দেশে দেশে অর্থের বিনিময়ে নাগরিকত্ব বিক্রি হচ্ছে। বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের যেসব ধনাঢ্য ব্যক্তি উন্নত দেশগুলোতে স্থায়ী হতে চান, তাঁদের জন্য ইউরোপ-আমেরিকার অনেক দেশ নাগরিকত্ব পাওয়ার এমন সুযোগ দিচ্ছে। এতে উন্নত দেশগুলো আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে থাকে। এমন দেশের তালিকায় যুক্তরাষ্ট্র আগে থেকেই ছিল। পুরোনো সে কর্মসূচি বাতিল করে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন।

গত মঙ্গলবার অভিবাসন নীতিতে বড় পরিবর্তন আনার ঘোষণা দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর ঘোষণা অনুসারে, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেতে হলে গুনতে হবে ৫ মিলিয়ন বা ৫০ লাখ মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ৬০ কোটি টাকার মতো। ওই পরিমাণ অর্থ দিলেই মিলবে ‘গোল্ড কার্ড’, যা সে দেশের নাগরিকত্বের প্রমাণ।

গোল্ড কার্ড থেকে প্রাপ্ত অর্থ সরাসরি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তহবিলে চলে যাবে। আর্থিক ঘাটতি মেটাতে এটি কাজে লাগবে বলেই জানাচ্ছে সে দেশের প্রশাসন।

এত দিন অভিবাসীরা গ্রিন কার্ডের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পেতেন। এবার চালু হতে চলেছে গোল্ড কার্ড। এই কার্ড গ্রিন কার্ডের পরবর্তী সংস্করণ। তবে শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, বিশ্বের অনেক দেশেই এখন এভাবে অর্থ বা বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। খবর বিবিসির

মূলত উন্নয়নশীল দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষেরা এ ধরনের নাগরিকত্বের সুযোগ নেন। বাংলাদেশের অনেক মানুষ দুবাই, কানাডা, মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে এই নাগরিকত্বের সুযোগ নিয়েছেন, যদিও দেশ থেকে বৈধভাবে অর্থ নেওয়ার সুযোগ নেই। অর্থাৎ এই অর্থ নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি অবৈধ। দ্বৈত নাগরিকত্বের আড়ালে চলে টাকা পাচার—এমন অভিযোগ দীর্ঘদিনের।

যুক্তরাষ্ট্র এখন গোল্ড কার্ড বিক্রির পরিকল্পনা করেছে। এতে খুলে যাবে সে দেশের নাগরিকত্ব পাওয়ার নতুন পথ। ধনী ব্যক্তিরা এই কার্ড কিনে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ী হতে পারবেন। ১৯৯০ সালে চালু হওয়া ইবি-৫ কর্মসূচি ডোনাল্ড ট্রাম্পের পছন্দ না হওয়ায় এবার তিনি নতুন কর্মসূচি চালুর ঘোষণা দিয়েছেন। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে এর রূপরেখা স্পষ্ট হবে।

দেশে দেশে নাগরিকত্ব বিক্রি

বর্তমানে ইউরোপের মাল্টা, সাইপ্রাস, মন্টেনেগ্রো, মলদোভা, লাটভিয়া, গ্রিস ও লিথুয়ানিয়া প্রভৃতি দেশ বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব দিচ্ছে। ক্যারিবীয় দেশ অ্যান্টিগা অ্যান্ড বারমুডা, গ্রানাডা, সেন্ট লুসিয়াতেও এই সুবিধা পাওয়া যায়।

এ ছাড়া কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, নিউজিল্যান্ড ও ইউরোপের অনেক দেশেই বিনিয়োগের বিনিময়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি পাওয়া যায়। এর মধ্যে কোনো কোনো দেশ পর্যায়ক্রমে নাগরিকত্ব নেওয়ার সুযোগও দেয়।

বাংলাদেশিরাও সুযোগ নেন

মালয়েশিয়ার ‘সেকেন্ড হোম কর্মসূচি’ খুবই জনপ্রিয়। এই সুযোগ নেওয়া বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মধ্যে বাংলাদেশিদের অবস্থান পঞ্চম। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়েছেন ৩ হাজার ৬০৪ জন বাংলাদেশি। ওই সময় পর্যন্ত মালয়েশিয়ায় সক্রিয় ‘সেকেন্ড হোম’ পাসধারী ছিলেন ৫৬ হাজার ৬৬ জন।

