আফগানিস্তান এখন গভীর সংকটে। যে স্থিতিশীলতার একটি বিভ্রম এত দিন ধরে ছিল, তা এখন পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। দেশের অর্থনীতি ভঙ্গুর অবস্থায়। নারীরা কার্যত গৃহবন্দী। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা স্থগিত থাকায় মানবিক সংকট আরও তীব্র হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

অনেকেই একসময় তালেবান সরকারের ওপর ভরসা রেখেছিলেন। এখন তাঁরা হতাশ হয়ে পড়ছেন। তালেবান নেতৃত্বের অভ্যন্তরীণ বিভক্তিও দিন দিন বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে দিচ্ছেন, এই ভাঙন আরও তীব্র হলে তালেবানের অভ্যন্তরেই বিদ্রোহ দেখা দিতে পারে।

তালেবানের মধ্যে ক্রমবর্ধমান মতবিরোধের বিষয়ে সম্প্রতি মুখ খুলেছেন তাদের মুখপাত্র জাবিহউল্লাহ মুজাহিদ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক আলোচনায় তিনি স্বীকার করেছেন যে ভিন্নমত রয়েছে। তবে তাঁর মতে তা সংঘাত বা লড়াইয়ের পর্যায়ে যায়নি। তবে বিশ্লেষকদের মতে, তালেবানের অভ্যন্তরে গভীর বিভেদ সৃষ্টি হচ্ছে। আর তা ভবিষ্যতে বড় সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে।

আরও পড়ুনআফগান তালেবান ও সৌদি আরবের সম্পর্ক কি নতুন মোড় নিচ্ছে২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

তালেবান কখনোই একটি পুরোপুরি ঐক্যবদ্ধ সংগঠন ছিল না। দলটি মূলত পশতু গোষ্ঠীর সদস্যদের নিয়ে গঠিত। তবু ভৌগোলিক, জাতিগত ও গোত্রগত ভিত্তিতে তাদের মধ্যে বিভাজন স্পষ্ট। এমনকি নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রেও তাদের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে। বিশেষ করে নারীশিক্ষা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে।

মোল্লা হিবাতুল্লাহর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জানা যাচ্ছে যে তিনি এখনো কঠোর আদর্শগত অবস্থানে অটল আছেন। তালেবানের রাজনৈতিক ও আদর্শিক ঐতিহ্য রক্ষার নামে তিনি চরম রক্ষণশীল গোত্রীয় মূল্যবোধ আঁকড়ে ধরে আছেন। দেশের অর্থনীতি, সামাজিক স্থিতিশীলতা, এমনকি তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযোগীদেরও তিনি বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। কিন্তু নিজের নীতিতে একচুলও ছাড় দিতে রাজি নন।

তালেবান সরকার আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা স্থগিতের বিষয়ে সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। তবে তা মোল্লা হিবাতুল্লাহ ও তাঁর সমমনাদের জন্য একপ্রকার ‘আশীর্বাদ’ হিসেবে কাজ করতে পারে। কারণ, তিনি ইতিমধ্যেই দেশ থেকে আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলো (এনজিও) বন্ধ করার পরিকল্পনা করছিলেন।

আরও পড়ুন তালেবানদের নিয়ে এখন কী করবে পাকিস্তান ২০ জানুয়ারি ২০২৫

তবে বাস্তবতা হলো, আফগানিস্তানের স্বাস্থ্য ও সামাজিক খাত পুরোপুরি নির্ভরশীল বিদেশি অনুদানের ওপর। একা এসব খাত টিকিয়ে রাখার সামর্থ্য তালেবান সরকারের নেই। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তারা সম্প্রতি পোলিও টিকাদানের পদ্ধতিতে পরিবর্তন এনেছে। আগের মতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিকা দেওয়ার অনুমতি নেই। শুধু মসজিদ ও গ্রাম্য কেন্দ্রগুলোতেই এই কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে।

এদিকে তালেবানদের ভেতরেও ক্রমেই ধারণা তৈরি হচ্ছে যে তাদের নেতা মোল্লা হিবাতুল্লাহ নিজের ক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। যদি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিকল্প কোনো পরিকল্পনা নিয়ে না আসে, কিংবা তালেবান সরকার নিজেই অর্থনীতি পুনর্গঠনের জন্য উদ্যোগ না নেয়, বিশেষ করে স্বাস্থ্য খাতে অর্থায়নের ব্যবস্থা না করে, তাহলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।

