বাল্যবেলায় একটা বাক্যকে জেনেছিলাম যার অন্তর্গত অর্থ বুঝতে আমার দীর্ঘ সময় লেগেছিল। তার কারণ অবশ্য হতেই পারে আমার নিজস্ব বোঝাপড়ার অক্ষমতা। বাক্যটি ছিল ‘কী করে খায়’। আমার শৈশব বা বাল্যকাল যেহেতু গ্রাম ও শহর মিলে কেটেছে, তাই এও আবার ভাঙিয়ে নেওয়া যায় যে কোথা হতে আমি ওই প্রবাদীয় বাক্য প্রথমে শুনেছিলাম। গ্রামে এই ধারণা নেই, ফলে হতে পারে শহরেই শুনেছি অর্থাৎ বরিশালে যেখানে আমার বাল্যকাল কেটেছে। হতে পারে সেই শহরের তখনকার দিনের উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্ত মানুষদের কথোপকথন হতে জেনেছিলাম বাক্যটি– ‘কী করে খায়’। আমার মনে এই নিয়ে প্রশ্ন হতো– মানুষ ওই কথাটি কেন বলে, এ কথা সকলেই জানে– কী করে মানুষ খেয়ে থাকে, তাহলে আবারও এ কথাটি কেন বলে। আমার মনে হতো– ‘খায়’ বললে তো মানুষ ভাতই খায় সে কথা বোঝানো হতো এবং তা কখনও ডাল বা মরিচে মেখে বা কখনও তা শাকসবজি দিয়ে সেই ভাত বাসন কি থালায় মেখে আবার হাত দিয়ে নলা করে মুখে দিয়ে খায়। এইভাবেই তো মানুষ খায়, এ কথা কে না জানে। তাহলে বিষয়টি নিয়ে অমন করে বলবার কী আছে। যখন থেকে অবশ্য বুঝলাম যে ওটা আসলে একটা বাগধারা তখন অবশ্য আমি জেনেশুনেই আর বুঝতে চাইনি ওর অর্থ এবং আজও আমার ওই না বোঝাটা রয়ে গেছে, তা এর পেছনের রুক্ষতার দিকটির কথা ভেবে, অর্থাৎ ওই কথার পেছনে যেহেতু একটা মানুষের জীবিকার যা ভালো কি মন্দ উদ্দেশ্যে বলা হয়ে থাকে, তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ওর অর্থ বুঝবার দরকার নেই। সভ্য মানবসমাজ ও বিন্যস্ত অর্থনৈতিক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে এটা অবধারিত হয়ে ওঠে যে মানুষের একটা যেমন জীবন থাকবে, সে জীবনে একটা জীবিকাও থাকবে। সেই জীবিকা-প্রাপ্তি প্রতিযোগিতায়ই কার্যত আমরা একটি জীবন কাটিয়ে দিয়ে থাকি, যার সূত্রপাত আসলে আমাদের একেবারে শিশুকাল হতে।
শৈশবে একবার বাবার মুখ ম্লান হতে দেখেছিলাম আমাকে নিয়ে। সেই স্মৃতিই মনে হয় আমার দেখা সবচেয়ে বাবার ম্লান অসহায় মুখ, যা আমাকে নিয়ে তার সেদিন ছিল। আমার বয়স তখন চার থেকে ছয় হতে পারে। আমরা একেবারে অজপাড়াগাঁয়ের নিখাদ কৃষক চাষাবাদি পরিবার। অমন পরিবারের ছেলেরা বড় হয়ে আরও ভালো বা উত্তম কৃষক বা চাষি হবে– সেটাই ধরে নেওয়া হয়, এর চেয়ে ভিন্ন কিছু প্রত্যাশা থাকে না। আমার তেমন বয়সকালে একদিন ভোর রাতে বাবা  তার নিয়মিত কাজের অংশ, ক’মাইল দূরের কাঁঠালতলির হাটে ভুতি বাবুর ধানের কলে ধান ভানতে গেলে আমাকেও সঙ্গে করে নিয়ে যায়। আমি বুঝি সে ছিল পুত্রসন্তানকে জীবনের প্রস্তুতিমূলক উদ্যোগের অংশ হিসেবে সঙ্গে করে নিয়ে অভিজ্ঞতা দেওয়া। আমরা যখন পৌঁছেছি সেই ধানের কলে, তখন কাঁঠালতলির খাল ও শ্রীমন্ত গাঙ্গের মোহনার গাঙ্গের ওপারের রামপুরা গ্রামের গাছপালার মাথার ওপর দিয়ে পায়রার গাঙ্গের দিকে ভোরের সূর্যের আলোর আভা ছড়িয়েছে। বাবা আমাকে নৌকা হতে তুলে নিয়ে ধান