কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার চালিভাঙ্গা ইউনিয়ন দ্বীপের মতো; চারদিকে নদী বেষ্টিত। সড়কপথে সেখানে পৌঁছানোর ব্যবস্থা নেই, একমাত্র নৌযানই যাতায়াতের মাধ্যম। এটা অবৈধ বালু উত্তোলনকারী চক্রের জন্য সুবিধাজনক জায়গায় পরিণত হয়েছে। রাত বাড়লেই রামপ্রসাদের চরে শুরু হয় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন। গভীর রাত থেকে ভোর পর্যন্ত নদীর বুক চিরে চলে এ তৎপরতা এবং দিনের আলো ফোটার আগেই চক্রটি উধাও হয়ে যায়।
নদী থেকে অবাধে বালু উত্তোলনের ফলে ইতোমধ্যে রামপ্রসাদের চর এলাকার প্রায় ৩০০ বিঘা জমি বিলীন হওয়ার পথে। এতে নদী তীরের বিস্তীর্ণ এলাকা ধসে যাচ্ছে, বাড়ছে ভাঙনের ঝুঁকি।
চালিভাঙ্গা ইউনিয়নের একাধিক বাসিন্দা সমকালকে জানান, বালুখেকোদের লাগামহীন দৌরাত্ম্যে এলাকার কৃষিজমি ও বসতভিটা হারিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি এ বিষয়ে স্থানীয়ভাবে একটি সমন্বয় সভা হয়। সেখানে বালু উত্তোলনকারীরা কার্যক্রম বন্ধ রাখার প্রতিশ্রুতি দেন। এর পর ১৫-২০ দিন বন্ধ ছিল, সপ্তাহখানেক আগে আবার শুরু হয়েছে রাতভর বালু উত্তোলন। 
এলাকাবাসী জানান, বালুখেকোরা বাল্কহেড ও ড্রেজারগুলো দিনের বেলায় নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ, আড়াইহাজার ও মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় লুকিয়ে রাখে। রাত ১১টার পর বাল্কহেডগুলো আড়াইহাজার ও বৈদ্যেরবাজার হয়ে মেঘনা সেতুর নিচ দিয়ে গন্তব্যে পৌঁছায়। বালু উত্তোলনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমির পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। স্থানীয়রা বাধা দিতে গেলে বা প্রশাসন ও সাংবাদিকদের জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। ফলে আতঙ্কিত হয়ে কেউ মুখ খুলতে সাহস পান না। ইউএনওকে বললেই বলেন, সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড, নৌ-পুলিশকে জানিয়েছেন অভিযান চালাবে, কিন্তু তেমন কোনো বড় পরিসরে অভিযান চালায় না।
কথা হয় রামপ্রসাদের চরের বাসিন্দা কুমিল্লা জেলা উত্তর যুবদলের সদস্য, মেঘনা উপজেলা ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও মেঘনা উপজেলা যুবদলের সভাপতি পদপ্রার্থী হোসাইন মোহাম্মদ মহসিন মিয়ার সঙ্গে। তারা বলেন, তাদের এলাকার মানুষ খুবই গরিব, কৃষিকাজ করে সংসার চালায়। বালুখেকোরা এই কৃষিজমির মাটি ড্রেজার দিয়ে দিনের বেলা কেটে নিত, এখন রাতে কেটে নিয়ে যায়। তাদের অভিযোগ, নলচর গ্রামের চালিভাঙ্গা ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক রবিউল্লাহ রবি ও তাঁর সহযোগীরা এই অবৈধ কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত। এসব অপকর্মের অভিযোগে আগেও তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিষয়ে অভিযুক্ত রবিউল্লাহ রবির সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।
চালিভাঙ্গা নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ আজমগীর হোসাইন বলেন, ‘আমি অনেকবার অভিযান চালিয়েছি, কিন্তু তারা রাতে কাজ করে। সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও স্থানীয়দের সহযোগিতা ছাড়া এটি বন্ধ করা কঠিন। সম্প্রতি নৌপথে চাঁদাবাজি বন্ধে অভিযান চালাতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছি। বালুখেকোরা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর।’ তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি, আমাদের আরও জনবল প্রয়োজন। যৌথ অভিযান ছাড়া তাদের থামানো আমাদের নৌ-পুলিশের পক্ষে অসম্ভব।’ 
চাঁদপুর অঞ্চলের কোস্টগার্ডের কমান্ডার তাকিউল আহসান জানান, চালিভাঙ্গা এলাকাটি তাদের আওতার বাইরে। তার পরও জনস্বার্থে অভিযান চালান তারা। তবে জেলা প্রশাসন 
যদি দায়িত্ব দেয়, তাহলে নিয়মিত অভিযান চালানো হবে।
চালিভাঙ্গা ইউপি চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবির বলেন, ‘প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার বালু উত্তোলন করা হয়। বাধা দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ আমাদের দল ক্ষমতায় নেই। যারা বালু উত্তোলন করে, তারাই নদীপথ থেকে প্রতিদিন প্রায় লাখ টাকা চাঁদা ওঠায়।’
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) হ্যাপী দাসের ভাষ্য, এটি নৌপুলিশের কাজ। নৌপুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জের সঙ্গে কথা হয়েছে তাদের জনবল কম, বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি সেনাবাহিনী, কোস্টগার্ড ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলেছি। শিগগিরই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এর আগেও তিনি কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন বলে জানান, কিন্তু তার কিছুই হয়নি। এ ব্যাপারে ইউএনও বলেন, ‘আমি মেঘনা উপজেলায় এসেছি তিন মাস হয়েছে। এর আগেও বালু উত্তোলন হয়েছে। আমাদের সঙ্গে বালুখেকোরা সিগনেচার (চুক্তি) করেছিল, এরপর ২০ দিন বন্ধ ছিল, আপনি জানেন সেটা। এখন আবার শুরু করেছে বালু উত্তোলন।’
রামপ্রসাদের চর গ্রামের বাসিন্দা অ্যাডভোকেট কামরুজ্জামান জানান, বাংলাদেশের আইনি কাঠামোর দুর্বলতার কারণেই বালুখেকোরা ভয় পায় না। নিয়মিত মামলা হলেও তারা সহজেই জামিন নিয়ে ফিরে আসে। গভীর রাতে লাখ লাখ টাকার বালু উত্তোলন করে তারা। অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনের দাবি তাঁর। তিনি বলেন, ‘বিএনপির কুমিল্লা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অধ্যক্ষ সেলিম ভূঁইয়াকে বলেছিলাম, তিনি পদক্ষেপ নিলে কিছুদিন বন্ধ ছিল। এরপর আবার শুরু হয়েছে বালু উত্তোলন।’