অন্যদিকে পাকিস্তানও তালেবান সরকারকে খুব একটা ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখছে না। এর মূল কারণ হলো পাকিস্তানি তালেবান বা টিটিপি (তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান)। তারা আফগান মাটি ব্যবহার করে পাকিস্তানে সন্ত্রাসী হামলা চালাচ্ছে। পাকিস্তান আশা করেছিল, তালেবান সরকার টিটিপিকে নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে। কিন্তু তারা এ বিষয়ে সহযোগিতা করছে না।

এখন পর্যন্ত তালেবানদের একমাত্র বড় সুবিধা হলো যে তাদের বিরোধীশক্তি দুর্বল। আফগানিস্তানের জাতীয় প্রতিরোধ ফ্রন্ট এখনো স্থানীয় জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আকৃষ্ট করার মতো রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, কৌশল বা আকর্ষণীয় নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারেনি।

এর প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তান আফগান শরণার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর নীতি গ্রহণ করেছে। একে তালেবান সরকারের ওপর চাপ তৈরির একটি কৌশল হিসেবে দেখা হচ্ছে। প্রথমে রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে শরণার্থীদের উচ্ছেদ শুরু হয়। পরে পুরো দেশ থেকেই তাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তালেবান সরকার পাকিস্তানের এই পদক্ষেপের নিন্দা জানালেও বাস্তবে শরণার্থীদের পুনর্বাসন নিয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না। কারণ, তালেবান নেতারা মনে করেন, এই শরণার্থীদের বড় একটি অংশ তাঁদের বিরোধী।

পাকিস্তান আফগান শরণার্থীদের দেশ থেকে বের করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তালেবান সরকারকে টিটিপির বিরুদ্ধে সহযোগিতায় বাধ্য করতে পারবে কি না, তা এখনো অনিশ্চিত। তবে শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো নিঃসন্দেহে আফগানিস্তানের দুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দেবে।

আরও পড়ুনভারত কি পাকিস্তান–তালেবান দ্বন্দ্বের সুযোগ নিচ্ছে১৫ জানুয়ারি ২০২৫

মোল্লা হিবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা তাঁর ক্ষমতা আরও শক্তিশালী করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো দেশের প্রতিটি প্রদেশে উলামা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা করা। এই কাউন্সিলগুলো কার্যত তাঁর প্রশাসনের ‘চোখ ও কান’ হিসেবে কাজ করছে। এই অনুগত আলেমরা তালেবান কর্মকর্তাদের যেকোনো নিয়ম লঙ্ঘন কিংবা মতবিরোধ পর্যবেক্ষণ করে তা সরাসরি তাঁকে জানিয়ে দেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব পিসের ফেলো অ্যান্ড্রু ওয়াটকিন্সের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, তালেবান নেতৃত্বের মধ্যে ইমামের (তালেবানদের সর্বোচ্চ নেতা) এজেন্ডার প্রতি সত্যিকারের অসন্তোষ রয়েছে। তালেবানের অনেক সদস্যই মনে করেন, মোল্লা হিবাতুল্লাহ নিজের ক্ষমতার সীমা অতিক্রম করছেন। তবে সমস্যা হলো, এই বিরোধীদের মধ্যে কোনো ঐক্য নেই। তাঁরা একত্র হয়ে কাজ করছেন না বা কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য সামনে রেখে এগোচ্ছেন না। ফলে সংগঠিত কোনো প্রতিবাদ বা পদক্ষেপ গ্রহণ করা তাঁদের জন্য কঠিন।

অন্যদিকে মোল্লা হিবাতুল্লাহ তাঁর নীতি ও অবস্থান স্থির রেখে তালেবানের একটি বড় অংশকে প্রভাবিত করে চলেছেন। সম্প্রতি এক জনসমাবেশে তিনি বলেন, জিহাদ বা ‘সংগ্রাম’ বিদেশি বাহিনীর অপসারণ এবং আফগান প্রজাতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যায়নি। জিহাদ এখনো চলছে। এর মূল লক্ষ্য হলো সমাজকে শুদ্ধ করা। কারণ, ‘শত্রুরা’ এখনো রয়ে গেছে।

তালেবানদের ভেতরে তাঁর জনপ্রিয়তা ও কঠোর নিয়ন্ত্রণের কারণে দলটির অভ্যন্তরীণ বিরোধীরা বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছে। এদিকে চীন, রাশিয়া, সৌদি, আমেরিকার নতুন প্রশাসনসহ বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিধর রাষ্ট্র আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য পরিকল্পনা করছে, যাতে দেশটি নতুন কোনো হুমকির উৎস না হয়ে ওঠে। তবে তালেবান সরকার কতটা সহযোগিতা করতে প্রস্তুত, আর দলটির ভেতরে কতটা ঐক্য রয়েছে, তার ওপরই নির্ভর করছে যে বিশ্বসম্প্রদায় তাদের সঙ্গে কতটা কার্যকরভাবে কাজ করতে পারবে।

