দীর্ঘ সাত বছর পর বর্ধিত সভায় বসেছে বিএনপি। আসন্ন ভোটের জোর প্রস্তুতিতে চোখ রেখে তৃণমূল আর কেন্দ্রের নেতাদের নিয়ে বৃহস্পতিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হল প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী সভায় বসে দলটি। এতে যুক্তরাজ্য থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা ‍জিয়া দেশবাসীকে ঐক্যের ডাক দেন। এ সময় গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণে সকলকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি। 

লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি সভার সভাপতিত্ব করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দলের বিভিন্ন স্তরের সাড়ে তিন হাজার নেতা এই বর্ধিত সভায় অংশ নেন। 

উন্নত চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়া এখন আছেন লন্ডনে, ছেলে তারেক রহমানের কাছে। তবে তার জন্যও একটি চেয়ার সংরক্ষিত ছিল বিএনপির বর্ধিত সভার মঞ্চে। তিনিই এ সভার প্রধান অতিথি বলে মঞ্চ থেকে ঘোষণা করা হয়।

আরো পড়ুন:

জাতীয় নির্বাচন আগে দিতে হবে: রিজভী

সমালোচনা করব, কিন্তু সরকারকে ব্যর্থ হতে দেব না: রিজভী

পটপরিবর্তনের পর যে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণের সুযোগ এসেছে, সেই সুযোগ কাজে লাগাতে ভ্রাতৃত্বের ওপর গুরুত্বারোপ করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।

তিনি বলেছেন, “আপনাদের মাধ্যমে ছাত্র-যুবকসহ দেশবাসীর কাছে আহ্বান রাখতে চাই, আসুন প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ নয়, পারস্পরিক ভালোবাসা ও ভ্রাতৃত্বে মাধ্যমে আমরা সকলে মিলে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থেই একটি বাসযোগ্য উন্নত ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করি।”

তিনি বলেন, “বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ বিশেষ করে তরুণ সমাজ আজ এক ইতিবাচক গণতান্ত্রিক পরিবর্তনের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সংকীর্ণতা ভুলে দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের কাজ করতে হবে।

“এখনো ফ্যাসিস্টদের দোসররা এবং বাংলাদেশের শত্রুরা গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রাপ্ত অর্জনকে নস্যাৎ করার জন্য গভীর চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে।”

যুক্তরাজ্যে লন্ডন ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধায়নে ছেলে তারেক রহমানের বাসায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন খালেদা জিয়া। গত ৭ জানুয়ারি কুয়েতের আমিরের পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে লন্ডন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়। সেখানে কিছুদিন চিকিৎসার পর তাকে ছাড়পত্র দেয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

জনগণকে সম্পৃক্ত করে ‘ঐক্যবদ্ধ বিএনপি’ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, “আমি যুক্তরাজ্য থেকে অসুস্থ অবস্থায় আপনাদের আহ্বান জানাতে চাই, আসুন জনগণকে সম্পৃক্ত করে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে পূর্বের ন্যায় আন্দোলন, সংগ্রাম ও রাষ্ট্র পরিচালনার নেতৃত্ব প্রদানে আরো ঐক্যবদ্ধ ও সুসংহতভাবে গড়ে তুলি।”

বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণে পরামর্শ রেখে খালেদা বলেন, “ইস্পাত কঠিনে ঐক্যের মাধ্যমে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ওদের চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দিতে হবে, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য আমাদের সকলকে একযোগে কাজ করতে হবে।

“আসুন, আমরা আগামী দিনগুলোতে শহীদ জিয়াউর রহমানের স্বপ্নের আধুনিক সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ বিনির্মাণের জন্য আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করি এবং এতো ত্যাগের বিনিময় এই অর্জনকে সুসংহত এবং ঐক্যকে আরো বেগবান করি।”

বিএনপিপ্রধান বলেন, “দীর্ঘ ৬ বছর পর নেতৃবৃন্দ আবার একসাথে ফ্যাসিস্টমুক্ত বাংলাদেশে একত্রিত হয়েছে। সেজন্য আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া আদায় করছি। দীর্ঘ ফ্যাসিবাদীবিরোধী সংগ্রামে যারা শহীদ হয়েছে এবং সম্প্রতি জুলাই-আগস্টের ফ্যাসিবাদী শাসনের নির্মম ভয়াবহ দমননীতির কারণে গণহত্যায় যারা শহীদ হয়েছে, তাদের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। যারা আহত হয়েছেন, তাদের প্রতি জানাচ্ছি আন্তরিক সমবেদনা।

