ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সাত মাস পার হলো। অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর কাজকর্মের প্রাথমিক অধ্যায় নিয়ে এখন কথা বলা যায়। সাত মাসে অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো প্রশাসনিকভাবে দেশবাসীকে কী ‍উপহার দিল, তার নির্মোহ বিচার-বিশ্লেষণ জরুরি এখন। রাজনৈতিকভাবে কী অর্জন হলো, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ এক ভাবনার ব্যাপার।

চব্বিশের জুলাইয়ের শেষ দিকে মানুষ রাষ্ট্রীয় সংস্কার, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ গঠন, অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সুশাসন প্রশ্নে সব মতাদর্শের ঊর্ধ্বে এক কাতারে দাঁড়িয়েছিল। সাংগঠনিকভাবে সেই অবস্থা এখন আর নেই। অভ্যুত্থানের চেতনা প্রবলভাবে সমাজে হাজির আছে বটে, কিন্তু তার ধারক ও অভিভাবকরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ছেন। অনেকে ছিটকেও পড়ছেন। 
অভ্যুত্থানকে তার চূড়ান্ত রাজনৈতিক স্লোগান তথা রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্য অর্জন করতে হলে এর অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলোর ঐক্যবদ্ধ থাকাই উত্তম ছিল। সেটা ছিল ছাত্রনেতাদের সাংগঠনিক চ্যালেঞ্জ। সেই কাজ হয়নি। এই বাস্তবতাকে নির্মোহভাবে না মেনে উপায় নেই। তারপরও সামনের দিকে এগোতে হবে সবাইকে। 

অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো যে পুরোনো দলীয়-উপদলীয় চেহারায় বিভক্ত হয়ে পড়ছে, সেটা এ দেশের অতীত রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিবেচনায় অস্বাভাবিক ছিল না। এ রকম অতীত থেকে বের হওয়া প্রকৃতই কঠিন। তবে বিশেষ বিশেষ মহল নানাভাবে ইন্ধন দিয়ে সম্ভাব্য বিভক্তিকে দ্রুত ও তিক্ত করছে। তরুণরা পরিকল্পিত ওইসব ইন্ধন এড়াতে পারেনি। সেটা দুঃখজনক হলেও বাস্তবতা হিসেবে মেনে নিতে হবে। চব্বিশে গৌরবময় এক রাজনৈতিক কর্তব্য পালন করলেও তরুণ সমাজের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার যে স্বাভাবিক ঘাটতি ছিল, কিছু অপশক্তি সেই সুযোগ নিয়ে তাদের বিভ্রান্ত করতে চেয়েছে। তাদের দিয়ে নানান সামাজিক দ্বিধাবিভক্তিতে জ্বালানি জুগিয়েছে। অভ্যুত্থানের সাংগঠনিক ভরকেন্দ্রে নানামুখী ফাটলের একটা কারণ নিশ্চয় এসব।
এ রকম বিভক্তি পর্বের এক পর্যায়ে ঢাকায় একটা নতুন রাজনৈতিক দলের জন্ম দেখছি আমরা। তরুণদের ভেতর থেকে রাজনৈতিক দল গঠনের ঘোষণা ইতিবাচক। দেশ নিয়ে ভাবলে রাজনৈতিকভাবেই এগোতে হবে। বর্তমান ধাঁচের ‘সচিবালয়’নির্ভর প্রশাসন যে আপাতত কিছু দেবে না– সেই উপলব্ধি নিশ্চয় ছাত্রনেতাদের হয়েছে এবং সেই অভিজ্ঞতাই হয়তো তাদের রমনা থেকে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে নিয়ে এসেছে। 

নতুন দলের রাজনৈতিক ইশতেহার পুরোটা আমরা জানি না এখনও। কিন্তু সেটা দেশে প্রতিযোগিতামূলক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করবে বলে আশা করা যায়। সামনের দিনগুলোতে নতুন দলের নেতারা নিশ্চয় অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাসের শাসন সম্পর্কেও কিছু অভিমত হাজির করবেন। এই সরকার যে কৃষক ও শ্রমিকদের প্রয়োজনে উল্লেখযোগ্য কোনো সংস্কারধর্মী পদক্ষেপ নিতে পারল না, সেটা এক মহাবিস্ময় তৈরি করেছে। পাশাপাশি কেন ভাঙচুরে এত বিধ্বস্ত হলো দেশের বিভিন্ন জায়গা; কেন সমাজে এত বেশি নিরাপত্তাহীনতা এবং ভয়-ভীতি বাড়ল; তার দায়দায়িত্ব কাদের এবং এই অবস্থা থেকে কীভাবে এখন বের হওয়া সম্ভব– সেসব বিষয়ে এই দল নিশ্চয় কিছু বলবে। এই সরকার এখনকার দক্ষতা ও সামর্থ্যে আদৌ সুষ্ঠু, অবাধ ও বিতর্কমুক্ত একটি জাতীয় নির্বাচন করতে সমর্থ কিনা; নাকি সেই কাজের জন্য নতুনদের নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার লাগবে– সে বিষয়েও মানুষ নতুন দলের অভিমত শুনতে চাইবে।

