বাংলা সংবাদপত্রের ভাষা: সাম্প্রতিক প্রবণতা
Published: 27th, February 2025 GMT
অধ্যাপক, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
‘সংবাদপত্রের ভাষা’ পরিভাষাটি খুবই প্রায়োগিক ও প্রাত্যহিক। এটি প্রায়োগিক কারণ এটি একটি দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত লিখিত ভাষাকে নির্দেশ করে। একইসঙ্গে এটি অবশ্যই প্রাত্যহিক। কেননা এই লিখিত রূপটি বিপুল আয়তনে প্রতিদিন মানুষের সামনে এসে হাজির হয় যা থেকে মানুষ দেশ-জাতি-রাষ্ট্র-সমাজ ও বিশ্বের রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি-ব্যবসা-বাণিজ্য-রোগবালাই ইত্যাদি সম্পর্কে সংবাদ লাভ করে।
সংবাদপত্রের ভাষা যেহেতু মানুষের মৌখিক রূপ নির্দেশ করে না, বরং তার লিখিত ভাষাচর্চার একটি অংশ, সেহেতু এটি শুধু অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণে ব্যবহৃত হয়। সে হিসেবে বলা যায়, দেশের বিপুলসংখ্যক নিরক্ষর মানুষের জন্য এই লিখিত ভাষারূপ কোনো অর্থই বহন করে না।
পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষার যত প্রাত্যহিক লিখিত রূপ আছে, তার মধ্যে সংবাদপত্রের ভাষার আকৃতি ও আওতা সর্ববৃহৎ। এটি বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও সত্যি। কারণ বাংলাদেশে মূলত বাংলা ভাষায় এবং কদাচিৎ অন্য আরও দু’একটি ক্ষুদ্র জনজাতির ভাষায় যেসব পত্রিকা, সাময়িকী প্রকাশিত হয়ে থাকে, তা সমগ্র বাংলাভাষার অন্য লিখিত রূপের তুলনায় শুধু আকৃতিতেই ব্যাপক না, বরং বিষয়চর্চার দিক থেকেও এটি বিশাল। কেননা একটি সংবাদপত্রে জাতির সামষ্টিক জীবনে ব্যবহৃত বহুবিধ বিষয়েরই সংবাদ পরিবেশিত হয়।
সংবাদপত্র আপামর সবশ্রেণির শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ স্বল্পশিক্ষিত কেরানি থেকে শুরু করে পণ্ডিত ও গবেষক অধ্যাপক সকল শ্রেণির মানুষই প্রতিদিনই সংবাদপত্র পাঠ করেন। ফলে সংবাদপত্রের ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর ভাষারূপ হতে হয় সহজ, সরল এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য, যাতে সবাই সংবাদপত্র পাঠ করে প্রয়োজনীয় অর্থ ও তথ্যটি উদ্ধার করতে পারেন। বিষয়টির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একটি সংবাদপত্রকে সবসময় ভাষার সাম্প্রতিক রূপটিকে নির্বাচন করতে হয়।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে গত দুই দশক ধরে সবগুলো জাতীয় দৈনিক চলিত বাংলাতেই সংবাদ প্রকাশ করে। তবে দুই দশক আগে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিক ইত্তেফাক সাধু রীতিকে অবলম্বন করলেও মানুষের আধুনিক রুচি এবং এর সহজ ভাবপ্রকাশ নিশ্চিত করা ও আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য সাধুরূপকে বাদ দিয়ে চলিত রূপে ফিরে এসেছে।
একটি দেশে জাতীয় ভাষা বা প্রধান ভাষার দুটি রূপ থাকে, যথা- প্রমিত রূপ বা মান রূপ এবং এর আঞ্চলিক রূপ বা উপভাষা। সংবাদপত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এর ভাষারূপকে অবশ্যই প্রমিত রূপ বা মান রূপ হতে হয়। কারণ সংবাদপত্রের উদ্দিষ্ট পাঠক হচ্ছে দেশের সর্ব অঞ্চলের শিক্ষিত পাঠক শ্রেণি।