“আমি চিকিৎসার কারণে যুক্তরাজ্যে অবস্থান করলেও আমি সব সময় আপনাদের পাশেই আছি। দীর্ঘ ১৫ বছর গণতন্ত্রের জন্য, আমার মুক্তির জন্য আপনারা যে নিরন্তর সংগ্রাম করেছেন এবং আমাদের অসংখ্য সহকর্মী প্রাণ দিয়েছে, জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন এবং প্রায় সোয়া লাখ মিথ্যা মামলায় জর্জরিত হয়েছেন- এখনো তারা আদালতের বারান্দায় ন্যায়বিচার পাওয়ার আশায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। আপনাদের শুধু দল নয়, জাতি চিরকাল স্মরণ রাখবে।”

‘নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধ কাজ করুন’

সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেন, “দেশ আজ এক সংকট সময় অতিক্রম করছে। আপনাদের এবং ছাত্রদের সমন্বিত আন্দোলনের ফলে ফ্যাসিস্ট শাসকেরা বিদায় নিয়েছে। একটা অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাদের কাছে জনগণের প্রত্যাশা, রাষ্ট্র মেরামতের ন্যূনতম সংস্কার দ্রুত সম্পন্ন করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার জন্য সকলের কাছে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্পন্ন করা।”

নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “আমার অবর্তমানে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এবং আপনাদের সকলকে নিয়ে নিরন্তর কাজ করে দলকে সুসংহত করেছেন, এজন্য আমি আপনাদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি বিশ্বাস করি, আপনারা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আগামী নির্বাচনের জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবেন।

“এমন কোনো কাজ করবেন না, যাতে আপনাদের এতো দিনকার সংগ্রাম আত্মত্যাগ বিফলে যায়। আমাদের সবসময় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সেই উক্তি মনে রাখা দরকার- ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ’।”

খালেদা জিয়া যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন পাশে বসে ছিলেন তারেক রহমান। দলের চেয়ারপারসনের বক্তব্যের সময়ে নেতাকর্মীদের পিনপতন নীরবতার মধ্যে তাদের নেত্রীর কথা শুনতে দেখা যায়।

খালেদা জিয়ার বক্তব্য দেওয়ার আগে প্রধান অতিথি হিসেবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বক্তব্য রাখেন।

তিনি দলের চেয়ারপারসনের অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে বলেন, “বিএনপির সর্বশেষ বর্ধিত সভা হয়েছিল ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ‘মাদার অব ডেমোক্রেসি’ বেগম খালেদা জিয়া। ফ্যাসিবাদী শাসনকালে এরপর আর বিএনপির বর্ধিতসভা বা কাউন্সিল করা সম্ভব হয়নি।

“চিকিৎসাধীন থাকার সময় দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ সভায় উপস্থিত থাকতে পারেনি। তবে এই সভার সাফল্য কামনা করেছেন। তিনি আপনাদের কাছে দোয়া চেয়েছেন। দেশনেত্রী শারীরিক সুস্থতার জন্য আমরা আল্লাহর দরবারে দোয়া কামনা করছি।”

‘জাতীয় নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে প্রস্তুত করুন’

দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সুশৃঙ্খলভাবে নিজেদের মধ্যে ঐক্য ধরে জাতীয় নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে প্রস্তুত করতে নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেন দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

সাত বছর পর অনুষ্ঠিত বিএনপির বর্ধিত সভায় যোগ দিয়ে তিনি বলেছেন, “মাফিয়া প্রধানের (শেখ হাসিনা) পালানোর পর দেশে বর্তমানে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে এসেছে। জাতীয় নির্বাচনের সময় হয়ত ঘনিয়ে আসছে। তাই কোনো ব্যক্তি নয়, বরং দলকে এ ব্যাপারে ধীরে ধীরে আপনারা প্রস্তুত করুন।

“সারা দেশে বিএনপি এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সর্বস্তরের নেতাকর্মী-সমর্থক-শুভাকাঙ্ক্ষীদের প্রতি আমার আহ্বান- আপনারা শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকুন, আপনারা যেকোনো মূল্যে ঐক্যকে ধরে রাখুন।”

দেশবাসীর প্রতি বার্তায় তিনি বলেন, “বিএনপি শুধু আপনাদের ভোটের পুনরুদ্ধারই নয়, আপনাদের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে চায়। আপনাদের সমর্থন পেলে বিএনপি এমন একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যে সরকার আপনার কাছে, আপনাদের কাছে তথা দেশবাসীর কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবে। আমি বিএনপির পক্ষ থেকে জনগণের সমর্থন চাই, চাই সকলের সহযোগিতা।”

গণআন্দোলনে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়। রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ সেরে চলতি বছরের শেষ দিকে নির্বাচনের কথা বলছে অন্তর্বর্তী সরকার। দেড় দশকের বেশি সময় সরকার ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিও দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বৃহস্পতিবারের সভায় যোগ দিয়ে ভোটের গুরুত্ব নিয়ে কথা বলেন।

