ছাত্র রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফিরিয়ে আনতেই হবে
Published: 27th, February 2025 GMT
জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের পর আমাদের শিক্ষাঙ্গন বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি থাকা উচিত কিনা, সে বিষয়ে বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ ও আলাপ-আলোচনা শুরু হয়েছে।
নব্বই-পরবর্তী সন্ত্রাস, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিনির্ভর লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতির খারাপ অভিজ্ঞতার কারণে, বিশেষ করে গত ১৬ বছরের আওয়ামী শাসনামলে দলটির ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এবং যুবলীগের নজিরবিহীন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও বুদ্ধিজীবীরা জোরালো মতামত দিচ্ছেন।
অন্যদিকে সচেতন নাগরিক বা জনসমাজ ও ছাত্রসমাজের একটি বড় অংশ শিক্ষাঙ্গনে ছাত্র রাজনীতির পক্ষে কথা বলছেন। তারা যুক্তি হিসেবে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন এবং সদ্য ঘটে যাওয়া চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রছাত্রীদের অপরিসীম অবদান তুলে ধরছেন। অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে আদর্শবাদী ছাত্র রাজনীতির ধারা চালু রাখা প্রয়োজন আছে বলে তারা মনে করছেন। আদর্শবাদী ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজন অবশ্যই রয়েছে। সেই রাজনীতি দলীয় জাতীয় রাজনীতির অঙ্গসংগঠন হিসেবে থাকতে পারবে না। সাম্প্রতিক সময়ের ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্র সংস্কার এবং রাষ্ট্র ক্ষমতা-কাঠামোতে জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিত করার তাগিদ ও প্রাসঙ্গিকতা আরও বেশি করে প্রতিভাত হচ্ছে।
আমরা চাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি হবে ছাত্র সংসদ বা স্টুডেন্ট ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে। প্রধানত ছাত্রদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা এবং অভাব-অভিযোগের নিরিখে। এখানে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের ‘নিয়মিত ও বৈধ’ ছাত্রছাত্রী তাদের অধিকার ও স্বার্থের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ বিভিন্ন নামে সংগঠন গড়ে তুলবে এবং ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে, যাতে করে তাদের সঙ্গে কোনোভাবেই জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো লেজুড়বৃত্তি না থাকে। ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সংঘাতমুক্ত হতে হবে। নির্বাচনে যাতে কোনোভাবেই অস্বচ্ছ প্রশাসনিক হস্তক্ষেপ না থাকে এবং দলীয় রাজনৈতিক পেশি শক্তি বা সন্ত্রাসের দাপট নির্বাচনের সুস্থ পরিবেশ ও বিশ্বাসযোগ্যতাকে ম্লান করতে না পারে সেদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে খেয়াল রাখতে হবে। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ফল ঘোষণা পর্যন্ত পুরো নির্বাচনী পরিবেশ স্বচ্ছ, নির্ঝঞ্ঝাট, সৌহার্দ্য ও শান্তিপূর্ণ রাখতে হবে, যাতে সব পক্ষ ভোটের ফল মেনে নেয় এবং পরাজিত পক্ষ বিজয়ী পক্ষকে অভিনন্দন জানায়। এভাবে একটি আদর্শ ‘ছাত্র সংসদ নির্বাচন’ জাতীয় নির্বাচনের আগে মডেল হয়ে উঠতে পারে।
দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি নিয়ে বিগত বছরগুলোতে বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের এবং জনমানুষের অভিজ্ঞতা একেবারেই সুখকর নয়। সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন সময়ে ছাত্ররা ন্যায্য অধিকার আদায়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছে, মানুষের পক্ষে তাদের কণ্ঠ উঁচু করেছে, নিজের জীবন দিতে অগ্রগামী হয়েছে। তবে ছাত্র রাজনীতি বলতে মূলত যা বোঝায়, সেটি এ দেশের শিক্ষাঙ্গনে অনুপস্থিত। এটি আসলে শিক্ষার্থীদের দ্বারা পরিচালিত শিক্ষার্থীদের স্বার্থকে কেন্দ্র করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চর্চা হওয়া রাজনৈতিক পথপরিক্রমা, রাজনৈতিক কর্মশালা, রাজনৈতিক পাঠচক্র বা কার্যক্রমের সমষ্টি। আমরা জনমানুষের মধ্যে ছাত্র রাজনীতির বিষয়ে এক ধরনের নেতিবাচক ধারণা দেখতে পাই। টেন্ডারবাজি, গেস্টরুম বা গণরুম, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, মারধর, ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতির ব্যানারে দখলদারিত্ব– এসব বিষয় ছাত্র রাজনীতির একটি বীভৎস রূপ হিসেবে দেশের মানুষের সামনে হাজির হয়েছে।
