‘প্রশাসনকে চাপ দাও, প্রক্টর অফিস ঘেরাও করো’
Published: 27th, February 2025 GMT
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) আলোচিত সেই ১০ শিক্ষার্থীর বহিষ্কারাদেশে এবার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রক্টরের উস্কানি প্রকাশ্যে এসেছে। বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর নুরুল হামিদ কানন ও অধ্যাপক ড. কোরবান আলীর এ ধরনের কিছু কথোপকথন ভাইরাল হয়েছে। এসব স্ক্রিনশটে ওই ১০ শিক্ষার্থীকে বহিষ্কার করতে ‘প্রশাসনকে চাপ’ প্রয়োগ করার জন্য একটি পক্ষকে উস্কে দিচ্ছেন এমন কথোপকথন দেখা গেছে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা শেখ হাসিনা হলের নামফলক ও হলের সামনে কংক্রিট নির্মিত নৌকা ভাঙতে গেলে ভাঙচুরকারীদের সঙ্গে বাকবিতন্ডা হয় ওই হলের শিক্ষার্থীদের। ছাত্রীদের অভিযোগ, তারা নৌকা ভাঙার বিপক্ষে নন; বরং প্রশাসন যেন এটি ভাঙে, সে দাবি করেছিলেন। এ জন্য তারা আগেই প্রশাসনকে চিঠি দিয়ে বিষয়টি জানিয়েছিলেন। তবে প্রশাসন সেটি ভাঙেনি। উল্টো মধ্যরাতে একদল শিক্ষার্থী সেটি ভাঙতে গিয়ে ছাত্রীদের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন। গালাগাল করেছে। বিভিন্ন কুরুচিপূর্ণ কথা বলেছে। এসব ঘটনায় হলের আবাসিক শিক্ষক ও প্রক্টরিয়াল বডিকে ফোন দিয়েও পাওয়া যায়নি।
এ ঘটনার প্রতিবাদে সেদিন রাতে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে প্রতিবাদ জানাতে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর ড.
তবে এই বহিষ্কারাদেশের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির হস্তক্ষেপ, শিক্ষার্থীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেওয়া ও তদন্তের যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার মতো বিভিন্ন অভিযোগ তুলে আন্দোলন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের দাবিতে নিয়মিত বিভিন্ন কর্মসূচিও পালন করছেন তারা। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষার্থীদের কুরুচিপূর্ণ মন্তব্যের জন্য প্রধান প্রক্টরের পদত্যাগের দাবিও তুলেছেন শিক্ষার্থীরা।
এসব ঘটনার মধ্যেই গতকাল বুধবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর নুরুল হামিদ কানন ও অধ্যাপক ড. কোরবান আলীর কিছু মেসেজের স্ক্রিনশট ভাইরাল হয়। বিভিন্ন পক্ষ ও নুরুল হামিদ কাননের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব স্ক্রিনশট ‘এডিটেড’ নয়। স্ক্রিনশটগুলো ঘটনার পর ৬ ফেব্রুয়ারি ভোর রাত, ৭ ফেব্রুয়ারি ও ১২ ফেব্রুয়ারির।
যেখানে দেখা যায়, অধ্যাপক ড. কোরবান আলী ঘটনাস্থলে উপস্থিত শেখ হাসিনা হলের কতিপয় শিক্ষার্থীদের তালিকা পাঠিয়েছেন। আরেক সহকারী প্রক্টর নূরুল হামিদ কানন একজন শিক্ষার্থীর জীবন বৃত্তান্তও পাঠিয়েছেন। আরও দুটি বার্তায় লেখা আছে, ‘তোমরা আগামীকাল কঠিন কর্মসূচি দাও। অন্তত যেন প্রাথমিক শাস্তি হিসেবে হল থেকে বের করে দেয়।’ ও ‘এদের বিরুদ্ধে শাস্তি নিতে প্রশাসনকে চাপ দাও। প্রক্টর অফিস ঘেরাও করো।’
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে প্রক্টর নুরুল হামিদ কাননকে ফোন করলে তিনি উক্ত মেসেজগুলো পাঠানোর প্রেক্ষাপট প্রতিবেদককে ব্যাখ্যা করেন। তবে কোনো মন্তব্য প্রকাশ করতে রাজি হননি।
এদিকে চবিতে এই বহিষ্কারের ঘটনায় সারা দেশে বিভিন্ন পক্ষের সমালোচনার মুখে ওই ১০ শিক্ষার্থীকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগের সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। স্থায়ী বহিস্কার হওয়া শিক্ষার্থীর সনদ বাতিলের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করা হয়েছে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে এখনও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হয়নি বলে জানিয়েছেন বহিষ্কৃতরা।