তিনি বলেন, “রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তার জন্য জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের কোনো বিকল্প নাই। রাষ্ট্র ও সমাজে জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার পূর্ব শর্ত হল, প্রতিটি নাগরিকের ভোট প্রয়োগের অধিকার বাস্তবায়ন। এজন্য রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি বারবার জনগণের ভোটে জনগণের কাছে দায়বদ্ধ সরকার প্রতিষ্ঠায় জাতীয় নির্বাচনের দাবি জানায়।”

‘নির্বাচন বিনষ্টের অপচেষ্টা চলছে’

রাষ্ট্র সংস্কার ও স্থানীয় নির্বাচনের মত বিষয়গুলো নিয়ে ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন তারেক রহমান। তিনি বলেন, “ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালানোর পর দেশে গণতন্ত্রকামী মানুষের সামনে বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের এক অপার সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত হয়েছে। একে নস্যাৎ করার জন্য ইতোমধ্যে চক্রান্ত শুরু হয়েছে। সুকৌশলে রক্ত পিছলে রাজপথে গড়ে উঠা জাতীয় ঐক্য এবং জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ বিনষ্টের অপচেষ্টা চলছে।

“জাতীয় ঐক্য ও জাতীয় নির্বাচনের পরিবেশ বিনষ্টের চক্রান্তের বিরুদ্ধে আমি আজ দেশের কৃষক-শ্রমিক-জনতা, আলেম-উলামা-পীর-মাশায়েক তথা সকল শ্রেণিপেশার মানুষকে…আপনারা যারা এখানে (বর্ধিত সভায় নেতাকর্মী) উপস্থিত হয়েছেন, আপনাদের প্রত্যেকের মাধ্যমে তাদের সতর্ক থাকার আহ্বান ও অনুরোধ জানাচ্ছি।”

তারেক বলেন, “যারা বাংলাদেশকে তাবেদার রাষ্ট্র বানিয়ে রাখতে চেয়েছিল তাদের ষড়যন্ত্র কিন্তু এখনও থামেনি। সংস্কার কিংবা স্থানীয় নির্বাচন এসব ইস্যু নিয়ে জনগণের মাঝে এক ধরনের ধূম্রজাল সৃষ্টি করা হচ্ছে।”

‘উপদেষ্টাদের বক্তব্য বিভ্রান্তিকর’

বিএনপির দ্রুত নির্বাচনের দাবির মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেসসচিবসহ অনেক উপদেষ্টা ভোট আয়োজনের সময় নিয়ে কথা বলেছেন। সরকারের তরফ থেকে চলতি বছরের শেষ দিকে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে।

তবে কোনো কোনো উপদেষ্টার বক্তব্যকে ‘বিভ্রান্তিমূলক’ বলে মনে করছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।

“বিভিন্ন সময়ে নির্বাচন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য জনমনে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করলেও জাতীয় নির্বাচন নিয়ে কোনো কোনো উপদেষ্টার বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য মন্তব্য স্বাধীনতা প্রিয় গণতন্ত্রকামী জনগণের জন্য হতাশার কারণও হয়ে উঠেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি বিএনপিসহ গণতন্ত্রের পক্ষের সকল রাজনৈতিক দলের নিঃশর্ত সমর্থন থাকলেও সরকার এখনো তাদের কর্ম পরিকল্পনায় অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে পারছে না বলে মনে হচ্ছে,” যোগ করেন তিনি।

জাতীয় নির্বাচনের পরে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের গুরুত্ব তুলে ধরে তারেক বলেন, “বর্তমান সরকার এখনো মনে হয় দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপরে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সরকার যেখানে বাজার পরিস্থিতি কিংবা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারছে না, সেখানে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের নামে কেন দেশের পরিস্থিতি আরো ঘোলাটে করতে চাইছে, এটি জনগণের কাছে বোধগম্য নয়।

“গণতন্ত্রকামী জনগণ মনে করেন, স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে সেটি হবে সারা দেশে পলাতক স্বৈরাচারের দোসরদের পুনর্বাসনের একটি প্রক্রিয়া, যা সরাসরি গণঅভ্যুত্থান আকাঙ্ক্ষাবিরোধী, গণহত্যাকারী, টাকা পাচারকারী দুর্নীতিবাজ মাফিয়া চক্রকে পুনর্বাসন প্রক্রিয়ার এই ফাঁদে বিএনপি পা দেবে না, বিএনপি পা দিতে পারে না।”

তিনি বলেন, “অন্তর্বতীকালীন সরকারের প্রতি আহ্বান, সারা দেশে গণহত্যাকারীদের দোসর মাফিয়া চক্রকে পুনর্বাসনের স্থানীয় সরকার নির্বাচনের পরিকল্পনা থেকে সরে আসুন। অবিলম্বে আগামী দিনগুলোর জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার রোডম্যাপ ঘোষণা করুন।”

