বাংলা সংবাদপত্রের ভাষা: সাম্প্রতিক প্রবণতা
Published: 27th, February 2025 GMT
অধ্যাপক, যোগাযোগ বৈকল্য বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
‘সংবাদপত্রের ভাষা’ পরিভাষাটি খুবই প্রায়োগিক ও প্রাত্যহিক। এটি প্রায়োগিক কারণ এটি একটি দেশের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত লিখিত ভাষাকে নির্দেশ করে। একইসঙ্গে এটি অবশ্যই প্রাত্যহিক। কেননা এই লিখিত রূপটি বিপুল আয়তনে প্রতিদিন মানুষের সামনে এসে হাজির হয় যা থেকে মানুষ দেশ-জাতি-রাষ্ট্র-সমাজ ও বিশ্বের রাজনীতি-অর্থনীতি-সংস্কৃতি-ব্যবসা-বাণিজ্য-রোগবালাই ইত্যাদি সম্পর্কে সংবাদ লাভ করে।
সংবাদপত্রের ভাষা যেহেতু মানুষের মৌখিক রূপ নির্দেশ করে না, বরং তার লিখিত ভাষাচর্চার একটি অংশ, সেহেতু এটি শুধু অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণে ব্যবহৃত হয়। সে হিসেবে বলা যায়, দেশের বিপুলসংখ্যক নিরক্ষর মানুষের জন্য এই লিখিত ভাষারূপ কোনো অর্থই বহন করে না।
পৃথিবীতে বিভিন্ন ভাষার যত প্রাত্যহিক লিখিত রূপ আছে, তার মধ্যে সংবাদপত্রের ভাষার আকৃতি ও আওতা সর্ববৃহৎ। এটি বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেও সত্যি। কারণ বাংলাদেশে মূলত বাংলা ভাষায় এবং কদাচিৎ অন্য আরও দু’একটি ক্ষুদ্র জনজাতির ভাষায় যেসব পত্রিকা, সাময়িকী প্রকাশিত হয়ে থাকে, তা সমগ্র বাংলাভাষার অন্য লিখিত রূপের তুলনায় শুধু আকৃতিতেই ব্যাপক না, বরং বিষয়চর্চার দিক থেকেও এটি বিশাল। কেননা একটি সংবাদপত্রে জাতির সামষ্টিক জীবনে ব্যবহৃত বহুবিধ বিষয়েরই সংবাদ পরিবেশিত হয়।
সংবাদপত্র আপামর সবশ্রেণির শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর জন্য প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ স্বল্পশিক্ষিত কেরানি থেকে শুরু করে পণ্ডিত ও গবেষক অধ্যাপক সকল শ্রেণির মানুষই প্রতিদিনই সংবাদপত্র পাঠ করেন। ফলে সংবাদপত্রের ভাষার প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এর ভাষারূপ হতে হয় সহজ, সরল এবং সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য, যাতে সবাই সংবাদপত্র পাঠ করে প্রয়োজনীয় অর্থ ও তথ্যটি উদ্ধার করতে পারেন। বিষয়টির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে একটি সংবাদপত্রকে সবসময় ভাষার সাম্প্রতিক রূপটিকে নির্বাচন করতে হয়।
উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশে গত দুই দশক ধরে সবগুলো জাতীয় দৈনিক চলিত বাংলাতেই সংবাদ প্রকাশ করে। তবে দুই দশক আগে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় দৈনিক ইত্তেফাক সাধু রীতিকে অবলম্বন করলেও মানুষের আধুনিক রুচি এবং এর সহজ ভাবপ্রকাশ নিশ্চিত করা ও আধুনিকতার সঙ্গে তাল মেলানোর জন্য সাধুরূপকে বাদ দিয়ে চলিত রূপে ফিরে এসেছে।
একটি দেশে জাতীয় ভাষা বা প্রধান ভাষার দুটি রূপ থাকে, যথা- প্রমিত রূপ বা মান রূপ এবং এর আঞ্চলিক রূপ বা উপভাষা। সংবাদপত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এর ভাষারূপকে অবশ্যই প্রমিত রূপ বা মান রূপ হতে হয়। কারণ সংবাদপত্রের উদ্দিষ্ট পাঠক হচ্ছে দেশের সর্ব অঞ্চলের শিক্ষিত পাঠক শ্রেণি।