ভানবার কলে ঢোকেন, ধানের-কলে এরই মধ্যে ধান ভানার কাজ চলছে। লোকেরা ধান ঢালছে কলের ধান দেওয়ার মুখে আর তার নিচ দিয়ে চাল হয়ে সামনের দিকে তা নামছে। আমার জ্ঞানে ধান ভেঙে চাল হতে দেখার অভিজ্ঞতা ছিল সেদিন পর্যন্ত ঢেঁকিতে ছাঁটা, যা একটি দীর্ঘ সময়ের পর্ব। আর এখানে কিনা ওপর হতে খোলে ধান ঢালবার সঙ্গে সঙ্গেই নিচ দিয়ে চাল হয়ে তা বেরিয়ে আসছে। এই আশ্চর্য হওয়াই ছিল যেন জীবনের প্রথম আশ্চর্য হওয়া। বাবা আমাকে এরপর ধানের কলের পেছনের অংশের কক্ষে নিয়ে গেলেন, যেখানে ওই কলের বিশাল যন্ত্র ও ওই যন্ত্রের এক ‘ঐশ্বরিক-চালচলন’। সামনে হতে ঘুরে আসা ফিতায় মোড়ানো বিশাল হুইলে ঘুরছে, যাবতীয় গিয়ার চলাচল ও ওঠানামা, এর সবকিছু আমি অবাক বিস্ময়ে দেখতে থাকি। 
সেখানে আমার বয়সী আরও একটি শিশু ছিল, ধরে নিচ্ছি তার বাবাও তাকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে আমারই মতন কারণে হয়তো যে কারণে আমার বাবা আমাকে নিয়ে এসেছে। 

বাবা আমার বিস্মিত হওয়াকে বিঘ্নিত না করে তিনি ধান ভানার তদারকি কাজে ফিরে গেলে এর কিছুক্ষণের মধ্যেই ওখানে উপস্থিত ওই শিশুটি আমাকে আক্রমণ করে বসল। বাবা ফিরে এসে দেখলেন যে আমাকে আক্রমণ করে মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে, আমি হয়তো ওঠার চেষ্টা করছিলাম। বাবা ওই ছেলেটিকে ধমক দিয়ে আমাকে মাটি থেকে তুলতে থাকলেন। মাটি হতে বাবার সাহায্যে ওঠার সময়ে তার চোখের দিকে আমার চোখ পড়লে তার যে অসহায় ও বেদনায় লেপটানো স্বপ্নভঙ্গের চোখ আমি সেদিন দেখেছিলাম, সেটাই আমার স্মৃতিতে রয়ে গেছে সারা জীবনের জন্য আমার স্মৃতিকে সংক্রমিত করে। আমি আজও বাবার অমন সুন্দর চোখের সেই বেদনামিশ্রিত চাউনি বিশ্লেষণ করে দেখি– সেই ছিল আমাকে নিয়ে কারও প্রথম শঙ্কা আমার ভবিষ্যৎ, আমার জীবন ও হয়তো অবশ্যম্ভাবীভাবেই তা ভবিষ্যতের “জীবিকার” সঙ্গেও জড়িত ছিল।
আমার এক বন্ধু যাকে আমি দেখেছি সাংবাদিকতা করতে, সাংবাদিকতার আবার বিবিধ শাখায়, এমনকি উৎপাদন ঘরানার কাজ মেকআপেও তিনি পারদর্শী নন শুধু, অন্যদের কাজ ভালো হয় না বলে তিনি নিজেই তা করেন, আর ওই বিভাগের বেতনভুক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি (এখানে জীবিকাকারী) আমার ওই বন্ধুকে তারা সহযোগিতা করে থাকে মাত্র। কেননা, তিনি ঊর্ধ্বতন বলে অন্যদের কাজকে চূড়ান্ত ভরসা করতে না পারা। আমি বলি– ‘তাহলে আপনি তো দেখি ‘গ্রাফিক-ডিজাইনার’ হিসেবেও জীবিকা করতে পারতেন? বললেন তা তো বটেই এবং বিবিধ অনেক কিছুই তো হতে পারতও, যাকে বলা হয়ে থাকে ‘জীবিকা’। পৃথিবীর অধিকাংশ মানুষই বিবিধ গুণের অধিকারী, জীবনযাপনের জন্যই তা হতে হয়, না হলে অচল হয়ে যেত চলমান জীবন। তবে কারও গুণ বা কার্যক্ষমতা অনেকগুলো শাখায় প্রায় নিখুঁত পর্যায়ে  অর্থাৎ ওই মাত্রার উৎকর্ষ এমন যে তাকেও জীবিকা উপযোগী ধরা যেতে পারে। অর্থাৎ ওই যে কিছু একটা করে খাওয়া; মানে ওই যে কথা এসেছে শুরুতেই ‘কী করে খায়’?
