলকাতার এমন অনেক ভবন আছে যেগুলো কয়েকশো বছরের পুরোনো। এই শহরের এই ভবনগুলো ব্রিটিশদের সময়ে তৈরি। ইতিহাসের পাতা ছাড়া এদের বয়স নির্ণয় করার উপায় নেই। মহারানী ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধটি তাজমহলের আদলে আগাগোড়া শ্বেত পাথরের তৈরি। এটি হঠাৎ কেউ দেখলে তাজমহল মনে করে গোলকধাঁধায় পড়ে যাবে।স্থাপত্যটির ইতিহাস যারা জানে না তাদের কাছে মেমোরিয়ালের জৌলুশ দেখে মনে হবে কয়েক বছর আগে নির্মাণ করা হয়েছে। 

মেমোরিয়ালের বাইরে মানুষ ছবি তুলতে হুড়োহুড়ি শুরু করে দিয়েছে। আমিও লোভ সামলাতে পারলাম না। ছবি তোলার আগে ভুঁড়ি পেটের ভেতরের দিকে চেপে ধরে, বুকটা এমন ভঙ্গিমায় উঁচু করে রাখলাম যেন ভুঁড়ি বোঝা না যায়। সুন্দর  ছবির জন্য পুরো এক মিনিট ধরে শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়া বন্ধ রাখলাম। বিশেষ ভঙ্গিতে ক্যামেরা বন্দী করার সময় উল্লাসে ফেটে পড়ল সঞ্জয়দা। বললেন, দাদা, কালজয়ী একটা চিত্র নিয়েছি।

মেমোরিয়ালের ভেতরের দৃশ্যপট দেখতে পথ চলছি। চলতি পথে সময়ের উল্টো স্রোত বইয়ে, ইতিহাসের পিছনে গিয়ে কলকাতাকে স্মরণ করতে থাকলাম। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির  সেনাপতি রবার্ট ক্লাইভ সিরাজউদ্দৌলাকে গদিচ্যুত করতে সেনাপতি মীর জাফরকে ঘুষ দিয়েছিল, প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল পরবর্তী নবাব করার। মাকড়সার জালে পোকামাকড় আটকে পড়ার মতো লোভের ফাঁদে আটকে গিয়েছিল মীর জাফর। তার বিশ্বাসঘাতকতার কারণে পলাশীর যুদ্ধে ১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাজিত হন সিরাজউদ্দৌলা। ভারতবর্ষে ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়।

ব্রিটিশ শাসন চলাকালীন কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী। যার কারণে কলকাতা পেয়েছিল ইউরোপীয় সংস্কৃতির ছোঁয়া। পৃথিবীর ইতিহাসে যে কজন নারী শাসক দীর্ঘ সময় শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন, তাদের মধ্যে রানী ভিক্টোরিয়া অন্যতম। নারী হয়েও ৬৪ বছর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে একহাতে শাসন করেন তিনি। ১৮৭৬ সাল থেকে ১৯০১ সাল অবধি ভারতবর্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক অঞ্চলের সম্রাজ্ঞীর দায়িত্ব পালন করেন রানী। এজন্য ব্রিটিশ শাসকদের মধ্যে রানী ভিক্টোরিয়াই ভারতবর্ষে বেশি পরিচিত। ১৯০১ সালে রানী মৃত্যুবরণ করেন। ব্রিটিশ শাসকরা রানীর স্মৃতি ধরে রাখতে ভারতীয় উপনিবেশে নির্মাণ করেন ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। চোখ ধাঁধানো ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল স্মৃতিসৌধটির প্রধান স্থাপতি স্যার উইলিয়াম এমারসন।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ভেতরে প্রবেশ করলাম। প্রথমেই চোখে পড়ল গর্বিত ভঙ্গিতে ভাস্কর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন মহারানী ভিক্টোরিয়া। নিখুঁত প্রতিমা দেখে মনে হচ্ছে এ যেন জীবন্ত! প্রসাধনচর্চিত রানীর এক হাতে রাজদণ্ড, অন্য হাতে গোলাকার কোন বস্তু। কংক্রিটের তৈরি অভিজাত পোশাকে সেজেছেন রানী। একটা মুকুট মহারানীর মস্তকে শোভাবর্ধন করছে। তীক্ষ্ণ সাদা চোখ, সুন্দর ঠোঁট জোড়ার উপর উঁচু নাক। বেনি বাঁধা কোঁকড়ানো চুল। মেমোরিয়াল প্রাঙ্গণে দৃষ্টি বুলিয়ে রানী যেন পর্যটকদের দেখছেন। অত্যন্ত সুদর্শনা দেখাচ্ছে ব্রোঞ্জ দিয়ে নির্মিত রানীকে! রানী ভিক্টোরিয়ার চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যে মুগ্ধ হলাম! 