‘নতুন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে স্বাগত জানাই’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা আসতে যাচ্ছে শুক্রবার। নতুন দল গঠনের বিষয়ে তারেক বলেন, “গণহত্যাকারী মাফিয়া প্রধান হাসিনা দেশ ছেড়ে পালানোর পর এ পর্যন্ত অনেকগুলো নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী বিএনপি সকল নতুন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে স্বাগত জানায়।

“তবে নির্বাচনের মাধ্যমে গ্রহণ কিংবা বর্জনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে জনগণ। সুতরাং প্রতিটি দলের অংশগ্রহণ একটি অবাধ সুষ্ঠু জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সবার আগে নির্বাচন কমিশনকে প্রস্তুত রাখতে হবে। দেশে একটি অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য নিরপেক্ষতাই হচ্ছে অন্তবর্তীকালীন সরকারের সবচেয়ে বড় পুঁজি। কিন্তু সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে ইতোমধ্যেই জনমনে সন্দেহ সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। নিজেদের নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে আমি বিএনপির পক্ষ থেকে অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রতি আরও সতর্কতা অবলম্বনের আহ্বান জানাই।”

বর্ধিত সভায় বিএনপি মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহ উদ্দিন আহমেদ, সেলিমা রহমান, হাফিজ উদ্দিন আহমেদ উপস্থিত ছিলেন। লন্ডন থেকে ভিডিও কলে যুক্ত হন স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য এজেডএম জাহিদ হোসেন।

এ ছাড়া, বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিল, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, মহানগর-জেলা-থানা-উপজেলা এবং পৌরসভা ইউনিটের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক, আহ্বায়ক ও সদস্য সচিবরা সভায় উপস্থিত ছিলেন। আরো ছিলেন দলের ১১টি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক এবং ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী এবং মনোনয়নপ্রত্যাশীরা।

‘কিছু কিছু ব্যক্তি–গোষ্ঠী ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে’

দেশে গণতন্ত্রকে বিঘ্নিত করতে একটি মহল চক্রান্ত করছে বলে মন্তব্য করেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ে অসন্তোষ জানিয়ে তিনি বলেছেন, ‘‘অর্থনীতির অবস্থা শোচনীয়। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হচ্ছে।’’

বিএনপির বর্ধিত সভায় দলের মহাসচিব বলেন, ‘‘আমরা ফ্যাসিবাদকে তাড়িয়েছি। শেখ হাসিনাকে তাড়িয়েছি। এখন অপেক্ষা করছি জনগণের যে আশা–আকাঙ্ক্ষা, বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের যে স্বপ্ন, আধুনিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ রূপান্তরিত করার, সেই গণতন্ত্রকে বিঘ্নিত করার জন্য, তাকে বাধা প্রধান করার জন্য একটি মহল, একটি গোষ্ঠী বিভিন্নভাবে চক্রান্ত শুরু করেছে। শেখ হাসিনা বিদেশে গিয়ে তিনি সেই চেষ্টা করছেন। বাইরে থেকেও চেষ্টা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে দেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থায়ও কিছু কিছু ব্যক্তি–গোষ্ঠী ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে।’’

অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘‘ক্রমান্বয়ে শিক্ষাঙ্গনগুলো, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার কোনো পরিবেশ থাকছে না। আরো মারাত্মকভাবে দেখছি, এই ভূখণ্ডে অবিভক্ত বাংলার যেসব বরেণ্য বিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, যাদের পূর্ব বাংলাদেশে জন্ম হয়েছে, তাদের নাম বাদ দিয়ে এখন কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো নাম পরিবর্তনের চেষ্টা করছে।’’

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘‘৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর ফ্যাসিস্ট হাসিনা পালিয়ে ভারতে যাওয়া পরে মানুষ আশা করেছিল দেশের অবস্থার পরিবর্তন হবে। অতিদ্রুত জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হবে। জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করে প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে দেখছি, এখনো সেই লক্ষ্যে আমরা সুস্পষ্ট কোনো নির্দেশনা পাচ্ছি না।’’

দলের নেতাকর্মীদের ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘‘১৫ বছর ধরে দলের নেতাকর্মীরা যে লড়াই করে আসছে, সেই লড়াইকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। এমন কিছু কাজ করা যাবে না, যাতে দলের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়। যাত্রা ব্যাহত হয়।’’

‘ফ্যাসিবাদ আ.