আমার জীবনে সবচেয়ে বেশি যা ‘করে খেতে’ ইচ্ছে হয়েছিল তা হলো পেশা হিসেবে ক্যানভাসারকে নেওয়া, প্রধানত তা বড়ি বিক্রি করা, তাও আবার চির-কৃমির বড়ি বিক্রি, যা তখনকার দিনের খুব প্রচলিত একটি ব্যাপার। শৈশব-কৈশোরে সেটাই দেখে থেকেছি যে। কৈশোরে কোনো পেশা যদি আমাকে মুগ্ধ করে থেকেছিল তা এই ক্যানভাসার পেশা। স্বাধীনতার বছর দুই-তিনেকের মধ্যে আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়– মনোরমা বসু মাসিমার প্রতিষ্ঠান মাতৃমন্দির প্রাথমিক বিদ্যালয় ছেড়ে যখন বরিশাল শহরের দ্বিতীয় সারির উচ্চ বিদ্যালয়,  বিখ্যাত নয় এক স্কুলে (এ.

কে. স্কুল) ভর্তি হলে, দিন শেষে সেই  বিদ্যালয় হতে ফিরে আসার সময়ে আমার সামনে এইই একমাত্র আকর্ষণীয় পেশাজীবীদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয় অর্থাৎ ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে এদের কাজবাজ দেখে থাকি এবং যার প্রতি আমি সীমাহীন আকর্ষণ বোধ করি।
আমার সেইই মনে হতে থাকে যে, মানুষের জীবনে এর চাইতে সুন্দর আর কিছু করার হতে পারে না। আমার মূল আগ্রহ ও আকর্ষণের বিষয় ছিল ক্যানভাসারদের গল্প বলা পর্বটি; তাদের গল্প যেনও দেহভঙ্গি প্রদর্শনসহ শ্রোতাদের সে গল্প বলে তা প্রায় দেখিয়ে দিয়ে বোঝানো হতো পর্যন্ত। এরপর মনে হয় আমি জীবনে যত দিন বরিশালে থেকেছি আমি কোনোদিন ক্যানভাসারদের ওই গল্প বলা পর্ব কখনও মিস করিনি। ফলে আমার জীবনের করতে চাওয়া বা ‘করে খাওয়ায়’ জন্য ওই পেশাটির প্রতি জন্মেছিল এক অপরিসীম আগ্রহ। হতে পারে ওই পেশায় যেতে না পারার বেদনা এখনও আছে আমার ভেতরে। আমার  একটা গল্প আছে যার নাম ‘ক্যানভাসার গল্পকার’, এই নামে আমার দ্বিতীয় মাত্র গল্পগ্রন্থও রয়েছে। এই নামকরণের ভেতরেই উপলব্ধি করা যাবে ওই ক্যানভাসার হতে চাওয়া যে কত বেশি আমার আগ্রহের বিষয় ছিল তা স্পষ্ট। আমাদের সংস্কৃতিতে মানুষের শৈশব-কৈশোরে যে খ্যাতি, যেমন ‘ভালো ছাত্র’ কি  ‘চালাক-চতুর’, এমন জাতীয় যেসব খ্যাতি থাকে তা আমার কক্ষনো জোটেনি তবে ‘মাথা-মন্দ নয়’ কিন্তু পড়াশোনা করে না– এমন সামান্য কথা হতো পেছনে বা সামনে, যদিও পরিশেষে গিয়ে এই অপবাদ জোটে যে সে একেবারে ‘গোল্লায়-গেছে’। 
শিশু-কিশোরদের সম্পর্কে এসব অভিযোগ বা মন্তব্যের পেছনে আসলে ওই-ই একটি সম্ভাবনার ইঙ্গিত থাকে– যা হলো শিশুটির ভবিষ্যৎ জীবিকার সম্ভাবনার কথা।
