‘আমার মেয়েডারে ওরা মাইরা ফালাইছে’
Published: 27th, February 2025 GMT
‘বাবা গো আমার মেয়েডা কী দোষ করছিল? দুই মাস ধইরা বিয়া অইছে আমার মেয়েডার। আমার মেয়েডারে ওরা মাইরা ফালাইছে। আমার মা কত না কষ্ট করছে। আমার মার বুকে, কমরে, পিঠে মারছে।’ এভাবেই বিলাপ করছিলেন নববধূ মাকসুদার মা রেহেনা খাতুন।
মাকসুদার বাড়ি ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার বাঘবেড় ইউনিয়নের খড়িয়া এলাকায়। সে ওই এলাকার হযরত আলীর মেয়ে। দুই মাস আগে পাশের চানপাগার এলাকার তোতা মিয়ার ছেলে নাঈমের সঙ্গে বিয়ে হয় মাকসুদার। প্রেমের বিয়ে হলেও পরিবার মেনে নিলে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বামীর সংসারে যায় মাকসুদা। সংসারও ভালো চলছিল। হাতে লাগা মেহেদী রং এখনও শুকায়নি। এরই মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ওই নববধূর রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে। স্বামীর বাড়ি থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়েছে পুলিশ। তবে এ ঘটনায় মেয়ের বাবা একটি হত্যা মামলা করেছেন। এ মামলায় মাকসুদার স্বামী ও শাশুড়িকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
জানা গেছে, টানাপোড়েনের সংসারে সহযোগিতা করতে ঢাকার গুলশান এলাকায় গৃহকর্মীর কাজ নেন মাকসুদা। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর পরিচয় হয় পাশের এলাকার নাঈমের সঙ্গে। এক পর্যায়ে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শুধু তাই নয়, পরিবারকে না জানিয়ে কোর্ট ম্যারেজ করে বাড়ি ফেরেন। পরে স্থানীয়দের সুপারিশে আনুষ্ঠানিকভাবে দুই পরিবারের সম্মতিতে স্বামীর সংসারে যান মাকসুদা। সংসারও ভালোই চলছিল। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে স্বামী নাঈম গরুর জন্য ঘাস কাটতে মাঠে চলে যান বলে দাবি তাঁর। ফিরে এসে দেখতে পান ঘরের দরজা বন্ধ। দরজা ভেঙে ভেতরে গিয়ে দেখেন মাকসুদার ঝুলন্ত লাশ। তবে মাকসুদার পরিবারের দাবি, তাদের মেয়ে আত্মহত্যা করেনি। পরিকল্পিতভাবে তাঁকে হত্যা করা হয়েছে।
রেহেনা খাতুন বলেন, ‘আমার মা তো মরতো না, পরে গলার মধ্যে উরনা পেঁচাইয়া মারছে। মাইরা ঝুলায়া রাইখা মাইসেরে কইছে সে নিজে মইরা গেছে। আমার মা মরতে পারে না। ওরা মা পুলা মিল্লা আমার মাইয়াডারে মাইরা ফালাইছে।’
মাকসুদার চাচা শহীদুল্লাহর দাবি, এটা আত্মহত্যা হতে পারে না, মেয়ের শ্বশুর-শাশুড়ি, ভাশুর ও জামাই মিলে এ হত্যাকাণ্ড ঘটান। নিজেরাই গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ঝুলিয়ে রেখে আত্মহত্যা বলে প্রচার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি নিজে ভাতিজিকে দেখেছি, তার শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। আমরা সঠিক তদন্তসাপেক্ষে বিচার চাই।’
বাঘবেড় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মেজবাহ উদ্দিন মামুন জানান, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, এটা আত্মহত্যা নয়। অন্য কিছু হতে পারে।
ধোবাউড়া থানার ওসি আল মামুন সরকার বলেন, ‘এ ঘটনায় লাশ উদ্ধার করে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পাঠানো হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ময়মনস হ আম র ম য় ড পর ব র
এছাড়াও পড়ুন:
ময়মনসিংহে রাজস্ব তহবিলের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার সাবেক নির্বাহী অফিসার সারমিনা সাত্তার ও উপজেলা প্রকৌশলী আয়েশা আখতারের বিরুদ্ধে নিয়ম বহির্ভূতভাবে প্রকল্প গ্রহণ ও ভুয়া প্রকল্প দেখিয়ে সরকারি অর্থ লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে।
নিজেদের দুর্নীতি আড়াল করতে এসব প্রকল্পের কাগজপত্রও অফিস থেকে গায়েব করা হয়েছে বলে অভিযোগ। যাদের নামে প্রকল্প দেখিয়ে টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে, তারা দুর্নীতিবাজ এসব কর্মকর্তাদের বিচার চেয়েছেন।
