শেয়ারবাজারকে রাজনৈতিকভাবে শোষণ করা হয়েছে: আমীর খসরু
Published: 26th, February 2025 GMT
‘অতীতে বাংলাদেশের কোনো সরকারই শেয়ারবাজারকে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে ধারণ (ওউন) করেনি। এ কারণে শেয়ারবাজার সব সরকারের আমলে কমবেশি অবহেলিত ছিল। আর আওয়ামী লীগ সরকার শেয়ারবাজারকে রাজনৈতিকভাবে শোষণ করেছে। আগামী দিনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়ে বিএনপি সরকার গঠন করলে আমরা শেয়ারবাজারকে “ওউন” করব। এটিকে অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তির অবস্থানে নিয়ে আসা হবে।’
শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে ব্রোকারেজ হাউস মালিকদের সংগঠন ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশন (ডিবিএ) আয়োজিত এক আলোচনা সভায় কথাগুলো বলেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। আজ বুধবার রাজধানীর নিকুঞ্জে ডিএসই টাওয়ার মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এই আলোচনা সভায় তিনি প্রধান অতিথি ছিলেন।
আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, দেশের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানগুলো গত ১৫–১৬ বছরে রাজনৈতিক ব্যবস্থা বা রাজনীতিকরণের সঙ্গে একাকার হয়ে গেছে। ফলে এসব প্রতিষ্ঠান তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন না করে উল্টো রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে মিলে গিয়েছিল। এ কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসি স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করেনি। আবার মাত্রাত্রিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে অবিশ্বাস্য রকমের দুর্নীতির বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। তাই আগামী দিনে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় এলে এই নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা শিথিল করা হবে।
ডিবিএর সভাপতি সাইফুল ইসলামের সঞ্চালনা ও সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ আলোচনায় সম্মানিত অতিথি ছিলেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী। এতে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর। প্যানেল আলোচক ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সাবেক ব্যাংক সুপারভাইজার সাবিদ সিদ্দিকী, ইংরেজি দৈনিক বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড–এর সম্পাদক ইনাম আহমেদ, অর্থনীতিবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন ইআরএফের সভাপতি দৌলত আকতার, পুঁজিবাজারবিষয়ক সাংবাদিকদের সংগঠন সিএমজেএফের সভাপতি গোলাম সামদানী।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি নেতা জহির উদ্দিন স্বপন, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের (সিএসই) চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ, ডিএসইর সাবেক পরিচালক আহমেদ রশিদ লালী প্রমুখ। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন ডিএসইর পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন। আলোচনার শুরুতে শেয়ারবাজারের গত ১৫ বছরের পরিস্থিতি ও সমস্যা সমাধানে করণীয় বিষয়ে পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনা দেন ডিবিএর জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মো.
প্রধান অতিথির বক্তব্যে আমীর খসরু মাহমুদ বলেন, পুঁজিবাজারে নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ ওয়াচডগের। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের সময় সংস্থাটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে একাকার হয়ে যাওয়ায় তারা ওয়াচডগ হিসেবে তাদের ভূমিকা পালন করেনি। একই অবস্থা ছিল ব্যাংক খাতেও। এ জন্য অর্থনীতির এই দুই খাতে বড় ধরনের লুটপাট ও কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটেছে। সর্বক্ষেত্রে যেভাবে ওভার রেগুলেশন বা মাত্রাতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা চালু করা হয়েছে, সেখান থেকে অর্থনীতিকে টেনে তুলতে হলে ডিরেগুলেশন বা নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা শিথিল করতে হবে। তা না হলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে না।
বর্তমান পুঁজিবাজারসহ সব ক্ষেত্রে বিনিয়োগের জন্য বিনিয়োগকারীরা রাজনৈতিক সরকারের অপেক্ষায় রয়েছে বলে মন্তব্য করেন আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার ছাড়া বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আস্থা পাবেন না। তাই যত তাড়াতাড়ি নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হবে, বিনিয়োগকারীদের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ ততই সুবিধাজনক হবে।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময় শেয়ারবাজার লুটপাটকারীদের বিচার নিশ্চিত করারও দাবি জানান বিএনপির শীর্ষস্থানীয় এই নেতা। তিনি বলেন, যারা বাজারে কারসাজি করেছে, ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের অর্থ লুটপাট করেছে, তাদের বিচার করতেই হবে। তাদের বিচারের মাধ্যমেই শেয়ারবাজারে নতুন দিনের সূচনা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে ব্রোকারেজ হাউস মালিকদেরও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, পুঁজিবাজারের সুশাসন এখন প্রশ্নবিদ্ধ। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির গত দুই কমিশন নিয়ে নানা কথা শোনা যায়। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগও শোনা যায়, যা দুঃখজনক। প্রশ্নবিদ্ধ নানা কোম্পানিকে তারা বাজারে এনেছে। অনেক ক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জের মতামতকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সেসব কোম্পানি এখন বাজারের জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে বাজার অংশীজনদের সঙ্গে যে দূরত্ব থাকার কথা, তা গত কমিশনের সময় হারিয়ে গেছে। বিদেশে রোড শোর নামে পিকনিক করতে গিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ও নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রতিষ্ঠান একে অপরের বন্ধু হয়ে গেছে।