যখন ছাত্র রাজনীতির প্রসঙ্গ আসে তখন আমরা বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের দেখা পাই– ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্রশিবির ইত্যাদি। এ রকম বেশ কিছু ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে দেখেছি– যে সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে, তাদের ছাত্র সংগঠন ক্যাম্পাসে একাধিপত্য তৈরির সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। আমরা এটিও দেখেছি, প্রায় ১৬ বছর ধরে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্রলীগ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেস্টরুম কালচার, জোরপূর্বক বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রোগ্রামে নিয়ে যাওয়া; কোনো নেতার বিরুদ্ধে কেউ বিরূপ মন্তব্য করলে এমনকি ফেসবুক পোস্টের জন্যও অনেককে বিপদে বা শাস্তির মুখে পড়তে হয়েছে। এই ধারার অশুভ রাজনীতি আমরা নব্বইয়ের পর থেকে দেখছি।
ছাত্র রাজনীতির সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ আমরা দেখেছি বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যার মধ্য দিয়ে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হলো। যখন জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান চলছিল, তখনও শিক্ষার্থীরা ৯ দফায় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি জানিয়েছিল। আসলে শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতির নামে ক্যাম্পাসে যেসব অপকর্ম এবং অপরাধ হয়ে আসছে, তার বিরোধিতা করেছে; এবং যেহেতু সেসব অপকর্ম রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না, তাই তারা ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের আলাপ জোরালো করেছে। প্রসঙ্গত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রশাসনের নির্লিপ্ত ভূমিকা অত্যন্ত হতাশাজনক। যদি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করে, তাহলে ছাত্র রাজনীতির নামে এসব অপকর্ম সম্ভব হবে না।
আমার বিশ্বাস শিক্ষার্থীরা কারও অধীনস্থ থাকতে চায় না এবং কোনোভাবেই নিজেদের রাজনৈতিক দাসত্বের মধ্যে আটকে রাখতে চায় না। নিজেদের স্বাধীন এবং মুক্তভাবে চলতে পারার আকাঙ্ক্ষা থেকে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের আলাপ উঠেছে। ছাত্র রাজনীতি যখন বুয়েটে বন্ধ করা হলো, তারপর আমরা দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীরা প্রতিবাদী ভূমিকা পালন করেছে। বুয়েটের শিক্ষার্থীরা সাধারণত প্রতিবাদী ভূমিকায় একটু দেরিতে উপস্থিত হয়েছে। তাদের কাছে হয়তো মনে হতো, যে কোনো ধরনের প্রতিবাদী কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করাই ছাত্র রাজনীতি হিসেবে বিবেচিত হবে। এ কারণে তাদের শিক্ষাজীবনে ক্ষতির মুখে পড়তে হতে পারে।
আমরা নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময়ে দেখেছি, ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল যেসব ছাত্র সংগঠন আছে, তারা নিজেরা জোটবদ্ধ হয়ে দলীয় ব্যানারে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কর্মসূচি ঘোষণা করত এবং শিক্ষার্থীরা তাদের ডাকে সাড়া দিত। তখন ছাত্র আন্দোলনগুলো সেভাবে পরিচালিত হতো। ২০১৮ সাল থেকে আমরা ভিন্নতা দেখতে পাচ্ছি; সুনির্দিষ্ট কোনো ছাত্র রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন সংঘটিত হয়নি। ২০২৪ সালে ছাত্র-জনতার যে অভ্যুত্থান দেখেছি, সেখানে ছাত্র সংগঠনগুলোর অংশগ্রহণ আমরা দেখেছি, কিন্তু নেতৃত্বের প্রশ্নে এককভাবে বা দলীয় ব্যানারে ছাত্র সংগঠনগুলোকে আমরা আসতে দেখিনি।