এ ক্ষেত্রে একটি সংবাদপত্র যদি কোনো অঞ্চলের মানুষের আবেগ বা সংবেদনকে গুরুত্ব দিয়ে সে অঞ্চলের আঞ্চলিক রূপকে গ্রহণ করে, তাহলে দেশের অন্য অঞ্চলের মানুষেরা এ থেকে কোনো অর্থ উদ্ধার করতে পারবে না, বা সংবাদপত্রটির কোনো মাহাত্ম্য বা আভিজাত্যও থাকে না। সে কারণে বাংলা ভাষার প্রমিত রূপেই বাংলাদেশের সকল জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রকাশিত হয়ে থাকে। একই কারণে পৃথিবীর কোনো দেশেই ভাষার মান রূপকে বাদ দিয়ে নির্দিষ্ট আঞ্চলিক রূপ বা উপভাষায় কোনো সংবাদপত্র প্রকাশের নজির নেই।
এবারে আশা যাক বাংলা সংবাদপত্রের ভাষার বানানরীতির প্রসঙ্গে। আগেই বলা হয়েছে, সংবাদপত্রের ভাষা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ভাষাটির সবচেয়ে বৃহৎ আকৃতির লিখিত রূপ যেটি প্রতিদিন দেশের সর্বাধিক পাঠককে আকৃষ্ট করে থাকে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, সংবাদপত্রের ভাষায় ব্যবহৃত বানানরীতিটি হতে হবে সহজবোধ্য, সাম্প্রতিক রূপের এবং সর্বজনীনও বটে। প্রথমত, এর বানানরূপ হবে সহজবোধ্য এবং সাম্প্রতিক রূপের যাতে সবশ্রেণির পাঠক তাদের নিয়মিত ও সহজ বানানরূপটি দেখে তা থেকে অনায়াসে অর্থ উদ্ধার করতে পারেন। এছাড়া এর বানানরীতি হবে সর্বজনীন। অর্থাৎ দেশের প্রধান ভাষা সংস্থা দ্বারা স্থিরকৃত রূপকেই অবলম্বন করে থাকে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এদেশের সব জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকেই বাংলা একাডেমি প্রণীত বানাননীতি অনুসরণ করা উচিত। এতে বাংলা বানানের ঐক্য যেমন থাকে, তেমনি এই রূপটিই একসময় স্থিরকৃত হয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে কোন কোন জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা বাংলা একাডেমি প্রণীত বানাননীতি বাদ দিয়ে নিজস্ব প্রণীত বানাননীতি অনুসরণ করে। আপাতদৃষ্টে এতে কোনো দোষের নয়। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, এর ফলে বেশ কিছু বাংলা বানানের বিকল্পরূপ দাঁড়িয়ে যায়। এর ফলে পাঠকের দৃষ্টিতে তা যেমন অর্থ উদ্ধারে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি ঠিক কোন রূপটি প্রকৃত মান বানান হিসেবে স্বীকৃতি পাবে তা নিয়ে পাঠকের এক ধরনের ঝামেলা তৈরি হয়। এই বিষয়টিকে বলা হয়, পাঠকের বোধগত ঝামেলা। এই ধরনের বানানঘটিত বোধগত ঝামেলা যত বেশি ঘটতে থাকবে, ততই বাংলা ভাষার বানানে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে থাকবে। সেই বিষয়টি বিবেচনা করে বাংলাদেশের সকল জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকেরই বাংলা একাডেমি প্রণীত সর্বজনীন রূপটি অনুসরণ করা উচিত।
সংবাদপত্র প্রকৃত অর্থেই তথ্যের আধার। কারণ সংবাদপত্র দেশ-জাতি-রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে এত তথ্যে ভরপুর থাকে যে, পাঠককে একটি সংবাদপত্র পড়ে সেসব তথ্য বিষয়ে অবহিত হয়ে সহজেই এর অর্থ উদ্ধার করতে চায়। সেইসঙ্গে পাঠক একটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায় যে, যেন সংশ্লিষ্ট সংবাদটিতে প্রকৃত তথ্যই খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ কোনো ধরনের অতিরঞ্জিত বা মনোকল্পিত বিষয় নয়, বরং একটি বিষয়ে প্রকৃত অর্থেই যা ঘটেছে, পাঠক ঠিক সেই তথ্যটিই পেতে চায়। সে কারণে সংবাদপত্রের ভাষা ও বয়ানকে হতে হয় যথাসম্ভব বস্তুনিষ্ঠ।