ইতিহাসের অতীত সময়ে কত মানুষ জীবন্ত রানীর সেবায় নিয়োজিত রেখেছিল। তার ক্ষমতার পরিধি ছিল দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। ভারতবর্ষের অনেক রাজা বাদশা প্রজাদের কাছ থেকে লুন্ঠন করা ধনসম্পদ রানীকে খুশি করতে বখরা দিত। সময়ের স্রোতে হারিয়ে রানী আজ ভাস্কর্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। সত্যি, মহাবিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী যদি কিছু থেকে থাকে, তা হচ্ছে সময়! সময়ের স্রোতের পাকে তলিয়ে রাজা-প্রজা সবাই বাধ্য হয় মৃত্যুর স্বাদ নিতে। সময়ের কাছে রানী থেকে দাসী সবাইকে কুপোকাত হতে হয়!

ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধটি বর্তমানে জাতীয় সংগ্রহশালা। এই মেমোরিয়ালে ছোট-বড় অনেকগুলো গ্যালারি রয়েছে। এখানে ভিন্ন ভিন্ন গ্যালারিতে রয়েছে আলাদা সংগ্রহশালা। রাজকীয় গ্যালারিতে রয়েছে মহারানী এবং তার পরিবারের ব্যবহৃত জিনিসপত্র। জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে ১৬৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে পুরোনো সাম্রাজ্যের ব্যবহৃত নানা জিনিসপত্র। এখানে সংরক্ষিত আছে ইতিহাসের  প্রতাপশালী ব্যক্তিদের পদক, অস্ত্র, ভাস্কর্য, কস্টিউমস এবং ব্যক্তিগত স্মৃতিচিহ্ন। বিশেষ করে পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত কামান ও কামানের গোলা, অস্ত্র রাখা আছে গ্যালারিতে। আছে টিপু সুলতানের যুদ্ধে ব্যবহৃত তলোয়ার, বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরের অস্ত্রসহ চারশ বছরের পুরনো ঢাল-তলোয়ার। 

সাহিত্য গ্যালারিতে ভারতবর্ষের বিখ্যাত সাহিত্যিক ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ অনেকের ছবি রয়েছে। বায়োগ্রাফিতে লেখা রয়েছে তাদের আদ্যোপান্ত। তাছাড়া বিখ্যাত সাহিত্যিকদের অমূল্য পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত রয়েছে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে। রয়েছে বিখ্যাত চিত্রশিল্পীর আকা চিত্রকর্ম। যাদুঘরের সংগ্রহশালার সামগ্রীগুলো বহন করে চলেছে সময়ের ইতিহাস। একটা গ্যালারিতে খাপ থেকে তরবারি খুলে দাঁড়িয়ে আছেন ভারতবর্ষ দখলের মূল পরিকল্পনাকারী লর্ড ক্লাইড। ক্লাইভের চোখে খুনে দৃষ্টি। তলোয়ারের বাটে ধরা হাত সাদা হয়ে আছে । ক্লাইভের কূটবুদ্ধির কাছে হার মেনে ভারতবর্ষকে প্রায় দুইশ বছর পরাধীনতার গ্লানির স্বাদ নিতে হয়েছে। 

