অন্তর্বর্তী সরকারে নারীদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা যায়নি: নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান
Published: 27th, February 2025 GMT
নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান শিরীন পারভীন হক বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফসল হিসেবে দেশে সংস্কারের সুযোগ এসেছে। আন্দোলনের ফলে একটা দায়বদ্ধতা তৈরি হয়েছে। দেশে বিরাজমান বৈষম্যগুলো চিহ্নিত করে নারীর প্রতি বৈষম্য নিরসনে কাজ করতে হবে। তাঁর মতে, সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে নারীদের অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা যায়নি।
আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২৫ সামনে রেখে আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর গুলশানের একটি হোটেলে অ্যাকশনএইড বাংলাদেশ আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ কথাগুলো বলেন শিরীন পারভীন হক। তিনি বলেন, ‘আমাদের মূলধারা হবে সব ক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্যের নিরসন। নারী-পুরুষের জেন্ডার বৈষম্য কমাতে কাজ করতে হবে। নারীর উন্নয়ন বিকাশে বাধাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। অন্য সব সংস্কার কমিশনে নারী অধিকারের প্রাধান্য নিশ্চিত করতে হবে।’
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে নারীদের উল্লেখযোগ্য নেতৃত্বের কথা স্বীকার করে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান বলেন, নারীদের অগ্রগতিতে পেছনে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। এটা কারা করছে, কেন করছে, সেটা বের করা দরকার। জুলাইয়ের আন্দোলনে মেয়েরাই রোকেয়া হল থেকে সবার আগে বের হলো। কিন্তু পরে এত দ্রুত মেয়েরা সরে গেল কেন? জায়গা কেউ ইচ্ছা করে ছেড়ে দেয়নি। চাপ সৃষ্টি করে জায়গা ছাড়তে বাধ্য করা হয়েছে।
শিরীন পারভীন হক আরও বলেন, ‘সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় নারীদের অন্তর্ভুক্তি আমরা নিশ্চিত করতে পারিনি। মেয়েদের পেছনে রাখার প্রবণতা দেখা গেছে।’
নারীদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর পরিচালক (প্রকল্প-২) আসিফ মাহমুদ।
আলোচনা সভায় একশনএইড বাংলাদেশ-এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির বলেন, ‘নারী সুরক্ষা, অবৈতনিক কাজের স্বীকৃতি, জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধে অবস্থান ও নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নসহ সমানাধিকারভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করছি আমরা।’
নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিতে গণমাধ্যমে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর আহ্বান জানিয়ে প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, গণমাধ্যম পেশায় নারীদের অগ্রগতি ও অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিতকরণে এ ক্ষেত্রে সমাজে সর্বতোভাবে পরিবর্তন আনতে হবে।
দেশের প্রান্তিক পর্যায়ের তিন নারীকে ‘নাসরীন স্মৃতিপদক ২০২৫’ পুরস্কার দেওয়া হয়। ঢাকা, ২৭ ফেব্রুয়ারি.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন শ চ ত কর সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ওয়াক্ফ আইন স্থগিত এবং নতুন চ্যালেঞ্জ