লীগের পতনের পর স্বস্তির পরিবেশ বিরাজ করছে’

ফ্যাসিবাদ আওয়ামী লীগের পতনের পর কিছুটা হলেও মুক্তি এবং স্বস্তির পরিবেশ বিরাজ করছে বলে মন্তব্য করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী। 
 
তিনি বলেছেন, ‘‘যারা এই ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনার বর্বরোচিত শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জানিয়েছিল, তাদের অনেকেই আমাদের কাছ থেকে হারিয়ে গেছে। এখনো তাদের কোনো হদিস মেলেনি।’’

‘‘কতজন আয়নাঘরে বন্দি ছিল, কতজন অসহ্য অত্যাচারের শিকার হয়েছেন, তারপর কোথায় তাদের ফেলে রাখা হয়েছে, এখনো পর্যন্ত তার হদিস পাওয়া যায়নি। কত নেতাকর্মী এবং দেশের নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ হারিয়ে গেছেন, তার অন্ত নেই। আমরা তাদের সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।’’

তিনি আরো বলেন, ‘‘দীর্ঘ রক্তের স্রোত ও আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশে আজ দলের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বর্ধিত সভার শুরুতেই বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে দলের প্রতিষ্ঠাতা ও মহান স্বাধীনতার ঘোষক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বীর বিক্রমকে। এদেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা, বাংলাদেশ বিনির্মাণ ও বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক ছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ন্যায়-নিষ্ঠা সততা এবং দেশপ্রেমের এক অনন্য ক্ষণজন্মা পুরুষ বীর মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান। যখনই গণতন্ত্র বিপন্ন হয়েছে, যখনই দেশ বিপন্ন হয়েছে, তখনই তিনি দেশের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে আপসহীন থেকে সংগ্রাম করেছেন।’’

বিএনপির এই নেতা বলেন, ‘‘গণতন্ত্রের প্রতীক গণতন্ত্রের মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আশু সুস্থতা কামনা করে ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পর্যায়ে যেসব নেতাকর্মী ও সমর্থকরা মারা গেছেন, তাদের সবাইকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে আজকের বর্ধিত সভায় শোক প্রস্তাব গ্রহণ করছি। এ ছাড়া, আমরা দেশের বরেণ্য নেতৃত্ব, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, বিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ, সুরকার, গীতিকারসহ যাদের হারিয়েছি, তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

এমন বড় পরিসরে বিএনপির সর্বশেষ যৌথ সভা হয়েছিল ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি, ঢাকার লো মেরিডিয়ান হোটেলে। সেই সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এর তিনদিন পরে ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার সাজায় তাকে কারাগারে যেতে হয়।

বর্ধিত সভার জন্য এলডি ভবনের সামনের মাঠে স্টিল অবকাঠামো দিয়ে তৈরি করা হয় সুসজ্জিত প্যান্ডেল। সভার মূল মঞ্চে বড় পর্দায় লন্ডন থেকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়ালি যুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আনুষ্ঠানিভাবে শুরু হয় সভার কার্যক্রম। তিনি সভাপতির আসন গ্রহণ করেন।

অনুষ্ঠানের শুরুতে কোরআন তেলাওয়াতের পর ‘ফ্যাসিস্ট’ সরকারের বিরুদ্ধে দীর্ঘ আন্দোলনে এবং ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে নিহতদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর শোক প্রস্তাব পাঠ করেন জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।

মঞ্চের এক পাশে দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান, চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রতিকৃতি বসানো হয়। সভার সঞ্চালনা করেন দলের যুগ্ম মহাসচিব শহিদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও কোষাধ্যক্ষ রসিদুজ্জামান মিল্লাত।

বিএনপির প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে ছাত্র-জনতার বিপ্লব পর্যন্ত দলের কার্যক্রমের ওপর তৈরি করা ‘প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ’ নামে একটি প্রামাণ্য চিত্র দেখানো হয় অনুষ্ঠানে।

মধ্যাহ্ন ভোজের পর তৃণমূল নেতারা সাংগঠনিক এবং বর্তমান পরিস্থিতির ওপর বক্তব্য রাখেন। টানা এই বর্ধিত সভায় অতিথিদের জন্য সকালের নাস্তা, দুপুরে খাবার, বিকালে স্ন্যাকের ব্যবস্থা রাখা হয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ছিল চা-কফির ব্যবস্থা।

বর্ধিত সভা উপলক্ষে সংসদ ভবনের বাইরে বিএনপির ৩১ দফা সংস্কার কর্মসূচিগুলো বড় প্ল্যাকার্ডের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়। সকাল সাড়ে ৮টা থেকে দূর-দূরান্ত থেকে আসা নেতারা আইডি কার্ড গলায় ঝুলিয়ে সভাস্থলে প্রবেশ করেন। সংসদ ভবনের প্রবেশমুখে অভ্যর্থনা কমিটির সদস্যরা গোলাপ-রজনী গন্ধা দিয়ে তাদের শুভেচ্ছা জানান। আমন্ত্রিত অতিথি ছাড়া বর্ধিত সভায় প্রবেশে কড়াকড়ি থাকায় বিপুল সংখ্যক কর্মী-সমর্থক সংসদ ভবনের বাইরে অবস্থান নেন।