তালেবানের মধ্যে বিদ্রোহের সম্ভাবনা নিয়ে নানা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। যদি তা বাস্তবে রূপ নেয়, তাহলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে তালেবান সরকারের সহযোগিতা আরও বিলম্বিত হতে পারে। আর যদি অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ সফল হয়, তাহলে আফগানিস্তান সম্পর্কে বৈশ্বিক মূল্যায়ন বদলে যেতে পারে। এর ফলে দেশটি আরও গভীর অস্থিরতার দিকে যাবে।

এখন পর্যন্ত তালেবানদের একমাত্র বড় সুবিধা হলো যে তাদের বিরোধীশক্তি দুর্বল। আফগানিস্তানের জাতীয় প্রতিরোধ ফ্রন্ট (এনআরএফ) একটি সামরিক জোট। তারা এখনো স্থানীয় জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহলের সমর্থন আকৃষ্ট করার মতো রাজনৈতিক দূরদৃষ্টি, কৌশল বা আকর্ষণীয় নেতৃত্ব গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে দেশটিতে কার্যকর কোনো বিরোধী আন্দোলন গড়ে ওঠেনি।

এই বাস্তবতায় তালেবান সরকারের ভেতর থেকে বিদ্রোহের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে প্রশ্ন হলো, তারা কি মোল্লা হিবাতুল্লাহর বিরুদ্ধে সফলভাবে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে পরবর্তী সময়ে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পারবে? যদি তালেবান ভেঙে পড়ে, তাহলে দলটি জাতিগত ও গোত্রীয় বিভাজনের শিকার হবে।

তবে আফগানরা চাইলে নিজেদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করতে পারে। এর জন্য সবচেয়ে ভালো উপায় হবে শান্তিপূর্ণভাবে তালেবানকে তাদের কঠোর নীতিগুলো পরিবর্তন করতে বাধ্য করা। তবে সমস্যা হলো, আফগানিস্তানে তালেবানবিরোধী সামাজিক শক্তি, প্রবাসী আফগানরা ও বুদ্ধিজীবী মহল রাজনৈতিক, নৈতিক ও সামরিক সমর্থনের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর দিকেই তাকিয়ে থাকে। গত ৫৫ বছরের সংঘাত ও বিদেশি হস্তক্ষেপের ফলে তারা স্থানীয়ভাবে শক্তিশালী কোনো শান্তিপূর্ণ আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি।

এই অভ্যন্তরীণ দুর্বলতাই তাদের রাজনৈতিকভাবে নাজুক করে তুলেছে। ফলে তারা বহির্বিশ্ব থেকে অনুপ্রেরণা খোঁজার চেষ্টা করছে। উদাহরণ হিসেবে, পাকিস্তানে পশতুন তাহাফুজ মুভমেন্টের (পিটিএম) মতো আন্দোলনগুলোর মধ্যে তারা অনুপ্রেরণা খুঁজছে। এমনকি তারা মানজুর পশতিন ও আলী ওয়াজিরের মতো ব্যক্তিদের আদর্শ হিসেবে দেখছে।

মুহাম্মদ আমির রানা পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিশ্লেষক

পাকিস্তানের ডন থেকে নেওয়া। ইংরেজি থেকে অনুবাদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ত ল ব ন সরক র র আফগ ন স ত ন র শরণ র থ দ র ত ল ব নদ র র জন ত ক সহয গ ত র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

ইউক্রেনে ট্রাম্পের ১০০ দিনের ব্যর্থতা

ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিরে আসার প্রায় ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের ওপর আঘাত হানছে। ট্রাম্প ‘প্রথম দিনেই’ যুদ্ধ বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো কোনো শান্তির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। প্রশ্ন হলো, ট্রাম্প প্রশাসন কবে স্বীকার করবে যে তারা ব্যর্থ হচ্ছে?