গত বৃহস্পতিবার সুপ্রিম কোর্ট ওয়াক্ফ আইন, ২০২৫-কে চ্যালেঞ্জ করে নতুন সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে ইতোমধ্যে দাখিল করা আবেদনের ওপর অন্তর্বর্তী সিদ্ধান্ত ৫ মে পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার আইনের পক্ষে হলফনামা দাখিলের জন্য সময় চেয়েছিল। কিন্তু আদালতকে আশ্বস্ত করেছিল– পরবর্তী শুনানির আগে তারা ওয়াক্ফ বোর্ডে অমুসলিমদের নিয়োগ দেবে না বা কোনো ওয়াক্ফের চরিত্র বা মর্যাদা পরিবর্তন করবে না।
১৬ এপ্রিল ভারতের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার নেতৃত্বে বিচারপতি পি ভি সঞ্জয় কুমার ও কে ভি বিশ্বনাথনের সমন্বয়ে গঠিত তিন বিচারপতির বেঞ্চ বিতর্কিত নতুন আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন। এতে তারা ৬৫টি আবেদনের প্রাথমিক শুনানি করেন। দুই ঘণ্টা ধরে চলা শুনানিতে বেঞ্চ কেন্দ্রের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলেন। পাশাপাশি আবেদনকারীদের ব্যাপারে বলেন, ‘আইনের কিছু ভালো দিক রয়েছে।’
আবেদনকারীদের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপনকারী জ্যেষ্ঠ অ্যাডভোকেট কপিল সিবাল মূলত আইনটিকে সংবিধানের ২৬ অনুচ্ছেদের লঙ্ঘন হিসেবে উপস্থাপন করেন। তাঁর মতে, এর মধ্য দিয়ে সংসদ ‘ধর্মবিশ্বাসের অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য অংশ’-এর ওপর হস্তক্ষেপ করেছে। সংবিধানের ৩ নম্বর অংশের অধীনে ২৬ অনুচ্ছেদ একটি মৌলিক অধিকার, যা নাগরিকদের ধর্মাচার পরিচালনার স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়। অনুচ্ছেদটি শুধু তিনটি বিধিনিষেধের এখতিয়ার রাখে– জনশৃঙ্খলা, নৈতিকতা ও স্বাস্থ্য।
আবেদনকারীরা ২০২৫ সালের আইনের সঙ্গে বেশ কয়েকটি বিষয় তুলে ধরেছেন। এর মধ্যে রয়েছে– ‘ব্যবহার অনুসারে ওয়াক্ফ’ ধারণাটি বাতিল করা। এই ধারণামতে, দীর্ঘ সময় ধরে মুসলিম ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত জমিকে ওয়াক্ফ হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে, এমনকি যদি এটি নিবন্ধিত নাও হয়। ২০২৫ সালের আইনটি ভবিষ্যতে উৎসর্গ করার জন্য ওয়াক্ফ করার সুযোগ বাতিল করে এবং এটি শুধু সেই সম্পত্তিগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ, যা ইতোমধ্যে ওয়াক্ফ হিসেবে নিবন্ধিত। আইনে আরও বলা হয়েছে, যেখানে কোনো বিরোধ রয়েছে অথবা যদি কোনো সম্পত্তি সরকারের মালিকানাধীন বলে অভিযোগ করা হয়, তাহলে প্রশ্নবিদ্ধ জমিটিকে ওয়াক্ফ ব্যবহার হিসেবে গণ্য করা হবে না।
সরকারের যুক্তি হলো, ওয়াক্ফের নামে প্রায়ই জমি দখল করা হয়। এ কারণে সমস্যাটি নিরসনে বিদ্যমান আইনি ব্যবস্থা বাতিল করা প্রয়োজন। এ ছাড়া সরকারের এই পদক্ষেপ বেশ কিছু ওয়াক্ফ হিসেবে ব্যবহারযোগ্য সম্পত্তি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে মসজিদ বা কবরস্থান থাকলেও এগুলো ওয়াক্ফ হিসেবে নিবন্ধিত হয়নি। আবেদনকারীদের যুক্তি হলো, ওয়াক্ফ ব্যবহারযোগ্য জমি নিবন্ধন করা কঠিন। প্রধান বিচারপতি খান্নাও এই অনুভূতির প্রতিধ্বনি করে কেন্দ্রকে জিজ্ঞাসা করেছেন, কেউ কীভাবে এমন একটি জমি নিবন্ধন করতে পারে, যা ৩০০ বছর ধরে ওয়াক্ফ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে?
