জুলাই-আগস্টের গণ-আন্দোলন যখন তুঙ্গে, ঠিক তখনই হঠাৎ সারা দেশে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইন্টারনেটহীন সময়টায় সবচেয়ে বড় ধাক্কা লাগে ব্যাংকিং খাতে। অনলাইন লেনদেন বন্ধ থাকায় ব্যাহত হয় ব্যবসায়িক কার্যক্রম, পেমেন্ট প্রসেসিং থমকে যায়, গ্রাহকেরা জরুরি লেনদেন করতে না পেরে চরম দুর্ভোগে পড়েন। বিকাশ, নগদ বা রকেট কার্যত অচল হয়ে পড়ে।

শুধু তা–ই নয়, দেশের ই-কমার্স খাতও ভয়াবহ ক্ষতির মুখে পড়ে। ক্রেতারা অনলাইনে কেনাকাটা করতে না পারায় ব্যবসা বন্ধ হয়ে যায়, ক্ষতিগ্রস্ত হন হাজারো উদ্যোক্তা। সবচেয়ে করুণ অবস্থা হয় প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সারের, যাঁরা আন্তর্জাতিক কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

এককথায়, মোট ১১ দিন ধরে গোটা অর্থনীতি যেন স্তব্ধ হয়ে পড়ে। শহর থেকে গ্রাম—সর্বস্তরের মানুষকে এই ইন্টারনেট বিচ্ছিন্নতার জন্য চরম ভোগান্তি সহ্য করতে হয়। প্রযুক্তিনির্ভর বর্তমান বিশ্বে এমন সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক, সেটাই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।

অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর মানুষের মধ্যে একটি প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। যদি একান্ত প্রয়োজন দেখা দেয়, তবে ইন্টারনেট শাটডাউনের মতো চরম পদক্ষেপগুলো যেন নিয়মতান্ত্রিক স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় গ্রহণ করা হয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে, এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো আলোচনাও পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সংশোধিত টেলিযোগাযোগ আইন শিগগিরই অধ্যাদেশ আকারে আসার কথা। শোনা যাচ্ছে, সেখানেও ইন্টারনেট শাটডাউন করার বিষয়ে কিছু উল্লেখ পর্যন্ত করা হয়নি।

কর্তৃত্ববাদী সরকারের শৃঙ্খল ভেঙে দেশ এগিয়ে যাওয়ার মূল ভিত্তি হচ্ছে স্বচ্ছতা। এ বিষয়ে আমরা খুব সহজেই পৃথিবীর নানা দেশের উদাহরণ থেকে শিক্ষা নিতে পারি।

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল ইন্টারনেটের সহজলভ্যতাকে একটি মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। অর্থাৎ যথেচ্ছভাবে ইন্টারনেট বন্ধ করা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। প্রতিটি দেশের নিজস্ব আইনি বিধান রয়েছে। তার বেশির ভাগই নির্দিষ্ট কিছু অভিন্ন মূলনীতির ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। বিভিন্ন দেশের ইন্টারনেট বন্ধের উদাহরণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সরকার যত বেশি স্বেচ্ছাচারী হবে, এসব ক্ষেত্রে অস্বচ্ছ হওয়ার আশঙ্কা তত বেশি হবে।

এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ কীভাবে অনুমোদিত হবে, কোন প্রক্রিয়ায় তা গ্রহণ করা উচিত, এবং কারা ও কোন পরিস্থিতিতে এসব আদেশ দিতে পারবেন—এসব বিষয়ে আমাদের একটি সুস্পষ্ট ও কাঠামোবদ্ধ নিয়ম থাকা প্রয়োজন।

ভারতে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর, ১৯৭৩–এর ধারা ১৪৪ এবং টেম্পোরারি সাসপেনশন অব টেলিকম সার্ভিসেস রুলস, ২০১৭-এর ওপর ভিত্তি করে ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ জন্য কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারকে ২০১৭ বিধির অধীনে উপযুক্ত কারণ উল্লেখ করে এবং রাজ্য বা কেন্দ্রীয় পর্যায়ের যথাযোগ্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে লিখিতভাবে আদেশটি জারি করতে হবে। পরিস্থিতি জরুরি হলে কমপক্ষে একজন যুগ্ম সচিব পর্যায়ের কর্মকর্তা আদেশ জারি করতে পারেন, তবে অবশ্যই ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একটি কমিটি দ্বারা এর যৌক্তিকতা পর্যালোচনা করতে হবে।