অনেক বাংলাদেশি মধ্যপ্রাচ্যের সংযুক্ত আরব আমিরাতের (ইউএই) দুবাইয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন কিংবা নিবাস গড়েছেন। দুবাই চেম্বারের হিসাব অনুসারে, ১১ হাজারের বেশি বাংলাদেশি দুবাইয়ে নিবন্ধন নিয়ে এখন ব্যবসা করেন। এর মধ্যে অনেকেরই হোটেল ও আবাসন ব্যবসা রয়েছে। তাঁদের কেউ কেউ দেশ থেকে অবৈধ উপায়ে অর্থ নিয়ে দুবাইয়ে লগ্নি করেছেন। এই সুবিধা দিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাত বিনিয়োগ ভিসার অন্যতম আকর্ষণীয় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। সে দেশে ৫ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করলে নাগরিকত্বের সুবিধা পাওয়া যায়, যাকে বলা হয় গোল্ডেন ভিসা।

বাংলাদেশ থেকে কানাডা ও যুক্তরাজ্যে যাওয়ার প্রবণতা অনেক বেশি। বিশেষ করে কানাডার বেগম পাড়ায় অনেক প্রভাবশালী বাংলাদেশি বাড়ি-গাড়ি কিনে বিলাসবহুল জীবন যাপন করছেন। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বা অস্ট্রেলিয়ার দিকেও অনেকের আগ্রহ রয়েছে। তবে এখন মাল্টা, সাইপ্রাস, লাটভিয়ার মতো ইউরোপের দেশগুলোয় সরাসরি নাগরিকত্ব নিয়ে চলে যাওয়ার প্রবণতাও দেখা যাচ্ছে।

কোথায় কত অর্থ খরচে নাগরিকত্ব মেলে

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বাংলাদেশের অনেক প্রভাবশালী ব্যবসায়ী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নাগরিকত্ব নিয়েছেন। বাংলাদেশের মানুষ সাধারণত যেসব দেশে দ্বিতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে থাকেন, সেগুলোতে জীবনযাত্রার মান অত্যন্ত উঁচু। এসব দেশে নাগরিকত্ব বা স্থায়ীভাবে বসবাসের অধিকার পেলে বিনা বাধায় থাকা ও কাজ করা যায়। আবার করের হারও কম। এ ছাড়া মানুষ সাধারণত সেই সব দেশেই যায় যেখানকার পাসপোর্ট শক্তিশালী। ওই সব পাসপোর্ট দিয়ে বিশ্বের অনেক দেশেই বিনা ভিসায় যাওয়া যায় বা অন অ্যারাইভাল ভিসায় ঢোকা সম্ভব।

একেক দেশে স্থায়ীভাবে বসবাস ও কাজ করার অধিকার পেতে একেক পরিমাণ অর্থ লাগে। যেমন কানাডায় ১২ লাখ কানাডীয় ডলার বিনিয়োগ করতে হয়।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক অভিবাসন প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্সের তথ্যানুসারে, ইউরোপের দেশ মাল্টায় নাগরিকত্ব পেতে ছয় লাখ ইউরো বিনিয়োগ করতে হয়। ইউরোপের আরেক দেশ নর্থ মেসিডোনিয়ায় দুই লাখ ইউরো বিনিয়োগের বিনিময়ে পাওয়া যায় নাগরিকত্ব। ইউরোপ ও এশিয়ার সংযোগস্থল তুরস্কের ক্ষেত্রে এই অঙ্ক চার লাখ মার্কিন ডলার।

ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে এন্টিগুয়া ও বারমুডার নাগরিকত্ব পাওয়া যায় ২ লাখ ৩০ হাজার ডলার বিনিয়োগের বিনিময়ে। ডমিনিকান রিপাবলিকের ২ লাখ মার্কিন ডলার; গ্রেনাডায় ২ লাখ ৩৫ হাজার ডলার, সেন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসে ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার ও সেন্ট লুসিয়ায় ২ লাখ ৪০ হাজার ডলার বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব পাওয়া যায়। ওশেনিয়া অঞ্চলের নাউরুতে নাগরিকত্ব মেলে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলারের বিনিময়ে। এ ছাড়া কোস্টারিকায় ১ লাখ ৫০ হাজার ডলার এবং পানামায় ১ লাখ ডলার বিনিয়োগের বিনিময়ে পাওয়া যায় নাগরিকত্ব।