মূলত ভাষারূপের মধ্যেই একটি সংবাদপত্রের বস্তুনিষ্ঠতার প্রাণভোমরা লুকায়িত থাকে। কিন্তু এর বিপরীতে কিছু সংবাদপত্র দেখা যায়, মূলত মালিকের অশুভ উদ্দেশ্য বা সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ভাবাদর্শ প্রচার করতে গিয়ে সংবাদপত্রের ঘটনাপ্রবাহকে তুলে ধরতে গিয়ে প্রায়শই উদ্দেশ্যমূলক শব্দ, পরিভাষা বা বাক্য সংযুক্ত করা হয়। এটিকে আমরা ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রকাশরূপ বলতে পারি। এ ধরনের ব্যক্তিনিষ্ঠ ভাষাসমৃদ্ধ সংবাদটি পড়ে মনে হয়, যেন পত্রিকাটি কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা দলের ডিকোর্সকে প্রচার করছে। এভাবে ব্যক্তিনিষ্ঠ ভাষাযুক্ত সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশের কিছু জাতীয় দৈনিক এবং ইউটিউব চ্যানেল মানুষকে বিভিন্ন অপতথ্য প্রদানের মাধ্যমে হলুদ সাংবাদিকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
সম্প্রতি আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের ফলে অতথ্য ও অপতথ্যযুক্ত শিরোনামযুক্ত সংবাদ এতই বেড়ে গিয়েছে যে, মানুষ এতে রীতিমত আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
সংবাদপত্রে সাংবাদিক বা রিপোর্টার যখন কোন বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন বা প্রতিবেদন তুলে ধরেন, তখন এতে দুটি অংশ পরিলক্ষিত হয়। একটি হচ্ছে সংবাদটির শিরোনাম, এবং অন্যটি এর বর্ণনাংশ। এই পর্যায়ে প্রথমেই সংবাদের শিরোনামের দিকে আলোকপাত করা যেতে পারে। একটি সংবাদের শিরোনাম কি রকম হওয়া উচিত? এ বিষয়ে সবাই অনায়াসে বলেন যে, সংবাদের শিরোনামটি হওয়া উচিত যথাসম্ভব সহজ, স্পষ্ট এবং আকর্ষণীয়। ‘সহজ ও স্পষ্ট’ বলতে শিরোনামটি এমন শব্দ বা পরিভাষা ব্যবহার করতে হবে, যাতে পাঠক সহজেই অর্থ উদ্ধার করতে পারে। সহজ ও স্পষ্ট করার জন্য যথাসম্ভব ক্রিয়াপদ বর্জন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম পাতার মূল শিরোনামটি উল্লেখ করা যেতে পারে- ‘অপরাধীরা বেপরোয়া, আতঙ্কে মানুষ’। এই শিরোনামটি পড়ে বাঙালি পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন যে, দেশে বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং মানুষ আতঙ্কে আছে। এই সংবাদের প্রতিবেদক শিরোনামটি লিখতে গিয়ে যৌক্তিকভাবেই দুটি ক্রিয়াপদ, যথা- ‘হয়ে উঠেছে’ এবং ‘আছে’ বাদ দিয়েছেন। এর ফলে নিশ্চয়ই বাংলাভাষী কোন পাঠকেরই এর অর্থ উদ্ধারে অসুবিধায় পড়তে হয় না।
এবারে আসা যাক, একটি শিরোনাম কীভাবে পাঠকের কাছে ‘আকর্ষণীয়’ হয়ে ওঠে। এই শর্ত পূরণ করতে গিয়ে প্রতিবেদক সংশ্লিষ্ট শিরোনামটি কি সরল বাক্যে লিখবেন, নাকি তাকে একটি রূপক বাক্যে পরিণত করবেন? এর উত্তরে বলা যায়, সংবাদপত্রের শিরোনামকে পাঠকের কাছে অধিকতর আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য একে সরলভাবে না লিখে বরং রূপকে পরিণত করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১২ সালের ২৪শে এপ্রিল দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদেও শিরোনাম ছিল, ‘অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে সিলেট’। এটি নিঃসন্দেহে একটি রূপক বাক্য, অতি সরল শিরোনাম নয়। যদি প্রতিবেদক এর শিরোনাম হিসেবে ‘সিলেটে আগুন জ্বলছে’ জাতীয় সরল বাক্য দিয়ে শিরোনামটি লিখতেন, তাহলে নিশ্চয়ই তা পাঠকের কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হতো না।