কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে কয়েক মাসে সাজাপ্রাপ্ত ফেরারি আসামিদের অস্ত্রের মহড়া বাড়ছে। ফলে ভারত সীমান্তঘেঁষা কয়েকটি ইউনিয়ন নতুন করে অশান্ত হয়ে উঠেছে। অস্ত্রধারীদের আনাগোনার মধ্যে প্রায়ই গোলাগুলি, লুটপাট, চাঁদাবাজি চলছে।

কয়েক মাসের ব্যবধানে শুধু ফিলিপনগর ইউনিয়নেই এক ইউপি চেয়ারম্যানসহ দু’জন হত্যার শিকার হয়েছেন। অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট হচ্ছে গোয়ালের গরু-মহিষ। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, এসব অপকর্মে সহায়তা করছে পুলিশ। যে কারণে থানায় যেতেও ভরসা নেই তাদের। 

গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে নিজ কার্যালয়ে গুলি করে হত্যা করা হয় ফিলিপনগর ইউপি চেয়ারম্যান নইমুদ্দিন সেন্টুকে। ১ অক্টোবর তাঁর ছেলে আহসান হাবীব বাদী হয়ে দৌলতপুর থানায় হত্যা মামলা করেন। টুকুকে হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ও প্রধান আসামি করা হয়। এ ছাড়া ১০ জনের নাম উল্লেখসহ ৮-১০ জনকে অজ্ঞাতপরিচয় আসামি করা হয়। 

এ হত্যার পেছনে লালচাঁদ বাহিনীর সদস্যরা জড়িত বলে স্থানীয় বিভিন্ন সূত্র নিশ্চিত করেছে। এলাকাবাসী জানায়, ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর পদ্মার চরাঞ্চলের ত্রাস হয়ে ওঠে লালচাঁদের বাহিনী। প্রায় এক দশক ধরে দৌলতপুর, পদ্মার উত্তরপারের নাটোর জেলার লালপুর ও রাজশাহীর বাঘার বিভিন্ন এলাকা ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। ভারত থেকে নদীপথে মাদক পাচার, ডাকাতি, ছিনতাই ও লুটপাটে ছিল তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। ২০০৯ সালের ২৮ এপ্রিল বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন লালচাঁদ। পরে এই বাহিনীর হাল ধরেন তাঁর ছোট ভাই সুকচাঁদ। বর্তমানে এলাকায় আছেন লালচাঁদের সেকেন্ড ইন কমান্ড নাহারুল ইসলাম। তিনি হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত ফেরারি আসামি। নাহারুলের ছেলে মামুন মিয়া এখন স্থানীয় দুর্বৃত্তদের নেতা। গত ৩১ জানুয়ারি রাতে ওই মামলার সাক্ষী ও নিহত সেন্টুর ভাতিজা জাহাঙ্গীরের ওপর হামলা করে দুর্বৃত্তরা। ১১ ফেব্রুয়ারি রাতে উপজেলার মরিচা ইউনিয়নের পদ্মা নদীর চরে রাজু আহমেদ (২০) নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি একই ইউনিয়নের ফারাকপুর ভাঙ্গাপাড়ার ইব্রাহিম প্রামাণিকের ছেলে। ১২ ফেব্রুয়ারি রাজুর মা ডলি খাতুন থানায় মামলা করেন। এ ঘটনার পর থেকে চরাঞ্চল উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। প্রায় প্রতিদিনই গুলি ও বোমাবর্ষণের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। 

এ মামলার প্রধান আসামি সাঈদকে ২২ ফেব্রুয়ারি ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাঁর বাড়ি উপজেলার মরিচা ইউনিয়নের বৈরাগীরচর দক্ষিণ ভাঙ্গাপাড়ায়। সাঈদের বাহিনীর বিরুদ্ধে এলাকায় বালুর ঘাট দখল, অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, অস্ত্র ও মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণসহ নানা অপরাধের অভিযোগ আছে। এসব নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরেই রাজু হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে ধারণা। 

১১ ফেব্রুয়ারি রাতে আবেদের ঘাটে কালু কবিরাজের বাথান থেকে ৩৪টিরও বেশি গরু লুট করে নেয় দুর্বৃত্তরা। আগের রাতে ওই এলাকার সাঈদের বাথান থেকে থেকে অন্তত ৫০টি মহিষ ও ১৫টি গরু লুট হয়। কালু কবিরাজের ভাষ্য, রাখালদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে দুর্বৃত্তরা তাঁর গরু লুটে নেয়। কারা জড়িত জানতে চাইলে বলেন, ‘নাম বললে আমাকে গুলি করে মেরে ফেলবে।’

স্থানীয় একটি সূত্রের দাবি, গরু-মহিষ লুটের পেছনে আছেন নিহত রাজুর চাচা ইউনিয়ন বিএনপির আহ্বায়ক সাইদুর রহমান। সাইদুর রহমান এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, ‘আমি কোনো খারাপ কাজে জড়িত নই। বেশ কিছুদিন ধরে এলাকায় অস্ত্রধারীদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। তাদের গুলিতে আমার ভাতিজা রাজু খুন হয়েছেন। এসব অস্ত্রধারীরাই গরু-মহিষ লুটে জড়িত।’

এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘নাহারুলের ছেলে মামুন এলাকায় ফিরে গণহারে চাঁদা চাইছে। কালু কবিরাজের কাছেও ৫ লাখ টাকা দাবি করে। না পেয়ে গরু লুট করে।’ এসব বিষয়ে মামুন ও তাঁর বাবা নাহারুলের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। 

