কথাশিল্পীর অবশ্যপাঠ্য কবিদের তারও বেশি
Published: 27th, February 2025 GMT
কেউ যদি আমাকে জিজ্ঞেস করেন, এই বইমেলায় যদি একটি বই কিনতে হয়, তাহলে আপনি কোন বইটি কিনবেন? আমি গত কয়েক বছর ধরেই সাহিত্য সম্পাদনার সূত্রে (যেহেতু ভালো বই বাছাই করতে হয়) এবং মেলার মাঠে মুখোমুখি নামের সাক্ষাৎকার আয়োজনের সূত্রে প্রায় সব শাখার লেখকদের প্রচুর বই পরখ করি। এবার মেলায় আমারও দুটি বই আছে। আছে প্রিয় মানুষের অনেক বই, যেসবের অনেক পাণ্ডুলিপির সঙ্গেই আমার আত্মিক যোগসূত্র রয়েছে। আমি সব ছেড়ে, একটুও না ভেবে একটি বইয়ের কথা বলব। বইটির নাম ‘আধুনিক বাংলা গদ্যভাষার সন্ধানে’।
ধ্রুপদি সাহিত্যের পাঠক যারা তাদের একটা বড় গোষ্ঠীর কাছে দীর্ঘদিন ধরে মুখে মুখে ফিরেছে ‘খোয়াজ খিজিরের সিন্দুক’ ও ‘বখতিয়ার খানের সাইকেল’। কথাসাহিত্য পাঠে আগ্রহী কতজনকে যে কত পাঠক এ দুই বই পড়তে পারেন বলে পরামর্শ দিয়েছেন! এ দুই বই ছাড়াও ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও ব্যাপক আলাপ-আড্ডার উপলক্ষ তৈরি করেছে ফয়জুল ইসলামের ‘জমিন’, ‘ঘুমতৃষ্ণা’, ‘আয়না’ কিংবা ‘নীলক্ষেতে কেন যাই’-এর মতো উন্মাতাল প্রেমের গল্প। আশির শেষভাগে প্রকাশিত ফয়জুল ইসলামের প্রথম বই নক্ষত্রের ঘোড়ার ৯টা গল্পের যে ভাষাভঙ্গি, যে নির্লিপ্ত বর্ণনা ও বয়ান, তা যে কোনো পাঠককেই উড়িয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে। একমাত্র উপন্যাস ‘বয়েজ স্কুল ব্যান্ড’-এ একটা বড় সময়, নির্দিষ্ট করে ৯০ দশকের ব্যান্ড সংগীত কালচারের এক প্রিমিয়াম এথনোগ্রাফিক বয়ান তৈরি করেছেন কথাসাহিত্যিক ফয়জুল ইসলাম। তারই গদ্যভাষার নিরন্তর নিরীক্ষা ও অনুসন্ধানের ফসল ‘আধুনিক গদ্যভাষার সন্ধানে’। আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশের প্রবন্ধসাহিত্যে ভবিষ্যতের এক অবশ্যপাঠ্য বই হয়ে উঠবে এটি, কথাসাহিত্যিকদের জন্য তো গদ্যভাষাটা জানতে হয়, তাদের জন্য অবশ্যপাঠ্য আর কবিদের জন্য তারও বেশি। কারণ, ভাষার অভিভাবক কবিই যদি ভাষাটির মোচড়, বাঁক ও বিন্যাস না জানেন, তবে হবে কীভাবে!
মৃত্যুর ক’দিন আগেই এ বই তাঁর হাতে পৌঁছে দিয়েছেন হাসপাতালের বিছানায় কথাপ্রকাশের প্রকাশক জসিম উদ্দিন। দেশের লেখকসমাজের তরফ থেকেই তিনি ধন্যবাদার্হ। কথাসাহিত্যে; গল্প বা উপন্যাসে কাঠামো, ভাষা আর অবয়বের এক দারুণ ব্লেন্ড করেছিলেন ফয়জুল ইসলাম, সারা আমলাজীবনের পর সাম্প্রতিক সময়ে কাঙ্ক্ষিত লেখকজীবন পেয়েছিলেন, তারই প্রমাণ অপ্রকাশিত দুটি উপন্যাস, ডায়েরি আর নতুন প্রবন্ধের বই। আমরা ফয়জুল ইসলামকে হারিয়ে কথাসাহিত্যের এমন এক রত্ন হারালাম, যা কোনোভাবেই পূরণীয় নয়; অফেরতযোগ্য ও অগম্য। আমি খুব তর্ক করতাম (ফয়জুল ইসলাম) সুমনের সঙ্গে এ নিয়ে যে, তাঁর ভাষাভঙ্গির যে স্বাতন্ত্র্য তা দাঁড়িয়ে আছে ওয়ালীউল্লাহ, ইলিয়াস, শহীদুল জহিরের বানানো পাটাতনে। উনি আমার মূর্খতার দিকে মিটিমিটি তাকিয়ে প্রশ্রয়ের হাসি হাসতেন, যেন ‘চ্যালেঞ্জটা দিয়া গেলাম মিঞা, এবার বুঝে পড়ো কিংবা পড়ে বোঝো যদি পারো!’