আমরা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল থেকে বিদায় নিয়ে হেঁটে সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রালের দিকে চললাম। চোখে পড়ছে রাস্তার দুইপাশের সবুজ ঘাসের প্রান্তর। বাতাস থেমে আছে, কুয়াশায় ছেয়ে আছে আকাশ। গোধূলির শেষ আলো মরে যায়নি, পশ্চিম আকাশে সামান্য ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছে। তেজহীন সূর্যটা দিগন্ত থেকে বিদায়ের আগে অন্ধকারের কাছে যেন বিদায় চেয়ে নিচ্ছে। 

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালেল খুব কাছে অবস্থিত সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রাল। এটি কলকাতার বৃহত্তম ক্যাথিড্রাল বা গির্জা।  গির্জাটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় ১৮৩৯ সালে এবং নির্মাণকার্য সমাপ্ত হয় ১৮৪৭ সালে। পায়ে হেঁটে মিনিট দশেকের মধ্যে আমরা যখন পৌঁছালাম, তখন সূর্য পশ্চিম দিগন্তের বাঁকে তলিয়ে গেলেও শেষ আভা মিলিয়ে যায়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবছা অন্ধকারে ছেয়ে গিয়ে চারপাশে সন্ধ্যা নেমে এলো। সেন্ট পল’স ক্যাথিড্রালে সকল ধর্মের মানুষের প্রবেশাধিকার রয়েছে। যে কোন ধর্মীয় উপাসনালয় মনকে অন্য রকম প্রশান্তিতে ভরে দেয়। গির্জায় উপাসনাকার্য চলছে। আমরা টিকেট কেটে ক্যাথিড্রালের ভেতরে প্রবেশ করলাম। প্রথমে চোখে পড়ল যিশুর একটা ভাস্কর্য। প্রবেশ পথের ডানদিকে আছে একটি বড় গ্রন্থাগার, পাশে রয়েছে স্মারক দ্রব্যের একটি প্রদর্শনশালা।

ক্যাথিড্রালটির বাম পাশে যেতেই চোখে পড়ল অডিটরিয়ামের মতো বিশাল উপাসনার স্থান। উপাসনার স্থানটিতে লোকজন কম, বিরাজ করছে সুনশান নীরবতা। যারা আছে, তারা চেয়ারে বসে ধ্যানী বকের মতো কেউ অর্ধেক বুজে, কেউ অর্ধেক চোখ খুলে প্রার্থনামগ্ন। ওদের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছে, কেউ গির্জায় এসেছে ভোগান্তির অবসান চাইতে, কেউ ফিরে পেতে চাইছে শারীরিক সুস্থতা, কেউবা এসেছে পাপের শাস্তি মওকুফের আবেদন নিয়ে। কেউবা মগ্ন নিজের পরিবার পরিজনের মৃত আত্না শান্তি পাক এই প্রার্থনায়। মানুষের প্রতিটি নীরব প্রার্থনায় মিশে থাকে আহাজারি ও গোঙানির শব্দ, যা বাইরে থেকে বোঝা যায় না। 

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা ক্যাথিড্রাল থেকে বেরিয়ে এলাম। ক্যাথিড্রালে প্রবেশের আগে প্রকৃতি চারদিকে অন্ধকারের যে প্রাচীর টেনে দিয়েছিল, বের হয়ে দেখছি, বিদ্যুতের আলো সে অন্ধকারের স্থান বেদখল করে হাসছে। সত্যি, চারপাশের আলো আমাদের চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। আরও কিছুদূর এগিয়ে এসে দেখতে পাচ্ছি সাদা আর রঙ্গিন আলো পুরো শহরকে  ছেয়ে ফেলেছে। দিনের ঘুমন্ত জীর্ণ-শীর্ণ কলকাতা যেন রাতে জেগে উঠছে আলোর ঝলকানিতে। সত্যি, রাতের ধবধবে আলোয় বয়োজ্যেষ্ঠা কলকাতা যেন সদ্য যৌবনে পদার্পণ করা ষোড়শী কিশোরীর যৌবন পেয়েছে। এ শহরকে সাজাতে সবই যেন আলোর কৃতিত্ব!  