ইতোমধ্যে নতুন দলের অঙ্গ সংগঠন হিসেবে একটি ছাত্র সংগঠনেরও জন্ম হয়ে গেছে। সে উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ঘরানার কর্মীদের ভেতর এক দফা মারামারিও হলো। মারামারি নিন্দনীয় হলেও এই বাস্তবতা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই– অভ্যুত্থানের মাঠে এখনও অনেক শক্তি অসংগঠিত অবস্থায় আছে, যারা সংগঠিত হতে চায়।
নতুন দল ও তার ছাত্র সংগঠনের জন্ম অভ্যুত্থানের একটা অংশ থেকে হয়েছে। জুলাই-আগস্টের তরুণ শক্তিকেন্দ্রে অনেক উপশক্তি এখনও রাজনৈতিকভাবে পরবর্তী আকার নেওয়ার অপেক্ষায় আছে। সম্ভাব্য সেসব সংগঠনকেও আগাম অভিনন্দন জানিয়ে রাখা যায়। এ রকম উদ্যোগ রাজনৈতিক অঙ্গনকে আরও প্রতিযোগিতামূলক ও প্রাণবন্ত করবে। এভাবে আমরা ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানের দ্বিতীয় পর্যায়ে ঢুকছি কেবল। অভ্যুত্থানের এই দ্বিতীয় রাজনৈতিক পর্যায়েও রাষ্ট্র সংস্কারের পুরোনো চ্যালেঞ্জগুলো কিন্তু থাকছে। যদিও দেশ রাজনৈতিকভাবে নির্বাচনমুখী হচ্ছে এবং সেটা প্রয়োজনও। কিন্তু চব্বিশের অভ্যুত্থানের প্রত্যাশার জায়গাগুলো ঊর্ধ্বে ধরে রাখার এখনও বিকল্প নেই।

বাংলাদেশ চরমভাবে শ্রেণিবিভক্ত একটি সমাজ। ধনবৈষম্য এবং সম্পদবৈষম্য তীব্র। এখানে নিচের তলার ১০ শতাংশ মানুষের কাছে জাতীয় আয়ের ২ শতাংশেরও কম যায়। ওপরতলার ১০ শতাংশের কাছে জাতীয় আয়ের ৪০ শতাংশের বেশি যাচ্ছে। বিগত সরকারের আমলে সমাজের এই প্রকৃত বৈপরীত্য বেশ দক্ষতার সঙ্গে আড়াল করে রাখা হয়েছিল। সেই আড়াল করার রাজনীতি থেকে জন্ম দেওয়া হয় ‘শাপলা বনাম শাহবাগ’ নামে একটি কৃত্রিম ও পপুলিস্ট বাইনারি।
চব্বিশের অভ্যুত্থানের ভরকেন্দ্র থেকে যেসব রাজনৈতিক দল ও শক্তি শিগগির সামনে আসবে, তাদের চলমান কৃত্রিম মেরূকরণের বাইরে এসে সমাজের প্রকৃত মেরূকরণের সমাধান খোঁজার দিকে মনোযোগ দেওয়া জরুরি।

অতীতে সমাজে ‘শাপলা বনাম শাহবাগ’ শব্দদ্বয় দিয়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বনাম সেক্যুলার রাজনীতির একটা দ্বন্দ্ব তৈরি করা হয়েছিল। আওয়ামী লীগ ও ধর্মভিত্তিক শক্তি উভয়ের বেশ কাজে লাগে এই মেরূকরণ। আওয়ামী লীগ বেশ দক্ষতার সঙ্গে এটি ব্যবহার করে ১৫ বছর কাটিয়ে দেয় সুষ্ঠু নির্বাচন ছাড়াই। এর মাঝে ব্যাপক লুটপাটের ভেতর দিয়ে সমাজে ধনী-গরিবের ব্যবধান বিপজ্জনক এক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সে কারণেই চব্বিশের অভ্যুত্থানের মূল স্লোগানই ছিল বৈষম্যের কাঠামো ভাঙা। কিন্তু গত সাত মাসে সে বিষয়ে আমরা তেমন এগোতে পারলাম না। উল্টো চ্যালেঞ্জে পড়ল বহুত্ববাদী সামাজিক যাবতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি।

দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশের অতীত শক্তির জায়গাটা ছিল তার উপনিবেশবিরোধী লড়াইয়ের ঐতিহ্য এবং বহুত্ববাদী সংস্কৃতি। চব্বিশের অভ্যুত্থানের শক্তিগুলো এই দুই ঐতিহ্যকে ধারণ করে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ এবং রাষ্ট্র সংস্কারকে মৌলিক লক্ষ্য হিসেবে হাজির করেছিল। আজকে গণঅভ্যুত্থানের দ্বিতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ হলো গত জুলাই-আগস্টের আদি লক্ষ্যগুলো সামনে নিয়ে আসা এবং সেই আলোকে সংগঠিত হওয়া। কেবল এ রকম লক্ষ্যে অভ্যুত্থানের ভরকেন্দ্র থেকে আরও আরও রাজনৈতিক দল ও সামাজিক শক্তির সাংগঠনিক জন্ম হোক। সবার লক্ষ্য হোক আর্থসামাজিক বৈষম্যের অবসান; আত্মঘাতী কৃত্রিম মেরূকরণ উস্কে দেওয়া নয়।