আমাদের কথাসাহিত্যের পাঠকদের বহু বহুদিন ফয়জুল ইসলামের গদ্য নিয়ে থাকতে হবে, বুঁদ। এই ফয়জুল ইসলামের জীবিতকালের সবশেষ প্রকাশনা ‘আধুনিক বাংলা গদ্যভাষার সন্ধানে’। বাংলা সাহিত্যের মনোযোগী পাঠকরা জানেন, আমাদের ভাষার এই সুলল আধুনিক অবয়বটি বহু পরিশ্রমে তৈরি করে উনিশ শতকের পাঠকের সামনে দিয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু সে অবয়বটি খুঁজে পেতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি তাঁকে। বাংলা আধুনিক গদ্যের পথপরিক্রমার শুলুক সন্ধান করেছেন ফয়জুল ইসলাম এই প্রবন্ধের বইয়ে। সূচিতে চোখ বুলালেও তা বোঝা যায়– রবিঠাকুরের ঠিক আগের বড় কথাকার বঙ্কিমচন্দ্র, ঈশ্বরচন্দ্রের ঠিকুজি নিয়েছেন এখানে ফয়জুল ইসলাম। তার আগে রেখেছেন প্যারীচাঁদ মিত্র, রামমোহন রায়, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, উইলিয়াম কেরি এবং রামরাম বসুকে। উপক্রমণিকায় গদ্যের মাটিকাটা শ্রমিক হিসেবে নিজের গদ্যচিন্তা এবং এই বই লিখতে ব্রতী হওয়ার পেছনে অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহার সঙ্গে ফোনালাপের অবদানকে মনে করেছেন তিনি।
সত্তরের বেশি ‘ভাষা নিয়ে আকর বই’ ঘেঁটে নিবিড় এবং নানা তলের পঠন পেরিয়ে, নিজের অগ্রজ ওয়াসি আহমেদ থেকে শুরু করে বন্ধুবৃত্তের জাকির তালুকদার, প্রশান্ত মৃধা, আহমাদ মোস্তফা কামাল, আবু হেনা মোস্তফা এনাম কিংবা আফসানা বেগম বা রুমা মোদক বা কিযী তাহনীন, এমনকি মুহিত হাসান দিগন্তর সঙ্গে আলাপ করে খটোমটো গদ্যে নয়, প্রাণোচ্ছল ও স্বতঃস্ফূর্ত গল্প বলার ঢঙে প্রাঞ্জল শিল্পিত শৈলীতে সব ধরনের পাঠক হজম করতে পারবেন এমন করে বইটি লিখেছেন ফয়জুল ইসলাম। বাংলা গদ্যচর্চার দীর্ঘ ইতিহাস ও দৃষ্টান্ত আমলে নিয়ে, জটিল ও একপেশে ব্যাখ্যা পেরিয়ে ফয়জুল এই সময়ে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত যুক্তিপূর্ণভাবে ‘বাংলা গদ্যচর্চার ইতিহাসে দিব্যদ্যুতিময়’ বইটি আমাদের দিয়ে গেছেন। আমাদের এর পরের কাজ বইটি পড়ে ফেলে বাংলা গদ্যকে নিজের হাতের রেখার মতো চিনে ফেলা। বাংলা গদ্যের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক এমন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগগুলো, নতুন লেখক কিংবা পাঠক-শিক্ষার্থীদের বইটি প্রবল কাজের হবে। ৭৩টি বইয়ের বদলে একটি বইয়ে পুরো বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশ পাওয়া গেলে তার চেয়ে বড় শিক্ষকের কাজ আর কী?
