ফসলের ভরপুর ফলনে আনন্দ আবেশের বদলে কখনও কখনও চাষির মন পোড়ে। এই যেমন এবারও দাম না পাওয়া সবজিচাষির চোখে জল দেখেছে দেশ। বাড়তি সবজি সংরক্ষণের সুযোগ না থাকায় প্রতিবছরই ভরা মৌসুমে কৃষক-হৃদয়ে কষ্ট জমে।
দীর্ঘমেয়াদি সবজি সংরক্ষণে সরকারিভাবেও কোনো ব্যবস্থা গড়ে না ওঠায় চাষির আর পথ খোলা থাকে না। উপায় না দেখে পানির দরে সবজি বেচে মাঠ খালি করে কৃষককুল। চাষির বেদনার আকাশের মেঘ কাটতে যাচ্ছে অবশেষে। কৃষকের মুখে হাসি ফেরানোর উদ্যোগ নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। চাষির ঘামে ভেজা খাটুনির সবজি শীতল থাকবে ফারমার্স মিনি কোল্ডস্টোরেজে। ‘কৃষকের শীতল ঘর’ নামে এই হিমাগার দেবে নতুন পথের দিশা।
মানিকগঞ্জের সিংগাইরের রাজেন্দ্রপুর গ্রামের কৃষি উদ্যোক্তা এস এম শহীদুল কবির লিপুর ২৫ বিঘা জমির পুরোটাই সমন্বিত খামার। এ মৌসুমে নানা পদের সবজি ফলিয়ে মাঠে মার খেয়েছেন তিনি। গাছে গাছে এখনও ঝুলছে অনেক সবজি, বেচতে না পারায় নষ্ট হচ্ছে ক্ষেতেই। আচকা তিনি খোঁজ পান সাভারের রাজালাখের হর্টিকালচার সেন্টারে পরীক্ষামূলক দুটি মিনি কোল্ডস্টোরেজ নির্মাণ করছে সরকার। কৃষি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে যোগাযোগ করে ১৫ দিন আগে ওই হিমাগারে দুই টন নানা জাতের সবজি সংরক্ষণ করেন লিপু। তার আশা, আসছে রোজায় এসব সবজি বিক্রি করে লাভ পকেটে তুলতে পারবেন। আরও কয়েকজন চাষি হিমাগারে টমেটো, শসা, লাউ, বিটরুট, ক্যাপসিকাম, বেগুন, গাজর, ফুলকপিসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি সংরক্ষণ করেছেন। গতকাল বুধবার হিমাগার দুটির উদ্বোধন করেন কৃষি উপদেষ্টা মো.
সাভারের হর্টিকালচার সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, ১০ টন ধারণক্ষমতার কৃষকের এই শীতল ঘরে ১৫ দিন আগের রাখা সবজি এখনও তরতাজা। সবজিতে নেই কোনো দাগ। সাধারণত ফ্রিজে সবজি সংরক্ষণ করা হলে ওপরের খোসা কুঁচকে যায়। তবে এই হিমাগারে সংরক্ষণ করা সবজিতে এমনটা দেখা যায়নি। একই দিনে কৃষি উপদেষ্টা উন্মোচন করেন বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের অ্যাপস ‘খামারি’। অ্যাপটিতে ঢুকলেই এলাকাভিত্তিক মাটির বৈশিষ্ট্য, ফসলের অর্থনৈতিক দিক, আবহাওয়া-জলবায়ুর তথ্য, ফসলের উপযোগিতা, সার সুপারিশ, ফসল জোন, শস্যবিন্যাস, সংরক্ষণের তথ্যসহ নানা উপাত্ত মিলবে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের ‘টিস্যু কালচার ল্যাবরেটরি-কাম হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপন ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক তালহা জুবাইর মাশরুরের তত্ত্বাবধানে দুটি মিনি কোল্ডস্টোরেজ তৈরি করা হয়। একটি রাজালাখ হর্টিকালচার সেন্টারের ঘরের ভেতরে, আরেকটি খোলা আকাশের নিচে কনটেইনারভিত্তিক ও সৌরচালিত। এই উদ্যোগের মূল লক্ষ্য আধুনিক শীতল সংরক্ষণ ব্যবস্থার মাধ্যমে কৃষকের উৎপাদিত পণ্যকে সঠিক সময়ে বাজারে ওঠানো। এর মাধ্যমে মৌসুমে দামের ওঠানামা নিয়ন্ত্রণ, ফসলের অপচয় রোধ ও কৃষকের আর্থিক ক্ষতির শঙ্কা কমবে। কৃষক সরাসরি বাজারে ন্যায্যমূল্যে পণ্য বেচার সুযোগ পাবেন। কমবে মধ্যস্বত্বভোগীর প্রভাব।
