আজ পর্দা নামছে অমর একুশে বইমেলা ২০২৫-এর। এবার মেলার প্রতিপাদ্য ছিল– ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থান। নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণ’। গণঅভ্যুত্থান-উত্তর এই বইমেলা নিয়ে পাঠক, লেখক ও প্রকাশকদের অনেক প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু আশানুরূপ বিক্রি না হওয়ায় একরাশ হতাশা নিয়ে আজ শুক্রবার মেলা প্রাঙ্গণ ছাড়বেন প্রকাশকরা।
প্রকাশকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এবারের বইমেলায় সবচেয়ে হতাশাজনক বিষয় হচ্ছে কম বিক্রি। বলা যায়, গত বছরের চেয়ে ৫০ শতাংশ বিক্রি কম হয়েছে।
শেষ দিনে এসে চলুন ফিরে দেখি এবারের বইমেলা কতটা আলোচনার জন্ম দিল। গত নভেম্বরে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মেলা হওয়া নিয়ে একটা শঙ্কা তৈরি হয়। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় ৬ নভেম্বর বাংলা একাডেমিকে চিঠি দিয়ে জানায়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পরিবর্তে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে মেলার আয়োজন করতে হবে। ১৩ নভেম্বর সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর আশ্বাসে সেই শঙ্কা কেটে যায়।
গত ৯ জানুয়ারি মেলা পরিচালনা কমিটি কয়েকটি প্রকাশনীর প্যাভিলিয়ন বাতিল এবং স্টল ছোট করে দেয়। ‘সুবিচারপ্রত্যাশী প্রকাশকবৃন্দ’ ব্যানারে ক্ষুব্ধরা বাংলা একাডেমির কাছে চিঠি দিয়ে এর প্রতিকার চায়। পরে প্রকাশনীগুলোর স্টল, প্যাভিলিয়ন বরাদ্দে অদলবদল আনা হয়।
১৩ জানুয়ারি সন্ধ্যার দিকে বইমেলার নির্মাণকাজ বন্ধ রাখতে বলেন ইসলামী যুব আন্দোলন পরিচয় দেওয়া একদল ব্যক্তি। তারা যুব সম্মেলনের জন্য উদ্যান ব্যবহারের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে বলে জানান। এর পর কাজ বন্ধ করে দেন শ্রমিকরা।
এত সব বাধা ডিঙিয়ে বইমেলা যথারীতি শুরু হয় ১ ফেব্রুয়ারি। ৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম শিশুপ্রহরে সিসিমপুর না থাকায় শিশুদের মন খারাপ হয়।
১০ ফেব্রুয়ারি তসলিমা নাসরিনের বই রাখায় মেলায় সব্যসাচীর স্টলে তৌহিদি জনতা চড়াও হয়। তারা স্টলটিতে গিয়ে প্রকাশককে ঘিরে ধরে। পরিস্থিতি সামাল দিতে প্রকাশক শতাব্দী ভবকে নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নিয়ে যায় পুলিশ। রাতে মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেয়। বাংলা একাডেমি থেকে এ বিষয়ে তিন কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন দাখিলের কথা ছিল। তবে এ বিষয়ে আর কোনো আপডেট সংবাদ পাওয়া যায়নি।
১৫ ফেব্রুয়ারি স্যানিটারি ন্যাপকিন ও ডায়াপার বিক্রি করায় একটি স্টল বন্ধের নির্দেশনা দেওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনা তৈরি হয়। স্টল বন্ধ-সংক্রান্ত একটি চিঠি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। সেখানে লেখা ছিল, ‘বেশ কিছু ইসলামিস্ট গ্রুপ’ স্টলটিতে স্যানিটারি ন্যাপকিন বিক্রিতে আপত্তি জানায়। পরে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘এই স্টলটি মেলায় নীতিমালা অনুযায়ী অনুমোদন নেয়নি। এ জন্য বন্ধ করা হয়েছে।’