উপজেলা পরিষদ রাজস্ব তহবিল ব্যবহার নির্দেশিকা ২০২০ অমান্য করে ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরে নিয়মিত রাজস্ব তহবিল ও উদ্বৃত্ত রাজস্ব তহবিল থেকে সরকারি অর্থ ব্যয় দেখানো হয়েছে। তাছাড়া অধিকাংশ প্রকল্পের কোন ধরনের কাজ না করে এবং অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে প্রকল্প দেখিয়ে অর্থ লোপাট করা হয়।
সরকারি বিধি মতে, উপজেলা পরিষদ রাজস্ব তহবিল ব্যবহার নির্দেশিকা ২০২০ অনুযায়ী কী কী খাতে অর্থ ব্যয় করা যাবে তা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করা আছে।
নিয়মানুযায়ী সরাসরি রাজস্ব তহবিল থেকে প্রকল্প গ্রহণ করার সুযোগ নেই। কিন্তু সাবেক নির্বাহী অফিসার সারমিনা সাত্তার ও উপজেলা প্রকৌশলী আয়েশা আখতার কোনো কিছুর তোয়াক্কা না করে ব্যক্তিগত বিলাসিতা ও লুটপাটের উদ্দেশ্যে উপজেলা পরিষদ নির্দেশিকার ‘ক’ থেকে ‘ম’ এর বাইরে বিভিন্ন প্রকল্প দেখিয়ে টাকা উত্তোলন করেছেন যা নিয়ম বহিভূর্ত।
তথ্য অধিকার আইনে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানাগেছে, ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসের মাসিক সভায় পিআইসির মাধ্যমে ৮৫ লাখ টাকার ৫৯টি প্রকল্প, আরএফকিউ এর মাধ্যমে তিন কোটি ২২ লাখ টাকার ৩৯টি প্রকল্প ও টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ৯৯ লাখ টাকার ১৩টি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়।
আরএফকিউ প্রকল্পের মাধ্যমে অফিস মেরামত বাবদ ১০ লাখ, ডরমেটরি মেরামত বাবদ ৫লাখ, আবাসিক ভবন রং করা বাবদ সাড়ে ৮ লাখ, অফিস ভবনের গ্রিল স্থাপন ৫ লাখ টাকা, উপজেলা নির্বাহী অফিসারের বাসভবনের টয়লেট নির্মাণ, গেইট নির্মাণ ও বাসা রং করার পৃথক দুটি প্রকল্পে ২০ লাখ টাকা, অফিস ভবন রং করার ১০ লাখ টাকা, উপজেলা পরিষদের সৌন্দর্য বর্ধন ৮ লাখ টাকা, বৃক্ষরোপণ ও শাক-সবজির বাগান ৫ লাখ টাকা, পুকুরের সৌন্দর্য বর্ধন দুই ধাপে ২০ লাখ টাকা, জামে মসজিদ মেরামত ২ লাখ টাকা, অফিসার্স ক্লাব মেরামত ৫ লাখ টাকা এবং উপজেলা চেয়ারম্যানের বাসভবনের টয়লেট মেরামত বাবদ ১০ লাখ টাকা উত্তোলন করা হয়।
যদিও উপজেলা পরিষদ ম্যানুয়াল অনুযায়ী এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই। তারপরেও এসকল প্রকল্প সরেজমিন দেখতে গিয়ে পুকুর সৌন্দর্যবর্ধন ও পরিষদের সীমানায় চুনকাম ছাড়া কোনকিছু চোখে পড়েনি।
এদিকে গত বছরের ৫ আগস্টের পর উপজেলার মাইজবাগ ইউনিয়নের চরশংকর গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য প্রয়াত আব্দুল খালেকের ছেলে নয়ন মিয়া তার বাড়িতে একটি সাবমারসেবল পাম্প বসানোর জন্য প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেন স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়াম্যান ফরিদ মিয়ার কাছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে রাজস্ব ও এডিপি খাতের পিআইসির আওতায় পাম্প নির্মাণের জন্য তার নামে ১ লাখ ২০হাজার টাকা বরাদ্দ আসে। কিন্তু কাজ না করেই পুরো টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়।
একই গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য আবুল কাশেমের নামেও সাবমারসেবল পাম্প বসানোর জন্য বরাদ্দ আসে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা। সেই টাকাও একইভাবে আত্মসাৎ করা হয়। পুরো ইউনিয়নে ৬টি প্রকল্পের মধ্যে কোনটিরও কাজ হয়নি। অথচ সুবিধাভোগিরা তাদের নামে টাকা বরাদ্দের বিষয়টি নিজেরাও জানেন না।
প্রকল্পের সভাপতি ফরিদ মিয়া জানিয়েছেন, কাজ না করে প্রকল্পের টাকা উত্তোলনের বিষয়ে তিনি অবগত নন। এমনটি হতে পারে তিনি বিশ্বাসও করছেন না।
একই অবস্থা উপজেলার ৯ ইউনিয়নে পিআইসির মাধ্যমে নেয়া ৫৯টি প্রকল্পের। এসব প্রকল্পের মোট বরাদ্দ ছিল ৮৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা। প্রকল্পের সভাপতি অনেক ইউপি চেয়ারম্যানরাও জানেন না প্রকল্পের বিষয়ে।