আলতাফ পারভেজ: গবেষক ও লেখক

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: র র জন ত ম র করণ পর য য় এ রকম স গঠন সরক র গঠন ক

এছাড়াও পড়ুন:

দিনাজপুরে পথেঘাটে গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে কাঁচাপাকা খেজুর

দিনাজপুরে রাস্তার পাশে, খালে-বিলে এবং বাড়ির আনাচে-কানাচে গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে কাঁচা-পাকা খেজুর। একসময় রাস্তার ধারে অনেক খেজুর গাছ ছিল। এখন অনেক কমে গেছে। নতুন করে খেজুর গাছের আবাদ করতে দেখা যাচ্ছে না স্থানীয়দের। তবে প্রকৃতির ভারসাম্যের জন্য ও বজ্রপাতের নিরোধক হিসেবে খেজুর গাছের আবাদ বাড়ানো উচিত বলে মনে করছেন তারা।

বছরে দুইবার ফলন আসে খেজুর গাছে, শীতকালে মিষ্টি সুস্বাদু রস, আর গরমকালে খেজুর ফল। 

এসময়ে জেলার বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে বের হলেই চোখে পড়ছে এই কাঁচাপাকা খেজুর। এখনই অনেক খেজুরে রঙ ধরেছে। তবে এখনো খাওয়ার উপযোগী হয়নি, এখনও খেতে কষ কষ লাগছে, পাকলে তা মিষ্টি হবে। পাকলে অনেকেই এই পাকা খেজুর বাজারেও বিক্রি করবেন। এখনও প্রায় ২৫ থেকে ৩০ দিন সময় লাগবে খেজুরগুলো পাকতে। 

সরকারি সড়কের পাশের গাছগুলো থেকে খেজুর পেড়ে স্থানীয় ছেলে-মেয়েরা খেতেও শুরু করেছে। 

সদর উপজেলার রামনগর এলাকার রুবেল হোসেন বলেন, “আমার বাড়ির পাশে একটি খেজুরের গাছ রয়েছে। বয়স প্রায় অনেক হয়েছে। শীতকালে প্রতিদিন অনেক রস হতো। এখন গরমের সময় গাছে অনেক খেজুর ধরেছে। খেজুরগুলো কাঁচাপাকা, পাকলে খেতে অনেক মিষ্টি। এখনও এক মাস সময় লাগবে খেজুরে পাক ধরতে।” 

বিরামপুর রেলগট এলাকার আরাফাত মিয়া বলেন, “এই রেলগেটের দক্ষিণ পাশে রেললাইনের দুই পাশে অনেক খেজুরের গাছ রয়েছে। শীতকালে রাজশাহী থেকে কয়েকজন লোক এসে গাছগুলো থেকে রস নামায়। প্রতিদিন অনেক রস হয়। রস থেকে তারা গুড় তৈরি করে এবং এলাকার মানুষের নিকট বিক্রি করে। এখন গরমকাল, প্রতিটি গাছে প্রচুর খেজুর ধরেছে। খেজুরগুলো পাকলে আমরা এলাকার মানুষেরা পেড়ে খাই। খেতে অনেক সুস্বাদু।” 

ঢাকা/মোসলেম/টিপু 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • বিশ্ব সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবন দিবস আজ
  • প্রাইম এশিয়া শিক্ষার্থী হত্যা, ছাত্রদল মিডিয়া ট্রায়ালে লিপ্ত হয়েছে: উমামা ফাতেমা  
  • রাস্তা নির্মাণে নিম্নমানের ইট খোয়া, স্থায়িত্ব নিয়ে শঙ্কা
  • প্রয়োজন বহুপক্ষীয় সক্রিয়তা
  • সুপেয় পানি সংকটের স্থায়ী সমাধানের পথ
  • যশোরে আত্মগোপনে থাকা আ’লীগ নেতাদের বাড়িতে পুলিশের অভিযান
  • দিনাজপুরে পথেঘাটে গাছে থোকায় থোকায় ঝুলছে কাঁচাপাকা খেজুর
  • যারা নির্বাচনের কথা বলে তারা লুটেরা ও মাফিয়া শ্রেণি: ফরহাদ মজহার
  • রাবি ভর্তি পরীক্ষায় শহীদ আবু সাঈদ ও জেন-জি নিয়ে প্রশ্ন
  • শুধু বিএনপির কথায় নির্বাচন হবে না: ইসলামী আন্দোলন