কবি ও শিক্ষক সোহেল হাসান গালিবের একটি কবিতা ঘিরে সমালোচনা শুরু হয়। তাঁর বিরুদ্ধে কবিতায় ‘নবীকে কটাক্ষ’ করার অভিযোগ ওঠে। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো ও রিমান্ডে নেওয়া হয়। ‘আমার খুতবাগুলি’ নামে গালিবের বইটি উজান প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। বইমেলায় স্টলে হামলার শঙ্কায় চার দিন ধরে স্টলটি বন্ধ থাকে। ১৭ ফেব্রুয়ারি লেখক-প্রকাশকরা মেলায় মানববন্ধন করে গালিবের মুক্তির জন্য ৭২ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন।
২২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে বেচাকেনা শুরু হওয়া মাত্র বৃষ্টি ও বাতাসে মেলাপ্রাঙ্গণ হয়ে পড়ে এলোমেলো। সাময়িক এই বৃষ্টিতে সেদিনের মতো মেলায় আর বিক্রি হয়নি বলে জানান প্রকাশকরা।
এ ছাড়া এবারের পরিবর্তিত পরিস্থিতির বেশ কিছু নতুন বিষয় মেলায় দর্শনার্থী ও পাঠককে আকর্ষণ করেছে। এর মধ্যে ছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে স্টল। বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে থাকা এই স্টলে গণঅভ্যুত্থানকেন্দ্রিক যত বই প্রকাশিত হয়েছে, তা পরিবেশিত ও বিক্রি করা হয়েছে। বিশাল খাতায় জুলাই স্মৃতিচারণ করার স্থানসহ জুলাইকেন্দ্রিক বিভিন্ন স্মারক চিহ্ন বিক্রি করা হয়েছে। এর বিপরীতে ছিল ইনকিলাব মঞ্চ। এই স্টলে গণঅভ্যুত্থানের স্লোগান ও ছবিসংবলিত বিভিন্ন অলংকার, শাড়ি, পেইন্টিং বিক্রি করা হয়েছে। তরুণ-তরুণীর ভিড় এই স্টলে ছিল বেশি। এর পাশে দেবাশীষ চক্রবর্তীর জুলাই অভ্যুত্থানের সময়কার পোস্টারের ভিআর বিনামূল্যে প্রর্দশন, পোস্টার ও ভিউকার্ড প্যাকেজ বিক্রি করা হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের স্টলে থাকা আন্দোলনের সময়কার তথ্যচিত্র, ছবি ঘুরে ঘুরে দেখেন দর্শনার্থী। এ বছর ইসলামিক বইয়ের স্টলগুলো ছিল চোখে পড়ার মতো।
এবারের মেলাজুড়ে প্রতিটি প্রবেশ ও বাহির গেটে হকারদের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ ছিল পাঠক, দর্শনার্থী। মেলার শুরুর দিকে এর পরিমাণ কম থাকলেও পরে এদের দৌরাত্ম্য লাগামছাড়া হয়। টিএসসি প্রান্তে মেলার গেট দেখতে ছোটখাটো একটা বাণিজ্য মেলা বলে মনে হয়েছে।
এ বছর যেন লেখক খরায় ভুগেছে বইমেলা প্রাঙ্গণ। ইমদাদুল হক মিলন, সেলিনা হোসেন ও আনিসুল হক থেকে শুরু করে স্বনামধন্য লেখকদের দেখা যায়নি। সেজন্য পাঠকরা কিছুটা হতাশাবোধ করলেও আহমাদ মোস্তফা কামাল ও সাদাত হোসাইনকে দেখা গেছে মেলা প্রাঙ্গণে। প্রতি বছরের বাঁধা পাঠকরাও আসেননি। মূলত মব, সহিংসতা, আন্দোলন ও নিরাপত্তা শঙ্কায় মেলায় আসেননি অনেকে।
বই হাতে নিচ্ছেন, বইয়ের সঙ্গে বিভিন্ন ভঙ্গিতে ছবি তুলছেন। স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে ভিডিও করছেন। এর পর বই রেখে চলে যাচ্ছেন। এই ছবি তোলার হিড়িক এ বছর ছিল প্রকট।
নতুন বই
গতকাল মেলায় আসে ১৭৬টি নতুন বই। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো– আবদুল মজিদের সায়াহ্নের কবিতা (প্রিয় বাংলা), ওমর কায়সারের ক্ষুধা ও কপিলা (খড়িমাটি), হৃদয় মোহাম্মদ আলীর কোথাও আলো নেই (সাহিত্যদেশ) ও আলী ইমামের ডায়নোসরের দেশে (ডাংগুলী)।
মঞ্চের আয়োজন