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, সংবাদের শিরোনাম হিসেবে রূপক বাক্য লেখার জন্য সংবাদকর্মীকে কি ভাষা প্রশিক্ষণ নিতে হবে। অবশ্যই না। কারণ আধুনিককালের ভাষাবিজ্ঞানীরা বলছেন যে, ভাষা মাত্রই রূপকের সমষ্টি। শুধু কবি-সাহিত্যিকেরাই নয়, বরং সাধারণ মানুষও তাদের দৈনন্দিন ভাষিক প্রকাশে অসংখ্য রূপক বাক্য তৈরি করে থাকেন। এর সাথে সুর মিলিয়ে আমি বলতে পারি যে, দৈনিক আমার দেশের সংশ্লিষ্ট সংবাদকর্মী নিশ্চয়ই ওপরের শিরোনামটি লিখতে গিয়ে বিশেষ কোন ভাষা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেননি। বরং তিনি তার সহজাত ভাষিক প্রকাশের অংশ হিসেবেই এই ধরনের একটি আকর্ষণীয় রূপকধর্মী বাক্য তৈরি করেছেন।
শিরোনামের পর সংবাদের পরবর্তী অংশ হচ্ছে বর্ণনাংশটি। এই অংশেই মূলত পাঠক সংবাদের প্রকৃত তথ্যটি পেয়ে থাকেন। সে বিবেচনায় বর্ণনাংশের ভাষাও অবধারিতভাবে হতে হবে সরল, স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ। ভাষার প্রগলভতা প্রকাশের চেয়ে সংবাদকর্মী সত্যিকার উদ্দেশ্য হচ্ছে, পাঠককে সংবাদের ভেতরগত মেসেজটি পৌঁছে দেওয়া। এ ছাড়া কখনও কখনও সংবাদকর্মী বা প্রতিবেদক কোনো বড় প্রতিবেদনের বর্ণনাংশে, সংবাদপত্রের ভাষায় যাকে ‘ভিউজ’ বলা হয়, উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিজস্ব ভাবাদর্শ প্রচারে মেতে ওঠেন। ফলে পাঠক সংবাদটির বস্তুনিষ্ঠ অর্থ উদ্ধারের পরিবর্তে সংবাদপত্রের মালিকের রাজনৈতিক আদর্শের বয়ান পাঠ করেন। এ কারণে সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় এবং পাঠক সহজেই সংবাদপত্র সংশ্লিষ্ট সকলের রাজনৈতিক আদর্শ বা ভাবাদর্শ সম্পর্কে জেনে যায়। পরিণতিতে অচিরেই পত্রিকাটি পাঠকের কাছে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মুখপত্র রূপে পরিচিত হয় এবং জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামে।
ঢাকা/ফারুক/টিপু
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
সঞ্চয়পত্র বিক্রির চেয়ে পরিশোধে ব্যয় বাড়বে ১২০০০ কোটি টাকা
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট ঘাটতি মেটাতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি করে ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা নিট ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। মোট বিক্রি থেকে গ্রাহকের আগে কেনা সঞ্চয়পত্রের মেয়াদ পূর্তি এবং মেয়াদ শেষের আগে ভাঙানো বাবদ অর্থ পরিশোধ করে নিট ঋণের হিসাব করা হয়। হালনাগাদ পরিসংখ্যান বলছে, গত অর্থবছরের মতো এবারও নতুন বিনিয়োগের চেয়ে গ্রাহকদের পরিশোধ করতে হচ্ছে বেশি।
বিনিয়োগ প্রবাহ পর্যালোচনা করে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের প্রাক্কলন হচ্ছে, অর্থবছর শেষে নিট ঋণ দাঁড়াবে ঋণাত্মক ১২ হাজার কোটি টাকা। এর মানে, এ খাত থেকে সরকারের ঋণ কমে যাবে। যে পরিমাণ বিক্রি হবে, তার চেয়ে পরিশোধ করতে হবে বেশি। মূলত নতুন বিক্রির তুলনায় সঞ্চয়পত্রের নগদায়ন বেড়ে যাওয়ার কারণে পরিশোধ বেশি হওয়ায় এ খাত থেকে বাজেট ঘাটতি মেটাতে কোনো ঋণ পাবে না সরকার। উল্টো বাজেটের অন্য আয় থেকে ১২ হাজার কোটি টাকা শোধ করতে হবে।