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আম দ র উপজ ল

এছাড়াও পড়ুন:

‘বাইচ্চান্তরে লইয়া বড়া ও হান্দেশ খাইমু, ইলাই আমরার ঈদ’

দলা পাকানো চালের গুঁড়া চ্যাপটা করে ছোট ছোট বড়া বানানোর পর সেগুলো কড়াইয়ে দিচ্ছিলেন লাভলী বেগম (২৫)। চুলায় খড়ের আগুন কমে আসছিল বারবার। মাথা নিচু করে চুলার নিচ দিকে ফুঁ দিতে দিতে ধোঁয়ায় নাস্তানাবুদ অবস্থা। কুলায় যে পরিমাণ চালের গুঁড়া, তাতে ২০ থেকে ৩০টা বড়া হবে।

ঈদের আয়োজন বলতে কি শুধু এই কয়টি বড়া? লাভলী বলেন, ‘মাইয়ে (মা) কিছু গুড় আনছিলা। গুড়ের হান্দেশ (সন্দেশ) করছি। আর কিতা করমু। সকালে বাইচ্চান্তরে লইয়া বড়া ও হান্দেশ খাইমু। ইলাই আমরার ঈদ।’ কথা শেষের সঙ্গে সঙ্গে লাভলী বেগমের একটা দীর্ঘশ্বাস যেন হাওরের বাতাসে মিশে গেল। তাঁর পাশে তখন পাখির ছানার মতো বসা দুই সন্তান সাহানা (৫) ও আবির (৩)। তাদের চোখ কড়াইয়ে, তেলের ওপর ভাসতে থাকা বড়ার দিকে।

লাভলী বেগমের বাড়ি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার দেখার হাওরপারের কান্দাহাটি গ্রামে। গতকাল রোববার পড়ন্ত বিকেলে ওই গ্রামে গিয়ে কথা হয় লাভলী ও তাঁর পরিবারের অন্যদের সঙ্গে। এর আগে গত বছরের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বন্যার সময় ওই গ্রামের যাওয়ার পর প্রথম দেখা হয়েছিল। বন্যা সব শেষ করে দিয়ে গেছে তাঁদের। হাওরের ঢেউয়ে তখন ঘরটি ভেঙে পড়ে।

লাভলী তিন সন্তান নিয়ে মা সবুরা বেগমের সংসারে আছেন। বাবা নেই; নেই মানে অন্য আরেকজনকে বিয়ে করে চলে গেছেন বহু আগে। লাভলীরও একই অবস্থা, স্বামী আরেকটা বিয়ে করে আলাদা থাকেন। এখন সবুরার আটজনের সংসার। ছেলে জহুরুল ইসলামের (২০) স্ত্রী ও এক মেয়ে আছে। এই সংসার মূলত সবুরা বেগম ও ছেলে জহুরুল ইসলামের শ্রম-ঘামে চলে। সবুরা, জহুরুল দুজনই শ্রমিক। যখন যে কাজ পান, সেটাই করেন, কিন্তু অভাব যায় না।

ঘরের চুলায় তেলের বড়া ভাজছেন লাভলী বেগম। সুনামগঞ্জের দেখার হাওরপারের কান্দিগাঁও গ্রাম থেকে গতকাল রোববার বিকেলে

সম্পর্কিত নিবন্ধ