হিমাগার পরিদর্শন শেষে কৃষি উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সবজি সংরক্ষণে দেশে কোনো হিমাগার নেই। এই মিনি কোল্ডস্টোরেজ কৃষকের ফসল সংরক্ষণে বড় পরিবর্তন আনবে। কৃষক নিজেই তাঁর উৎপাদিত সবজি সংরক্ষণ করে বেচতে পারবেন। এতে বাম্পার ফলন কৃষকের জন্য অভিশাপ নয়, আশীর্বাদ হয়ে আসবে।
কৃষি সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান বলেন, কৃষকের শীতল ঘরের মাধ্যমে আমরা ফসলের অপচয় কমাব। কৃষকদের লাভজনক উৎপাদনের সুযোগ বাড়বে। সরকার ও বেসরকারি বিনিয়োগের মাধ্যমে এই প্রযুক্তিকে সহজলভ্য করা হবে। এ বিষয়ে কৃষককে দেওয়া হবে প্রশিক্ষণ। আপাতত সারাদেশে এ রকম আরও ১০০ মিনি কোল্ডস্টোরেজ সরকার নির্মাণ করে দেবে। কৃষক বিনামূল্যে সেখানে সবজি সংরক্ষণ করতে পারবেন। খামারি অ্যাপসের মাধ্যমে কৃষক জমিতে দাঁড়িয়ে কোন ফসল ভালো হবে, কী পরিমাণ সার ও কীটনাশক দিতে হবে– তা নির্ধারণ করতে পারবেন। এ রকম নিত্যনতুন আরও উদ্ভাবন নিয়ে আমরা কৃষকের সামনে হাজির হবো।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম বলেন, এই কোল্ডস্টোরেজ কৃষকের জন্য নতুন দরজা খুলবে। এখন কৃষক নিজেই ফসল সংরক্ষণের মাধ্যমে দর নির্ধারণ করতে পারবেন। উন্নত এই প্রযুক্তি আমরা দেশজুড়ে ছড়িয়ে দিতে চাই।
‘টিস্যু কালচার ল্যাবরেটরি কাম হর্টিকালচার সেন্টার স্থাপন ও উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক তালহা জুবাইর মাশরুর বলেন, স্থানীয় ও আমেরিকান হাই-টেক ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষকের শীতল ঘর তৈরি হয়েছে। ইন্টারনেটভিত্তিক এবং রিয়েল টাইম তদারক সুবিধা থাকায় মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ঘরে বসে এই মিনি কোল্ডস্টোরেজ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। মাত্র পাঁচ লাখ টাকা খরচে কৃষক নিজের বাড়িতেই এটি তৈরি করতে পারবেন। আর কনটেইনারে সোলারসহ বানাতে লাগবে ১৫ লাখ টাকা। প্রচলিত কোল্ডস্টোরেজের চেয়ে এখানে খরচ প্রায় ৭০ শতাংশ কম লাগবে।
তিনি বলেন, সোলার মিনি কোল্ডস্টোরেজ কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য একটি পরিবেশবান্ধব ও টেকসই সমাধান। এটি জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ও গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর পাশাপাশি নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করে। ১০ টন ধারণক্ষমতার কোল্ডস্টোরেজ বছরে সাড়ে তিন হাজার কেজি কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণ কমাতে পারে, যা সমপরিমাণ কার্বন কমানোর জন্য ১৪০-১৬০টি পরিণত গাছের বার্ষিক শোষণ ক্ষমতার সমান। সোলার কোল্ডস্টোরেজ খাদ্য সংরক্ষণ, কৃষকের আয় বাড়ানো এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
ঈদের টানা ছুটিতে পর্যটক বরণে প্রস্তুত মৌলভীবাজার
ঈদের লম্বা ছুটি আর শুকনা মৌসুম থাকায় মৌলভীবাজারে এবার লাখো পর্যটকের ঢল নামবে বলে আশা করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।
জেলার শ্রীমঙ্গল ও কমলগঞ্জ উপজেলায় রয়েছে দৃষ্টি নন্দন নানা পর্যটন স্পট। রয়েছে পর্যটকদের থাকা খাওয়ার জন্য ভালোমানের হোটেল মোটেল ও রির্সোট। হোটেল-রিসোর্ট মালিকরা ইতোমধ্যে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। চলছে সাজসজ্জার কাজ।