বিকেল ৪টায় বইমেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘একটি অভ্যুত্থানের জন্ম ও আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। কাজী মারুফের সভাপতিত্বে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন রেজাউল করিম রনি। আলোচনায় অংশ নেন সৈয়দ নিজার।
রেজাউল করিম রনি বলেন, ইতিহাসে অনেক আন্দোলনকে গৌরবের সঙ্গে স্মরণ করা হয়। তেমনি জুলাই গণঅভ্যুত্থান গোটা জাতির জন্য নতুন অভিজ্ঞতার জন্ম দিয়েছে।
সৈয়দ নিজার বলেন, স্বতঃস্ফূর্ততা ও কাঠামোগত দিক থেকে মিল থাকলেও অভ্যুত্থানের প্রথাগত ধারণার সঙ্গে চব্বিশের অভ্যুত্থানের ভিন্নতাও রয়েছে।
লেখক বলছি মঞ্চে আলোচনা করেন সায়ীদ আবুবকর, মিতা আলী এবং শিশুসাহিত্যিক জামসেদ ওয়াজেদ।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করেন মনজুর রহমান, রফিক হাসান ও জান্নাতুল ফেরদৌসী প্রমুখ।
সংগীত পরিবেশন করেন ছন্দা চক্রবর্তী, ইমরান খন্দকার, নাসরিন বেগম, আফসানা রুনা প্রমুখ।
.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বইম ল গণঅভ য ত থ ন প র ঙ গণ এক ড ম স টলট বইম ল
এছাড়াও পড়ুন:
গণপরিষদের বদলে সংস্কার বাস্তবায়নে সময়সীমা
সাম্প্রতিক গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সামনে এনেছে– সংসদ নির্বাচন আয়োজনের আগে কি একটি সাংবিধানিক গণপরিষদ প্রয়োজন? অনেক গণপরিষদপন্থির মতে, নিয়মিত নির্বাচনী রাজনীতির আগে রাষ্ট্র ও সংবিধানের মৌলিক রূপান্তর অপরিহার্য। তবে সমালোচকেরা এতে একটি কূটাভাস খুঁজে পান– যদি বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে অসাধারণ গণতান্ত্রিক বৈধতা অর্জন করে থাকে, তাহলে সাংবিধানিক সংস্কারের জন্য আলাদা ম্যান্ডেটের প্রয়োজনীয়তা কি অপ্রাসঙ্গিক নয়? এই প্রশ্নটি ‘বৈধতা’ ধারণাকে ঘিরে একটি গভীরতর বিশ্লেষণের দ্বার উন্মোচন করে।
গণপরিষদপন্থিদের মতে, ইউনূস সরকারকে ‘অনির্বাচিত’ হিসেবে আখ্যায়িত করা অনুচিত। তাদের দাবি, এই সরকার একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন ঘটিয়ে একটি বিস্তৃত গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে। জনগণের রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই বৈধতা একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক ম্যান্ডেটের প্রতিফলন, যা প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থায় অর্জিত যেকোনো ম্যান্ডেটের চেয়ে অধিক গ্রহণযোগ্য ও বলিষ্ঠ।
এই দৃষ্টিভঙ্গির একটি সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক ভিত্তিও রয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবৈষম্য-পরবর্তী সময়ে, তিউনিসিয়ায় গণঅভ্যুত্থানের পরে এবং নেপালে রাজতন্ত্রের পতনের পর নির্বাচন ছাড়াই সরকার বৈধতা লাভ করেছে। এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক শৃঙ্খলা গঠিত হয়েছে কেবল নির্বাচনী চক্রের মাধ্যমে নয়, বরং একটি সামষ্টিক বিপর্যয় এবং নতুন রাষ্ট্র বিনির্মাণের সদিচ্ছা থেকে।
তবে এই বৈধতাকে স্বীকৃতি দিলেও, সাংবিধানিক গণপরিষদের দাবি কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে। যদি বর্তমান সরকারের গণভিত্তি সাম্প্রতিককালের যেকোনো নির্বাচিত সরকারের তুলনায় অধিক শক্তিশালী হয়, তাহলে নতুন করে কোনো নির্বাচনী প্রক্রিয়া ছাড়া তাদের ওপর সংবিধান সংস্কারের দায়িত্ব অর্পণ করাটা কি যুক্তিসংগত নয়?
