আপনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে চলেছেন, কীভাবে বুঝবেন
Published: 27th, February 2025 GMT
২০২১ সালের হিসাব অনুযায়ী, দুনিয়ায় প্রায় ৭২ কোটি মানুষ প্রি–ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় জানা গেছে, ৮০ শতাংশই জানেন না যে তাদের প্রি–ডায়াবেটিস আছে। কোনো উপসর্গ না হওয়ায়, অধিকাংশের ক্ষেত্রে রক্ত পরীক্ষা ছাড়া এটি চিহ্নিত করা যায় না। তবে আগেই নির্ণয় করা গেলে ডায়াবেটিস থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা সম্ভব।
প্রি–ডায়াবেটিস কীসুস্থ–স্বাভাবিক একজনের রক্তে একটা নির্দিষ্ট মাত্রার গ্লুকোজ বা শর্করা থাকে। গাইডলাইন অনুযায়ী, রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা একটা নির্দিষ্ট ধাপ অতিক্রম করলে তাকে বলে ডায়াবেটিস। এই দুইয়ের মাঝামাঝি অবস্থাকে বলা হয় প্রি–ডায়াবেটিস। তার মানে যখন রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিক পর্যায়ের থেকে বেশি হয়, কিন্তু ডায়াবেটিসের নির্ধারিত মাত্রায় পৌঁছায় না, সে পর্যায়কে বলে প্রি–ডায়াবেটিস।
খাদ্যাভ্যাস, দৈনন্দিন জীবনধারা, বংশগত ত্রুটি, স্থূলতা—এসব কারণেই মূলত প্রি–ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেড়ে যায়। এসব কারণে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হয়ে যায়। ইনসুলিন আমাদের রক্তের গ্লুকোজকে স্বাভাবিক রাখে। এ ক্ষেত্রে ইনসুলিন থাকার পরও শরীরের অতিরিক্ত মেদ ইনসুলিনকে অকার্যকর করে রাখে।
আশার ব্যাপার হলো, প্রি–ডায়াবেটিস পর্যায়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিলে, যেমন খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, ব্যায়াম ও হাঁটাচলার অভ্যাস গড়ে তুললে এটি স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা যায়।
আরও পড়ুনডায়াবেটিস হঠাৎ বেড়ে গিয়ে মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে, কীভাবে জানেন০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪প্রি–ডায়াবেটিস নির্ণয়কয়েকটি পরীক্ষার মাধ্যমে প্রি–ডায়াবেটিস নির্ণয় করা যায়। যেমন—
১.
HbA1c পরীক্ষা
এটি এমন এক পরীক্ষা, যেটিতে বিগত দু-তিন মাসের গড় রক্তের গ্লুকোজ ইঙ্গিত করে। এর মাত্রা ৫.৭–৬.৪ শতাংশের মধ্যে হলে একে প্রি–ডায়াবেটিস বলা যায়।
২. খালি পেটে রক্তের গ্লুকোজ
আগের রাত থেকে খালি পেটে থেকে সকালে রক্তের গ্লুকোজ সুগার দেখা হয় এতে। রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা ৬.১–৭.০ মিলিমোলের মধ্যে হলে প্রি–ডায়াবেটিস হিসেবে ধরা হয়।
৩. গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট
এতে গ্লুকোজ খাওয়ার দুই ঘণ্টা পর গ্লুকোজের মাত্রা দেখা হয়। ৭.৮–১১.১–র মধ্যে থাকলে তা প্রি–ডায়াবেটিস হিসেবে বিবেচ্য।
উপসর্গসবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যাপার হলো প্রি–ডায়াবেটিসে বেশির ভাগ সময় কোনো উপসর্গই থাকে না। তবে কারও কারও ক্ষেত্রে কিছু লক্ষণ ও উপসর্গ দেখা যেতে পারে। যেমন—
ঘন ঘন পিপাসা ও প্রস্রাব।
দুর্বলতা ও ক্লান্তিবোধ।
চোখে ঝাপসা দেখা।
ওজনে পরিবর্তন (হ্রাস বা বৃদ্ধি)।