জানতে চাইলে বহিষ্কারের শিকার শিক্ষার্থী জান্নাতুল মাওয়া মিথিলা সমকালকে বলেন, ‘সিন্ডিকেট সভায় আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগের কথা বলা হলেও আমাদেরকে এখনও কোনো ফোনকল বা যোগাযোগ করা হয়নি। এ বিষয়টি যেন এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা তো এখনও কোনো বহিষ্কারাদেশের চিঠিও পাইনি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া কথোপকথনের বিষয়ে জান্নাতুল মাওয়া মিথিলা বলেন, ‘এটি দেখে খুবই মর্মাহত হয়েছি। এখানে একজন শিক্ষক আমাকে ব্যক্তিগতভাবে চিনেন। এছাড়াও তদন্ত প্রক্রিয়ায় প্রক্টরিয়াল বডির হস্তক্ষেপও খেয়াল করেছি। আমাদের বিরুদ্ধে শিক্ষকদের এ ধরনের উস্কানিমূলক কথা বার্তা ও আমাদেরকে প্রতিপক্ষ করে ফেলছেন দেখে বেশ খারাপ লেগেছে।’
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সড়কে রক্তের দাগ
ঈদের সময় সড়ক দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি সংক্রান্ত সংবাদপত্রের সাম্প্রতিক খবরগুলো বড় বেদনার। স্বাভাবিক সময়েই অনেক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে থাকে। শহীদ রওশনের মায়ের চোখের পানি এখনও শুকায়নি। ২০১৮ সালের সেই জুলাইয়ের সকালে তিনি তাঁর ছেলেকে স্কুলে পাঠিয়েছিলেন স্বপ্ন নিয়ে। ফিরে পেয়েছিলেন রক্তাক্ত দেহ। একটি বেপরোয়া বাসের চাকায় শুধু একটি প্রাণই নয়, একটি পরিবারের সব স্বপ্ন চূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
প্রতিদিন বাংলাদেশের সড়কে গড়ে ২২ জন প্রাণ হারান। প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে রয়েছে একটি পরিবারের অশ্রু আর অপূরণীয় ক্ষতি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, গত দশকে আমরা হারিয়েছি ৭৫ হাজার প্রাণ, যা একটি ছোট শহরের জনসংখ্যার সমান।
আমাদের সড়কগুলো যেন মৃত্যুর মিছিল চলার উন্মুক্ত প্রান্তর। প্রতি ১০০টি গাড়ির মধ্যে ৩৫টি মেয়াদোত্তীর্ণ। ৪০ শতাংশ চালক বিনা লাইসেন্সে গাড়ি চালায়। এর পেছনে রয়েছে জটিল নেটওয়ার্ক– দুর্নীতি, অদক্ষতা। সর্বোপরি আমাদের সামাজিক অবক্ষয়।
২০১৮ সালের ছাত্র আন্দোলন ছিল এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক জোরালো প্রতিবাদ। কিন্তু ছয় বছর পর আমরা কতটুকু এগিয়েছি? ডিজিটাল লাইসেন্সিং সিস্টেম চালু হয়েছে, কিন্তু অনেক আবেদনকারী এখনও
দালালের কারণে হয়রানির শিকার। আইন হয়েছে, কিন্তু প্রয়োগ দুর্বল।
আমাদের সমস্যা শুধু প্রযুক্তিগত নয়। এটি মূলত সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়। প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনার পেছনে রয়েছে সামাজিক অবক্ষয়ের ছাপ। আমরা যেখানে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নয়ন করছি, সেখানে আমাদের মানবিক মূল্যবোধ পিছিয়ে পড়ছে।
সরকারের নতুন উদ্যোগগুলোকে স্বাগত জানাই। পাশাপাশি আমাদের প্রয়োজন সামাজিক বিবেককে জাগ্রত করা। প্রত্যেক চালক যেন বুঝতে পারে, তার হাতে শুধু স্টিয়ারিং নয়, অসংখ্য প্রাণের দায়িত্বও রয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার গুরুত্বপূর্ণ। লাইসেন্স প্রদান থেকে শুরু করে গাড়ি পরিদর্শন– সর্বক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। শুধু সড়ক নয়, আমাদের প্রয়োজন একটি সমন্বিত যানবাহন ব্যবস্থা, যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে।
২০১৮ সালের সেই নিরাপদ সড়ক আন্দোলন আমাদের দেখিয়েছিল– পরিবর্তন সম্ভব। আজ আমাদের প্রয়োজন সেই চেতনাকে আবার জাগিয়ে তোলা। প্রতিটি প্রাণ অমূল্য, প্রতিটি দুর্ঘটনা অপ্রয়োজনীয়। রওশনের মায়ের মতো চোখের জল যেন আর কোনো মাকে ফেলতে না হয়। সড়কগুলো যেন আর না হয় কবরস্থান। এটি শুধু একটি স্বপ্ন নয়, অধিকার। আসুন,সবাই মিলে গড়ে তুলি এমন এক বাংলাদেশ, যেখানে সড়ক দুর্ঘটনা হবে অতীতে ঘটে যাওয়া করুণ ইতিহাস, যা বর্তমানে নেই।
মো. রাইসুল ইসলাম: স্বেচ্ছাসেবক, চট্টগ্রাম