অনেকের কাছে এটি এক ধরনের বৈপরীত্য বলে প্রতিভাত হতে পারে– একদিকে শ্রেয়তর বৈধতার দাবি, অন্যদিকে সেই বৈধতা প্রমাণে একটি নতুন প্রক্রিয়াগত কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা। তবে গণতান্ত্রিক ও প্রক্রিয়াগত বৈধতার মধ্যে পার্থক্য বিবেচনায় আনলে এ আপাত বিরোধ সহজে প্রশমিত হতে পারে।
গণতান্ত্রিক বৈধতা একটি অন্তর্বর্তী সরকারকে শাসনের নৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রদান করে, বিশেষত গণঅভ্যুত্থানের মতো ব্যতিক্রমী প্রেক্ষাপটে। তবে সংবিধান পুনর্লিখনের মতো মৌলিক সংস্কার কেবল নৈতিক বৈধতার ভিত্তিতে সম্ভব নয়; এর জন্য প্রয়োজন স্বচ্ছতা, অংশগ্রহণ এবং রাজনৈতিক পরিসরের সর্বস্তরের সম্মতি। এখানে পদ্ধতিগত বৈধতার গুরুত্ব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এটি নিশ্চিত করে যে গণপরিষদপন্থি সমর্থক থেকে শুরু করে সমালোচক পর্যন্ত সমাজের সকল অংশ একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে, যার মাধ্যমে সকলের জন্য প্রযোজ্য শাসনব্যবস্থার ভিত্তি নির্ধারিত হয়।
এই প্রেক্ষাপটে, সাংবিধানিক গণপরিষদের দাবি বর্তমান সরকারের বৈধতাকে অস্বীকার নয়; বরং সেটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার একটি সচেতন ও গণতান্ত্রিক প্রয়াস। এটি সেই প্রবণতার প্রকাশ, যেখানে গণঅভ্যুত্থানের অসাধারণ শক্তিকে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি স্থায়ী রাজনৈতিক কাঠামোয় রূপান্তর করার চেষ্টা করা হয়। সমালোচকেরা যাকে বৈপরীত্য হিসেবে দেখেন, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এক সূক্ষ্ম ভারসাম্য হিসেবে প্রতিভাত হয়– একদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের কর্তৃত্বকে স্বীকৃতি, অন্যদিকে নিশ্চিত করা যে সাংবিধানিক পরিবর্তন একটি সম্মিলিত মালিকানার ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত।
তা সত্ত্বেও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন থেকে যায়– একটি নির্বাচিত সরকার কি একযোগে নিয়মিত শাসনকার্য পরিচালনাকারী কর্তৃপক্ষ এবং সাংবিধানিক গণপরিষদের ভূমিকা পালন করতে পারে? বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে এর উত্তর হতে পারে স্পষ্টভাবে সদর্থক, যদি প্রক্রিয়াটি সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত, সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য এবং স্বচ্ছভাবে তদারকযোগ্য হয়।
এই উদ্দেশ্যে জাতীয় নির্বাচনের আগে একটি জাতীয় রাজনৈতিক সমঝোতায় পৌঁছানো হতে পারে একটি বাস্তবসম্মত পথ। সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ অন্যান্য কমিশনের প্রস্তাবগুলো যদি বিএনপি ও অন্যান্য প্রধান রাজনৈতিক দলের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বিস্তৃত আলোচনার মাধ্যমে এবং ব্যাপক সম্মতির ভিত্তিতে চূড়ান্ত করা যায়, তবে পরবর্তী নির্বাচিত সরকারকে নির্দিষ্ট একটি সময়সীমার মধ্যে–ধরা যাক ছয় থেকে বারো মাস–এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের জন্য একটি স্পষ্ট ম্যান্ডেট দেওয়া সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সরকারের গণতান্ত্রিক বৈধতা কেবল নির্বাচনী বিজয়ের ওপর নয়, বরং এই সংস্কার রোডম্যাপ বাস্তবায়নের প্রতিও নির্ভর করবে। যদি সরকার এই লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ হয়, তাহলে তার নৈতিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব যথার্থভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে, এবং সে পরিস্থিতিতে সরকারের পদত্যাগ অনিবার্য হয়ে উঠবে।