আফ্রিকা অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে মিসরের নাগরিকত্ব পাওয়া যায় ২ লাখ ৫০ হাজার ডলার বিনিয়োগের বিনিময়ে। মধ্যপ্রাচ্যের জর্ডানে ৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার বিনিয়োগের বিনিময়ে নাগরিকত্ব মেলে।

এ ধরনের নাগরিকত্ব বিক্রির কর্মসূচি নিয়ে সারা বিশ্বেই সমালোচনা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে উন্নত দেশগুলোতে অর্থ চলে যাচ্ছে। ট্রাম্পের নতুন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে এই প্রক্রিয়া আরও জোরদার হবে বলেই আশঙ্কা করছেন বিশ্লেষকেরা।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র অন ক দ শ ইউর প র ব যবস

এছাড়াও পড়ুন:

দাবির বন্যা সামলাতে সরকারকে যা করতে হবে

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের তিন দিন পর ৮ আগস্ট অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো সরকারপ্রধান গণ-অভ্যুত্থানের মুখে দেশত্যাগ করেন। যদিও এর আগে দুজন রাষ্ট্রপতি ক্ষমতায় থাকাকালে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। শেখ হাসিনার দেশত্যাগ এবং বর্তমান সরকার—উভয়ের ছয় মাস পূর্ণ হলো।

এই ছয় মাসে সরকারের অন্য অনেক ডেবিট-ক্রেডিটের মধ্যে যে বিষয় সবচেয়ে লক্ষণীয়, তা হচ্ছে নানা শ্রেণি-পেশা ও গোষ্ঠীর স্বার্থকেন্দ্রিক (অ)শান্তিপূর্ণ আন্দোলন। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকায়, যেকোনো দাবিতে গণজমায়েতভিত্তিক আন্দোলনের রাজনীতি এ সময়ে এক নতুন মোড় নিয়েছে। কারণে-অকারণে, যখন-তখন ঢাকায় এই গোষ্ঠীভিত্তিক আন্দোলন জনজীবনে অভিশাপ হয়ে আবির্ভূত হতে দেখা যাচ্ছে, যার বেশির ভাগেরই যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ। অনেকে আন্দোলনের এই নতুন ঢেউকে বর্তমান সরকারের দুর্বলতা (ক্যাপাসিটি ট্র্যাপ) ও সমন্বয়হীনতা দিয়ে মূল্যায়ন করছেন।

কিন্তু এর পেছনে আছে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিশেষ করে বিগত সরকারের তথাকথিত ‘উন্নয়নতন্ত্র’ ও অগণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে জনগণের সঞ্চিত বঞ্চনাবোধ ও অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ।

পতিত আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৪–দলীয় জোট সরকারের প্রতি জনগণের ক্ষোভ ছিল সীমাহীন। এর পেছনে অন্যতম প্রধান কারণ ছিল জনগণের যেকোনো দাবিকে শেখ হাসিনার তুচ্ছজ্ঞান করা। উদাহরণ হিসেবে সর্বশেষ ২০২৪ সালে ১৪ জুলাই গণভবনে চীন সফর-পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সর্বজনীন পেনশন স্কিম ‘প্রত্যয় কর্মসূচি’ বাস্তবায়নের বিরোধিতা করে আন্দোলনরত দেশের প্রায় সব স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রসঙ্গে তাঁর মূল্যায়ন, ‘তাঁরা আন্দোলন করে টায়ার্ড হলে তখন তাঁদের সঙ্গে আলোচনায় বসব।’

অধিকন্তু, একই সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনার মন্তব্য কারোই অজানা নেই; মন্তব্যে তিনি আন্দোলনকারীদের ‘রাজাকার’–এর সঙ্গে তুলনা করেন। এমনকি ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তিনি দেশের বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষকদের বেতনসংক্রান্ত দাবির আন্দোলন নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে ‘মনে হচ্ছে, শিক্ষকদের বেতন একটু বেশি বাড়িয়ে ফেলেছি, তাই এখন তাঁরা সম্মানের প্রশ্ন তুলছেন।’

অন্যথায় আন্দোলনের নামে ‘মব জাস্টিস’-এর প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে, যা দীর্ঘ মেয়াদে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বদলে সমাজে আরও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে এবং ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। অতএব সরকারের শুধু দাবি মেনে নেওয়াই যথেষ্ট নয়; বরং একটি কাঠামোবদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনা চালুর মাধ্যমে সব ন্যায্য দাবির সমাধানের পথ খুঁজে বের করাই জরুরি।