সাইবারস্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন অব চায়না চীনে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ। সাইবার নিরাপত্তা আইন (২০১৭), রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা আইন এবং জাতীয় নিরাপত্তা আইন অনুসারে চীনের ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি পরিচালিত হয়। ‘দ্য গ্রেট ফায়ারওয়াল’ নামের চীনের কঠোর ইন্টারনেট সেন্সরশিপ ব্যবস্থা গুগল, ফেসবুক, টুইটারের মতো অনেক বিদেশি ওয়েবসাইট ও প্ল্যাটফর্মের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে রেখেছে। কর্তৃপক্ষ বিচার বিভাগীয় তদারকি ছাড়াই ওয়েবসাইট নিষিদ্ধ বা ইন্টারনেট বন্ধ করে দিতে পারে।

পাকিস্তানে ইন্টারনেট বন্ধ বা নিষিদ্ধকরণ কার্যকর করার কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ হলো পাকিস্তান টেলিকমিউনিকেশন অথরিটি। ইন্টারনেট বন্ধের আদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা প্রাদেশিক সরকার দ্বারা জারি করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে বিচার বিভাগীয় তদারকি খুবই সীমিত। এ ছাড়া আদালতের অনুমোদন ছাড়াই শাটডাউনের আদেশ দেওয়া যেতে পারে। অবশ্য অনেক ক্ষেত্রে ইন্টারনেট বন্ধের পরে বিষয়টি আদালতে উত্থাপন করা হয়েছে।

ইরানের ‘সুপ্রিম কাউন্সিল অব সাইবারস্পেস’ কম্পিউটার অপরাধ আইন (২০০৯)–এর অধীনে জাতীয় নিরাপত্তা বা ইসলামিক মূল্যবোধ রক্ষার জন্য ইন্টারনেট–সুবিধা নিষিদ্ধ বা সীমাবদ্ধ করতে পারে। প্রতিষ্ঠানটি দেশের শীর্ষনেতাদের সরাসরি তত্ত্বাবধানে ইন্টারনেট বন্ধের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়। ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্তে বিচার বিভাগীয় তত্ত্বাবধান খুবই কম এবং এসব সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার কোনো বালাই নেই বললেই চলে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যুদ্ধ বা জাতীয় জরুরি অবস্থার সময়ে ইলেকট্রনিক যোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ বা বন্ধ করতে পারেন। ১৯৩৪ সালের যোগাযোগ আইন (ধারা ৭০৬)-এর মাধ্যমে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে এ জরুরি ক্ষমতা প্রদান করা হয়। বিক্ষোভের মতো ঘটনা বা নিরাপত্তা হুমকির প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্রে ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। তবে অন্যান্য দেশের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার ঘটনা কম।

মিয়ানমারের টেলিযোগাযোগ আইন (২০১৩)-এর অধীন সরকার ইন্টারনেট পরিষেবা সীমিত বা স্থগিত করতে পারে। ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের সময়, সামরিক সরকার বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণ করতে এবং তথ্যের প্রবাহ সীমিত করতে ঘন ঘন ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়। সামরিক বা রাজনৈতিক নেতারা প্রায়ই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। এসব সিদ্ধান্তের স্বচ্ছতা বা বিচারিক পর্যালোচনা খুবই সামান্য।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে ভবিষ্যতে আর কখনো ইন্টারনেট বন্ধ হবে না—এমন আশা করা অবাস্তব। বিশেষ করে, কোনো নির্দিষ্ট এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকার স্বল্প সময়ের জন্য ইন্টারনেট বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তবে যদি ভবিষ্যতে কর্তৃপক্ষ আবারও ইন্টারনেট বন্ধের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চায়, তাহলে একটি আধুনিক ডিজিটাল সমাজের নাগরিক হিসেবে আমরা অবশ্যই একটি ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থার দাবি জানাব, যাতে রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধি বা ক্ষমতার অপব্যবহারের কোনো সুযোগ না থাকে।

এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ কীভাবে অনুমোদিত হবে, কোন প্রক্রিয়ায় তা গ্রহণ করা উচিত, এবং কারা ও কোন পরিস্থিতিতে এসব আদেশ দিতে পারবেন—এসব বিষয়ে আমাদের একটি সুস্পষ্ট ও কাঠামোবদ্ধ নিয়ম থাকা প্রয়োজন। সবচেয়ে কার্যকর উপায় হতে পারে, যদি হাইকোর্টের বেঞ্চ বা বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত একটি পর্যালোচনা কমিটিকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত অনুমোদনের ক্ষমতা দেওয়া হয়। অন্তর্বর্তী সরকার এ বিষয়ে একটি গেজেট প্রজ্ঞাপন জারি করতে পারে, যা পরবর্তী সংসদ দায়িত্ব গ্রহণের পর আইনে পরিণত হবে।

যদি ভবিষ্যতে আবারও ইন্টারনেট বন্ধ করার প্রয়োজন হয়, তবে বিষয়টি অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। যতটা সম্ভব সীমিত পরিসরে প্রয়োগ করতে হবে। অযৌক্তিকভাবে ইন্টারনেট শাটডাউন করলে তার ভয়াবহ পরিণতি কতটা গভীর হতে পারে, তা আমরা এরই মধ্যে প্রত্যক্ষ করেছি। তাই অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের দ্রুত ভবিষ্যতের জন্য উপযোগী ও সুসংগঠিত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

সাহেদ আলম টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: পর স থ ত এ ধরন র আম দ র অন ম দ র জন য সবচ য় সরক র ব যবস ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

জিআইপিএ’র সদস্য হলেন আজমীর তারেক

‘গ্লোবাল ইমপ্যাক্ট প্রডিউসার অ্যালায়েন্স’ (জিআইপিএ)-এর সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা আজমীর তারেক চৌধুরী। এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন এই চলচ্চিত্র নির্মাতা নিজেই।

জিআইপিএ একটি বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক, যেখানে বিশ্বের প্রভাবশালী প্রযোজকরা সামাজিক পরিবর্তনের লক্ষ্যে একত্রিত হন। চলচ্চিত্র ও গণমাধ্যমকে ব্যবহার করে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তনের কাজ করে এই প্ল্যাটফর্ম। এটি বিভিন্ন দেশ থেকে প্রভাবশালী প্রযোজকদের সংযুক্ত করে। পাশাপাশি প্রশিক্ষণ, সহায়তা ও কৌশলগত পরামর্শ প্রদান করে থাকে।

এই নেটওয়ার্কের অংশ হতে পেরে সম্মানিত বোধ করছেন আজমীর তারেক চৌধুরী। বাংলাদেশের গল্পগুলোকে বৈশ্বিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া এবং চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তনের অনুপ্রেরণা জাগানো তার লক্ষ্য। সদস্য পদ পাওয়ায় কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন আজমীর তারেক চৌধুরী।

আরো পড়ুন:

সস্ত্রীক অস্কারজয়ী অভিনেতার মরদেহ উদ্ধার

স্যার রুমে ডেকে নিয়ে প্রভা আপুর ভিডিও দেখায়: মিষ্টি জান্নাত

চলচ্চিত্র নির্মাতা ও সাংস্কৃতিক সংগঠক আজমীর তারেক চৌধুরী। চলচ্চিত্র, সংগঠন ও সামাজিক সচেতনতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে কাজ করছেন তিনি। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর কেন্দ্রীয় সংগঠক হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন আজমীর তারেক চৌধুরী। জহির রায়হান ফিল্ম ইনস্টিটিউটের আয়োজনে ‘মাতৃভাষার চলচ্চিত্র উৎসব’ ও ‘বৈচিত্র্যের ঐক্যতান’-এর অন্যতম সংগঠক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।

ঢাকা/শান্ত

সম্পর্কিত নিবন্ধ