এ রকম কোনো লক্ষণ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে একজন চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
আরও পড়ুনডায়াবেটিস থেকে সুরক্ষার মূলমন্ত্র ১৫ নভেম্বর ২০২৪প্রি–ডায়াবেটিসে খাদ্যাভ্যাসে যেসব পরিবর্তন আনা উচিতপ্রোটিন–জাতীয় খাবার, যেমন মুরগির মাংস, ডিম, মাছ বেশি করে খেতে হবে।
শাকসবজি বেশি করে খেতে হবে। স্টার্চ–জাতীয় সবজি, যেমন আলু কম খেতে হবে বা পরিহার করতে হবে।
বাদাম, অলিভ ওয়েলের মতো তেল বা তেল–জাতীয় খাবার গ্রহণ করা যেতে পারে।
চিনি–জাতীয় খাবার, যেমন সোডা, মিষ্টান্ন খাবার কম খাওয়া উচিত।
সাদা ভাত, সাদা পাউরুটি , সাদা পাস্তার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স অনেক বেশি, মানে এসব গ্রহণ করলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায় খুব দ্রুত।
ওজন কমানোওজন কমানো প্রি–ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের একটি গুরুত্বপূর্ণ পন্থা। ওজন বেড়ে গেলে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স হয়ে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। ওজন কমালে মেদ কমে ইনসুলিনের কার্যক্ষমতা বেড়ে যায়।
হাঁটাচলা ও শরীরচর্চাগবেষণায় দেখা গেছে, সপ্তাহে অন্তত ১৫০ মিনিট বা তার বেশি হাঁটলে ও শরীরচর্চা করলে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়।
ওষুধপ্রয়োজন মনে করলে চিকিৎসকের পরামর্শে মেটফরমিন প্রি–ডায়াবেটিস পর্যায় থেকে ব্যবহার করা যায়। সেমাগ্লুটাইড বা জিএলপি ওয়ান এগোনিস্ট ব্যবহার করা হয় যাঁদের ওজন কমানো জরুরি।
ডা. সাইফ হোসেন খান, মেডিসিন কনসালট্যান্ট, পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ধানমন্ডি, ঢাকা
আরও পড়ুনকোনো উপসর্গ না থাকলেও ৪০ পেরোলে কেন ডায়াবেটিস পরীক্ষা করা প্রয়োজন১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইনস ল ন উপসর গ পর য য় পর ক ষ
এছাড়াও পড়ুন:
কালো পতাকার মানুষ
সব গমনাগমনে কি তৈরি পথ লাগে! আলো, হাওয়া, শব্দ নিজেরা পথ তৈরি করে ছুটে চলে দিগ্বিদিক, যাদের ধরার তারা ধরে ফেলে। শব্দ আসার সম্ভাব্য ক্ষীণ পথগুলো কাপড়ের টুকরা বা কাগজের দলা দিয়ে বন্ধ করতে থাকেন ‘আম্মা’। বিছানায় ছেলেমেয়েরা ঘুমাচ্ছে। ওরা এভাবে গাদাগাদি করে শুতে অভ্যস্ত নয়। বড় ছেলেদের ঘর আলাদা, তারা নিজ নিজ বিছানায় হাত–পা ছড়িয়ে ঘুমায়। মেয়ে দুটো ছোট, তারা মায়ের ঘরে শুলেও তাদের আলাদা খাট। কিন্তু বড় মেয়েটা ভীতু হওয়ায় ও প্রায় সময় মায়ের কাছে ঘুমায়। আজও সে ছটফট করছে। ওর জন্যই জানালার পাল্লার চিকন, ক্ষুদ্র, ফাঁকও বন্ধ করার চেষ্টা করছেন তিনি। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির ঝমঝমানি ছাপিয়ে বাইরের খানকাঘরের বারান্দার সামনের তর্জন–গর্জন আর আর্তনাদের মিহিন ছিটেফোঁটা নিশুতি রাতে দ্বিগুণ হয়ে ঘরে আসছে। সেসব শব্দে তীব্র আতঙ্কে বাচ্চা মেয়েটা কেবল চমকে চমকে উঠছে। সন্তানের জন্য আম্মা শব্দের পথ একটা একটা করে বন্ধ করে চলেছেন।