প্রধান বিচারপতি খান্না বলেন, ‘যতদূর ওয়াক্ফ ব্যবহারকারীর কথা বলা হচ্ছে, এটি নিবন্ধন করা খুব কঠিন হবে। তাই এখানে অস্পষ্টতা রয়েছে। আপনার হয়তো একটা যুক্তি থাকতে পারে যে (এটির) অপব্যবহার হচ্ছে...। কিন্তু একই সঙ্গে প্রকৃত ওয়াক্ফ ব্যবহারকারীও রয়েছে।’ আবেদনকারীরা আরও বলেছেন, ওয়াক্ফ ব্যবহারকে একটি ধারণা হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে আদালত স্বীকৃতি দিয়েছেন, যা ২০১৯ সালের অযোধ্যার সুপ্রিম কোর্টের ঐতিহাসিক রায়ে স্বীকৃতি পেয়েছে। এ সময় জেলা কালেক্টরের ক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন ওঠে। বিচারকরা এ সময় উল্লেখ করেন, কোর্ট জেলা কালেক্টরের ক্ষমতা সম্পর্কিত আরেকটি বিধান স্থগিত করার কথা বিবেচনা করছেন, যা ওয়াক্ফ ব্যবহারকারী জমির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
২০২৫ সালের আইন অনুসারে, জেলা কালেক্টর যদি ওয়াক্ফ হিসেবে ব্যবহৃত জমিকে সরকারি জমি হিসেবে চিহ্নিত করেন, তাহলে আদালতে বিরোধের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এটি ওয়াক্ফ জমি হিসেবে থাকবে না। আইনের ধারা ৩(গ)-এর একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত থেকে প্রবাহিত এই ক্ষমতা আদালত ওয়াক্ফ জমির অবস্থা নির্ধারণের আগেই তার অবস্থা পরিবর্তন করতে পারে। যদিও এই বিধান এখনও স্থগিত করা হয়নি, তবে বৃহস্পতিবারের আদেশে কেন্দ্রের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যে কোনো ওয়াক্ফের ‘চরিত্র বা অবস্থা’ পরিবর্তন করা হবে না।
এ ছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হলো, ওয়াক্ফ বোর্ডে অমুসলিমদের অন্তর্ভুক্তি। আবেদনকারীরা যুক্তি দিয়েছিলেন, ২০২৫ সালের আইন অমুসলিমদের ওয়াক্ফ বোর্ড ও ওয়াক্ফ কাউন্সিলের অংশ হওয়ার সুযোগ দেয়। অথচ এই পদক্ষেপ সংবিধানের ২৬(খ), ২৬(গ) ও ২৬(ঘ) অনুচ্ছেদ লঙ্ঘন করে, যা যথাক্রমে একটি সম্প্রদায়ের ‘ধর্মীয় বিষয়ে নিজস্ব বিষয় পরিচালনা’, ‘স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানা ও অর্জন’ এবং ‘আইন অনুসারে এই জাতীয় সম্পত্তি পরিচালনা’ করার অধিকার নিশ্চিত করে। কেন্দ্র থেকে যুক্তি দেওয়া হয়, ওয়াক্ফের ব্যাপারে অমুসলিমদের অনুমতি দেওয়াটা সম্প্রদায়ের ভেটো অধিকারকে প্রভাবিত করবে না। আবেদনকারীরা বলেছিলেন, এ ক্ষেত্রে ‘একজনও (অমুসলিম) অনেক বড় ব্যাপার।’
এ বিষয়ে বেঞ্চ কেন্দ্রকে প্রশ্ন করেন। সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতাকে এমন একটি উদাহরণের নাম বলতে বলেন, যেখানে সংসদ অন্য ধর্মের সদস্যদের একটি সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিষয় পরিচালনাকারী বোর্ডে যোগদানের অনুমতি দিয়েছে। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি কি বলছেন যে, এখন থেকে আপনি মুসলিমদের হিন্দু এনডাওমেন্ট বা উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সম্পত্তি বোর্ডের অংশ হতে দেবেন? বিষয়টি খোলাখুলিভাবে বলুন।’
অপূর্ব বিশ্বনাথ: নয়াদিল্লিতে দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ‘জাতীয় আইন সম্পাদক’; দি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে ভাষান্তর ইফতেখারুল ইসলাম