যদি এই জাতীয় রাজনৈতিক সমঝোতা প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয় এবং প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের দ্বারা অনুমোদিত হয়, তবে তা একটি নৈতিকভাবে বাধ্যবাধকতামূলক চুক্তি হিসেবে কার্যকর হতে পারে। যদিও এটি কোনো সাংবিধানিক ধারার মতো আইনগতভাবে প্রয়োগযোগ্য নয়, তবুও এটি জনমত, গণমাধ্যমের স্বচ্ছতা এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থেকেও কার্যকর শক্তি অর্জন করতে পারে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এই সমঝোতার ভিত্তিতে গৃহীত সংস্কার ও নির্ধারিত বাস্তবায়ন সময়সীমা নিয়ে স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করতে পারে। একটি স্বাধীন তদারকি সংস্থা এই পুরো প্রক্রিয়ার অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করবে এবং নিয়মিত প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে। এর মাধ্যমে সরকারকে জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য করা যাবে এবং গণসার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার পথ আরও সুদৃঢ় হবে।
এ প্রক্রিয়াকে বলা যেতে পারে শর্তসাপেক্ষ বৈধতার মডেল– যেখানে একটি নির্বাচিত সরকারের কর্তৃত্ব কেবল ব্যালট বাক্সে অর্জিত বিজয় থেকে নয়, বরং পূর্বঘোষিত সংস্কার এজেন্ডার কার্যকর বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতির ওপরও নির্ভরশীল। এই মডেল কল্পনাপ্রসূত বা অভিনব কোনোটি নয়। দক্ষিণ আফ্রিকা, তিউনিসিয়া এবং নেপাল প্রত্যেকেই তাদের রাজনৈতিক রূপান্তরের সময় এ ধরনের কাঠামোর বিভিন্ন রূপ গ্রহণ করেছিল। এসব উদাহরণ আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে বৈধতা কেবল কারা নির্বাচনে জয়ী হয়েছে, তা দিয়ে নির্ধারিত হয় না; বরং নির্বাচনের পর তারা কী করার ম্যান্ডেট নিয়ে এসেছে, সেটিও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
আজকের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, শর্তসাপেক্ষ বৈধতা একটি বাস্তবসম্মত পথ নির্দেশ করে, যা ভুল বিকল্পের ফাঁদ এড়িয়ে চলে। এটি যেমন সংস্কারের নামে নির্বাচন বিলম্বিত করে না, তেমনি সংস্কার ম্যান্ডেট ছাড়া তড়িঘড়ি করে নির্বাচনের দিকেও ধাবিত হয় না। এটি একদিকে জনগণের পরিবর্তনের আহ্বানে সাড়া দেয়, অন্যদিকে গণতন্ত্রে ‘গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া’ বলতে সাধারণত যা বোঝানো হয়, তার প্রতিও পূর্ণ শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে।
এই প্রেক্ষাপটে, শর্তসাপেক্ষ বৈধতা কেবল একটি কৌশল নয়, বরং একটি বাস্তবভিত্তিক গণতান্ত্রিক সমাধান, যা একদিকে গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে সম্মান জানায়, অন্যদিকে সংস্কারকে সামষ্টিক সম্মতির ভিত্তিতে প্রোথিত করে। এর শক্তি নিহিত ‘নির্বাচন বনাম সংস্কার’ এই ক্লান্তিকর দ্বৈততার সুস্পষ্ট প্রত্যাখ্যানে। বাংলাদেশের প্রয়োজন উভয়ই– একটি নির্বাচন, যা জনগণের কণ্ঠকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করবে; এবং এমন একটি সংস্কার প্রক্রিয়া, যা নিশ্চিত করবে এই কণ্ঠ আর কখনও স্তব্ধ করা যাবে না। এই প্রেক্ষাপটে, একটি নির্বাচিত সরকারের শর্তসাপেক্ষ বৈধতা হতে পারে সেই কার্যকর ও গ্রহণযোগ্য পথ, যা বহুল আলোচিত সাংবিধানিক গণপরিষদকে অপ্রাসঙ্গিক করে তুলতে সক্ষম।
ড. কাজী এ এস এম নুরুল হুদা: সহযোগী অধ্যাপক, দর্শন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,
huda@du.ac.bd।