মঙ্গলবার রাজধানীর এক অনুষ্ঠানে সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ‘মন খুলে’ কিছু কথা বলেছেন; জনপরিসরে সেগুলো ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। রিটায়ার্ড আর্মড ফোর্সেস অফিসার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন (রাওয়া) ক্লাব জাতীয় শহীদ সেনা দিবস উপলক্ষে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।

সেনাপ্রধানের বক্তব্য শুনে মনে হয়েছে, দেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তিনি বিরক্ত। গত সাত মাসে দেশে ‘মব’ বা উচ্ছৃঙ্খল গোষ্ঠীর উৎপাত, নাগরিকের জানমালের নিরাপত্তাহীনতা এবং ‘ফ্যাসিবাদের অবশেষ’ গুঁড়িয়ে দেওয়ার নামে যেসব কাণ্ড ঘটেছে, সেগুলো কেন ঘটছে, কারা ঘটাচ্ছে এবং কেন এগুলো প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না, তাও মোটামুটি সবিস্তার ব্যাখ্যা করেছেন জেনারেল ওয়াকার। তিনি বলেছেন, সেনাবাহিনী ছাড়া রাষ্ট্রের আর একটা প্রতিষ্ঠানও টিকে নেই। আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিভিন্ন বাহিনী ও সংস্থার নামোল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘এই অর্গানাইজেশনগুলোকে আন্ডারমাইন (হেয়) করে যদি আপনারা মনে করেন যে দেশে শান্তিশৃঙ্খলা বিরাজ করবে, সবাই শান্তিতে থাকবেন, এটা হবে না।’ এত সংস্থার কাজ সীমিত শক্তির সেনাবাহিনীর পক্ষে করা সম্ভব নয়– এটাও জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। তিনি কার্যত বলেছেন–  যথেষ্ট হয়েছে; এবার ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক’ নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধিদের হাতে দেশের দায়িত্বভার তুলে দিয়ে সেনাবাহিনীকে নিজের কাজ করতে দিন।

সেনাপ্রধান বলেছেন, ‘আমরা দেশে একটা ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ইনক্লুসিভ ইলেকশনের জন্য (সামনের দিকে) ধাবিত হচ্ছি’ (সমকাল, ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫)। তাঁর এ অবস্থানের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকার বিশেষত প্রধান উপদেষ্টা ড.

মুহাম্মদ ইউনূসও যে একমত, সেটাও জানিয়েছেন। 

সংস্কার ও নির্বাচন নিয়ে জেনারেল ওয়াকার আগেও কথা বলেছেন। গত সেপ্টেম্বরে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এবং গত ডিসেম্বরে প্রথম আলোকে দেওয়া তাঁর দুটো সাক্ষাৎকার এর প্রমাণ। কিন্তু তাঁর মঙ্গলবারের বক্তব্য আরও স্পষ্ট। 

জেনারেল ওয়াকার এমন সময়ে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট সময় এবং ধরন সম্পর্কে বলেছেন, যখন বিষয়গুলো নিয়ে এক প্রকার ঢাকঢাক গুড়গুড় চলছে। বিশেষত বিএনপি ও বিভিন্ন বামপন্থি রাজনৈতিক দল সরকারকে বারবার দ্রুত নির্বাচনের তাগিদ দিয়েও স্পষ্ট কোনো বার্তা পাচ্ছিল না।

আমরা সর্বশেষ, গত ১০ ফেব্রুয়ারি বিএনপি মহাসচিবকে দলের একটি প্রতিনিধি দল নিয়ে ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে উপস্থিত সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলতে শুনেছি, প্রধান উপদেষ্টা আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। গত বিজয় দিবসে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, কম সংস্কার চাইলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে, আর বেশি সংস্কার চাইলে আরও ছয় মাস পর ২০২৬ সালের জুনে নির্বাচন হবে। প্রেস সচিব ১৪ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিকদের এটিই শুনিয়েছেন। এমনকি গত ২৪ ফেব্রুয়ারিও এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি বলেছেন, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা সর্বোচ্চ পরের বছরের মার্চের মধ্যে হবে। 