আমরা সামনের দিকে  আসতেই চোখে পড়ল বিড়লা প্ল্যানেটেরিয়াম। এটি ক্যাথেড্রালের ঠিক সামনেই অবস্থিত। বিড়লা এশিয়ার বৃহত্তম প্ল্যানেটেরিয়াম এবং বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্ল্যানেটোরিয়াম। টেলিস্কোপে চোখ রেখে মহাকাশের বিস্ময়কর দারুণ সব গ্রহ নক্ষত্র দেখা যায় এই সেন্টার থেকে । আধুনিক এই প্ল্যানেটোরিয়াম রাতের আকাশে ভার্চুয়াল ভ্রমণ এবং মহাজাগতিক শো প্রদর্শন করে। মানুষ এই প্লাটরিয়াম থেকে জ্যোর্তিবিজ্ঞান, মহাকাশবিজ্ঞান এবং গ্রহণক্ষত্র সংক্রান্ত মহাবিশ্বের তথ্য জানতে পারে। ভারতের মহান শিল্পপতি বিএম বিড়লার স্মৃতিতে 1988 সালে নির্মিত এই প্লাটরিয়ামটি। মহাকাশ বিজ্ঞান সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের দেওয়া তথ্য আমাদের অনেকেরই অজানা। গ্রহ নক্ষত্র, সৌর জগৎ, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি সংক্রান্ত মহাবিশ্বের তথ্য শুনলে তা অনেকের কাছে গাঁজাখুরি গল্প  মনে হবে।  

আমরা আটশ পঞ্চাশ কোটি মানুষ বসবাস করছি পৃথিবী নামক এই গ্রহে। আমাদের ৫১ কোটি বর্গ কিলোমিটারের পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে। সূর্যটা পৃথিবী থেকে ১৫ কোটি কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। সূর্যের সাইজ বা আকারটা হচ্ছে  আমাদের পৃথিবী থেকে তেলো লাখ গুন বড়। সূর্যের বাহিরের তাপমাত্রা ৬ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস আর ভেতরের তাপমাত্রা দেড়কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াস। সূর্যের ২৩ কোটি ভাগের একভাগ তাপ পৃথিবী পৌঁছে। 

শুক্র, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি, ইউরেনাস, নেপচুন ও পৃথিবীসহ যে ৮টি গ্রহ সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, আমরা একেই বলছি সৌর জগৎ। সূর্যটা অবস্থান করছে আবার মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে। মনে করা হয় একশো থেকে চারশ বিলিয়ন সূর্যের মতো নক্ষত্র মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির চারপাশে চক্রাকারে ঘুরছে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত আলো পৌঁছাতে এক লাখ বছর প্রয়োজন। যেখানে আলোর গতি সেকেন্ডে ৩ লাখ কিলোমিটার। এবারের যে অসম্ভব তথ্যটি তা শুনে অনেকের অবিশ্বাস্য মনে হবে। মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির সবচেয়ে বড় নক্ষত্রের নাম স্কুটি। স্কুটি নক্ষত্রটা সূর্যের চেয়ে পাঁচশ কোটি গুন বড়। মহাকাশে দুই লাখ কোটি মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি আছে যা আমরা রাতের আকাশে তারা হিসাবে দেখি। 

মহা সাগরের জলের কাছে এক বালতি জল যেমন তুচ্ছ তেমনি মহাবিশ্বের তুলনায় ক্ষদ্র আমাদের এ পৃথিবী! মহাকাশের এসব গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি মহান স্রষ্টার সৃষ্টি।  তাহলে স্রষ্টা কত বড় আর তার শক্তি কতুটুকু! এটা মানুষের পক্ষে কল্পনা করাও অসম্ভব। সৃষ্টির বিশালত্বের কথা যদি কোন মানুষ ঠান্ডা মস্তিস্কে চিন্তা করতে পারে তবে সে কখনো অন্য মানুষের সাথে ঠগবাজী, হানাহানি খুনোখুনিতে জড়ানোর কথা চিন্তাও করবে না। ইচ্ছে ছিল বিড়লা প্লানেটরিয়ামে প্রবেশ করে  টেলিস্কোপে চোখ রেখে মহাবিশ্ব দেখার। রাতে বিড়লা প্লানেটরিয়ামের টিকেট কাউন্টার বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা সময় নষ্ট না করে ট্যাক্সিতে রওনা হলাম ঐতিহাসিক স্থান প্রিন্সেপ ঘাটের দিকে। 