উন্নত সমাজ ও সংস্কৃতিতে মানুষের জীবিকা কী হবে বা হওয়া উচিত, তা প্রধানত নির্ধারিত হয়ে থাকে ব্যক্তির কোনো কাজের প্রতি ঝোঁক বা আগ্রহ হতে। কেউ যদি রোগী সেবাদান করতে ভালোবাসেন তবে তিনি যে জীবিকাকে মাথায় রেখে অগ্রসর হবেন তা হলো চিকিৎসক বা সেবাদান শিল্পের কোনো শাখায় যেখানে যে ব্যক্তি যে কাজের জন্য উপযোগী বলে বিবেচিত হবেন, সে কাজেই তিনি যোগ দেবেন। আমাদের সংস্কৃতিতে তেমনটি নেই বললেই চলে; যেন প্রতিটি শিশুই হতে চায় চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও আমলা।
যেসব আমার পছন্দের কাজ ছিল, তা কোনোদিন কেউ আমাদের সমাজে ভাবতেও পারে না তাদের ভবিষ্যৎ জীবিকা হিসেবে। কৃষক পরিবারের হিসাবে ধরেই নেওয়া হয় সন্তানদের ক্ষেত্রে যে তাদের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ জীবিকা হবে সে ওই চাষাবাদনির্ভর, যদিও তাকে আমাদের সমাজে কেউ ঠিক জীবিকা মনে করে না বরং কোনো জীবিকায় বা পেশায় কেউ অনুপযোগী হলেই ওই কৃষি জীবিকায় গিয়ে থাকে। কৃষিকাজের বর্ষা মৌসুম সময়ে অর্থাৎ যা জল-পানি-কাদার ভেতরে কাজ করা তার প্রতি আমার কোনো আগ্রহ ছিল না তবে শুকনো মৌসুমের ধুলো ক্ষেতের প্রীতি আমার অপরিসীম আগ্রহ ছিল। অর্থাৎ সমগ্র কৃষি প্রক্রিয়া যে মৌসুম নিয়ম তাতে দেখা যায় আমার আগ্রহ ছিল কম অংশের প্রতি। কেননা, ধান চাষ যেখানে কৃষির প্রধান উৎপাদন, যার দুই মৌসুমেই ওই পানি কাদা লাগে ধান চাষে কেবল সবজি চাষকে ওই ‘ধুলো’ চাষাবাদ বাল যাবে। অতএব এটা ভালো কৃষক হওয়ার কোনো লক্ষণ নয়। আমি কৃষক হওয়ায় অযোগ্য হয়ে পড়ি।
ব্যক্তিগতভাবে আমি প্রায় যে কোনো কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করতে পারি ও করে থাকি। কোনো কাজের ধরন হতে তার প্রতি আমার আগ্রহ জন্মে থাকে। ছেলেবেলায় যখন নানাবাড়ি যেতাম নানাবিধ খাল ও ছোট নদী ধরে তখন মাঝিদের নৌকা বাইবার বৈঠা চালানোর যে শব্দ তা ছিল আমার জন্য যেন অদ্ভুত নেশার এক বাদ্য। আমি মাঝির ওই বৈঠা চালানো, জল কেটে স্লাৎ করে যে শব্দ হওয়া ও মাঝিদের হাতের ছান্দিক বৈঠা ধরা হাতের ওঠানামা, সেটাই ছিল আমার বড় হয়ে মাঝি হওয়ার বাসনার সূত্রপাত। কৈশোরে আমাদের এলাকায় আমার চাইতে কেউ বৈঠা বা লগি দিয়ে ভালো নৌকা বাইতে পারত না! সে হয়তো কোনো ভালো বা সার্থক জীবিকা নয় জানি কিন্তু আমার ভালো লাগা ছিল অর্থাৎ আমি যদি জীবনে মাঝি হতাম তবে নিঃসন্দেহে একটি ভালো না হোক, একটি সুখী জীবন করতে পারতাম, প্রধানত তা যদি হতো আমার সবচেয়ে প্রিয় মাঝির কাজ ‘খেয়া পারাপার’।