যেখানে বিএনপি দলীয়ভাবে এ বছরের আগস্টের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন চেয়েছে; সিপিবি, বাসদসহ বাম গণতান্ত্রিক জোট নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ দাবি করেছে, সেখানে জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক কমিটি বলেই চলেছে– আওয়ামী লীগের বিচারের আগে দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। যদিও জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের অত্যন্ত পরিচিত মুখ সারা হোসেন ও ব্যারিস্টার রাশনা ইমামের মতো খ্যাতনামা আইনজীবীরাই বলছেন, এত অল্প সময়ে গ্রহণযোগ্য বিচার অনুষ্ঠান সম্ভব নয়। তড়িঘড়ি বিচার হলে তা দেশের বাইরে তো বটেই, ভেতরেও বিতর্কের জন্ম দেবে। রহস্যজনক হলো, সরকারও বিষয়টি পরিষ্কার করছে না। তাই আদৌ নির্বাচন হবে কিনা– এ সংশয়ও অনেকের মধ্যে বিরাজমান। 

এদিকে স্থানীয় সরকারবিষয়ক উপদেষ্টা একাধিকবার বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জামায়াত নেতারাও নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বৈঠক করে কিছুদিন আগে একই কথা বলেছেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে। অন্যদিকে বিএনপি নেতারা স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে অন্য কোনো নির্বাচন আয়োজন হলে তারা তা ঠেকাবেন। এই নেতারা এমনও বলছেন, ছাত্রদের প্রস্তাবিত দলকে অন্যায্য সুবিধা দিতেই আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। 

সমস্যা হলো, ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি চলছে এবং এর মধ্যে স্থানীয় নির্বাচন করা সম্ভব নয়– নির্বাচন কমিশনের এমন ঘোষণা থাকলেও, সরকার কিন্তু এ বিষয়ে একেবারে স্পিকটিনট। তাই জনমনে নানা সন্দেহ দানা বাঁধছে। রাজনৈতিক পরিস্থিতিও জটিল ও সংঘাতময় হয়ে পড়ছে ক্রমশ।

ছাত্রদের দল গঠনে তিনি নিজে উৎসাহ দিয়েছেন বলে প্রধান উপদেষ্টা লন্ডনের ফিন্যান্সিয়াল টাইমসকে (৩০ জানুয়ারি পত্রিকাটি এ সংক্রান্ত এক পডকাস্টের ট্রান্সক্রিপ্ট ছাপিয়েছে) যা বলেছেন, তাতেও অন্তত নির্বাচন পরিচালনায় অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রাজনৈতিক মহলে এমনও কথা চালু আছে, জাতীয় নির্বাচনটি শেষমেশ হয়তো নতুন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হবে। তেমনটি হলে যে নির্বাচনও পিছিয়ে যেতে পারে, তা বোঝার জন্য কারও বিশেষজ্ঞ হতে হয় না।

মনে আছে, গত সেপ্টেম্বরে রয়টার্সের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন হবে বলায় অন্তর্বর্তী সরকারের সদস্যসহ প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেছিলেন, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার এখতিয়ার একমাত্র প্রধান উপদেষ্টার। তখন এ নিয়ে বিশেষত স্থিতিশীলতার স্বার্থে কথাবার্তা তেমন হয়নি। কিন্তু মঙ্গলবার সেনাপ্রধান ওই একই কথার পুনরাবৃত্তি করেছেন আগের চেয়ে স্পষ্ট করে। এ ক্ষেত্রে তিনি খোদ প্রধান উপদেষ্টাকেই সাক্ষী মেনেছেন। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বড় অংশেরও এতে সায় আছে।