এই চিনিয়ে দেওয়ার কাজটি করে দিয়েছেন বলেই বাংলা কথাসাহিত্যের ইতিহাসে প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবেন ফয়জুল ইসলাম। ফয়জুল ইসলাম সুমন, বাংলা কথাসাহিত্যের বন্ড, সুমন বন্ড।
আধুনিক বাংলা গদ্যভাষার সন্ধানে।। ফয়জুল ইসলাম।। প্রকাশক: কথাপ্রকাশ ।। প্রচ্ছদ: সব্যসাচী হাজরা।। পৃষ্ঠা : ৩৬০ ।। মূল্য: ৭০০ টাকা
শিমুল সালাহ্উদ্দিন, কবি ও সাংবাদিক#
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: বইম ল ন ফয়জ ল ইসল ম ফয়জ ল ইসল ম র আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
প্রধান উপদেষ্টাকে জাতিসংঘ মহাসচিবের চিঠি
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চলমান সংস্কার প্রচেষ্টার প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়ে চিঠি দিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব এন্তোনিও গুতেরেস।
বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি) ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঠানো এক চিঠিতে এ সমর্থনের কথা জানানো হয়।
চিঠিতে জাতিসংঘ মহাসচিব উল্লেখ করেছেন, ‘‘৪ ফেব্রুয়ারি আপনি যে চিঠি দিয়েছেন, তার জন্য আপনাকে আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই। ৭ ফেব্রুয়ারি সাক্ষাতের সময় আপনার রোহিঙ্গা সংকট ও অগ্রাধিকার বিষয়ক প্রতিনিধি খলিলুর রহমান আমার কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। আমি বাংলাদেশের সঙ্গে জাতিসংঘের দৃঢ় সংহতি এবং আপনার নেতৃত্বে সংস্কার প্রক্রিয়ার প্রতি আমাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করতে চাই।’’
আন্তোনিও গুতেরেস লিখেছেন, ‘‘বাংলাদেশ ও ওই অঞ্চলের ওপর রোহিঙ্গা সংকটের প্রভাবের পাশাপাশি রাখাইন রাজ্যে ক্রমবর্ধমান মানবিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আপনি (ড. ইউনূস) যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, আমিও তার সঙ্গে একমত। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন আদায়ের কাজ অব্যাহত রাখবে জাতিসংঘ। মিয়ানমারের সংকট রাজনৈতিকভাবে সমাধানের লক্ষ্যে আঞ্চলিক সংস্থা, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সংগঠন আসিয়ান এবং অন্যান্য অংশীদারদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ অব্যাহত থাকবে। বিশেষ করে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ এবং স্বেচ্ছায় প্রত্যাবাসনের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি করা হবে।’’
রাখাইনের সম্প্রদায়গুলোর কাছে মানবিক সহায়তা এবং তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য জাতিসংঘের কান্ট্রি টিমগুলোকে নির্দেশ দেওয়ার কথা জানিয়ে মহাসচিব লিখেন, ‘‘আমি আমার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেছি, তারা যেন রাখাইনের সম্প্রদায়গুলোর কাছে মানবিক সহায়তা এবং তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য সর্বাধিক সহায়তা প্রদানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের জাতিসংঘের স্থানীয় টিমগুলোকে নির্দেশ দেন। এ সকল বিষয়ে সম্পৃক্ত প্রতিটি বিষয়কেই অগ্রাধিকার দেবে জাতিসংঘ। রাখাইন এবং সমগ্র মিয়ানমারের অভাবী মানুষের কাছে নিরাপদ, টেকসই এবং বাধাহীন মানবিক সহায়তা পৌঁছাতে সমন্বয়কে অগ্রাধিকার দেবে জাতিসংঘ। এই অগ্রাধিকারের মধ্যে মিয়ানমারের জন্য জরুরি ত্রাণ এবং আবাসিক ও মানবিক সমন্বয়কারী এ.আই. অন্তর্ভুক্ত থাকবে।’’
চিঠির শেষ অংশে তিনি লিখেছেন, ‘‘আমি আশাবাদী যে, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা মুসলিম এবং অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি নিয়ে উচ্চ স্তরের সম্মেলনটি নতুন করে বিশ্বব্যাপী মনোযোগ আকর্ষণ করবে। এর মাধ্যমে রোহিঙ্গা ও অন্যান্য সংখ্যালঘুদের জন্য বিস্তৃত সমাধান বিকাশে অবদানের সুযোগ তৈরি হবে। সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে পরামর্শের পর জাতিসংঘ কীভাবে সর্বোত্তম পথে বিষয়টিকে সমর্থন করতে পারে তার জন্য সম্মেলনের ফলাফল এবং পরিকল্পনার অপেক্ষা করছি।’’
মহাসচিব আরো লিখেছেন, ‘‘আগামী মার্চে পবিত্র রমজান মাসে আমার আসন্ন বাংলাদেশ সফরে এই আলোচনা আরো এগিয়ে নেয়ার জন্য আমি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।’’
ঢাকা/হাসান/রাজীব