শৈশবে নিতাই নরসুন্দর তার হাঁটুতে চেপে ধরে যেভাবে কাঁচি চালাতেন তাতে নিজ ঘাড় মাথায় একটা অসম্ভব ব্যথা ও দুঃসময় কাল মনে হলেও তার চুলে কাঁচি চালাবার ফাঁকে কাঁচির কুটকুট শব্দ চুলে চালাবার আগে-পরে তার প্রতি আমার অসীম আগ্রহ হতো। একসময়ে শিশু আত্মীয়স্বজনের চুল কেটে দিতাম সে ওই কাজটার প্রতি ভালো লাগা হতে। ওই অর্থে আমার ওই ‘করে খাওয়া’ ধারণায় হতে পারত আমি একজন সুখী নাপিত অর্থাৎ নাপিতগিরি করেও হতে পারত একটি সুখী জীবিকা আমার জন্য (নাপ্তালি নয়!)। এই নাপিত “পেশাটি” (এ ক্ষেত্রে পেশা নয়) আজও আমি ধরে রেখেছি নিজের জন্য। এখন অন্য কোনো লোক না পাওয়া গেলেও নিজের জন্য প্রতি সপ্তাহে নিজেই নাপিত হয়ে নিজেকে সামনে দাঁড় করাই। আর সে জন্য আছে আমার চুল কাটার বিশাল সংগ্রহের যান্ত্রিক যন্ত্রপাতি। কাজটি ভালোবাসি বলে ধরে রেখেছি। এতে কোথাও কোনো সামাজিক বিবাদ বা সংঘাত নেই, প্রশ্ন নেই, পরাজিত জীবিকার অপবাদ নেই, নিজেকেই নিজের প্রিয় পেশায় নিবেদন, প্রিয় পেশার প্রিয় নাপিত। যদিও কালেভদ্রে আমিও পেশাদারি দোকানে গিয়ে চুলে অতি সামান্য কাটার অভিজ্ঞতা করে থাকি, যাতে সেটাও একেবারে ভুলে না যাই তারই একটা উদ্যোগ।
আমি জুতাপ্রিয় মানুষ। অনেক ধরনের জুতার সংগ্রহ আমার আছে। প্রায় প্রতিটি জুতা চামড়ার এবং সেসবেরও বিবিধ শ্রেণি আছে এবং সেসব জুতার যত্ন বা কালি দেওয়া একধরনের ঝামেলাপূর্ণ কাজ। অথচ ঝামেলার এই কাজটিই খুব প্রিয় আমার। ফলে কেউ যদি জেনে থাকে যে আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ওই জুতা সেবা করছি তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই, সে আমার অতি প্রিয় কাজ। পরিবারের অন্যদের জুতা যত্ন যে আমিই করে থাকি। যদিও জীবনের একটি সময় গেছে যখন সে সুযোগ ছিল না। যেহেতু নিজের একটিমাত্র জুতাই ছিল, যার যত্ন-আত্তি করার দৈনন্দিন সময় মিলত না। আর এখন আমার একটা ছোটখাটো আলমারি আছে, যেখানে কেবল ওই আমার জুতা-কালি ও অন্যান্য যাবতীয় জুতা-যত্ন করার সরঞ্জামাদি থাকে। আমার তো মনে হয় যে কোনো পেশাদারি ‘মুচি’র মতোই বা তার চাইতে আমার নিজস্ব সরঞ্জামাদি কম নেই! ওই-ই অর্থাৎ আমার নাপিত জীবন বা মুচি জীবন, জীবিকা হিসেবে না নিতে পারলেও সে জীবন আমি কখনও বাদ দেইনি। যা কিনা এভাবে বলা যায় আমার ওই মুচির জীবিকা না হলেও জীবন আছে। সাদত হাসান মান্টোর সে গল্পটির মতন; এ যেন আমার সেই গল্পের প্রীত উৎসর্গ বা নিবেদন।
