জুলাই–আগস্ট আন্দোলনের পর দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুরোটা ভেঙে পড়েছিল। সেখান থেকে একটু একটু করে পরিস্থিতি উন্নতির দিকে গেলেও সম্প্রতি আবারও আইনশৃঙ্খলার অবনতি চরমভাবে লক্ষণীয়। সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থান রাজধানী ঢাকায়। প্রতিমুহূর্তে আতঙ্কে আছেন রাজধানীবাসী। বাইরে কিংবা ঘরে কোথাও নিরাপদবোধ করেছেন না বাসিন্দারা। রাস্তায় ছিনতাই, বাসে ডাকাতি, ধর্ষণ, বাসায় ডাকাতি, গুলি—এমন ঘটনা পত্রিকার পাতার নিত্যদিনের খবর।

জনগণের প্রশ্ন—কেন এমন হচ্ছে? আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গড়া সরকার কেন নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না? পুলিশকে কেন এখনো সক্রিয় করতে পারছে না সরকার? কারা ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করছে? শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেন মুক্তি দেওয়া হলো? স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা করছেনই–বা কী? ‘ডেভিল হান্ট’ অভিযানে কী হচ্ছে?—এমন নানা প্রশ্ন মানুষের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু উত্তর পাচ্ছেন না কেউই।

সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বা পাওয়া সহজ নয়, কিন্তু ধারণা পাওয়া যায় অনেক কিছু। সম্প্রতি রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় ব্যবসায়ীকে ৪টি গুলি করে ২০০ ভরি সোনা ছিনতাই করে সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনার পর দিবাগত রাত তিনটার দিকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন। বেশ কিছুদিন হলো তাঁর পদত্যাগের আলাপ তুলেছেন ছাত্রসমাজ থেকে শুরু সর্বস্তরের মানুষ। সংবাদ সম্মেলনে তাঁকে এ বিষয়ে অবগত করেনও সাংবাদিকেরা। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, আওয়ামী লীগের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার সব ধরনের চেষ্টা করছে। দেশ থেকে সরিয়ে নেওয়া প্রচুর টাকা তারা এ কাজে ব্যবহার করছে। এটা কোনো অবস্থাতেই করতে দেবে না সরকার। যেভাবে হোক, এটা প্রতিহত করা হবে।

৫ আগস্টের পর অর্ধডজন শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে বের হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এই সন্ত্রাসীরা আগে জেলে বসেই তাদের কার্যক্রম চালিয়েছে। জেলে বসেই যখন তারা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে, তাহলে এখন মুক্ত বাতাসে তাদের কার্যক্রম কেমন হতে পারে! বিশেষজ্ঞরা তাদের মুক্তির পরই শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। রাজধানীর অপরাধজগৎ আরও তৎপর হবে বলে অনেকেই বলেছেন। সেটি দিন যত যাচ্ছে, তা প্রকট হচ্ছে।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আর কোথাও কোনো অপরাধ যেন না ঘটে, তাঁরা সে ব্যবস্থা নেবেন। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যদি এই নির্দেশনা কার্যকর না করতে পারে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।

আদৌ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার হুঁশিয়ারিতে কাজ হবে কি না বা রাজধানীবাসীর ভয়ের পরিবেশ কাটবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। তবে আওয়ামী লীগের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করেছে—স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার এ বক্তব্য উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আওয়ামী লীগের পলাতক অনেক নেতার অডিও বা ভিডিও বক্তব্য থেকেও এ কথা স্পষ্ট। একটি অডিওতে এক নেতাকে বলতে শোনা গেছে, ‘আমাদের লোকেরা ঢাকায় শান্তিতে দিনের বেলায় চলতে না পারলে আমরাও ঢাকার কাউকে শান্তিতে ঘুমাতে দেব না।’

তবে যে–ই এসব কাজ করুক না কেন, এটি নিয়ন্ত্রণের কাজ তো স্বরাষ্ট্র দপ্তরের। কিন্তু তারা সেটা করতে পারছে না; এটি স্পষ্ট।

৫ আগস্টের পর অর্ধডজন শীর্ষ সন্ত্রাসী জামিনে বের হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, এই সন্ত্রাসীরা আগে জেলে বসেই তাদের কার্যক্রম চালিয়েছে। জেলে বসেই যখন তারা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে, তাহলে এখন মুক্ত বাতাসে তাদের কার্যক্রম কেমন হতে পারে! বিশেষজ্ঞরা তাদের মুক্তির পরই শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন। রাজধানীর অপরাধজগৎ আরও তৎপর হবে বলে অনেকেই বলেছেন। সেটি দিন যত যাচ্ছে, তা প্রকট হচ্ছে।