ঢাকা/নাজমুল

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর ম র জ ফখর ল ইসল ম আলমগ র ব এনপ ত র ক রহম ন ত ক ল ন সরক র র গণত ন ত র ক ব গণতন ত র র প ন ত কর ম দ র কর ন ব এনপ অন ষ ঠ ন র র পর ব শ ব ব গম খ ল দ ব এনপ র প উপদ ষ ট র সরক র র প ন ব এনপ র র র জন য ত র জন য ন অন ষ ঠ র ন ত কর ন র জন য পর স থ ত আপন দ র ল ইসল ম উপস থ ত সরক র প য় সরক র জনগণ র গণহত য বল ছ ন ন য আম আম দ র ত হয় ছ কম ট র ত কর র কর ছ ন ক জ কর হয় ছ ন ন র পর র সময় স মরণ র ওপর স গঠন আগস ট গঠন র আপন র অবস থ গ রহণ ফখর ল সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

এরদোয়ান এই দফায় আন্দোলন মোকাবিলা করে টিকতে পারবেন তো?

বারো বছর আগে যখন কর্তৃপক্ষ ইস্তাম্বুলের গেজি পার্ক ধ্বংস করে সেখানে শপিং মল বানাতে যাচ্ছিল, তখন পার্কটিকে বাঁচাতে হাজার হাজার মানুষ ইস্তাম্বুলের রাস্তায় নেমেছিল। আমি সে সময় একটি লেখায় প্রশ্ন তুলেছিলাম: ‘তুরস্ক কেন বিদ্রোহ করছে?’

আর আজ মানুষ আবার রাস্তায় নেমেছে। তবে এবার কারণ ভিন্ন। তারা শুধু গাছ বা সবুজ জায়গার জন্য নয়, বরং বছরের পর বছর ধরে চলা আইনের অপব্যবহার ও কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করছে। তখনকার মতো এখনো তুরস্কের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধীরে ধীরে ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় মানুষের ক্ষোভ বেড়ে চলেছে।

স্থানীয় নির্বাচনে দু’বার ক্ষমতাসীন জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে (একেপি) পরাজিত করা নেতা ও ইস্তাম্বুলের মেয়র একরেম ইমামোগলুকে গত সপ্তাহে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে সেই দিন, যেদিন তিনি ২০২৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণার কথা ভাবছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ আনা হয়েছে। এই অভিযোগকে বিরোধীরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে প্রত্যাখ্যান করেছেন। অনেকের মতে, ইমামোগলু প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী। এ কারণে তাঁর এই আকস্মিক গ্রেপ্তার কাকতালীয় নয়।

ইমামোগলুর গ্রেপ্তারে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছে। ইস্তাম্বুল, আঙ্কারা, ইজমির, কোনিয়া, দিয়ারবাকিরসহ সারা দেশে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। লাখো মানুষের জন্য এটি শুধু একজন ব্যক্তি বা একটি রায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন নয়; বরং এটি পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থার বৈধতা হারানোর বিরুদ্ধে ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।

এখন তুরস্ক জুড়ে একটাই প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে—কর্তৃত্ববাদী শাসনের পতন কি আর রোধ করা সম্ভব হবে?

যারা ২০১৩ সালের গেজি আন্দোলন দেখেছেন, তাঁদের কাছে বর্তমান পরিস্থিতির চিত্র বেশ পরিচিত। রাস্তায় টিয়ার গ্যাস, শহরের কেন্দ্রে স্লোগান, আদালত ও বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে পুলিশ মোতায়েন—এগুলো আন্দোলনে সাধারণ দৃশ্য।

তবে এবার আন্দোলনের কেন্দ্রে রয়েছে অর্থনীতি। ২০১৩ সালে তুরস্ককে তখনও একটি সম্ভাবনাময় উদীয়মান অর্থনীতি হিসেবে দেখা হতো। প্রবৃদ্ধি ভালো ছিল, মুদ্রাস্ফীতি ৬ শতাংশের আশপাশে ছিল, এবং লিরার মান স্থিতিশীল ছিল।

একেপি সরকার তখনও ২০০০ সালের গোড়ার দিকে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) সমর্থিত সংস্কারের সুফল ভোগ করছিল এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন করেছিল।

কিন্তু সেই উজ্জ্বল চিত্র এখন ভেঙে পড়েছে। ২০২৫ সালে তুরস্কের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে গেছে, আর মুদ্রাস্ফীতি এখনো দুই অঙ্কের ঘরে রয়ে গেছে; যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি প্রচলিত অর্থনৈতিক নীতিতে ফিরে এসেছে।