সত্তরের দশকে আমার বাবা যে ঘর বানিয়েছিলেন তাতে ছিল সব কাঠের কারুকাজ। সেই শিল্পকর্ম যিনি করতেন তাঁর নাম ছিল তারকেশ্বর। সেই মিস্ত্রি তারকেশ্বর দিনরাত ধরে যখন কাজ করতেন তাঁর ওই শিল্পকর্মের পাশে হাতুড়ি-বাটাল বা অন্যান্য সব হাতে তুলে দেওয়া বা সহযোগী যেন সর্বার্থে সাগরেদ হিসেবে থাকতাম আমি এবং মিস্ত্রি তারকেশ্বর আমাকে ছোট কিছু কাজ করতে দিতেন।  মা ও বাবা বলতেন আমাদের ছোট মিস্ত্রি! যদিও বড় হয়ে আমার ওই মিস্ত্রি হওয়ার বাসনার কোনো ব্যবহারিক প্রয়োগ করার সুযোগ হয়নি। তবে দৃঢ় বিশ্বাস জীবিকা হিসেবে তারকেশ্বর আমাকে সে সম্ভাবনার একজন মনে করতেন এবং সে কথা বলতেন।
আমি একটানা তিন-চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে আমার জন্য নিয়মিত রান্না করে থাকি এবং এ কথা স্বীকৃত যে রান্নাঘর ওই সময় অর্থাৎ রান্না সরঞ্জামাদি ব্যবহারেও আমার রয়েছে নিজস্ব অদ্বিতীয় পদ্ধতি। যেমন– আমি একই তরকারি কাটতে একাধিক চাকু ব্যবহার করে থাকি; আর রান্নার সময়ে দেখা যাবে আট-দশটা চামচ নামিয়ে ফেলেছি একটা বা দুটো তরকারি রান্না করতে গিয়ে। যদিও অনেকের মতন সেসব আবার এলোপাতাড়ি থাকে না অনভিজ্ঞদের মতন বরং একেবারে পেশাদার পাচকের মতন সবকিছু আবার গুছিয়েও ফেলতে পারি। পরিশেষে রান্নার চেহারা ও স্বাদ এমন পর্যায়ে যে তাতে করে জীবিকা হিসেবে আমার ওই পেশাও ভালো ও সুখীই হতে পারত। তা না হতে পারলেও ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজে ওই পেশা অর্থাৎ পাচকের কাজ হতে ক্ষান্ত দিইনি এখনও।
জীবনে অনেক কাজ করেছি; ভালো লাগা হতে সাংবাদিকতা ও চলচ্চিত্র নির্মাণের সঙ্গে এবং ওর সংশ্লিষ্ট সব ধরনের কাজই আমি নিজে করতে পারি। সাংবাদিকতা একদা জীবিকা হলেও চলচ্চিত্র তা হয়নি; হলে ভালো হতো, হয়তো এক অর্থে আবার হবেও অথবা  নাইবা হলো। যদিও ওই কথাটি অর্থাৎ ‘কী করে খাবে’ বা জীবিকা শব্দ এখন অপ্রয়োজনীয় আমার জীবনে। যেখানে আমার জন্য ‘একটি ভালো কাজের হোটেলটি’ পর্যন্তও আমার জন্য খোলা আছে যে! সেখানে লোকটি ভবিষ্যতে ‘কী করে খাবে’ সমস্যা আর থাকে না আমার জন্য। জীবনে ভালো লাগা হতে জীবিকা অর্থে আরও যেসব কাজ করেছি; যেমন– গ্রাফিক ডিজাইনার, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, ফটোগ্রাফি, করপোরেট বিজনেস এক্সিকিউটিভ (এটা ঠিক ভালো লাগা হতে করিনি)। চলচ্চিত্রের সবগুলো শাখায় আমি কথিত পারদর্শী, সেসব কাজ করে ওই অর্থে ‘জীবিকা’ও করেছি একসময়ে। ভালো লাগেনি এমন জীবিকাও করেছি অর্থাৎ জীবিকা কী হবে– এ নিয়ে আমি কখনও থামিনি অর্থাৎ টিকে থাকা অর্থে আমি সবই করতে পারি যদি তখনকার বাস্তবতায় আমাকে তা করতেই হয়। আমেরিকাতে সংসার করা বিবেচনায় নারীরা একধরনের সঙ্গী-স্বামী পছন্দ করে থাকে, যাদের বলা হয় ‘হ্যান্ডিম্যান’ (কারিগর!)