আরও পড়ুনছিনতাইকারী হলেই কি পিটিয়ে মারা যাবে৩ ঘণ্টা আগে

প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জামিনে মুক্ত হওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে আছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খাতায় ‘কিলার আব্বাস’ হিসেবে পরিচিত মিরপুরের আব্বাস আলী, তেজগাঁওয়ের শেখ মোহাম্মদ আসলাম ওরফে সুইডেন আসলাম, মোহাম্মদপুরের ইমামুল হাসান হেলাল ওরফে পিচ্চি হেলাল, হাজারীবাগ এলাকার সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন। এ ছাড়া ঢাকার অপরাধজগতের আরও দুই নাম খন্দকার নাঈম আহমেদ ওরফে টিটন ও খোরশেদ আলম ওরফে রাসু ওরফে ফ্রিডম রাসুও কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তাঁরা ইতিমধ্যে পুরো শহরে ত্রাস সৃষ্টি করছেন। আধিপত্য বিস্তার, ছিনতাই, খুন, চাঁদাবাজিতে যিনি যাঁকে পারছেন ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। তৈরি করছেন নতুন গ্যাং।

একটা ঘটনা তুলে ধরলে তাঁদের তৎপরতা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। আমার এক বন্ধু এলাকা থেকে কিছুদিন আগে পাড়ি জমিয়েছে রাজধানীতে। থাকছেন হাজারীবাগ এলাকায়।

সম্প্রতি আমার সামনে আমার আরেক বন্ধু অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন দিয়ে তাঁর সঙ্গে মজা করতে নিজেকে হাজারীবাগ থানার পুলিশ কর্মকর্তা পরিচয় দেন। অপর পাশ থেকে আমার বন্ধু ওই ছেলেটি বলেন, ‘আমি ইমন ভাইয়ের (সানজিদুল ইসলাম ওরফে ইমন) সঙ্গে কাজ করি। আপনি আমাকে খুঁজছেন কেন? আপনি কোথায় আছেন?’ আমার বন্ধু তাঁকে বলেন, ‘আমি থানায় আছি, আপনার নামে কিছু অভিযোগ আছে।’ উত্তরে বিশ্রী ভাষায় গালি দিয়ে আমার বন্ধু বলেন, ‘তোকে দেখতেছি, থানায় থাকিস, আসতেছি আমি। ইমন ভাইকেও তোর কথা বলতেছি।’ এমন অনেক কথোপকথন চলে।

এ ঘটনা দিয়ে বোঝা যায়, মুক্তি পাওয়া সন্ত্রাসীরা কতটা তৎপর। নতুন ছেলেরা এসে তাদের অধীন অথবা অধীন না থাকলেও তাদের কথা বলে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করছে। তারা এতটাই ভয়ংকর যে পুলিশ পরিচয় দেওয়ার পরও তারা ক্ষিপ্ত হয়। থানায় গিয়ে নিজের জাত চেনাতে চায়। ভাইয়ের ছত্রচ্ছায়ায় থাকি—এই হুংকার দেয়।

এমন ঘটনা শহরে শত শত। মার্কেট দখল, ফুটপাত দখল, ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ থেকে শুরু করে অপরাধের প্রতিটি ক্ষেত্রে তারা বিচরণ করছে। এই সন্ত্রাসীদের জামিন দেওয়ার পর তাদের ওপর নজরদারি করার কথা বলেছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। পুরোনো অপরাধের নেটওয়ার্ক সচলের আগেই তাদের থামানো দরকার ছিল। তা তারা করেনি, তাই হয়তো আজ ছাত্র-জনতার নতুন বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা নষ্ট হচ্ছে।

সর্বোপরি শীর্ষ সন্ত্রাসী বা আওয়ামী লীগের দোসর—যে বা যারাই দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালাচ্ছে, তাদের আটকানোর দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার অথবা সরকারের।

গোলাম ওয়াদুদ প্রথম আলোর সহসম্পাদক

[email protected]

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: অপর ধ ব যবস সরক র আওয় ম ম ওরফ

এছাড়াও পড়ুন:

পাহাড়ি পাঁচ শিক্ষার্থী অপহরণের প্রতিবাদে বিক্ষোভের ডাক

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) পাঁচ পাহাড়ি শিক্ষার্থী অপহরণের প্রতিবাদে রোববার তিন পার্বত্য জেলা, সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধনের ডাক দেওয়া হয়েছে।

শনিবার বিকেলে চাকসু ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় আদিবাসী শিক্ষার্থীদের ব্যানারে এ কর্মসূচি দেওয়া হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে যথাযথ পদক্ষেপ নিচ্ছে না অভিযোগ করে তিন দাবি তুলে ধরা হয়।

দাবিগুলো হলো– পাঁচ শিক্ষার্থীকে সুস্থ অবস্থায় দ্রুত মুক্তি, তাদের উদ্ধারে প্রশাসনের জোরালো ও কার্যকর ব্যবস্থা এবং অপহরণকারীদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে।

বিজু উৎসব শেষে চবি ক্যাম্পাসে ফেরার পথে গত বুধবার ভোরে খাগড়াছড়ি সদরের গিরিফুল এলাকা থেকে রিশন চাকমা, অলড্রিন ত্রিপুরা, মৈত্রীময় চাকমা, দিব্যি চাকমা ও লংঙি ম্রোকে অপহরণ করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় জেএসএস সমর্থিত পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের কেন্দ্রীয় সভাপতি নিপুন ত্রিপুরা ইউপিডিএফকে দায়ী করলেও, অস্বীকার করেছেন সংগঠনের জেলা সংগঠক অংগ্য মারমা।

শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে যৌথ বাহিনী খাগড়াছড়ির বিভিন্ন স্থানে অভিযান অব্যাহত চালাচ্ছে। শনিবারও খাগড়াছড়ি সদরের ভাইবোন ছড়াসহ কয়েকটি স্থানে অভিযান চালানো হয়। তবে চার দিনেও অপহরণে জড়িত কাউকে আটক করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এ ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা জানান, তিনি প্রাণপণ চেষ্টা চালাচ্ছেন শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে। সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ভালো ভূমিকা নিয়েছে। শিক্ষার্থীরা মুক্ত হওয়ার পর আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে চবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী জাল্লাং এনরিকো কুবি বলেন, অপহরণের পর শিক্ষার্থীদের উদ্ধারে চবি প্রশাসন, খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। চার দিনেও আমরা তাদের কোনো খোঁজ পাইনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আদিবাসী শিক্ষার্থীরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, তিন পার্বত্য জেলা শহর, মহানগরে বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধনে সংহতি জানাতে সচেতন, মানবিক, প্রগতিশীল ছাত্র এবং নাগরিক সমাজের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

সংবাদ সম্মেলনে পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের চবি শাখার সভাপতি অন্বেষ চাকমা বলেন, ‘স্থানীয় বাসিন্দা ও বিভিন্ন সূত্রে আমরা এ অপহরণে ইউপিডিএফের জড়িত থাকার বিষয় জানতে পেরেছি। যে এলাকা থেকে অপহৃত হয়েছেন, সেটিও ইউপিডিএফ অধ্যুষিত।’

তিনি বলেন, ‘অভিভাবকদের ডেকে নিয়ে অপহরণকারীরা কী বলেছে, তা জানা সম্ভব হয়নি। তবে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অভিভাবকদের দেখা করতে দেওয়া হয়নি জেনেছি।’

সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক শাংথুই প্রু, ইতিহাস বিভাগের শিক্ষার্থী ভুবন চাকমা, পহেলা চাকমা, পালি বিভাগের উহ্লাথোয়াই মারমা প্রমুখ।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • পাহাড়ি পাঁচ শিক্ষার্থী অপহরণের প্রতিবাদে বিক্ষোভের ডাক
  • আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিলের বিরুদ্ধে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা পেলে কঠোর ব্যবস্থা: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
  • আওয়ামী লীগ যেন মিছিল করতে না পারে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে 
  • আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হলে পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে  
  • আ.লীগের মিছিল ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার
  • ভোলাগঞ্জে বিজিবির সদস্যদের ওপর চড়াও অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনকারীরা
  • অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ২ মাসে আড়াই হাজার গ্রেপ্তার
  • উদ্ধারপ্রক্রিয়ায় এলাকাবাসীকে যুক্ত করুন
  • আইনের হাত বনাম নিজের হাত