শহর থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী দিয়ে বাড়ি ভরা। এত এত ঘর, প্রতিটি ঘরে মানুষ, বিপন্ন মানুষ, যুদ্ধাক্রান্ত মানুষ। খাটে জায়গা হচ্ছে না বলে মেঝেতে বিছানা পাতা হয়েছে। আম্মারা নিজেরাও শহর ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে এসেছেন। এটি তাঁর শ্বশুরবাড়ি। বিশাল বড় বাড়ি। সারি সারি ঘর। অন্য সময়ে খালি পড়ে থাকলেও আজ এই চরম বিপর্যয়ের দিনে কাজে লাগছে। তাঁরা নিজেদের শোবার ঘর, বসার ঘর, পড়ার ঘর ছেড়ে দিয়ে নিজেরা একটি ঘরে কোনো রকমে থাকছেন।
তাঁর স্বামী এলাকার মান্যগণ্য প্রাজ্ঞ ব্যক্তি। তিনি ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, নানা মানুষের সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা। তাঁর বাড়িতে আশ্রয়ের জন্য মানুষ আসবে, এটাই স্বাভাবিক।
রাত বেড়ে গভীর হচ্ছে। চেয়ারম্যান সাহেব মেয়ের পাশে উদ্বিগ্ন আধশোয়া স্ত্রীকে বলেন, ‘দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, আমি বাইরে যাচ্ছি, কখন ফিরব ঠিক নেই।’
যুদ্ধের পুরো সময়টা ফেরার ঠিক নেই, খাওয়া, ঘুমের ঠিক নেই। এভাবেই কাটছে তাঁদের।
শহর থেকে পালিয়ে আসা শরণার্থী দিয়ে বাড়ি ভরা। খাটে জায়গা হচ্ছে না বলে মেঝেতে বিছানা পাতা হয়েছে। বিশাল বড় বাড়ি। সারি সারি ঘর। অন্য সময়ে খালি পড়ে থাকলেও আজ এই চরম বিপর্যয়ের দিনে কাজে লাগছে।২.বাড়িতে দিনের বেলা খানসেনারা আসে মুক্তির খোঁজে। চেয়ারম্যান সাহেব তাদের নানাবিধ কথা দিয়ে, ভালো খাবারদাবার দিয়ে তুষ্ট রাখার চেষ্টা করেন, শান্ত করে বিদায় দেন। রাতের অন্ধকারে সুপ্ত আতশবাজির মতো আসে মুক্তির ছেলেরা। চেয়ারম্যান সাহেব এবং বাড়ির আম্মা তাদের বুক দিয়ে সহায়তা দিতে চেষ্টা করেন। তারা খেয়েদেয়ে কিছু রসদ, কিছু পরামর্শ নিয়ে অন্ধকারে মিলিয়ে যায়। এসব কাজে পাশে থাকেন তাঁর স্ত্রী, সবাই যাঁকে ‘আম্মা’ বলে ডাকে। এভাবে সস্ত্রীক মানুষটি তাঁর নিজের এলাকা, এলাকার আতঙ্কিত মানুষগুলোকে রক্ষা করেন। যখন চারপাশের এলাকা যুদ্ধ নামক আগুনের করালগ্রাসে ভস্মীভূত হয়ে যাচ্ছে, তখন তাঁরা নিজেদের সবটুকু দিয়ে নিজ এলাকাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছেন প্রাণপণে।
মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আজ একজন স্থানীয় রাজাকারকে ধরে এনেছে। তারা বাইরের আঙিনায় সেই কুলাঙ্গারের বিচার করছে। বরাবরের মতো বিচারিক দায়িত্ব দিয়েছে বিজ্ঞ চেয়ারম্যান চাচাকে। আবার নিজেরাও শান্ত থাকতে না পেরে নানাবিধ শাস্তির কথা উল্লেখ করছে।
রাজাকারের নাম মকবুল। সে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষজনকে, এমনকি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কথা বলা মানুষদের ধরিয়ে দিত। আরেকটা কাজ সে নিষ্ঠার সঙ্গে করত, মিলিটারির হাতে নিহত মানুষদের শেষ সময়ে সবাইকে নিজের পেশাব খাওয়াত, সরাসরি মুখে পেশাব করে দিত। এ জন্য তার নাম হয়েছে ‘মুতিয়া মকবুল’। এ নাম পাওয়াতে সে এতই খুশি যে কেউ এ নামে ডাকলে খুশিতে খ্যাক খ্যাক করে হাসে। মনে হয় সে খান বাহাদুর উপাধি পেয়ে গেছে। আজ আর মুখে হাসি নেই।