রাজিবপুর ইউনিয়নের চরশংকর গ্রামে গিয়ে কথা হয় নয়ন মিয়ার সাথে। তিনি বলেন, “প্রত্যেকের বাড়িতে কল আছে, আমার নেই। তাই আমি বিষয়টি ফরিদ চেয়ারম্যানের সাথে বলেছিলাম। তিনি আমার সকল কাগজপত্র নিয়েছেন। প্রায়ই সময় তাকে জিজ্ঞাসা করেছি কল কবে পাব? তিনি বলেছিলেন বরাদ্দ আসলে পাব। এখন শুনছি আমার নামে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা এসেছে। কিন্তু আমি তা পাইনি। যারা আমার মত গরিবের হক মেরে খেয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানাচ্ছি।”
একই গ্রামের আবুল কাশেম বলেন, “কল তো দূরের কথা কাগজ জমা দেওয়ার পর কারো সাথে এ বিষয়ে কথা বলারও সুযোগ হয়নি। অপেক্ষায় ছিলাম হয়তো কল পাব। এখন লুটপাটের কথা শুনে অন্তত হলেও অপেক্ষার অবসান হয়েছে। ৫ আগস্টের পর মনে করেছিলাম দেশে অনিয়ম দুর্নীতি বন্ধ হবে। কিন্তু তা না হয়ে আরও বেড়েছে। আমরা আর ভালো হতে পারলাম কই? ছেলে-মেয়েদের রক্তে রাঙা এই নতুন দেশে প্রশাসনিক কর্মকতাদের কাছ এমন অনিয়ম প্রত্যাশিত নয়।”
স্থানীয় আবুল মুনসুর বলেন, “প্রকল্পের নামে কোটি কোটি টাকার নয়-ছয় এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। শুনছি আমাদের ইউনিয়নে ৬টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু একটিরও কাজ হয়নি। যারা প্রকল্পের নামে টাকা আত্মসাৎ করেছে তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হোক।”
মাইজবাগ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও প্রকল্পের সভাপতি ফরিদ মিয়া বলেন, “পিআইসির মাধ্যমে আমার ইউনিয়নে কোনো কাজ হয়নি। সেখানে টাকা তোলারতো প্রশ্নই ওঠে না। এখন শুনছি ৬টি প্রকল্পের নামে টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। কিন্তু আমার কোনোভাবেই বিশ্বাস হচ্ছে না। এমনটি হয়ে থাকলে আমি আইনগত ব্যবস্থা নেব।”
তারুন্দিয়া ইউনিয়নে ৫টি প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া সাত লাখ টাকা। এরমধ্যে অফিস মেরামত ও ল্যাপটপ ক্রয়ে দেওয়া হয় আড়াই লাখ টাকা।
তারুন্দিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও প্রকল্পের সভাপতি মাহমুদ হাসান রানা বলেন, “৫টি প্রকল্পের মধ্যে ড্রেন নির্মাণ দুটি প্রকল্পের কাজ করা হয়েছে। কিন্তু ল্যাপটপ এবং অফিস মেরামতের বরাদ্দের বিষয়ে আমি অবগত নই।”
ঈশ্বরগঞ্জ এলজিইডির উপজেলা বর্তমান প্রকৌশলী আমিনুল ইসলাম বলেন, “প্রকল্পের নামে টাকা উত্তোলন হয়েছে। লোকজন এসে বর্তমান ইউএনও স্যারের কাছে অভিযোগও করেছেন শুনেছি। টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য প্রকল্পের সভাপতিদেরকে তিনি চিঠিও দিয়েছেন। তবে আমি এসে আমার অফিসে প্রকল্পের কোনো কাগজপত্র পাইনি।”
ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এরশাদুল আহমেদ বলেন, “আমি যোগদানের পর আত্মসাৎ করা প্রকল্প বাতিল করে নতুন প্রকল্প দিয়েছি। তারা কাজ না করে কীভাবে টাকা উত্তোলন করেছে সে বিষয়ে আমি অবগত নই। তবে চেয়ারম্যানদেরকে নির্দেশনা দিয়েছি জনগুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করার জন্য।”
তিনি আরও বলেন, “উপজেলা পরিষদের ভেতরে-বাইরে কী কাজ হয়েছে আপনারা তো নিজের চোখেই দেখছেন। আমার বলার কী আছে?”
ঈশ্বরগঞ্জ এলজিইিডির সাবেক ও বর্তমানে হবিগঞ্জের আজমিরীগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলীর দায়িত্বে থাকা আয়েশা আখতার বলেন, “কোন প্রকল্প কী হয়েছে এ বিষয়ে পরে কথা বলব।”
এ কথা বলে মোবাইলের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন তিনি। এরপর কয়েকবার চেষ্টা করেও তাঁর কোন সাড়া পাওয়া যায়নি।
এদিকে বর্তমানে ঈশ্বরগঞ্জের সাবেক ও নান্দাইল উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকা সারমিনা সাত্তার বলেন, ‘‘কাজ চলাকালীন সময়ে আমার বদলি হয়েছে। পরে প্রকল্পের কী হয়েছে না হয়েছে সেটা আমার জানার বিষয় নয়।”
প্রকল্প শেষ না হওয়ার আগে বিল প্রদানের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সেটি করা আমার ভুল হয়েছে।”
ঢাকা/এস