বছরের পর বছর অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনার ফলে যে বৈদেশিক বিনিয়োগ হারিয়ে গিয়েছিল, তার কিছুটা গত বছর ফিরে আসতে শুরু করেছিল। কিন্তু ইমামোগলুর গ্রেপ্তারের পর বিনিয়োগকারীদের আস্থা আবার ধাক্কা খেয়েছে। লিরার মান ব্যাপকভাবে কমে গেছে, আর তুরস্কের ঝুঁকি সূচক বেড়ে গেছে।

২০১৩ সালের মতো, চলমান বিক্ষোভের গভীর বার্তাটি স্পষ্ট—অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্থিতিশীলতা একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আপনি যদি কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ে দক্ষ প্রযুক্তিবিদ নিয়োগ করেন, তবুও যদি বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত হয়, গণমাধ্যম স্তব্ধ করে দেওয়া হয়, এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চাপে রাখা হয়, তাহলে শুধু এই "দক্ষ লোকজন" যথেষ্ট নয়। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক ঝুঁকিকে অর্থনৈতিক ঝুঁকি হিসেবে বিবেচনা করে, যা মূলধনের ব্যয় বাড়িয়ে দেয়।

একটি গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখার জন্য শুধু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন ও দক্ষ প্রযুক্তিবিদ যথেষ্ট নয়। টেকসই গণতন্ত্রের ভিত্তি হলো শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান। যখন আইনের শাসন দুর্বল হয়ে যায়, ভিন্নমত দমন করা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও গণমাধ্যম স্বাধীনতা হারায়, তখন অর্থনীতিও ধসে পড়ে।

গণতন্ত্র খুব কম ক্ষেত্রেই এক মুহূর্তে ধ্বংস হয়। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিঃশেষের পথে এগিয়ে যায়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলা, বিরোধীদের কারাবন্দী করা বা নির্বাচন থেকে অযোগ্য ঘোষণা করা, প্রতিবাদকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ইত্যাদির মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র ধ্বংস করা হয়। তবে কবি ডিলান থমাসের কথা ধার করে বললে বলা যায়, তুরস্কের জনগণ দেখিয়ে দিচ্ছে, তারা এত সহজে স্বৈরাচারের অন্ধকারে তলিয়ে যাবে না।

ইমামোগলুর কারাবাস হয়তো সেই শেষ ধাক্কা হতে পারে। এটি তুরস্কের মানুষকে আরও বেশি ভাবিয়ে তুলেছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার মধ্যকার সম্পর্ক তারা এখন ভালোভাবেই বুঝতে পারছে।

ইমামোগলু শুধু একজন জনপ্রিয় মেয়র নন, তিনি রাজনৈতিক বহুত্ববাদ ও গণতন্ত্রের সম্ভাবনার প্রতীক হয়ে উঠেছেন। ইস্তাম্বুলের মেয়র নির্বাচনে তার টানা বিজয় জনগণের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করেছিল। কিন্তু এখন তার অপসারণ দেখিয়ে দিচ্ছে যে এরদোয়ানের সরকার সেই পরিবর্তন গণতান্ত্রিক উপায়ে ঘটতে দিতে চায় না।

এই মুহূর্তটি গেজি আন্দোলনের চেয়েও বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ এটি আরও বৃহৎ ও বৈচিত্র্যময় প্রতিরোধের প্রতিফলন। ২০১৩ সালের আন্দোলন মূলত ধর্মনিরপেক্ষ, শহুরে তরুণদের দ্বারা চালিত ছিল। কিন্তু আজকের বিক্ষোভ সামাজিক, প্রজন্মগত এবং মতাদর্শগত বিভাজন অতিক্রম করে এগিয়ে যাচ্ছে।

শিক্ষার্থী, শ্রমিক সংগঠনের সদস্য, ছোট ব্যবসায়ীরা, রক্ষণশীল তরুণেরা, উদারপন্থীরা, বয়স্করা এবং কুর্দিরা সবাই একসঙ্গে রাজপথে নেমেছে। তাদের একমাত্র স্লোগান: ‘হক, হুকুক, আদালেত’—অর্থাৎ ‘অধিকার, আইন, ন্যায়বিচার’।

আরও পড়ুনএরদোয়ানবিরোধী লড়াইয়ে তরুণেরা যেভাবে পথ দেখাচ্ছেন ১৭ ঘণ্টা আগে

তাদের ক্ষোভ কেবল ইমামোগলুকে ঘিরে নয়। তারা প্রতিবাদ করছে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ইচ্ছাকৃত অপব্যবহারের বিরুদ্ধে, যা ভিন্নমতকে অপরাধে পরিণত করছে এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যকে আরো দৃঢ় করছে।