জসিম স্টেনগানের নলটা মাথায় ঠেকিয়ে বলে, ‘দেই? ওই শালা হারামি দেই ট্রিগার টিপে?’ ঘোড়েল মকবুল আজ অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। ধরা সে পড়েছে কয়েক দিন আগে। লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। ধরা পড়ার পরপরই চাচার কাছে খবর যায়। তিনি জানিয়ে দেন, একেবারে মেরে না ফেলে শিক্ষা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায় কি না। তাঁর কড়া নির্দেশ—অহেতুক কোনো প্রাণ যেন নষ্ট না হয়। দুরন্ত ছেলেরা তাঁর নির্দেশ মেনে চলে।
তবে ছেলেরা মকবুলকে ভালো রকম শিক্ষা দিচ্ছে। মারধর তো করেছেই, ক্ষণে ক্ষণে গুলি করার হুমকি, এ ছাড়া খাবার, পানীয় কিছুই দেয়নি, ঠিক করেছে ওকে পানি দেওয়া হবে না। মিলিটারিরা এই বর্ষণমুখর রাতে আসবে না জেনে তারা এই বিচার বসিয়েছে। তাদের চাচা বাড়ি থেকে এখনো বের হননি। তিনি আসার আগেই ছেলেরা ওকে যা করার তা–ই করছে। হঠাৎ দেখা যায়, এক যুবক হনহন করে আসছে। এসে হিসহিস করে বলে, ‘খবরদার, এই কুত্তার বাচ্চাক গুলি কইরবা না। অরে আমি ধারালো ছুরি দিয়া কুচি কুচি কইরব। অরে পানি দেব না। অর মুখত মুতি দেব। শালা আমার ভাইয়ের মুখত মুতি দিছিল। পাকি কুত্তারা আমার ভাইটাকে গুলি করে ঝাঁঝরা করি দিছিল, আর এই হামার পড়শি, এই জানোয়ার, শেষ সময়ে তার মুখে মুতি দিছে।’
মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা আজ একজন স্থানীয় রাজাকারকে ধরে এনেছে। তারা বাইরের আঙিনায়। বরাবরের মতো বিচারিক দায়িত্ব দিয়েছে বিজ্ঞ চেয়ারম্যান চাচাকে। আবার নিজেরাও শান্ত থাকতে না পেরে নানাবিধ শাস্তির কথা উল্লেখ করছে।এই বলে সে মাটিতে থেবড়ে বসে হু হু করে কেঁদে ওঠে। আরও একবার সবাই ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে। মন্টু বলে ওঠে, ‘আরে এত কথায় কাজ কী, দেই শালাক শেষ করে। এই এক বালের জন্য এত সময় নষ্ট।’ সোহরাব ফিসফিস করে ওঠে, ‘এই চাচা আসতেছে।’ গুঞ্জন থেমে যায়। এর মধ্যেই একজন সর্বশক্তি দিয়ে একটা লাথি কষলে হাত বাঁধা মকবুল একদিকে কাত হয়ে পড়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে একজন ঘুষি মেরে সোজা করে দেয়, ‘হারামজাদা, সোজা হয়া বসি থাক।’
চেয়ারম্যান সাহেব এসে বসে সব কথা শোনেন। তিনি গম্ভীর স্বরে বলেন, ‘একে আমার সামনে থেকে নিয়ে যাও। তোমাদের যা ভালো মনে হয় তাই করো।’ তিনি এখন জানেন, এই গাদ্দার এলাকার নারীদের ক্যাম্পে নিয়ে গেছে, এলাকার তরুণ–যুবকদের ধরিয়ে দিয়েছে। যে বাড়ির ছেলেরা মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিয়েছে সে বাড়ির মানুষজনকে মিলিটারির কাছে ধরিয়ে দিয়েছে। এমনকি তার পড়শিকেও নানাভাবে যন্ত্রণা দিয়েছে, হেনস্তা করেছে। চেয়ারম্যান সাহেব ওর দিকে একটা ঘৃণার দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভেতরে চলে যান।
এবারে ছেলেরা চাপা উল্লাসে জেগে ওঠে। ওরা ওকে হাত বাঁধা অবস্থায় হাঁটিয়ে নিতে থাকে।
মকবুল ঘাড়ের ওপর প্রেশার কুকারের সিটির মতো মৃত্যুর গরম নিশ্বাস অনুভব করে। পানির তৃষ্ণায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে; কিন্তু এরা তো পানি দিচ্ছে না।
চেয়ারম্যান চাচার বাড়ির পেছন দিয়ে বয়ে গেছে একটি শান্ত নদী। পাড় দিয়ে অগণন বৃক্ষের সারি। সেখানে সবাই এসে হাজির হয়। বৃষ্টি থেমে গেছে। মেঘের আড়াল থেকে চাঁদ বের হয়ে এসেছে।
