ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে যেসব ঋণ দেওয়া হয়েছিল, তা একে একে খেলাপি হয়ে পড়েছে, যা অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ তৈরি করেছে। গত ডিসেম্বরের শেষে ব্যাংক খাতের খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা।

এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করেছে, এর ২০ দশমিক ২০ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে গত বছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর—ছয় মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর গতকাল বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘আগেই বলেছিলাম, খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আপাতত ভালোর দিকে যাবে না। যতই নতুন তথ্য আসছে, ততই বাড়ছে। যেভাবে ধারণা দিয়েছিলাম, সেভাবে বাড়ছে। সামনে আরও বাড়বে।’

গভর্নর জানান, আগে খেলাপি ঋণ কিছুটা কম দেখানো হতো। একসময় ছিল ৯ শতাংশ, যা বেড়ে ২০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। খেলাপি ঋণ এখনো সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছায়নি। এ ছাড়া নীতিমালায় কিছু পরিবর্তন আসছে। আগে ১৮০ দিন পর খেলাপি হতো, এখন ৯০ দিনে খেলাপি হয়ে পড়ছে। এ কারণেও খেলাপি ঋণ কিছুটা বাড়বে।

আগেই বলেছিলাম, খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি আপাতত ভালোর দিকে যাবে না। যতই নতুন তথ্য আসছে, ততই বাড়ছে। যেভাবে ধারণা দিয়েছিলাম, সেভাবে বাড়ছে। সামনে আরও বাড়বে।বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর খেলাপি ঋণ বাড়ল কত

গত সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ ছিল ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা ডিসেম্বরে বেড়ে হয় ৩ লাখ ৪৫ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা। ফলে অক্টোবর-ডিসেম্বর প্রান্তিকেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার ৭৮৭ কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে মোট বিতরণ করা ঋণ ছিল ১৭ লাখ ১১ হাজার ৪০১ কোটি টাকা।

এর আগে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে বা ওই তিন মাসে ব্যাংকব্যবস্থায় খেলাপি ঋণ বাড়ে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে যে অর্থ বের করে নেওয়া হয়েছে, তা এখন খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হতে শুরু করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার কিছুটা বেড়েছে। এ হার আগের সেপ্টেম্বরে ছিল ৪০ দশমিক ৩ শতাংশ, যা বেড়ে ৪২ দশমিক ৮৩ শতাংশ। একই সময়ে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১১ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন মোট খেলাপি ঋণ ছিল ২২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা। এর পর থেকে এই পরিমাণ বেড়েই চলছে। অর্থনীতিবিদেরা অনেক দিন ধরেই অভিযোগ করছেন, সাবেক সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ব্যাংক থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট হয়েছে, যার একটা বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে।

গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। সাবেক সরকারের আমলে ব্যাংক থেকে প্রভাবশালীদের বড় অঙ্কের ঋণ দিতে নানা সুবিধা দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি খেলাপি ঋণ কাগজে-কলমে কম দেখানো হতো। সরকার পরিবর্তনের পর সেই নীতি থেকে সরে এসেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর শেষে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে মোট বিতরণ করা ঋণের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার কিছুটা বেড়েছে। এ হার আগের সেপ্টেম্বরে ছিল ৪০ দশমিক ৩ শতাংশ, যা বেড়ে ৪২ দশমিক ৮৩ শতাংশ। একই সময়ে বেসরকারি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ১১ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ১৫ দশমিক ৬০ শতাংশ।কেন বাড়ছে খেলাপি

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, আওয়ামী লীগঘনিষ্ঠ ও সমালোচিত ব্যবসায়ী গোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নামে-বেনামে যেসব ঋণ ছিল, তার প্রকৃত চিত্র এখন দেখাতে শুরু করেছে ব্যাংকগুলো। যার কারণে খেলাপি ঋণ সবচেয়ে বেশি বাড়ছে। ইসলামী ব্যাংকে খেলাপি ঋণ বেশি বেড়েছে। একইভাবে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক ও সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণও বেশ বেড়েছে। পাশাপাশি সাবেক প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, সিকদার গ্রুপসহ কিছু বড় ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর ঋণ খেলাপি হয়ে পড়েছে। বেশির ভাগ ঋণ বেনামি, যা অনিয়ম ও জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া হয়েছিল।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের শীর্ষ ১০ খেলাপি প্রতিষ্ঠান হলো বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, এননটেক্স গ্রুপ, মাইশা গ্রুপ, এফএমসি গ্রুপ, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপ, জাকিয়া গ্রুপ, রিমেক্স ফুটওয়্যার ও রাঙ্কা গ্রুপ।

ব্যাংক খাত ঠিক করতে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘খেলাপি ঋণ বাড়ছে, এই গল্প আর কত দিন শুনব। বাংলাদেশ ব্যাংক তাহলে কি সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে, কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কত টাকা খেলাপি ঋণ আদায় হলো। খেলাপি ঋণের কারণে কতজন আইনের আওতায় এসেছে। ছয় মাসে কী পদক্ষেপ নেওয়া হলো, জাতি জানতে চায়। না হলে মনে হবে মূল সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।’