এ ধরনের ব্যঙ্গাত্মক ও অপমানসূচক মন্তব্যে শুধু সাধারণ শিক্ষকসমাজই নয়, খোদ শেখ হাসিনার নিজ দলের অনেক নেতা-কর্মী-সমর্থকও বিরক্ত ছিলেন। যেহেতু তাঁর শাসনামলে প্রকাশ্যে সমালোচনা প্রায় অসম্ভব ছিল, তাই অনেককেই অপ্রকাশ্যে উষ্মা প্রকাশ করতে দেখা যেত।

কিন্তু আমাদের সবার মনে রাখা প্রয়োজন, বর্তমান সরকার রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত কোনো স্বাভাবিক সরকার নয়; বরং বিশেষ পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া একটা আপত্কালীন সরকার। ফলে একের পর এক, কারণে-অকারণে এরূপ অরাজনৈতিক আন্দোলন ও দাবি তোলার মাধ্যমে ঢাকার মতো এমন একটা প্রায় পরিত্যক্ত বসবাস–অযোগ্য শহরে অযাচিত যান চলাচল বন্ধ করে জনদুর্ভোগ বাড়ানো কতটা যুক্তিসংগত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে সব মহলেই।

কথা সত্য যে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দাবিভিত্তিক আন্দোলন বৃদ্ধির পেছনে বর্তমান সরকারের আন্দোলন মোকাবিলায় ব্যর্থতা স্পষ্ট। বিশেষ করে এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের সচিবালয় ঘেরাওয়ের পরপরই যখন সে সময় পর্যন্ত স্থগিত থাকা পরীক্ষাগুলো বাতিল করে সেসব বিষয়ে পরীক্ষা ছাড়াই পাসের দাবি মেনে নেওয়া হয়, তখন এটি একটি খারাপ নজির তৈরি করে, যা অন্য অনেক ক্ষেত্রে আজ অবধি আন্দোলনের নেতিবাচক উদ্দীপনা (নেগেটিভ ডমিনো ইফেক্ট) দিয়ে যাচ্ছে।

এর পর থেকেই মূলত বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষ বিশেষত নিজ নিজ শ্রেণি ও গোষ্ঠীভিত্তিক দাবি আদায়ের জন্য রাস্তায় নামতে শুরু করেছে। এসব জমায়েত গণ-আন্দোলনের মতো মনে হলেও আসলে এগুলো বিচ্ছিন্ন গোষ্ঠীভিত্তিক স্বার্থকেন্দ্রিক সুযোগের সদ্ব্যবহার, যার পেছনে একক কোনো রাজনৈতিক পরিকল্পনা বা ঐক্যবদ্ধ গণদাবির কাঠামো নেই।

বর্তমান সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, জনগণের মধ্যে একধরনের ধারণা সৃষ্টি হয়েছে যে আন্দোলনে নামলেই দাবি পূরণ হবে। মূলত সরকারের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও সর্বোপরি সমন্বয়ের অভাবই এ পরিস্থিতি তৈরি করেছে। সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে যে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা রয়েছে, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিভিন্ন খাতের আন্দোলন ও তা সামালে অপরিপক্ব দুর্বল প্রচেষ্টা, যা মূলত এ ক্ষেত্রে ব্যর্থতার প্রধান কারণ।

বিশেষ করে কোনো আন্দোলন শুরু হলেই তড়িঘড়ি করে তা মেনে নেওয়ার প্রবণতা সরকারকে আরও দুর্বল করে তুলছে। জনগণের মনে যখন এই ধারণা বদ্ধমূল হয় যে রাস্তায় নামলেই দাবি আদায় হবে, তখন এ ধরনের জনদুর্ভোগ তৈরির মাধ্যমে আন্দোলন একটি অপকৌশলে পরিণত হয়।

এর ফলে যাঁরা ন্যায্য দাবির পক্ষে আন্দোলন করেন, তাঁদেরও গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