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ছাত্রছাত্রীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবে নিজেদের মতামত ব্যক্ত করতে চায়। দলীয় রাজনৈতিক পরিচয়ে না থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে চায় এবং দলীয় ব্যানারের বাইরে এসে সংগঠিত হতে চায়। এ প্রবণতাকে আমরা ইতিবাচকভাবে দেখতে চাই।
গণঅভ্যুত্থানের পর এসব বিষয় বিদ্যমান ছাত্র সংগঠনগুলোকে আমলে নিতে হবে এবং তাদের খুঁজে বের করতে হবে কীভাবে তারা শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন করবে। যেহেতু ৩৪ বছর ধরে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলোকে দেখে অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীরা একটি অনাস্থার জায়গায় চলে এসেছে, সেই আস্থা ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য প্রতিটি সংগঠনকে কথায় এবং কাজে প্রমাণ দিতে হবে– তারা আসলেই কোনো রাজনৈতিক দলের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কাজ করছে না। তারা শিক্ষার্থীদের ন্যায্য অধিকার, গবেষণা, দেশীয় স্বার্থের বিষয়ে সোচ্চার ভূমিকা রাখবে। কোনোভাবেই ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে তারা যুক্ত করবে না। যদি এসবের ব্যত্যয় ঘটে, সে ক্ষেত্রে কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। সম্প্রতি কুয়েটে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক সহিংসতা আবার নতুন করে আমাদের দুশ্চিন্তায় ফেলেছে। তারপরও আমরা মনে করি, দেশের কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিয়মিতভাবে প্রতিবছর ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতিকে সুস্থ, ইতিবাচক ও গঠনমূলক ধারায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব।
শেখ নাহিদ নিয়াজী: সহযোগী অধ্যাপক; ইংরেজি বিভাগ; স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
nahidneazy@yahoo.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ছ ত র র জন ত ছ ত র স গঠনগ ল ছ ত র র জন ত র গণঅভ য ত থ ন ছ ত র স গঠন র জন ত ক প র র জন ত ক য় র জন ত
এছাড়াও পড়ুন:
শহীদ পরিবারে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঈদ উপহার বিতরণ
জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানে বীর শহীদ হওয়া নারায়ণগঞ্জ জেলার ২২টি শহীদ পরিবারের মাঝে ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড (WEWB) অর্থায়নে ঈদ উপহার ও নগদ অর্থ বিতরণ করেছে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন, নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর কমিটি।
ঈদুল ফিতর উপলক্ষে শহীদ পরিবারগুলোর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে সংগঠনটি এই মানবিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। বৃস্পতিবার(২৭ই মার্চ) সকালে সোনারগাঁ বালুয়াদিঘির পাড়ে শহীদ জনির পরিবারের মাঝে এই উপহার দিয়ে কার্যক্রম শুরু করে
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন নারায়ণগঞ্জ জেলার মূখ্য সংগঠক জাহিদুল হক বাঁধন বলেন, "গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের আত্মত্যাগ আমাদের কাছে চিরস্মরণীয়। তাঁদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।"
উপহার সামগ্রী বিতরণকালে সংগঠনের নেতৃবৃন্দ শহীদ পরিবারগুলোর সঙ্গে সময় কাটান এবং তাঁদের খোঁজখবর নেন।
যুগ্ম সদস্য সচিব অনিক খান সিয়াম বলেন, এই উদ্যোগ ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে এবং আমরা ভবিষ্যতেও শহীদ পরিবারের পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন।
এসময় আরো উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সহ মুখপাত্র সাব্বির আল রাজ, সদস্য ইরফান সাদিক, হোসাইন ভূইয়া,আজিম আল হাসান প্রমুখ।