শুরুতে ট্রাম্পের দাবি ছিল খুব সহজ, ‘যুদ্ধ থামাও, আলোচনায় বসো।’ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে প্রথম ফোনালাপের পর তিনি বলেছিলেন, খুব দ্রুত যুদ্ধ বন্ধ হবে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও সেই সম্ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।

কিন্তু এরপর যা ঘটেছে, তা হলো পুতিন ও তাঁর ক্রেমলিনের ছোট একটি দল ট্রাম্পের অনভিজ্ঞ আলোচক স্টিভ উইটকফকে এমন এক জটিল ও অসম্ভব শর্তের গোলকধাঁধায় ফেলেছেন, যেখান থেকে বেরোনো কঠিন। এত দিন ধরে এই নাটক চলার পর এমনকি সবচেয়ে বোকা আলোচকেরও বোঝার কথা, পুতিনের যুদ্ধ থামানোর কোনো ইচ্ছা নেই। তিনি ট্রাম্পের পরিকল্পনা বা সময়সূচিও মানবেন না।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুতিন যখন ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় হামলা শুরু করেন, তখন থেকেই তিনি মূলত রুশ সামরিক শক্তির ওপর ভরসা করেছিলেন, যাতে তিনি ইউক্রেনের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। প্রথমে তাঁর সেনাবাহিনীতে প্রায় দুই লাখ ভাড়াটে সৈনিক ছিলেন। এরপর তিনি কয়েক দফা আংশিক মোতায়েন এবং বিশাল আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে সেনাসংখ্যা বাড়িয়ে তা প্রায় ছয় লাখে নিয়ে যান।

এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার সাত–আট লাখ সেনা হতাহত হয়েছেন, যার মধ্যে দুই লাখের বেশি নিহত হয়েছেন। এত বড় ক্ষয়ক্ষতির পরও কথিত শক্তিশালী রুশ সেনাবাহিনী এখন ইউক্রেনের আগের চেয়ে কম ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে। সুনির্দিষ্টভাবে বললে, মাত্র ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ ভূখণ্ড রুশ সেনারা নিয়ন্ত্রণ করছে।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সামরিকভাবে পুতিনের যুদ্ধকে এক ভয়াবহ ব্যর্থতা বলা যেতে পারে। হয়তো তিনি এখনো বিশ্বাস করেন, তাঁর বাহিনী ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে কোনো না কোনো বড় সাফল্য অর্জন করবে। কিন্তু নিরপেক্ষ বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এর সম্ভাবনা খুবই কম।

রাশিয়া হয়তো ইউক্রেনের তুলনায় যুদ্ধে বেশি সংখ্যায় সেনা পাঠাতে পারবে, বেশি বোমাও ফেলতে পারবে, কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে থাকা সেনাদের মধ্যে লড়াই করার মানসিকতা জাগিয়ে তুলতে পারবে না। এখন পর্যন্ত দেখা গেছে, আত্মরক্ষা যত সহজ, আক্রমণ করা ঠিক ততটাই কঠিন। এর মানে দাঁড়ায়, শেষ পর্যন্ত পুতিন কোনো ধরনের বিজয়ের ছবি তুলে ধরতে চাইলে তাঁকে রুশ সেনাবাহিনীর চেয়ে ট্রাম্পের ওপর বেশি ভরসা করতে হবে।

তাত্ত্বিকভাবে ট্রাম্প চাইলে নিজেই নিজের অবস্থান বদলে পুতিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন এবং ইউক্রেনকে আরও সহায়তা দিতে পারেন। যদি তিনি এটা করেন, তাহলে হয়তো সেই যুদ্ধবিরতি আদায় করতে পারবেন, যার প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। তা না হলে তিনি ব্যর্থই হবেন, আর পুতিন ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা তাঁর পেছনে বসে হেসেই যাবেন।

এ কারণে ট্রাম্পকে প্রভাবিত করার জন্য পুতিন তাঁর হাতে থাকা সব কৌশল কাজে লাগাচ্ছেন। সবাই জানে, ট্রাম্প প্রশংসায় দুর্বল হয়ে পড়েন। আর সেই সুযোগ নিয়েই পুতিন বাড়াবাড়ি রকমের চাটুকারিতা করছেন। তিনি দাবি করেছেন, ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ‘চুরি’ হয়েছিল এবং যদি ট্রাম্প তখন ক্ষমতায় থাকতেন, তাহলে এই যুদ্ধ কখনোই হতো না।

এমনকি পুতিন বলেছেন, ২০২৪ সালে ট্রাম্পের ওপর হামলার পর তিনি তাঁর ব্যক্তিগত প্রার্থনাকক্ষে গিয়ে ট্রাম্পের জন্য প্রার্থনা করেছেন। শুধু তা–ই নয়, তিনি ক্রেমলিনের দরবারি শিল্পীকে দিয়ে ট্রাম্পের একটি প্রতিকৃতি আঁকিয়ে তা উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন।