দৌলতপুর থানার ওসি নাজমুল হুদা বলেন, সাঈদকে রাজু হত্যা মামলায় ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সাঈদের বিরুদ্ধে দৌলতপুর থানায় ৯টি মামলা রয়েছে। তিনি পদ্মার চর এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী ও একটি বাহিনীর প্রধান। 

কুষ্টিয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফয়সাল মাহমুদ বলেন, একটি হত্যাকাণ্ডের পর চরাঞ্চলে গরু-মহিষ লুটের খবর পেয়েছি। কেউ লিখিত দেননি। দিলে ব্যবস্থা নেবেন। কোনো সন্ত্রাসী বাহিনী সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করলে বিশেষ অভিযান চালাবেন।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: দ লতপ র এল ক য় পদ ম র

এছাড়াও পড়ুন:

প্রতিবন্ধী নারীর অনন্য পাঠশালা

গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার গোপালপুর ইউনিয়নের বন্যাবাড়ি গ্রাম। এ গ্রামে এক সাহসী নারীর হাত ধরে গড়ে উঠেছে অসাধারণ এক পাঠশালা। শারীরিক প্রতিবন্ধী হয়েও দারিদ্র্য, প্রতিবন্ধকতা আর সামাজিক সীমাবদ্ধতা জয় করে শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছেন জয়ন্তী রায়।
৪০ বছর বয়সী জয়ন্তীর জীবন কখনও সহজ ছিল না। তিনি কুঁজো, সোজা হয়ে চলতে পারেন না। ঝুঁকে চলতে হয়। এই প্রতিবন্ধকতার কাছে কখনও তিনি মাথা নিচু করেননি। এসএসসি পাস করেও অর্থাভাবে কলেজে যেতে পারেননি। কৃষক হরিচাঁন রায়কে বিয়ে করে আরও কঠিন এক সংসার জীবন শুরু হয়। একমাত্র সন্তানকে নিয়ে টানাপোড়েনের সংসারে এক দিন সিদ্ধান্ত নেন– শুধু নিজের জীবনের উন্নতি নয়, এলাকার শিশুদেরও পড়াতে হবে।
বাড়ির উঠানের এক গাছতলায় মাত্র ১০ জন শিশুকে নিয়ে শুরু হয় তাঁর পাঠশালা। শিশুপ্রতি মাসে ৩০০ টাকা করে নিলেও অনেকেই দিতে পারত ৫০ বা ১০০ টাকা। কিন্তু অর্থ নয়, জয়ন্তীর মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া। ঝড়-বৃষ্টি এলে গাছতলার পাঠশালা সরিয়ে নেওয়া হতো পাশের মন্দিরে।
২০২৪ সালের শুরুর দিকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মঈনুল হক বন্যাবাড়ি গ্রামে একটি রাস্তার কাজ পরিদর্শনে গিয়ে দেখে ফেলেন এই অনন্য পাঠশালা। এর পর থেকেই বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট। ইউএনও জয়ন্তীকে বলেন, অভিভাবকদের কাছ থেকে আর কোনো টাকা নিতে হবে না। উপজেলা অফিস থেকে তাঁর সম্মানী দেওয়া হবে।
২০২৪ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর প্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা করে পেয়েছেন জয়ন্তী। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে তাঁর পাঠশালাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের মন্দিরভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রমে। এখন জয়ন্তী প্রতি মাসে পাচ্ছেন ৫ হাজার টাকা সরকারি বেতন। পাশাপাশি ইউএনওর উদ্যোগে টিআর প্রকল্পের 
আওতায় ১ লাখ ১৪ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়েছে একটি টিনশেড পাঠশালা। লাগানো হয়েছে তিনটি বৈদ্যুতিক পাখাও। জয়ন্তীর বিদ্যালয়ে এখন ৩০ জন শিশু পড়াশোনা করছে।
স্থানীয়রা জানান, এক সময় রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে শিশুদের পাঠ নিতে হতো। এখন সুন্দর ঘরে বিনামূল্যে চলছে পাঠদান।
অভিভাবক শিউলী বিশ্বাস ও সবিতা রায় বলেন, জয়ন্তীর পাঠশালায় তাদের ছেলেমেয়েরা অনেক ভালোভাবে পড়াশোনা করছে। আগে যা কল্পনাও করতে পারেননি তারা। দারিদ্র্যের কারণে তারা অনেকেই শিশুদের পড়ানোর জন্য জয়ন্তীকে টাকা দিতে পারতেন না। ইউএনওর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তারা বলেন, তিনি পাঠশালার 
জন্য একটি ঘর ও জয়ন্তীর পারিশ্রমিকের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এখন বিনা বেতনে এ পাঠশালায় তাদের ছেলেমেয়েরা 
পড়াশোনা করছে।
নিজেই এক সময় আলো থেকে দূরে সরে পড়া জয়ন্তী এখন অন্যদের জন্য বাতিঘর হয়ে উঠেছেন। তিনি বলেন, ‘কোনোদিন ভাবিনি আমার মতো একজন প্রতিবন্ধী নারীও এভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াতে পারে। ইউএনও স্যারের প্রতি কৃতজ্ঞ, যিনি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছেন। যতদিন বাঁচি, ততদিন শিশুদের শিক্ষা দিয়ে যাব।’
টুঙ্গিপাড়ার ইউএনও মঈনুল হক বলেন, এটি একটি অনন্য পাঠশালা। জয়ন্তী যা করেছেন, তা এ সমাজের জন্য দৃষ্টান্ত। এ পাঠশালার শিশুদের জন্য একটি টিনশেড ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। গ্রীষ্মের গরমে শিশুদের কষ্টের কথা ভেবে প্রশাসন থেকে তিনটি পাখার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। জনকল্যাণে উপজেলা প্রশাসন এমন কাজ চালিয়ে যাবে বলে জানান তিনি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