কলকাতা শহর নিজেকে সজ্জিত করেছে ঐতিহাসিক সব  স্থান দ্বারা। এই শহরে ঐতিহাসিক যত স্থাপনা আছে ইন্ডিয়ার অন্য কোনো প্রদেশে তা নেই। কলকাতা নিজস্ব কিছু ঐতিহ্য সংস্কৃতির সৌন্দর্য মুগ্ধ করে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত ভ্রমণপিপাসুদের। প্রিন্সেপ ঘাট কলকাতার পুরনো দর্শনীয় স্থানের মধ্যে একটি। এই ঘাটকে কলকাতার ঐতিহ্যপূর্ণ পর্যটক কেন্দ্র মনে করা হয়। জেমস প্রিন্সেপের স্মৃতিতে নির্মিত হয় এই ঘাট। প্রিন্সেপ ঘাট ব্রিটিশ আমলে ১৮৪১ সালে নির্মিত হয়েছে কলকাতার হুগলি নদীর তীরে। ব্রিটিশদের সব যাত্রীবাহী জাহাজের যাত্রী ওঠানামার কাজে ব্যবহার করা হতো এই ঘাট। বৃটিশরা ভারতবর্ষের দামী প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ লুট করে নিয়ে যেত এই ঘাট দিয়ে। আবার এখান থেকেই অনেকে নৌকায় প্রমোদভ্রমণে যেত।

বিড়লা প্লানেটরিয়াম থেকে রওনা হয়ে ৩০-৪০ মিনিটে আমরা পৌঁছালাম প্রিন্সেপ ঘটে। কলকাতার ঘিঞ্জি শহর থেকে দূরে নির্জনে অবস্থিত প্রিন্সেপ ঘাট। ঘাটে প্রবেশের আগে একটি সুন্দর মনুমেন্ট নির্মাণ করা হয়েছে ,যা বিশেষ আকর্ষণীয়। রাতের অন্ধকার আর বাহারি লাইট মিলিয়ে এক অপরূপ দৃশ্য ধারণ করেছে প্রিন্সেপ ঘাট। মনুমেন্টের পেছন দিকটায় ছায়া পড়ে আবছা অন্ধকারে ছেয়ে আছে। পেছনে তাকাতেই দেখা গেল জোড়া প্রেমিক-প্রেমিকারা ভালোবাসার আবহে জড়িয়ে ধরে গল্পে মগ্ন! দৃশ্য দেখে মনে হলো, শান্তিপূর্ণভাবে বিশেষ মুহূর্ত কাটানোর জন্য প্রিন্সেপ ঘাট আদর্শ স্থান। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা মূল ঘাটে এসে পৌঁছালাম। ঘাটের চারপাশের পরিবেশ বেশ মনোরম ও খোলামেলা। ঘাটের ডানদিকে একটি পার্ক। পার্কটিতে আছে বিভিন্ন গাছের সুসজ্জিত বাগান। ঘাট ঘিরে পর্যটক কেন্দ্র ভালোই গড়ে উঠেছে। আশেপাশে  বাহারি খাবারের দোকান বিক্রি হচ্ছে পাউ ভাজি, ফুচকা। সত্যিই, ব্রিটিশ নির্মিত ঘাটির সৌন্দর্য্যের তুলনা হয় না।

আমরা সিঁড়ি বেয়ে ঘাটের নিচে নামলাম। আমাদের দাঁড়ানো সিঁড়ির বেশ উপরেও জলের দাগ লেগে আছে। হুগলি নদীতে ভাটা চলছে। জলের উপর কয়েকটি জাহাজ নোঙর করা আছে। নদীর জলের উপর আলোর ঝাঁপটা পড়ে অন্য রকম এক আবহ সৃষ্টি হয়েছে। আলো যেন তার অফুরন্ত সৌন্দর্য ঢেলে দিয়েছে নদীর বুকে। ইচ্ছে হলো, নৌকা নিয়ে খোলা নদীর বুকে চষে বেড়াতে। ঘাটে মাঝিমাল্লা না থাকায় জলের বুকে ঘুরে স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল। 