এদিকে পর্যটক নিরাপদে চলাচলে প্রশাসন থেকে নেওয়া হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সবুজের সমারোহ, চা বাগান, হাওর টিলার এই জনপদে চমৎকার প্রাকৃতিক পর্যটন স্পট-গুলো নয়নাভিরাম সৌন্দর্যের প্রতীক।
হামহাম জলপ্রপাত, মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, প্রাণ প্রকৃতি আর জীববৈচিত্র্যের আধার লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানসহ অর্ধশত পর্যটনকেন্দ্রে বছর জুড়ে পর্যটকদের পদচারনায় মুখরিত থাকে। তবে প্রতিবছরই ঈদের ছুটিতে আনন্দ উপভোগ করতে ছুটে আসেন সবুজের রাজ্যে অগনিত ভ্রমণ পিপাসু।
এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। আগেভাগেই বেশিরভাগ হোটেল রিসোর্ট বুকিং সম্পন্ন হয়ে গেছে। পর্যটকদের আরামদায়ক অভিজ্ঞতা নিশ্চিত করতে হোটেল রিসোর্টগুলোতে নতুন সাজসজ্জার পাশাপাশি থাকছে বিশেষ অফার ও সেবার ব্যবস্থা।
একাধিক ব্যবসায়ী জানান, এবারের ঈদে ভালো ব্যবসা হবে তাদের। সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সভাপতি সেলিম আহমেদের সাথে।
তিনি বলেন, “ঈদের আনন্দ ভাগাভাগিতে মানুষজনের ঢল নামার সম্ভাবনা রয়েছে এখানে। আমরা তাদের বরণ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।”
শ্রীমঙ্গল পর্যটন সেবা সংঘের সদস্য সচিব কাজী সামছুল হক বলেন, “এবারের ঈদে লম্বা ছুটি রয়েছে। মনে হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তা কর্মচারীদের ঘোরাফেরার বড় সুযোগ। আর এই সুযোগ তারা হাতছাড়া করবেন না। আশা করি পর্যটকের ঢল নামবে মৌলভীবাজারে। ইতোমধ্যে আমাদের কটেজ-গুলো বুকিং প্রায় শেষ। বাকীগুলো কয়েকদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে।”
শ্রীমঙ্গল রাধানগর পর্যটন কল্যাণ পরিষদের সদস্য সচিব মো. তারেকুর রহমান পাপ্পু বলেন, “ঈদকে সামনে রেখে আমরা পর্যটকদের সাচ্ছ্যন্দবোধে ঘুরাফেরা করার জন্য সবধরনের সেবা প্রদান ও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেব। আমাদের এলাকার কোন বদনাম যেন না হয়, সে ব্যবস্থা করব।”
চান্দের গাড়ির চালক তনিজিস মিয়া বলেন, “রমজানে আমাদের মান্দা যাচ্ছে। ঈদে আশা করি রেকর্ড পরিমাণ পর্যটক আসবেন। এতে আমাদের আয় রোজগার ভালো হবে।”
শ্রীমঙ্গল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইসলাম উদ্দিন বলেন, “পর্যটকদের নির্বিঘ্ন ভ্রমণের জন্য প্রসাশন তৎপর রয়েছে। এবার ঈদ মৌসুমে পর্যটন খাত যেমন চাঙ্গা হবে, তেমনি স্থানীয় অর্থনীতিতেও আসবে গতি।”
ট্যুরিস্ট পুলিশ ইনচার্য কামরুল হাসান চৌধুরী বলেন, “পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জেলা প্রসাশক ও জেলা পুলিশ সুপারের সাথে সমন্বয় করে আমরা কার্যক্রম পরিচালনা করব।”
জেলা পুলিশ সুপার এম কে এইচ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, “পর্যটকদের নিরাপত্তার টহল জোরদার করা হবে। অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রাখা হবে যেন আগত পর্যটকদের কোন সমস্যা না হয়। এখানে পাঁচতারা মানের কয়েকটি হোটেল মোটেল ও রিসোর্ট আছে। আমাদের সার্বক্ষণিক নজরদারী থাকবে।”
ঢাকা/আজিজ/এস