আন্দোলনের সাংবিধানিক অধিকার মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে জনপরিসরে এর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে একটি সুস্পষ্ট অবস্থান গড়ে উঠেছে, যা আন্দোলনকারীদের প্রতি নেতিবাচক ও তির্যক মন্তব্যের মাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। এ প্রবণতা সরকারের দুর্বলতার সুযোগে ঘটছে বলেই অনেকের অনুমান। কিছু ব্যক্তি কিংবা গোষ্ঠীর বিশেষ স্বার্থে অগণিত মানুষের দুর্ভোগ লাঘবে সরকার সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বঞ্চনাবোধ কিংবা বৈষম্যবোধ থেকে গোষ্ঠীগত আন্দোলনের নামে যদি প্রায় প্রতিদিনই জনদুর্ভোগ বাড়ে, তবে তা গণতান্ত্রিক অধিকারের সীমা লঙ্ঘন করে, যা আমরা অনেক সময় ভুলে যাই।

এ ক্ষেত্রে তথাকথিত ‘মব জাস্টিস’-এর ধারণা প্রাসঙ্গিক। সংঘবদ্ধভাবে কোনো প্রতিষ্ঠান বন্ধের হুমকি, অধিকার আদায়ের নামে রাস্তাঘাট ব্যারিকেডের মাধ্যমে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে গোষ্ঠীগত দাবি আদায়ের চেষ্টা সুবিধাবাদেরই নামান্তর।

বর্তমান সরকারের সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপ হওয়া উচিত আন্দোলনের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নির্ধারণ করা। সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বার্তা দেওয়া প্রয়োজন, আন্দোলন করলেই সব দাবি পূরণ করা হবে না। বরং কীভাবে সাংবিধানিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে জনদুর্ভোগ না বাড়িয়ে দাবি উপস্থাপন করা যাবে, সে বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে দিকনির্দেশনা থাকা জরুরি হয়ে পড়েছে। আন্দোলনের দাবি পূরণের জন্য যদি যথাযথ সংলাপ ও আলোচনা ফোরামের ব্যবস্থা থাকত, তবে দিন দিন পরিস্থিতি এত জটিল হয়ে উঠত না।

বর্তমান সরকারের কাঠামোগত দুর্বলতাও স্পষ্ট। যেনতেনভাবে সংস্কারের নামে কমিশন গঠন, শিক্ষা খাতে দীর্ঘদিন ধরে চলা অসংগতি উপেক্ষা করা, শিক্ষাবিষয়ক কোনো সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি না দেওয়া, স্বাস্থ্য খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সরকারের ব্যর্থতা, গণহত্যার বিচারে দীর্ঘসূত্রতার প্রকটতা, শুধু জনতুষ্টির জন্য স্বল্পমেয়াদি সমাধানের দিকে ঝোঁকা এবং জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সুস্পষ্ট রোডম্যাপের অভাব—এ সব কটি বিষয়েই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে ইতিমধ্যে ম্লান করে দিয়েছে।

দেশের সাম্প্রতিক আন্দোলনের প্রকৃতি ও সরকারের প্রতিক্রিয়া বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ পরিস্থিতির জন্য উভয় পক্ষই কমবেশি দায়ী। একদিকে জনগণের বঞ্চনাবোধ, অসন্তোষ ও সরকারের প্রতি আস্থার অভাব আন্দোলনকে অনেকাংশে উসকে দিচ্ছে, অন্যদিকে সরকারের অপরিকল্পিত ও দ্রুত আন্দোলনের দাবির প্রতি সংহতি আন্দোলনের মাত্রা ও সংখ্যা আরও বাড়িয়ে তুলছে। যদিও আন্দোলনের সাংবিধানিক ভিত্তি রয়েছে, তবে একে সঠিক পথে পরিচালিত করা বর্তমান সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত।

অন্যথায় আন্দোলনের নামে ‘মব জাস্টিস’-এর প্রবণতা বৃদ্ধি পেতে পারে, যা দীর্ঘ মেয়াদে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বদলে সমাজে আরও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবে এবং ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ গঠনে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। অতএব সরকারের শুধু দাবি মেনে নেওয়াই যথেষ্ট নয়; বরং একটি কাঠামোবদ্ধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আলোচনা চালুর মাধ্যমে সব ন্যায্য দাবির সমাধানের পথ খুঁজে বের করাই জরুরি।

ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • দাবির বন্যা সামলাতে সরকারকে যা করতে হবে
  • বাংলা সংবাদপত্রের ভাষা: সাম্প্রতিক প্রবণতা
  • জাপান ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্র্যাজুয়েট স্কলারশিপ, ১৯ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে করুন আবেদন
  • শত কোটি ভারতীয়ের পছন্দসই পণ্য কেনার অর্থের অভাব: প্রতিবেদন