মকবুলের হাত বাঁধা ছিল। এবারে পা–ও বেঁধে ওকে পানির কিনারে বসিয়ে দেওয়া হয়। তার নড়াচড়া করার শক্তিও নেই, উপায়ও নেই। তবে খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। মনে মনে ভাবে, এরা কি একটু পানি দেবে না! আবার ভাবে, সে এত মানুষকে প্রস্রাব খাইয়েছে, কীভাবে এরা পানি দেবে।
একজন গলা তুলে বলে, ‘ফায়ার কিন্তু আমি করব।’ আরেকজন বলে ওঠে, ‘না, আমি ধরছি, ফায়ার আমি করব।’ আরেকটি কণ্ঠ শোনা যায়, ‘তার আগে হারামজাদার মুখটা কেউ তুলে ধর তো, আমি অর মুখত পেচ্ছাব করে দেই, তারপর গুলি না করে জবাই করা হোক।’
মকবুলের হাত বাঁধা। তার নড়াচড়া করার শক্তিও নেই, উপায়ও নেই। তবে খুব পানির পিপাসা পেয়েছে। মনে মনে ভাবে, এরা কি একটু পানি দেবে না! আবার ভাবে, সে এত মানুষকে প্রস্রাব খাইয়েছে, কীভাবে এরা পানি দেবে।মকবুল নিজের অবস্থা বুঝে কেঁপে কেঁপে ওঠে। এরা তো মারবেই। তা মরার সময় একটু পানিও খেতে পারবে না? ওর মনে পড়ে, ওরই বয়সের হামিদুলের কথা। হামিদুল মুক্তি। সে এসেছিল বাবা–মায়ের সঙ্গে দেখা করতে। সে নিজে মিলিটারি ডেকে এনে ধরিয়ে দিয়েছে। গুলি খেয়ে পড়ার পর হামিদুল পানি পানি করছিল। তখন সে লুঙ্গি তুলে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা খেলার সাথি হামিদুলের মুখে ছরছর করে প্রস্রাব করে দিয়েছিল। হামিদুল কী গভীরতর ঘৃণা নিয়ে ওর দিকে শেষবারের মতো তাকিয়েছিল।
আজ এরা ওকে প্রস্রাবই দেবে। কিন্তু বুকটা তো ফেটে যাচ্ছে। একটু পানি, হিমশীতল একটু পানি না খেলে হবে না। শরীরের প্রতিটি রন্ধ্রে পানির জন্য হাহাকার জেগে উঠছে। জিবটা শুকনা খড়ের মতো রুক্ষ হয়ে গেছে, ঠোঁট ফেটে গেছে, ভেতরে একটু থুথুও জমছে না। গলার ভেতরটা মরুভূমির বালুর মতো খসখসে, ঢোক গিলেতে গেলে কাঁটার মতো বিঁধছে। বুকের ভেতর হাহাকার করে ওঠে, এক ফোঁটা পানি, এক বিন্দু তরল যেন জীবনটাকে শীতল করে দিত। চোখ দুটো জ্বালা করতে থাকে, মাথার ভেতর হালকা ধোঁয়ায় ভরে যায়, ঘোর লাগে, মনে হয় এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দিলে জীবনের সব যন্ত্রণা মুছে যেত। পানির পিপাসা যে এমন, তা মকবুল আগে বোঝেনি।
সে গুঙিয়ে ওঠে, ‘ভাই রে, তোমার আল্লাহর দোহাই, আমাক এনা পানি দেও। আমাক গুলি করো, জবাই করো, কিন্তু এক ফোঁটা পানি আমাক দেও। আমাক দয়া করো, তোমার পাও ধরি একনা পানি দেও...’
বৃষ্টি থেমে গিয়ে মেঘের আড়াল থেকে চাঁদটা বেরিয়ে এসে সবার ওপর সমানভাবে জ্যোৎস্না ছড়াতে থাকে।
ঠিক সে সময় বাড়ির খাস কাজের লোক স্বচ্ছ কাচের জগ ভর্তি টলটলে পানি আর ঝকঝকে একটি গ্লাস নিয়ে এসে দাঁড়ায়। বলে, ‘আম্মা কয়া দিছে অরে পানি খাওয়াইতে। যা করমেন করেন, কিন্তক পানি খাওয়ান।’
মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ওদের মতোই আরেক যোদ্ধা এই আম্মাকে ভালোভাবে চেনে, জানে। আম্মা ঘরের ভেতর থেকে লড়াই করে যাচ্ছেন নানাভাবে। তারা সবাই থির হয়ে যায়। জগের গায়ে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা জমে ওঠে। সবার চোখ জগের দিকে।
মুতিয়া মকবুলের খড়খড়ে জ্বলুনি চোখেও কি পানি জমে! সে পানি ভরা চোখে জগটার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন একটা অপার্থিব দৃশ্য। সবার জোড়া জোড়া চোখের সামনে দৃশ্যটা একটা ঐশ্বরিক ফ্রেমে আটকা পড়ে।