যখন বিচার ব্যবস্থা রাজনৈতিক হয়ে যায়, তখন ভিন্নমতাবলম্বীরা দেশদ্রোহী বলে চিহ্নিত হন, আর যারা সরকারের অনুগত, তারা সুবিধা ভোগ করেন, বিপরীতে স্বাধীন কণ্ঠস্বরগুলো শাস্তি পায় এবং সমাজের প্রান্তে ঠেলে দেওয়া হয়।

কাঠামোগত সমস্যা (যেমন নারী হত্যা, শিক্ষা ব্যবস্থার বৈষম্য, তরুণদের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া) অবহেলিতই থেকে যায়, কারণ সরকারি সম্পদ ইতিহাস নতুনভাবে লেখার কাজে এবং সরকারের অনুগতদের পুরস্কৃত করতে ব্যয় করা হয়।

এটি শুধু তুরস্কের নাগরিকদের জন্য নয়, বরং দেশটির মিত্রদের জন্যও উদ্বেগের কারণ হওয়া উচিত, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। আসলে, এটি সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনের সঙ্গে কিছু মিল দেখিয়ে দেয়।

ইউরোপের অনেক গণতান্ত্রিক দেশ যেখানে ইমামোগলুর কারাবাসের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে, সেখানে ৮ কোটি ৫০ লাখ মানুষের এই ন্যাটো সদস্য রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধসে পড়ার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া অনেকটাই নীরব।

এর চেয়েও খারাপ হলো, গত এক দশকে তুরস্কে যা ঘটেছে, তার অনুরূপ ঘটনাগুলো এখন যুক্তরাষ্ট্রেও দেখা যাচ্ছে। ট্রাম্প প্রশাসন জ্ঞানের প্রতিষ্ঠানে, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর বারবার আঘাত হেনেছে। কারণ, উচ্চশিক্ষিত ভোটাররা সাধারণত বিরোধী দল, অর্থাৎ ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন করে, তাই একাডেমিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে একটি সহজ টার্গেটে পরিণত করা হয়েছে।

একাডেমিক স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ, বিজ্ঞানের অস্বীকৃতি এবং ষড়যন্ত্র তত্ত্ব প্রচারের যে ধারা তুরস্কে ২০১৩ সাল থেকে চলে আসছে, সেটি যুক্তরাষ্ট্রেও দেখা যাচ্ছে।

তুরস্ক এখনো সম্পূর্ণরূপে গণতন্ত্র হারায়নি। কিন্তু এটি ভয়ানকভাবে স্বৈরতন্ত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তারা প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের পথে ফিরবে নাকি স্বৈরতন্ত্রের দিকে আরও গভীর হবে, তা আগামী দিনের সিদ্ধান্তগুলোর ওপর নির্ভর করছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের এই পরিস্থিতির দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। শুধু তুরস্কের ভূরাজনৈতিক গুরুত্বের কারণে নয়, বরং কারণ দেশটির রাস্তায় ছাত্রদের সঙ্গে নিরাপত্তা বাহিনীর যে লড়াই চলছে, তা বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও তার শত্রুদের মধ্যকার সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি।

গণতন্ত্র খুব কম ক্ষেত্রেই এক মুহূর্তে ধ্বংস হয়। এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নিঃশেষের পথে এগিয়ে যায়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মামলা, বিরোধীদের কারাবন্দী করা বা নির্বাচন থেকে অযোগ্য ঘোষণা করা, প্রতিবাদকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া ইত্যাদির মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র ধ্বংস করা হয়।

তবে কবি ডিলান থমাসের কথা ধার করে বললে বলা যায়, তুরস্কের জনগণ দেখিয়ে দিচ্ছে, তারা এত সহজে স্বৈরাচারের অন্ধকারে তলিয়ে যাবে না।

শেবনেম কালেমলি-ওজকান ব্রাউন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতির অধ্যাপক এবং গ্লোবাল লিঙ্কেজ ল্যাবের পরিচালক।

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • এখনো ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে: আমীর খসরু
  • গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য কোনো ধরনের সংস্কার নয়: রুহুল কবির রিজভী
  • জনগণের স্বার্থে আঘাত এলে আবারও মাঠে নামবে বিএনপি: মির্জা ফখরুল
  • নোবেল শান্তি পুরষ্কারের জন্য মনোনয়ন পেলেন ইমরান খান
  • এরদোয়ান এই দফায় আন্দোলন মোকাবিলা করে টিকতে পারবেন তো?
  • রাষ্ট্র মেরামত জলে গেলে জনতা ছাড়বে না
  • সরি, এটা আপনাদের দায়িত্ব নয়: সংস্কার প্রশ্নে আমীর খসরু
  • দুবাইয়ে বিএনপির ইফতার: নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ গণতন্ত্র ফিরবে
  • গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর বিভাজন স্বৈরাচারের পুনরুত্থান ঘটাবে
  • গণতন্ত্রের নির্বিঘ্ন উত্তরণে বান কি মুনের সমর্থন চেয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস