১৬ বছরে ৩৮ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে শেয়ারবাজার
Published: 27th, February 2025 GMT
দেশের শেয়ারবাজার গত ১৬ বছরে প্রায় ৩৮ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে। মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে এ সময়ে শেয়ারবাজার থেকে বিনিয়োগকারীরা কোনো মুনাফা তো পানইনি, উল্টো প্রতিবছর ৩ শতাংশ হারে মূলধন হারিয়েছেন। বিপরীতে একটি প্রভাবশালী গোষ্ঠী বাজারকে ব্যবহার করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছে।
গত ১৬ বছরে ১৩৪টি কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হয়েছে। প্রাথমিক গণপ্রস্তাবের (আইপিও) মাধ্যমে এসব কোম্পানি বাজার থেকে ৯ হাজার কোটি টাকার মূলধন সংগ্রহ করেছে। এসব কোম্পানির মধ্যে ৪২টিই এখন দুর্বল মানের কোম্পানি হিসেবে ‘জেড’ শ্রেণিভুক্ত। ফলে এই কোম্পানিগুলো থেকে বিনিয়োগকারীরা কোনো মুনাফা তো পাচ্ছেনই না, উল্টো কোম্পানিগুলোর শেয়ার কিনে পুঁজি হারিয়েছেন।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্রোকারেস হাউস মালিকদের সংগঠন ডিবিএ আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বাজারের এই চিত্র তুলে ধরা হয়। সভার শুরুতে গত ১৬ বছরের বাজার চিত্র তুলে ধরে একটি পাওয়ার উপস্থাপনা দেন ডিবিএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি ও আইডিএলসি সিকিউরিটিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো.
উপস্থাপনায় আরও বলা হয়, শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৩৬০টি কোম্পানির মধ্যে দুর্বল মানের জেড শ্রেণিতেই এখন আছে ১০৩টি। শুধু বাজারে আসা নতুন কোম্পানিই যে খারাপ হয়েছে, তা নয়। মিউচুয়াল ফান্ড ও শেয়ারের বিপরীতে নেওয়া ঋণও বাজারে বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করেছে। শেয়ারের বিপরীতে নেওয়া ঋণ বা মার্জিন ঋণের পরিমাণ এখন প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ৯ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণাত্মক বা নেগেটিভ ইক্যুইটিতে পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক ঋণ আর আদায় হচ্ছে না। এতে অনেক ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানও তাদের বিনিয়োগ সক্ষমতা হারিয়েছে।
সাইফউদ্দিন তাঁর উপস্থাপনায় বলেন, বর্তমানে শেয়ারবাজারে ৪৫০টি ব্রোকারেজ হাউস, ৬৭টি মার্চেন্ট ব্যাংক, ৩৯টি সম্পদ ব্যবস্থাপক প্রতিষ্ঠান ও ৮টি ঋণমান যাচাইকারী সংস্থা রয়েছে। বাজারের আকার বিবেচনায় প্রতিষ্ঠানের এই সংখ্যা অনেক বেশি। এ কারণে একধরনের অসুস্থ প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে।
আগামী দিনে বিএনপি সরকার গঠন করলে শেয়ারবাজারকে আমরা ‘ওউন’ করব। এটিকে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তির অবস্থানে নিয়ে আসা হবেআমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, স্থায়ী কমিটির সদস্য, বিএনপিরাজধানীর নিকুঞ্জে ডিএসই টাওয়ার মিলনায়তনে গতকাল বুধবার অনুষ্ঠিত এই আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। ডিবিএর সভাপতি সাইফুল ইসলামের সঞ্চালনা ও সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সম্মানিত অতিথি ছিলেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। প্যানেল আলোচক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সাবেক ব্যাংক সুপারভাইজার সাবিদ সিদ্দিকী, ইংরেজি দৈনিক বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর সম্পাদক ইনাম আহমেদ, অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইআরএফের সভাপতি দৌলত আকতার, পুঁজিবাজারবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন সিএমজেএফের সভাপতি গোলাম সামদানী।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি নেতা জহির উদ্দিন স্বপন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ, ডিএসইর সাবেক পরিচালক আহমেদ রশিদ লালী, ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন প্রমুখ।
আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘অতীতে বাংলাদেশের কোনো সরকারই শেয়ারবাজারকে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে ধারণ (ওউন) করেনি। আওয়ামী লীগ সরকার শেয়ারবাজারকে রাজনৈতিকভাবে শোষণ করেছে। আগামী দিনে বিএনপি সরকার গঠন করলে শেয়ারবাজারকে আমরা “ওউন” করব। এটিকে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তির অবস্থানে নিয়ে আসা হবে।’ আওয়ামী লীগ সরকারের সময় শেয়ারবাজার লুটপাটকারীদের বিচার নিশ্চিত করারও দাবি জানান বিএনপির এই নেতা।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, পুঁজিবাজারের সুশাসন এখন প্রশ্নবিদ্ধ। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির গত দুই কমিশনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ শোনা যায়, যা দুঃখজনক। প্রশ্নবিদ্ধ নানা কোম্পানিকে তারা বাজারে এনেছে। অনেক ক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জের মতামতকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সেসব কোম্পানি এখন বাজারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সাবেক কর্মকর্তা সাবিদ সিদ্দিকী বলেন, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে হলে কোম্পানির নিরীক্ষকদের আরও বেশি তদারকি ও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
মূল প্রবন্ধে অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বাংলাদেশের মতো ছোট একটা বাজারে এত বেশি তদন্ত ও তদন্ত কমিটি হয়, যা বিশ্বের আর কোনো দেশে হয় না। গত সরকারের সময়ে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে যে ‘অলিগার্ক’ শ্রেণিগোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল, তার উদাহরণ শেয়ারবাজার। এই বাজারে বিনিয়োগের নানা গল্প তৈরি করে শেয়ারের দাম বাড়ানো ও কমানোর মতো ঘটনা ঘটেছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ১৬ বছর ত হয় ছ ব এনপ আহম দ
এছাড়াও পড়ুন:
সমস্যা সবই জানা, সমাধানে মানসিকতার বদল জরুরি
শেয়ারবাজার সমস্যা বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও শেয়ারবাজার উন্নয়ন কমিটির সভাপতি ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেছেন, শেয়ারবাজারের সমস্যা সবই জানা। এগুলোর সমাধানে মানসিকতার পরিবর্তন জরুরি।
শেয়ারবাজারের সমস্যা এবং উত্তরণের পথ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামত জানতে ড. আনিসুজ্জামান গতকাল বুধবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি কার্যালয়ে যান। সেখানে বিএসইসি কর্মকর্তা এবং বাজার অংশীজনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথম বিএসইসি কার্যালয়ে যান তিনি।
শেয়ারবাজারকে অর্থনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে উন্নয়নের লক্ষ্যে গত ১৯ মার্চ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি) ড. আনিসুজ্জামানকে প্রধান করে একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে। গতকালের বৈঠকে কমিটির সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকুল ইসলাম এবং অপর সদস্য এফআইডির অতিরিক্ত সচিব মো. সাঈদ কুতুব উপস্থিত ছিলেন।
ড. আনিসুজ্জামান প্রথমে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। পরে বাজার অংশীজন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করেন। বৈঠকে দেশের দুই স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান, সিডিবিএলের এমডি এবং ডিএসই ব্রোকার, মার্চেন্ট ব্যাংক, সম্পদ ব্যবস্থাপক, নিরীক্ষক, ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি এবং তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। উভয় বৈঠকে বিএসইসির চেয়ারম্যান রাশেদ মাকসুদসহ তিন কমিশনার অংশ নেন।
বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিএসইসি বা বাজার অংশীজনের কেউই বাজারের জানা সমস্যার বাইরে নতুন কিছু জানাতে পারেনি বলে মন্তব্য করেছেন আনিসুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘আপনারা যেসব কথা বলেছেন, তার সবটাই জানা। সমস্যার কথা সবাই জানে। তবে সমাধান কীভাবে চান, সে বিষয়ে শুনতে চাই।’ তিনি সবার কাছে সমাধানের লিখিত প্রস্তাব চেয়েছেন।
শেয়ারবাজার বিষয়ে বিস্তারিত পরিকল্পনা গ্রহণের আগে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ পরিদর্শন এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার কার্যালয়ের বাইরে ব্রোকারসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কমিটির বৈঠকের প্রস্তাব করেন ডিএসইর চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম। বিএসইসির চেয়ারম্যান ডিএসইর পরিবর্তে তা সিএসইতে করার পক্ষে মত দেন। তাঁর কথা, ডিএসইতে এ ধরনের বৈঠক বহু হয়, সে তুলনায় সিএসইতে কম হয়।
সূত্র জানায়, বিএসইসির কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে কমিটিকে শেয়ারবাজারের বর্তমান আকার এবং এর কাঠামোগত বিষয়ে ধারণা দেন কর্মকর্তারা। তারা জানান, এ বাজার বর্তমানে বড় ধরনের যেসব চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে, সেগুলোর অন্যতম হলো– নেগেটিভ ইক্যুয়িটি ইস্যু, সম্পদ ব্যবস্থাপনা কোম্পানিতে সুশাসনের অভাব, ভালো আইপিওর অভাব, বিনিয়োগ পণ্যের ঘাটতি এবং বাজার কারসাজিসহ শেয়ারবাজার ইস্যুতে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট।
আলোচনায় ডিএসইর চেয়ারম্যান জানান, শেয়ারবাজারের লেনদেন ব্যাপক হারে কমায় লেনদেনে উৎসে কর বেশি থাকায় ব্রোকারেজ হাউসগুলোর ব্যবসা করে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই উৎসে কর কমানো দরকার। সিএসইর চেয়ারম্যান জানান, আগামী এক মাসের মধ্যে কমোডিটি এক্সচেঞ্জের পরীক্ষামূলক লেনদেন চালু হবে। প্রাথমিকভাবে কমোডিটি এক্সচেঞ্জে স্বর্ণ, তুলা, পাট বা কমিশন যেসব পণ্য কেনাবেচার অনুমোদন দেবে, সেগুলো কেনাবেচা হবে।
তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি রূপালী চৌধুরী তাঁর বক্তব্যে বলেন, ভালো মূল্য ও কর সুবিধা না থাকায় দেশের বড় ও স্বনামধন্য কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হতে চায় না। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলোর সভাপতি মাজেদা খাতুন বলেন, শেয়ারবাজার নিয়ে আলোচনা হলে সবাই সেকেন্ডারি শেয়ারবাজার নিয়ে আলোচনা করেন, যেখানে আইপিও নিয়ে আলোচনা শুরু হওয়া উচিত।
বৈঠকে অন্যরা স্টক এক্সচেঞ্জসহ লেনদেনে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের মধ্যে সমন্বয়ের ঘাটতি আছে বলে জানান। তারা নগদ লভ্যাংশ বিতরণে বিলম্ব বা না দেওয়া ঠেকাতে তৃতীয় পক্ষের সম্পৃক্ততা এবং আইপিওতে ভালো কোম্পানিকে আকৃষ্ট করতে কর রেয়াত সুবিধা বাড়ানোর সুপারিশ করেন।