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তর থেকে পাঠানো এক প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। নিরাপত্তা ও অধিক মুনাফার আশায় মানুষ সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে। কিন্তু কয়েক বছরের উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপ সামাল দিতে সুদ বেশি হওয়ার পরও সঞ্চয়পত্র কেনা কমিয়ে দিয়েছে মানুষ। এমনকি সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে ফেলার প্রবণতাও বেড়েছে।
সাবেক অর্থ সচিব মাহবুব আহমেদ সমকালকে বলেন, গত কয়েক বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতি সঞ্চয়পত্র ভাঙিয়ে ফেলা বা কম বিক্রি হওয়ার অন্যতম করণ হতে পারে। সুদহার বেশি হওয়ায় কয়েক বছর ধরেই এ খাত থেকে ঋণ কমিয়ে আনতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার। বর্তমানে ব্যাংকের তুলনায় সুদহার প্রায় সমান। তাছাড়া সরকারের রাজস্ব আয় কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ছে না। এমন পরিস্থিতিতে বাজেট ঘাটতি মেটাতে অর্থায়নের উৎস কমে যাওয়া কাম্য নয়। সঞ্চয়পত্র থেকে অর্থ পাওয়া না গেলে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ আরও বেড়ে যাবে। তখন বেসরকারি খাত ব্যাংক থেকে প্রয়োজন অনুযায়ী ঋণ পাবে না।
অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি অর্থবছরে মোট ৮৩ হাজার ৩৪০ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। এর মধ্যে আগে কেনা সঞ্চয়পত্রের পরিশোধ বাদ দিয়ে সরকারের নিট ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) মোট ৪৮ হাজার ৬১৫ কোটি বিক্রির লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বিক্রি হয়েছে ৩৬ হাজার ৪৬৩ কোটি টাকার। একই সময়ে গ্রাহকের আগে কেনা সঞ্চয়পত্রের নগদায়ন বাবদ ৪৩ হাজার ৪৭৬ টাকা পরিশোধ করতে হয়েছে। এ কারণে নিট বিক্রি দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক ৭ হাজার ১৩ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর পরিমাণ বেশি হওয়ায় নিট বিক্রি কমেছে। সঞ্চয়পত্র বিক্রিতেও নিম্নমুখী প্রবণতা রয়েছে। বিনিয়োগের এ ধারা অব্যাহত থাকলে অর্থবছর শেষে মোট ৬২ হাজার ৫০৮ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হতে পারে। একই সময়ে গ্রাহকের নগদায়নের পরিমাণ দাঁড়াবে ৭৪ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। জুন শেষে নিট বিক্রি দাঁড়াবে ঋণাত্মক ১২ হাজার ২২ কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি মেটাতে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন উৎস থেকে ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল সরকারের। দেশি উৎসের মধ্য থেকে ব্যাংক খাত থেকে ঋণ নেওয়ার অঙ্ক বেশি। সঞ্চয়পত্র থেকে নিট ঋণ ঋণাত্মক হওয়ায় ব্যাংকের দিকে বেশি ঝুঁকতে হচ্ছে। এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, তিন-চার বছর আগে ব্যাংক ঋণের চেয়ে সঞ্চয়পত্রে সুদ বেশি হওয়ায় বাজেট ঘাটতি মেটাতে এর ওপর নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ নেয় সরকার। আইএমএফও চেয়েছিল সঞ্চয়পত্রে সরকারকে প্রতিবছর যে সুদ গুনতে হয়, তা কমে আসুক। এখন ব্যাংকে আমানতের সুদহার বেড়েছে। ফলে সঞ্চয়পত্র থেকে কিছু অর্থ এলে সরকারের বাজেট ঘাটতি মেটাতে সুবিধা হতো।