এ ক্ষেত্রে একটি সংবাদপত্র যদি কোনো অঞ্চলের মানুষের আবেগ বা সংবেদনকে গুরুত্ব দিয়ে সে অঞ্চলের আঞ্চলিক রূপকে গ্রহণ করে, তাহলে দেশের অন্য অঞ্চলের মানুষেরা এ থেকে কোনো অর্থ উদ্ধার করতে পারবে না, বা সংবাদপত্রটির কোনো মাহাত্ম্য বা আভিজাত্যও থাকে না। সে কারণে বাংলা ভাষার প্রমিত রূপেই বাংলাদেশের সকল জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিক পত্রিকাগুলো প্রকাশিত হয়ে থাকে। একই কারণে পৃথিবীর কোনো দেশেই ভাষার মান রূপকে বাদ দিয়ে নির্দিষ্ট আঞ্চলিক রূপ বা উপভাষায় কোনো সংবাদপত্র প্রকাশের নজির নেই।
এবারে আশা যাক বাংলা সংবাদপত্রের ভাষার বানানরীতির প্রসঙ্গে। আগেই বলা হয়েছে, সংবাদপত্রের ভাষা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ভাষাটির সবচেয়ে বৃহৎ আকৃতির লিখিত রূপ যেটি প্রতিদিন দেশের সর্বাধিক পাঠককে আকৃষ্ট করে থাকে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, সংবাদপত্রের ভাষায় ব্যবহৃত বানানরীতিটি হতে হবে সহজবোধ্য, সাম্প্রতিক রূপের এবং সর্বজনীনও বটে। প্রথমত, এর বানানরূপ হবে সহজবোধ্য এবং সাম্প্রতিক রূপের যাতে সবশ্রেণির পাঠক তাদের নিয়মিত ও সহজ বানানরূপটি দেখে তা থেকে অনায়াসে অর্থ উদ্ধার করতে পারেন। এছাড়া এর বানানরীতি হবে সর্বজনীন। অর্থাৎ দেশের প্রধান ভাষা সংস্থা দ্বারা স্থিরকৃত রূপকেই অবলম্বন করে থাকে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, এদেশের সব জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকেই বাংলা একাডেমি প্রণীত বানাননীতি অনুসরণ করা উচিত। এতে বাংলা বানানের ঐক্য যেমন থাকে, তেমনি এই রূপটিই একসময় স্থিরকৃত হয়ে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে কোন কোন জনপ্রিয় জাতীয় দৈনিকের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তারা বাংলা একাডেমি প্রণীত বানাননীতি বাদ দিয়ে নিজস্ব প্রণীত বানাননীতি অনুসরণ করে। আপাতদৃষ্টে এতে কোনো দোষের নয়। কিন্তু গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যায়, এর ফলে বেশ কিছু বাংলা বানানের বিকল্পরূপ দাঁড়িয়ে যায়। এর ফলে পাঠকের দৃষ্টিতে তা যেমন অর্থ উদ্ধারে বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তেমনি ঠিক কোন রূপটি প্রকৃত মান বানান হিসেবে স্বীকৃতি পাবে তা নিয়ে পাঠকের এক ধরনের ঝামেলা তৈরি হয়। এই বিষয়টিকে বলা হয়, পাঠকের বোধগত ঝামেলা। এই ধরনের বানানঘটিত বোধগত ঝামেলা যত বেশি ঘটতে থাকবে, ততই বাংলা ভাষার বানানে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে থাকবে। সেই বিষয়টি বিবেচনা করে বাংলাদেশের সকল জাতীয় ও আঞ্চলিক দৈনিকেরই বাংলা একাডেমি প্রণীত সর্বজনীন রূপটি অনুসরণ করা উচিত।
সংবাদপত্র প্রকৃত অর্থেই তথ্যের আধার। কারণ সংবাদপত্র দেশ-জাতি-রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে এত তথ্যে ভরপুর থাকে যে, পাঠককে একটি সংবাদপত্র পড়ে সেসব তথ্য বিষয়ে অবহিত হয়ে সহজেই এর অর্থ উদ্ধার করতে চায়। সেইসঙ্গে পাঠক একটি বিষয়ে নিশ্চিত হতে চায় যে, যেন সংশ্লিষ্ট সংবাদটিতে প্রকৃত তথ্যই খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থাৎ কোনো ধরনের অতিরঞ্জিত বা মনোকল্পিত বিষয় নয়, বরং একটি বিষয়ে প্রকৃত অর্থেই যা ঘটেছে, পাঠক ঠিক সেই তথ্যটিই পেতে চায়। সে কারণে সংবাদপত্রের ভাষা ও বয়ানকে হতে হয় যথাসম্ভব বস্তুনিষ্ঠ।
মূলত ভাষারূপের মধ্যেই একটি সংবাদপত্রের বস্তুনিষ্ঠতার প্রাণভোমরা লুকায়িত থাকে। কিন্তু এর বিপরীতে কিছু সংবাদপত্র দেখা যায়, মূলত মালিকের অশুভ উদ্দেশ্য বা সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক ভাবাদর্শ প্রচার করতে গিয়ে সংবাদপত্রের ঘটনাপ্রবাহকে তুলে ধরতে গিয়ে প্রায়শই উদ্দেশ্যমূলক শব্দ, পরিভাষা বা বাক্য সংযুক্ত করা হয়। এটিকে আমরা ব্যক্তিনিষ্ঠ প্রকাশরূপ বলতে পারি। এ ধরনের ব্যক্তিনিষ্ঠ ভাষাসমৃদ্ধ সংবাদটি পড়ে মনে হয়, যেন পত্রিকাটি কোন নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা দলের ডিকোর্সকে প্রচার করছে। এভাবে ব্যক্তিনিষ্ঠ ভাষাযুক্ত সংবাদ প্রচারের মাধ্যমে বর্তমানে বাংলাদেশের কিছু জাতীয় দৈনিক এবং ইউটিউব চ্যানেল মানুষকে বিভিন্ন অপতথ্য প্রদানের মাধ্যমে হলুদ সাংবাদিকতা ছড়িয়ে দিচ্ছে।
সম্প্রতি আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান ও রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের ফলে অতথ্য ও অপতথ্যযুক্ত শিরোনামযুক্ত সংবাদ এতই বেড়ে গিয়েছে যে, মানুষ এতে রীতিমত আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে।
সংবাদপত্রে সাংবাদিক বা রিপোর্টার যখন কোন বিষয়ে সংবাদ পরিবেশন করেন বা প্রতিবেদন তুলে ধরেন, তখন এতে দুটি অংশ পরিলক্ষিত হয়। একটি হচ্ছে সংবাদটির শিরোনাম, এবং অন্যটি এর বর্ণনাংশ। এই পর্যায়ে প্রথমেই সংবাদের শিরোনামের দিকে আলোকপাত করা যেতে পারে। একটি সংবাদের শিরোনাম কি রকম হওয়া উচিত? এ বিষয়ে সবাই অনায়াসে বলেন যে, সংবাদের শিরোনামটি হওয়া উচিত যথাসম্ভব সহজ, স্পষ্ট এবং আকর্ষণীয়। ‘সহজ ও স্পষ্ট’ বলতে শিরোনামটি এমন শব্দ বা পরিভাষা ব্যবহার করতে হবে, যাতে পাঠক সহজেই অর্থ উদ্ধার করতে পারে। সহজ ও স্পষ্ট করার জন্য যথাসম্ভব ক্রিয়াপদ বর্জন করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে ২৫শে ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সালে প্রকাশিত দৈনিক প্রথম আলোর প্রথম পাতার মূল শিরোনামটি উল্লেখ করা যেতে পারে- ‘অপরাধীরা বেপরোয়া, আতঙ্কে মানুষ’। এই শিরোনামটি পড়ে বাঙালি পাঠকমাত্রই বুঝতে পারবেন যে, দেশে বর্তমানে বিভিন্ন স্থানে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে এবং মানুষ আতঙ্কে আছে। এই সংবাদের প্রতিবেদক শিরোনামটি লিখতে গিয়ে যৌক্তিকভাবেই দুটি ক্রিয়াপদ, যথা- ‘হয়ে উঠেছে’ এবং ‘আছে’ বাদ দিয়েছেন। এর ফলে নিশ্চয়ই বাংলাভাষী কোন পাঠকেরই এর অর্থ উদ্ধারে অসুবিধায় পড়তে হয় না।