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের শীর্ষ ১০ খেলাপি প্রতিষ্ঠান হলো বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, এননটেক্স গ্রুপ, মাইশা গ্রুপ, এফএমসি গ্রুপ, ক্রিসেন্ট গ্রুপ, রতনপুর গ্রুপ, জাকিয়া গ্রুপ, রিমেক্স ফুটওয়্যার ও রাঙ্কা গ্রুপ।টাকা ফেরত পাবেন সবাই

ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধি পেলেও সব আমানতকারী টাকা ফেরত পাবেন বলে গতকাল আবারও জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকের আমানত প্রবৃদ্ধি পর্যাপ্ত হচ্ছে না। আমানত প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৪৪ শতাংশ গ্রহণযোগ্য নয়। ব্যাংক খাতের ওপর জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি লেনদেন ভারসাম্যের উন্নতি করতে হবে ও রিজার্ভ বাড়াতে হবে। রিজার্ভ এখন ২১ বিলিয়ন ডলার।

গভর্নর বলেন, ‘আইএমএফ যে লক্ষ্য দিয়েছে, তা আমরা অর্জন করেছি। সামনের মার্চেও তা সম্ভব হবে। আমরা স্বস্তিকর অবস্থায় আছি। সহসাই লেনদেন ভারসাম্য ও ব্যাংক খাত থেকে কোনো চাপ আসবে না। তবে কিছু ব্যাংকের তারল্যে সমস্যা আছে। আমানত প্রবৃদ্ধি বাড়লে এটা দূর হয়ে যাবে। দুর্বল ব্যাংকগুলোকে আমরা একীভূত করার চেষ্টা করব। এ জন্য আইন করা হচ্ছে।’

পাশাপাশি আমানত বিমা আইন পরিবর্তন করার কথাও বলেন গভর্নর। তিনি মনে করেন, কোনো ব্যাংক বন্ধ হবে না। ব্যাংকে টাকা রেখে ফেরত পাবে না, তা হবে না। কিছু দায়বদ্ধতা সরকার নিচ্ছে। সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত ব্যাংক থাকুক না থাকুক, সব আমানতকারী টাকা ফেরত পাবেন।

খেলাপি ঋণ বাড়ছে, এই গল্প আর কত দিন শুনব। বাংলাদেশ ব্যাংক তাহলে কি সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। বাংলাদেশ ব্যাংককে জানাতে হবে, কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কত টাকা খেলাপি ঋণ আদায় হলো। খেলাপি ঋণের কারণে কতজন আইনের আওতায় এসেছে। ছয় মাসে কী পদক্ষেপ নেওয়া হলো, জাতি জানতে চায়। না হলে মনে হবে মূল সমস্যাকে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে।বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স প ট ম বর ড স ম বর ম বর শ ষ সরক র র পর ম ণ ঋণ ছ ল ঋণ ব ড় ইসল ম সমস য দশম ক

এছাড়াও পড়ুন:

সুইজারল্যান্ডের এক্সিলেন্স মাস্টার ফেলোশিপ, জিআরই–আইইএলটিএস–টোয়েফল স্কোরে করুন আবেদন

সুইজারল্যান্ড আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষায় নানা বৃত্তি ও ফেলোশিপ দেয়। এবার দিচ্ছে ফেলোশিপ। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয় দেবে এ ফেলোশিপ। এর কেতাবী নাম ‘এক্সিলেন্স মাস্টার ফেলোশিপ’। এর আওতায় নির্বাচিত শিক্ষার্থীরা জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের সব বিষয়ে স্নাতকোত্তরে পড়তে পারবেন। বাংলাদেশসহ অন্য সব দেশের শিক্ষার্থীরা এ স্কলারশিপের জন্য আবেদন করতে পারবেন।

জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয় সুইজারল্যান্ডের অন্যতম প্রাচীন একটি বিশ্ববিদ্যালয়। এটি ১৫৫৯ সালে যাত্রা শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে আইন, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন বিষয়ে অসংখ্য কোর্স ও গবেষণার সুযোগ রয়েছে, যা বিশ্বের শিক্ষার্থীদের জন্য আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত।

আরও পড়ুনবুয়েটে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ১২ ঘণ্টা আগেকোন কোন বিষয়ে পড়াশোনা—

জেনেভা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদ বিশ্বের অন্যতম স্বীকৃত গবেষণাপ্রতিষ্ঠান। অ্যাস্ট্রোনমি, বায়োলজি, কেমিস্ট্রি অ্যান্ড বায়োকেমিস্ট্রি, কম্পিউটার সায়েন্স, ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্স, ম্যাথমেটিকস, আর্থ সায়েন্স, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স বিষয়ে আবেদন করতে পারবেন।

সুযোগ-সুবিধা—

এক্সিলেন্স মাস্টার ফেলোশিপে শিক্ষার্থীরা সর্বোচ্চ ১০ থেকে ১৫ হাজার সুইস ফ্রাঙ্ক পাবেন। এক বছরের জন্য এ ফেলোশিপ দেওয়া হয়। তবে প্রথম সেমিস্টারে সফলতার সঙ্গে একাডেমিক কার্যক্রম সম্পন্ন করার শর্তে ফেলোশিপের মেয়াদ দ্বিতীয় বছরে বৃদ্ধি করা হতে পারে।

প্রথম আলো ফাইল ছবি

সম্পর্কিত নিবন্ধ