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী আরও বলেন, অর্থনীতিতে গতি না ফিরলে শেয়ারবাজারেও গতি আসবে না। নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার না আসা পর্যন্ত বেসরকারি খাত বিনিয়োগ করবে না। আর বেসরকারি বিনিয়োগ না বাড়লে পুঁজিবাজারও সমৃদ্ধ হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভের সাবেক কর্মকর্তা সাবিদ সিদ্দিকী বলেন, পুঁজিবাজারের ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের আস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর আস্থার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিষয় তথ্যের সত্যতা। কোম্পানিগুলো যে তথ্য দেয় তা যদি যথাযথ না হয়, তাহলে বিনিয়োগকারীদের আস্থায় চিড় ধরে। আর তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করতে হলে কোম্পানির নিরীক্ষকদের আরও বেশি তদারকি ও জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এ ছাড়া শেয়ারবাজারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে অনিয়ম, দুর্নীতিসহ যেসব ‘মোরাল হেজার্ড’ আছে, সেগুলো দূর করতে হবে।
অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বাংলাদেশের মতো ছোট একটা বাজারে এত বেশি তদন্ত ও তদন্ত কমিটি হয়, যা বিশ্বের আর কোনো দেশে হয় না। গত সরকারের সময়ে রাজনৈতিক বন্দোবস্তের মাধ্যমে যে ‘অলিগার্ক’ শ্রেণিগোষ্ঠী তৈরি হয়েছিল, তার উদাহরণ শেয়ারবাজারও। এই বাজারে বিনিয়োগের নানা গল্প তৈরি করে শেয়ারের দাম বাড়ানো ও কমানোর মতো ঘটনা ঘটেছে। আর এটি সম্ভব হয়েছে কোম্পানিগুলোতে আত্মীয়স্বজনদের স্বতন্ত্র পরিচালক করে রাখায়।
বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড সম্পাদক ইনাম আহমেদ বলেন, শেয়ারবাজারকে রাজনীতিকরণের বাইরে রাখতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে বাজারের স্বচ্ছতা। আর বাজারের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হলে মিডিয়াকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।
ডিবিএর সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, গত ১৫ বছরে স্টক এক্সচেঞ্জ পরিচালনায় স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের নামে রাজনীতিকরণ করা হয়েছে। ডিমিউচুয়ালাইজেশনের (মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা আলাদা করা) নামে রিমিউচুয়ালাইজড হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা তাদের পছন্দের লোকদের পরিচালক পদে বসিয়েছে। ফলে স্টক এক্সচেঞ্জগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির বদলে আরও দুর্বল হয়েছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স বতন ত র প র জন ত ক ব ন শ চ ত কর সরক র র ব যবস থ ক আহম দ ব এসইস ন ত কর র সময় ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
সাংবাদিক নেতাদের প্রতিবাদ: নোয়াবের সিদ্ধান্ত সাংবাদিকদের সঙ্গে চরম নিষ্ঠুরতা
আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে নিউজপেপার ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (নোয়াব) সংবাদপত্রে তিন দিন বন্ধের ঘোষণার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করায় তীব্র ক্ষোভ ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে), ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন (ডিইউজে), ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি (ডিআরইউ), ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) ও ঢাকা সাব এডিটরস কাউন্সিল (ডিএসইসি)।
বুধবার এক যুক্ত বিবৃতিতে এ প্রতিবাদ জানানো হয়।
বিবৃতিতে বিএফইউজে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ওবায়দুর রহমান শাহীন, মহাসচিব কাদের গণি চৌধুরী, ডিইউজে সভাপতি মো. শহিদুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক খুরশীদ আলম, রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি আবু সালেহ আকন, সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হাসান সোহেল, ইআরএফের সভাপতি দৌলত আখতার মালা, সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম এবং ডিএসইসির সভাপতি মোক্তাদির অনীক ও সাধারণ সম্পাদক জাওহার ইকবাল খান বলেন, সাংবাদিকদের সংগঠনগুলো নোয়াবের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনা করে ঈদ ছুটি বৃদ্ধির দাবি জানিয়ে ছিল। কিন্তু নোয়াব এখনও সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না করায় এবং সাংবাদিকদের দাবি আমলে না নেওয়ায় তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানাচ্ছি।
নোয়াবের ঘোষণা অনুযায়ী ৩০ ও ৩১ মার্চ এবং ১ এপ্রিল ছুটি থাকবে। তবে চাঁদ দেখা সাপেক্ষে ঈদুল ফিতর ১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হলে সে ক্ষেত্রে পরদিন ২ এপ্রিল সংবাদপত্র বন্ধ থাকবে। নোয়াবের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে তারা বলেন, এবার ঈদে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দীর্ঘ ছুটি পাচ্ছেন। ঈদে টানা পাঁচ দিন সরকারি ছুটির সঙ্গে এবার আগে-পরেও মিলছে স্বাধীনতা দিবস, শবে কদর ও সাপ্তাহিক ছুটি। সবকিছু মিলিয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মার্চের শেষ সপ্তাহ ও এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ যাবে ছুটির মধ্যে। অথচ সংবাদ মাধ্যম কর্মীদের কথা বিবেচনায় না নিয়ে নোয়াবের মাত্র ৩ দিনের ছুটি ঘোষণা চরম নিষ্ঠুরতা ছাড়া কিছু নয়।
বিবৃতিতে তারা আরও বলেন, আমরা নোয়াবের এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং ছুটি বৃদ্ধির দাবি করছি। কারণ, সারা জাতি যখন বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করছে তখন নোয়াব গণমাধ্যমকর্মীদের নতুন করে বৈষম্যের দিকে ঠেলে দেওয়া অমানবিক-নিষ্ঠুরতা ছাড়া কিছু না। সাংবাদিক সমাজের যৌক্তিক দাবিকে আমলে নিয়ে ছুটি বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছেন সাংবাদিক নেতারা।