। যারা হলেন গিয়ে সকল কাজের কাজি। আমি সেই গোত্রের। হেন কাজ নেই যা আমি নিজে করে থাকি না বা পারি না; হেন সমস্যা নেই যার একধরনের আমার মতন করে সমাধান আমার কাছে নেই। ফলে একজন ওই ‘হ্যান্ডিম্যান’ হিসেবে আমার চাহিদা নিশ্চয়ই মন্দ হওয়ার কথা ছিল না তখনকার দিনে ওই সমাজে! আমার বউ নিশ্চয়ই সেটা উপভোগ করে।  
ওই অর্থে আমার জীবিকা বড় হয়ে কী হতে পারে, এই সংশয় থাকার কথা ছিল না, যেহেতু আমি সব কাজই করতে পারি। এমনকি আমার ধারণা, আমি বাংলাদেশের ভালো সৎ দক্ষ সরকারপ্রধানও হতে পারতাম! হ্যাঁ, আমি প্রধানমন্ত্রীর পদের কথাই বলছি অথবা আমেরিকার একজন দক্ষ ভালো সিনেটর!! সিনেটর বললাম যেহেতু প্রেসিডেন্ট হতে হলে জন্মসূত্রে নাগরিক হতে হবে যে।
অতএব, সেই যে কোনো এক গ্রামীণ রাঙা সকালে ধানকল-ঘরের পেছনের কক্ষে ‘শিশুবিক’ আক্রমণে পরে যাওয়া ছেলেকে তুলতে থাকা সময়ে আমি যে বাবার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত চোখ দেখেছিলাম, বাবা আসলে অত অসহায় বোধ না করলেও পারতেন। যেখানে ওই ভবিষ্যৎ জীবিকা বা নানাবিধ পাশবিকতা প্রতিরোধ করে টিকে থাকার কতসব যাবতীয় গুণ ও দক্ষতা যে আমার রয়েছে। তারপরও বাবা বা মায়েরা তো অমনই হবেন– একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে এই সমাজে তারা উদ্বিগ্নই ছিলেন, যেমন– এখনও বাবা-মায়েরা তেমনই থাকেন; চারদিকে আমি তেমনটাই তো দেখি সারাক্ষণ। 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: আম র জ ব ধ ন র কল আম দ র স আম র ব য় আম র ক জ কর পর ব র আম র স আম র ক এক ব র ওই প শ ব দ কত আম র ম জ বন র আম র চ র একট অবশ য হওয় র র মতন

এছাড়াও পড়ুন:

ই-বুককে জনপ্রিয় করছে ‘বইটই’, বিনামূল্যে পড়া যায় তিন শতাধিক বই

বইপ্রেমীদের কাছে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে ই-বুক। কখনও বিনা মূল্যে আবার কখনও অল্প মূল্যে ই-বুক পাওয়া যায়। আমাদের দেশে ই-বুক সম্প্রসারণে কাজ কাজ করছে ‘বইটই’। বইটই-এর যাত্রা শুরু হয় ২০১৮ সালে। এর উদ্যোক্তা জনপ্রিয় কিবোর্ড রিদমিক ল্যাবস-এর সিইও শামীম হাসনাত। তিনি বুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করেছেন। এরপর নিজেকে নিয়োজিত করেছেন বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিকাশে। 