শুধু প্রশংসা নয়, পুতিন ট্রাম্প ও তাঁর প্রতিনিধি স্টিভ উইটকফকে ব্যবসার প্রলোভনও দেখাচ্ছেন। রিয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রথম আলোচনায় পুতিনের দল একটি বিশাল বিনিয়োগ সম্ভাবনার তালিকা নিয়ে আসে, যেগুলো নাকি বাস্তবায়ন করা হবে যদি ট্রাম্প ইউক্রেনকে ছেড়ে দেন এবং রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।

উইটকফ জানিয়েছেন, পুতিনের সঙ্গে তাঁর সাম্প্রতিক বৈঠকের একটি বড় অংশ এই বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়েই আলোচনা হয়েছে।

আরও পড়ুনট্রাম্পকে রুখতে চীন-ইউরোপ কি হাত মেলাবে১৯ এপ্রিল ২০২৫

দুই ধরনের কৌশলই স্পষ্টভাবে কাজ করেছে। পুতিন জানেন, কীভাবে কাজ করতে হয় এবং তিনি জানেন, কার সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। এখন পর্যন্ত কোনো যুদ্ধবিরতি হয়নি এবং পুতিন যে এমন কিছুতে রাজি হবেন, তার কোনো লক্ষণও নেই। তিনি নির্দ্বিধায় ইউক্রেনের শহরগুলোতে বেসামরিক লক্ষ্যে হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এই তথাকথিত আলোচনায় ক্রেমলিন মূলত দুটি দাবি তুলেছে। প্রথম দাবি হলো, ইউক্রেন যেন লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন—এই চারটি অঞ্চল রাশিয়ার হাতে তুলে দেয়। উইটকফ এ বিষয়ে ইতিমধ্যে একপ্রকার রাজিও হয়ে গেছেন: যুক্তরাষ্ট্র নাকি রাশিয়ার দখল করা এই চার অঞ্চলের ওপর রাশিয়ার মালিকানা মেনে নিতে প্রস্তুত।

কিন্তু রাশিয়া এখনো এ চার অঞ্চলের পুরোটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি।

জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসনের আঞ্চলিক রাজধানীগুলোতে (যেখানে যুদ্ধের আগে এক মিলিয়ন লোকের বসবাস ছিল) এখনো ইউক্রেনীয় পতাকা উড়ছে। কিয়েভের কোনো সরকার এসব শহর হেলায় ছেড়ে দিলে টিকে থাকতে পারবে না। হয়তো ইউক্রেন বর্তমান যুদ্ধরেখাকে কেন্দ্র করে একধরনের ‘জমে থাকা’ সংঘাত মেনে নিতে পারে, কিন্তু এর চেয়ে বেশি নয়।

রাশিয়ার দ্বিতীয় দাবি হলো, ইউক্রেনের ওপর নিরাপত্তাগত কর্তৃত্ব বজায় রাখা। অর্থাৎ ভবিষ্যতে ইউক্রেনে পশ্চিমা সামরিক উপস্থিতি বা সহায়তা যেন না থাকে। ট্রাম্প ইতিমধ্যেই ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ ন্যাটো সদস্য পদ প্রশ্নে হার মানিয়েছেন এবং তিনি সম্ভবত পুতিনকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সহায়তা পুরোপুরি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতিও দিতে যাচ্ছেন।

কিন্তু এখানেই ইউরোপীয়দের ভূমিকা শুরু হয়। পুতিন ও ট্রাম্প—দুজনেই ইউরোপীয়দের আলোচনার টেবিলে আনতে চাননি। কিন্তু এটাই ভালো হয়েছে। ইউরোপীয়রা যদি ইউক্রেনকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থানে থাকেন, তাহলে পুতিন ও ট্রাম্প যা-ই নিয়ে নিজেদের মধ্যে একমত হোন না কেন, তা বাস্তব মাটিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না।

এ অবস্থায় ইউরোপের হাতে রয়েছে সবচেয়ে বড় তাস। যদি তারা রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে পারে, তাহলে ইউক্রেনকে ‘মিউনিখ চুক্তি’র মতো লজ্জাজনক বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব। ইউরোপীয় নেতাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া উচিত, যেভাবেই হোক তাঁরা ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে তাদের সহায়তা অব্যাহত রাখবেন।

তাত্ত্বিকভাবে ট্রাম্প চাইলে নিজেই নিজের অবস্থান বদলে পুতিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন এবং ইউক্রেনকে আরও সহায়তা দিতে পারেন। যদি তিনি এটা করেন, তাহলে হয়তো সেই যুদ্ধবিরতি আদায় করতে পারবেন, যার প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। তা না হলে তিনি ব্যর্থই হবেন, আর পুতিন ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা তাঁর পেছনে বসে হেসেই যাবেন।

কার্ল বিল্ডট সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