এ ছাড়া আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষত ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের স্পষ্ট বক্তব্যও প্রণিধানযোগ্য। তারা উভয়েই বাংলাদেশে দ্রুত একটা নির্বাচিত সরকার দেখতে চায়।
এদিকে, জনজীবনের নানামুখী সংকট ইতোমধ্যে যতটা গভীরে গেছে, তাতে একদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের কর্মকাণ্ড ও কর্মপদ্ধতি নিয়ে ইতোমধ্যে জনপরিসরে প্রশ্ন উঠছে। সর্বোপরি, গণঅভ্যুত্থানের শক্তিগুলোও পরস্পর সংঘাত-সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। সব মিলিয়ে নানামুখী নৈরাজ্যের হাত থেকে দেশ-জাতিকে বাঁচাতে হলে ডিসেম্বর বা পারলে তারও আগে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানই এখন সবার অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।

সাইফুর রহমান তপন: সহকারী সম্পাদক, সমকাল

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ড স ম বর অন ষ ঠ ন র জন ত ক সরক র র বল ছ ন ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

পাকিস্তানকে এক বছরেই বদলে দিতে পারবেন যুবরাজের বাবা

সমালোচনা তো সবাই করতে পারেন। পথ দেখাতে পারেন কয়জন? খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাওয়া পাকিস্তান ক্রিকেট দলের সমালোচকদের ধুয়ে দিয়েছেন সাবেক ভারতীয় অলরাউন্ডার যুগরাজ সিং। যাঁর আরেকটা পরিচয়, তিনি সাবেক ভারতীয় অলরাউন্ডার যুবরাজ সিংয়ের বাবা। ওয়াসিম আকরামের মতো আরও যাঁরা পাকিস্তানের সমালোচনা করছেন, তাঁদের এত কথা না বলে দলের দায়িত্ব নিতে বললেন যুগরাজ। এমনকি দাবি করলেন, তিনি কোচ হলেও পাকিস্তানকে এক বছরের মধ্যে বদলে দিতে পারবেন।

আরও পড়ুনবাংলাদেশ–পাকিস্তান ম্যাচে বৃষ্টির সম্ভাবনা কতটা১৭ ঘণ্টা আগে

সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে যুগরাজ বলেছেন, ‘ওয়াসিম ধারাভাষ্য দিয়ে টাকা কামাচ্ছে। আমি তাকে বলবো, দেশে ফিরে যাও, এই ক্রিকেটারদের নিয়ে একটা ক্যাম্প করো। আমি দেখতে চাই, তোমরা পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ জেতাতে সাহায্য করতে পারো কি না। না পারলে পদত্যাগ করো।’

ভারতের হয়ে একটি টেস্ট ও ছয়টি ওয়ানডেতে খেলা যুগরাজ এখন কোচিং করান নিজের একাডেমিতে। পাকিস্তানকে নিয়ে তাই একটি চ্যালেঞ্জও দিয়েছেন যুগরাজ, ‘আমি তাদের কোচ হলে, এক বছরের ভেতর এমন দল তৈরি করে দেব, তোমাদের মনে থাকবে। এটা পুরোপুরি প্যাশনের বিষয়। আমি এখানে (নিজের একাডেমিতে) ১২ ঘণ্টা কাটাই। আপনাকে নিজের দেশের জন্য রক্ত ও ঘাম দিতে হবে।’


চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে ঘরের মাঠে নিজেদের প্রথম ম্যাচে পাকিস্তান ৬০ রানে হারে নিউজিল্যান্ডের কাছে। এরপর চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে ৬ উইকেটে হেরে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় নেয়। কাল বাংলাদেশের বিপক্ষে পাকিস্তানের শেষ ম্যাচটি তাই এখন শুধুই আনুষ্ঠানিকতা রক্ষার।

আরও পড়ুনএলোমেলো ক্রিকেট থেকে বের হতে চান নাজমুল২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