এবারে আসা যাক, একটি শিরোনাম কীভাবে পাঠকের কাছে ‘আকর্ষণীয়’ হয়ে ওঠে। এই শর্ত পূরণ করতে গিয়ে প্রতিবেদক সংশ্লিষ্ট শিরোনামটি কি সরল বাক্যে লিখবেন, নাকি তাকে একটি রূপক বাক্যে পরিণত করবেন? এর উত্তরে বলা যায়, সংবাদপত্রের শিরোনামকে পাঠকের কাছে অধিকতর আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য একে সরলভাবে না লিখে বরং রূপকে পরিণত করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১২ সালের ২৪শে এপ্রিল দৈনিক আমার দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি সংবাদেও শিরোনাম ছিল, ‘অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে সিলেট’। এটি নিঃসন্দেহে একটি রূপক বাক্য, অতি সরল শিরোনাম নয়। যদি প্রতিবেদক এর শিরোনাম হিসেবে ‘সিলেটে আগুন জ্বলছে’ জাতীয় সরল বাক্য দিয়ে শিরোনামটি লিখতেন, তাহলে নিশ্চয়ই তা পাঠকের কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হতো না।
অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, সংবাদের শিরোনাম হিসেবে রূপক বাক্য লেখার জন্য সংবাদকর্মীকে কি ভাষা প্রশিক্ষণ নিতে হবে। অবশ্যই না। কারণ আধুনিককালের ভাষাবিজ্ঞানীরা বলছেন যে, ভাষা মাত্রই রূপকের সমষ্টি। শুধু কবি-সাহিত্যিকেরাই নয়, বরং সাধারণ মানুষও তাদের দৈনন্দিন ভাষিক প্রকাশে অসংখ্য রূপক বাক্য তৈরি করে থাকেন। এর সাথে সুর মিলিয়ে আমি বলতে পারি যে, দৈনিক আমার দেশের সংশ্লিষ্ট সংবাদকর্মী নিশ্চয়ই ওপরের শিরোনামটি লিখতে গিয়ে বিশেষ কোন ভাষা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেননি। বরং তিনি তার সহজাত ভাষিক প্রকাশের অংশ হিসেবেই এই ধরনের একটি আকর্ষণীয় রূপকধর্মী বাক্য তৈরি করেছেন।
শিরোনামের পর সংবাদের পরবর্তী অংশ হচ্ছে বর্ণনাংশটি। এই অংশেই মূলত পাঠক সংবাদের প্রকৃত তথ্যটি পেয়ে থাকেন। সে বিবেচনায় বর্ণনাংশের ভাষাও অবধারিতভাবে হতে হবে সরল, স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ। ভাষার প্রগলভতা প্রকাশের চেয়ে সংবাদকর্মী সত্যিকার উদ্দেশ্য হচ্ছে, পাঠককে সংবাদের ভেতরগত মেসেজটি পৌঁছে দেওয়া। এ ছাড়া কখনও কখনও সংবাদকর্মী বা প্রতিবেদক কোনো বড় প্রতিবেদনের বর্ণনাংশে, সংবাদপত্রের ভাষায় যাকে ‘ভিউজ’ বলা হয়, উদ্দেশ্যমূলকভাবে নিজস্ব ভাবাদর্শ প্রচারে মেতে ওঠেন। ফলে পাঠক সংবাদটির বস্তুনিষ্ঠ অর্থ উদ্ধারের পরিবর্তে সংবাদপত্রের মালিকের রাজনৈতিক আদর্শের বয়ান পাঠ করেন। এ কারণে সংবাদের বস্তুনিষ্ঠতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয় এবং পাঠক সহজেই সংবাদপত্র সংশ্লিষ্ট সকলের রাজনৈতিক আদর্শ বা ভাবাদর্শ সম্পর্কে জেনে যায়। পরিণতিতে অচিরেই পত্রিকাটি পাঠকের কাছে একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মুখপত্র রূপে পরিচিত হয় এবং জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামে।
ঢাকা/ফারুক/টিপু
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
ভারতীয়দের বিদেশে পড়াশোনায় আগ্রহ কমছে, কারণ কি শুধুই রাজনীতি
উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশের অনেক নামী প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করতে যান ভারতের ছাত্রছাত্রীরা। করোনাপরবর্তী সময়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে এলেও শিক্ষার্থীদের বিদেশযাত্রার প্রবণতা কমছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য বলছে, বিদেশে অধ্যয়নরত ভারতীয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ১৫ শতাংশ। এখন প্রশ্ন উঠছে, কেন উচ্চশিক্ষার জন্য অন্য দেশে যাওয়ার আগ্রহ কমছে ভারতীয়দের?