দিনের শেষ ভ্রমণ হিসেবে রাত্রির যাত্রী হয়ে বাসে চেপে রওনা হয়েছি হাওড়া ব্রিজের দিকে। কলকাতা ও হাওড়া শহরের মধ্যে সংযোগকারী ব্রিজ হচ্ছে হাওড়া। সেতুটার মূল আকর্ষণ হলো এতে কোনো পিলার নেই। বিশাল বিশাল স্টিলের পাত একটার সঙ্গে আরেকটা জুড়ে বানানো হয়েছে। হাওড়া ব্রিজ আমাদের রাঙ্গামাটির ঝুলন্ত সেতুর মতো তবে আকারে অনেক বড়। ব্রিজটি দেড়শ বছরের ইতিহাসের সাক্ষী দাঁড়িয়ে আছে হুগলী নদীর উপর। নিজেদের বাণিজ্যের সুবিধার কারণে নাট-বোল্টু ছাড়াই ১৮৭৪ সালে ব্রিটিশরা হাওড়া সেতু নির্মাণ করেছিলেন। হাওড়া না কি এখনও বর্তমান বিশ্বের ষষ্ঠ দীর্ঘতম সেতু। হাওড়া সেতু কলকাতার গর্ব। সরকারিভাবে হাওড়া ব্রিজের নাম  পরিবর্তন করে রবীন্দ্র সেতু রাখা হলেও মানুষ হাওড়া নামেই চেনে। 

আমরা যখন বাসে হাওড়া এসে পৌঁছালাম তখন রাত্রি আটটা।  সফরসঙ্গী লিটু ভাই আর সঞ্জয়দাসহ বাসস্ট্যান্ড থেকে  ব্রিজের দিকে যাচ্ছি। ব্রিজের দুই পাশের আলো জলের উপর পড়ে এক অন্য রকম আবহ সৃষ্টি করেছে। দূর থেকে জল আর আলোর মিলনমেলা দেখে সৌন্দর্যের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে আমার চোখ। মানুষের কলরবে হাওড়া ব্রিজে রাত্রির নিস্তব্ধতা  নেমে আসতে পারে নি। কিছু কিছু বিরল সৌন্দর্য দাঁড়িয়ে দেখতে মন চায়। আমি হাওড়ার সৌন্দর্য দেখতে হঠাৎ   ব্রিজের গোড়ায় দাঁড়িয়ে গেলাম। ব্রিজের সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য দুইদিকে সুসজ্জিত করে লাগানো হয়েছে রংবেরঙের শতশত এলইডি লাইট। ব্রিজের দুইপাশে মায়াবি আলোয় ঝলমল করছে। রাতের হাওড়া ব্রিজে চলছে আলোর ছন্দে ছন্দে রং বদলানোর দৃশ্যপট! আমি রীতিমতো উপভোগ করছি এই মনোরম আলো আঁধারের খেলা। একবার ভাবছি, আঠারো শতকে সেতু প্রকৌশল ও তাদের প্রযুক্তি জ্ঞানের কথা। দেড়শ বছর আগে কীভাবে নকশা প্রনয়ণ করে, নাট-বোণ্টু ছাড়াই  ব্রিজ নির্মাণ করল তারা? আবার ভাবছি, ইংরেজরা শুধু  ভারতবর্ষ নয়, পৃথিবী শাসন করতো বুদ্ধির জোরে। এজন্যই  ওদের তৈরি অনেক স্থাপনা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। 

হঠাৎ দেখি ভ্রমণসঙ্গী লিটু ভাই আর সঞ্জয়দা সামনে নেই। তাদের দেখতে না পেয়ে আমি ভড়কে গেলাম। এতটা ভয় পেলাম, যা কলকাতা ভ্রমণকালে পাইনি। কারণ জনস্রোতের মধ্যে দলছুট হলে যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে পড়ব। তাছাড়া  আমার সঙ্গে ইন্ডিয়ার সিম নেই। আমি অনেকটা দৌড়ের গতিতে হেঁটে হেঁটে সফরসঙ্গীদের খুঁজতে লাগলাম। (চলবে) 

তারা//

সম্পর্কিত নিবন্ধ