গত কয়েক বছর বিশ্বব্যাপী উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক ঋণে সুদহার বাড়িয়েছে বিভিন্ন দেশ। বাংলাদেশও সুদের হার বাড়িয়েছে। এ ছাড়া সরকার ট্রেজারি বিল এবং বন্ড বিক্রি করে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে যে ঋণ নেয়, সেখানেও সুদহার বেড়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা সঞ্চয়পত্রের চেয়েও বেশি। সরকারের ট্রেজারি বিল ও বন্ডে ব্যাংকের মাধ্যেম ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়ছে, যা সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে পাঁচ বছর মেয়াদি বন্ডে সুদহার ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। গত ফেব্রুয়ারির আগ পর্যন্ত তা ছিল ১২ শতাংশের ওপরে। ২ বছর মেয়াদি বন্ডের সুদহার ফেব্রুয়ারির আগে ছিল প্রায় সাড়ে ১২ শতাংশ। অথচ গত জানুয়ারির আগ পর্যন্ত পাঁচ বছর মেয়াদি সঞ্চয়পত্রে সুদ ছিল ১১ দশমিক ২৮ শতাংশ। আর তিন বছর মেয়াদে তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্রে সুদহার ছিল ১১ দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ। তাছাড়া সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে কর থাকলেও বিল-বন্ডে বিনিয়োগে কোনো ধরনের কর দিতে হয় না। সুদহারে সামঞ্জস্য আনতে গত জানুয়ারি থেকে পাঁচ ধরনের সঞ্চয়পত্রে সুদহার প্রায় ১ শতাংশ হারে বাড়িয়েছে সরকার। সার্বিক বিবেচনায় বিক্রি বাড়াতে এর আগেও বিভিন্ন সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগে বেশ কিছু বিধিনিষেধও কমিয়ে আনা হয়েছে।
প্রতিবেদনে সঞ্চয়পত্রে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ও সংস্কার কার্যক্রমের উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ১১টি জাতীয় সঞ্চয় স্কিমের মধ্যে ৯টির লেনদেন কার্যক্রম ‘জাতীয় সঞ্চয় স্কিম অনলাইন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’-এর মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে। গত ১৫ জানুয়ারি পাঁচটি সঞ্চয় স্কিমের মুনাফার হার বাড়ানো হয়েছে। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে জাতীয় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের প্রথম স্ল্যাবে সাড়ে ৭ লাখ টাকা পর্যন্ত প্রিমিয়াম হারে সুদ দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠান ব্যতীত ব্যক্তি পর্যায়ের সব সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে মেয়াদ শেষে পুনর্বিনিয়োগ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। পেনশনার সঞ্চয়ত্রে মুনাফা তিন মাসের পরিবর্তে প্রতি মাসে দেওয়া হচ্ছে। সুবিধা বাড়লেও পুনর্বিনিয়োগ হচ্ছে খুব কম। সে তুলনায় মেয়াদের আগেই ভাঙানোর প্রবণতা বেশি।
অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডের বিনিয়োগসীমা প্রত্যাহার করা হয়েছে। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্র ও ডাকঘর সঞ্চয় ব্যাংকে মেয়াদি হিসাবের পুনর্বিনিয়োগ সুবিধা ফের চালু করা হয়েছে। বিদেশি মালিকানাধীন শিপিং বা এয়ারওয়েজ কোম্পানির বিদেশে অফিসে কর্মরত অনিবাসী বাংলাদেশি মেরিনার, পাইলট এবং কেবিন ক্রুদের ওয়েজ আর্নার ডেভেলপমেন্ট বন্ডে বিনিয়োগ করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতির ভিত্তিতে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়াতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার সুপারিশও করেছে অধিদপ্তর।