কেন্দ্রের পরিসংখ্যান
ভারতের সংসদে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০২৪ সালে বিদেশে পড়তে যাওয়া ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা তুলে ধরেছে। এ পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ কয়েকটি দেশে ২০২৩ সালের তুলনায় গত বছরে (২০২৪) শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১৫ শতাংশ কমেছে।
লোকসভায় এক সংসদ সদস্যর প্রশ্নের জবাবে কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে ৮ লাখ ৯২ হাজার ৯৮৯ জন ভারতীয় শিক্ষার্থী অন্য দেশে পড়াশোনা করেছেন। ২০২৪ সালে এসে ৭ লাখ ৫৯ হাজার ৬৪ জন শিক্ষার্থী উচ্চশিক্ষার জন্য গেছেন ভিনদেশে। অর্থাৎ এক বছরে সোয়া লাখের বেশি শিক্ষার্থী কমেছে।
সবচেয়ে বেশি কমেছে কানাডায়। এ দেশে শিক্ষার্থী কমার হার ৪২ শতাংশ। ইংল্যান্ডে প্রায় ২৮ শতাংশ, আমেরিকায় প্রায় ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী কম পড়তে গেছেন।
আরও পড়ুনইংল্যান্ডে পড়াশোনা: খণ্ডকালীন চাকরি ও স্কলারশিপের সুযোগ, আইইএলটিএসে ৬.৫ স্কোর হলে আবেদন ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪ভারতীয় শিক্ষার্থীদের কাছে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, কানাডার উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বরাবরই খুব আকর্ষণীয়। তবে অন্য দেশেও পড়ার ঝোঁক রয়েছে। ভারতের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, অন্য কয়েকটি দেশে বিপরীতমুখী প্রবণতা দেখা গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রাশিয়া ও ফ্রান্স। ২০২৩–এর তুলনায় ২০২৪ সালে রাশিয়ায় ভারতীয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েছে ৩৪ শতাংশ, ফ্রান্সে সংখ্যাটি ১৪ শতাংশ।
রাশিয়ার ক্ষেত্রে মেডিকেলে পড়তে যাওয়ার ঝোঁক বেশি। হাজারো শিক্ষার্থী সে দেশে যাচ্ছেন ডাক্তারি পড়তে। সেখানে পড়াশোনার খরচ যেমন কম, তেমনি মেডিকেলের পাঠ নেওয়ার জন্য কঠিন প্রবেশিকা পরীক্ষার মুখে পড়তে হয় না। এ ছাড়া শিক্ষার্থীদের বৃত্তি থেকে বসবাসের ব্যবস্থা, বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সুবিধা দেওয়া হয়। শুধু এমবিবিএস নয়, পিএইচডি করতেও অনেকে রাশিয়ায় যাচ্ছেন।
আরও পড়ুনলিথুয়ানিয়ায় উচ্চশিক্ষা: ৩৫০টির বেশি প্রোগ্রামে পড়াশোনা, স্কলারশিপের সুবিধা, সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজ১৪ নভেম্বর ২০২৪ছাত্র কমার কারণ—
বিদেশে ভারতীয়দের পড়তে যাওয়ার প্রবণতা কমার পেছনে অনেকগুলো কারণ রয়েছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এর মধ্যে অন্যতম রাজনৈতিক কারণ। বিভিন্ন দেশে দক্ষিণপন্থী দলের উত্থান হয়েছে। এর ফলে কঠোর হয়েছে অভিবাসননীতি। ভিসা পাওয়া অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই কারণে গন্তব্য হিসেবে আমেরিকা, ইউরোপের একাধিক দেশ আগের মতো আর অনুকূল নয় বলে তাঁদের মত।
বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ও পররাষ্ট্রনীতি ছাত্রসংখ্যা কমার পেছনে কিছুটা দায়ী বলে মন্তব্য তাঁদের। এ ক্ষেত্রে কানাডার প্রসঙ্গ বিশেষভাবে উল্লেখ্য। এ দেশেই সবচেয়ে বেশি কমেছে ভারতীয় শিক্ষার্থীর সংখ্যা। বিশেষজ্ঞদের মতে, শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জরের হত্যা নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল। তার প্রভাব পড়েছে ভিসার ক্ষেত্রে।
ভারতের রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী বলেন, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকার যে নীতি, তা কোনো ভিনদেশির পক্ষে সুবিধাজনক নয়। কানাডার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়ে গেছে। এর ফলে এই দুটি দেশে পড়তে যাওয়া ভারতীয় শিক্ষার্থীরা অন্য দিকে ঝুঁকেছেন। ইউক্রেন, রাশিয়ায় অনেক মেডিকেল ছাত্র পড়তে যেতেন, সেখানে যুদ্ধ হলেও যাচ্ছেন। আমেরিকা বা কানাডার মতো সেখানে পড়তে যাওয়ার ক্ষেত্রে বাধা নেই, পড়াশোনার খরচও কম।’
বিদেশে না যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় হয়ে উঠেছে অর্থনৈতিক কারণ। বিশেষজ্ঞদের মতে, সার্বিক মন্দা, শিল্প উৎপাদনে ঘাটতি, কর্মসংকোচন নিয়োগের ক্ষেত্রকে অনিশ্চিত করে তুলেছে। অতীতে ভারতীয় শিক্ষার্থীরা বিদেশে পড়তে যেতেন যে লক্ষ্য নিয়ে, সেখানে কোথাও নিয়োগ খুঁজে নেওয়া, তেমন পরিস্থিতি আর নেই। বড় বহুজাতিক সংস্থায় কর্মী ছাঁটাইয়ের খবর পাওয়া যায় মাঝেমধ্যে।
আরও পড়ুনথাইল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা: ২০ ঘণ্টা খণ্ডকালীন কাজ, আইইএলটিএসে ৫.৫–এ আবেদন০২ অক্টোবর ২০২৪আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য বলেন, ‘দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে জনকল্যাণের ধারণাটা ফিকে হয়ে আসছে। যে উদারনৈতিক নীতির ফলে অন্য দেশের ছাত্রছাত্রীরা স্বাগত ছিল, সেখানে আজ বাধা তৈরি হয়েছে। এর ফলে আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশে তাদের নিজেদের রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। ভারতীয় ছাত্রদের যে মেধা ও পরিশ্রম, তার গুরুত্ব কমে যাচ্ছে। এই প্রবণতা আগামী দিনেও বজায় থাকবে।’
শুধু বিদেশযাত্রা নয়, দেশের সার্বিক শিক্ষার পরিবেশের সঙ্গে বিষয়টিকে সংশ্লিষ্ট করতে চাইছেন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার। তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে শিক্ষার গুরুত্ব কমছে। বাজেট কমছে, নিয়োগের সম্ভাবনা কমছে। তাই কলেজে ছাত্র ভর্তি কমে গিয়েছে। বিদেশে পড়ার ক্ষেত্রে সম্ভবত সেই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। বাইরের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ার উৎসাহ কমে যাচ্ছে অথবা যোগ্যতাতেও ঘাটতি হচ্ছে।’