যেভাবে বইটই এর যাত্রা শুরু: শামীম হাসনাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন তিনি তৈরি করেন রিদমিক কিবোর্ড, যা অ্যান্ড্রয়েড এবং অ্যাপল ডিভাইসে ব্যবহার করা যায়। শামীম ২০১২ সালে রিদ্মিক কিবোর্ড চালু করেন, যার বর্তমান ব্যবহারকারী সংখ্যা ১২ কোটির বেশি। ২০১৮ সালের আগস্ট থেকে তিনি রিদ্মিক ল্যাবস-এর যাত্রা শুরু করেন, যেখানে নানা ধরনের অ্যাপ তৈরি করা হয়। সেই রিদমিক ল্যাবসের অন্যতম একটি প্রকল্প হলো বইটই।

কোথায় পাওয়া যায়:  বইটই অ্যাপ প্লে স্টোর ও অ্যাপল স্টোরে পাওয়া যায়। অ্যাপে লগইন করার পর পাঠকরা বিনামূল্যে পড়তে পারবেন তিন শতাধিক বই। এছাড়াও মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস বিকাশ, নগদ, রকেট এবং ডেবিট/ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে পেমেন্ট করে বারো হাজারের বেশি ই-বই কিনতে পারবেন। এসব বইয়ের মান অনুযায়ী দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। কোনো ব্যবহারকারী একবার একটি ই-বই কিনলে সারাজীবন পড়তে পারবেন। এছাড়াও, পড়ার সময় বই দাগানো, কোনো বিশেষ চরিত্র বা সংখ্যা মার্ক করা—এসব সুবিধাও পাওয়া যাবে বইটই অ্যাপে। জুম ইন বা জুম আউট করে প্রয়োজন অনুযায়ী লেখার আকার ছোট-বড় করেও পড়া যাবে।

আরো পড়ুন:

পর্যাপ্ত পানি পান করার পরেও ত্বক শুষ্ক হয় কেন?

চাকরিজীবী নারীরা ব্যাগে যা যা রাখতে পারেন

বইটই সাইটে গিয়ে যেকোনো বইয়ের শুরুর অংশ পড়া যাবে। এরপর ইচ্ছে হলে কিনতে পারবেন। দেখতে পারবেন কোন লেখকের বই সবচেয়ে বেশি পড়া হচ্ছে, কোন ক্যাটাগরিতে কোন লেখক সেরা—এসব তথ্যও জানা যাবে। পাঠকরা ই-বই পড়ে তাদের মূল্যবান মতামত দিতে পারবেন।

বইটই’র কাস্টমার অফিসার মো. আসিফ অনিক রাইজিংবিডিকে বলেন, ‘‘আমাদের উদ্দেশ্য ছিল সহজে ও সুলভে বই সবার হাতে পৌঁছে দেওয়া। তবে লক্ষ্যটা আরও বড়। ইচ্ছে আছে শত বা হাজার নয় বরং দেশ ও বিদেশের প্রতিটি মানুষের হাতেই বই পৌঁছে দেওয়ার।’’

ঢাকা/লিপি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জীবনপাঠ ও মাটিগন্ধী গল্প
  • জহির কোনো দিন ওর ধর্ম আমার ওপর চাপিয়ে দেয়নি: সোনাক্ষী
  • গোবিন্দর স্ত্রীর বিচ্ছেদের আবেদন, মুখ খুললেন আইনজীবী
  • বিবাহ বিচ্ছেদের পথে গোবিন্দ-সুনীতা!
  • ছেলেটি গায়ের টি-শার্ট খুলে অটোগ্রাফ দিতে বললো: ফারুক
  • ছেলেটি গায়ের টি – শার্ট খুলে অটোগ্রাফ দিতে বললো: ফারুক
  • ছেলেটি গায়ের টি শার্ট খুলে অটোগ্রাফ দিতে বললো: ফারুক আহমেদ
  • ছেলেটি  তাঁর গায়ের টি শার্ট খুলে আমাকে অটোগ্রাফ দিতে বললো: ফারুক আহমেদ
  • ই-বুককে জনপ্রিয় করছে ‘বইটই’, বিনামূল্যে পড়া যায় তিন শতাধিক বই