মহাকুম্ভ শেষ, ১৪৪ বছর পর এমন আয়োজন নিয়ে শঙ্কা পরিবেশবাদীর
Published: 26th, February 2025 GMT
শেষ হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল ধর্মীয় অনুষ্ঠান মহাকুম্ভ। ভারতের উত্তর প্রদেশের প্রয়াগরাজে (সাবেক এলাহাবাদ) গঙ্গা, যমুনা ও অন্তঃসলীলা সরস্বতীর সঙ্গমস্থলে বুধবার শিবরাত্রির দিন শেষ অবগাহনের মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটতে চলেছে ৪৫ দিনব্যাপী মহাকুম্ভের। মঙ্গলবার রাত দুইটা থেকে শুরু হয় শেষ তিথির স্নান, আজ বুধবার দিনাবসানের মধ্য দিয়ে তা শেষ হতে চলেছে। শেষ দিন সঙ্গমে জড়ো হওয়া পুণ্যার্থীদের ওপর আকাশ থেকে বর্ষিত হয় ফুলের পাপড়ি। এত দিন ধরে এত মানুষের উপস্থিতিতে এমন ধর্মীয় আচার ভারতে আগে কখনো হয়নি।
মহাকুম্ভ আজ শেষ হলেও ভবিষ্যতে এই আয়োজনস্থল পরিবেশগত বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে বলে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছেন ভারতের পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সোনম ওয়াংচুক। তিনি বলেছেন, পরিবেশের যে ক্ষতি হচ্ছে, তাতে ১৪৪ বছর পর আয়োজিত মহাকুম্ভে পুণ্যার্থীদের সঙ্গমে জলের পরিবর্তে বালিয়াড়িতে ডুব দিতে হবে।
এবারের মহাকুম্ভ শুরু হয়েছিল ১৩ জানুয়ারি, পৌষপূর্ণিমার পুণ্যস্নানের মধ্য দিয়ে।
পরদিন ১৪ জানুয়ারি ছিল মকরসংক্রান্তি। তার পরের পুণ্য তিথি ছিল ২৯ জানুয়ারির মৌনী অমাবস্যা, যেদিন ঘটে যায় পদপিষ্ট হওয়ার মতো দুঃখজনক ঘটনা। ওই দুর্ঘটনাও পুণ্যার্থীদের স্রোত কমাতে পারেনি। বসন্তপঞ্চমী (৩ ফেব্রুয়ারি), মাঘীপূর্ণিমা (১২ ফেব্রুয়ারি) এবং ২৬ ফেব্রুয়ারির শিবরাত্রির দিন শাহি স্নান উপলক্ষে কোটি কোটি মানুষ প্রয়াগরাজে ভিড় করেছেন। কোটিপতির সঙ্গে সাধারণ মানুষ, খ্যাতনামার পাশাপাশি অখ্যাত–অজ্ঞাত সবাই মিলেমিশে অবগাহন করেছেন সঙ্গমে। মারাত্মক জলদূষণের বিতর্কও দমাতে পারেনি পুণ্যলোভী জনতাকে। বিজ্ঞান ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে বিশ্বাস।
মহাকুম্ভে কোটি কোটি মানুষ এবার যেখানে ডুব দিয়েছেন, সঙ্গমের সেই এলাকার গভীরতা হাঁটুজলের বেশি নয়। আরও ১৪৪ বছর পর এবারকার মতো গ্রহ–নক্ষত্রের মহামিলন মহাতিথির জন্ম দিলে মহাকুম্ভের যে আসর বসবে, সে সময় সঙ্গমস্থলে জলের ক্ষীণ প্রবাহও থাকবে না বলে সাবধান করে দিয়েছেন লাদাখের পরিবেশ আন্দোলনকর্মী শিক্ষাবিদ সোনম ওয়াংচুক। আমির খানের তৈরি ‘থ্রি ইডিয়টস’–এর ‘র্যাঞ্চো’ বাস্তবের সোমন ওয়াংচুক দিল্লিতে সবাইকে সতর্ক করে মঙ্গলবার বলেছেন, লাদাখসহ গোটা হিমালয়ে উষ্ণায়ন, সেনানীদের দাপাদাপি, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন পরিবেশের যে ক্ষতি করে চলেছে, তাতে ১৪৪ বছর পর আয়োজিত মহাকুম্ভে পুণ্যার্থীদের সঙ্গমে জলের পরিবর্তে বালিয়াড়িতে ডুব দিতে হবে।
পরিসংখ্যান দেখিয়ে সোনম বলেছেন, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন যে হারে ঘটছে, তাতে ২০৫০ সালে পৃথিবীর অধিকাংশ হিমবাহের দৈর্ঘ্য এক–তৃতীয়াংশ কমে যাবে। হিমালয়ের হিমবাহগুলো ক্রমে পেছিয়ে যাচ্ছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, লাদাখের নুব্রা উপত্যকায় খারদুংলা হিমবাহ পার হতে সেনাবাহিনী লোহার সেতু তৈরি করেছিল ১৯৯২ সালে। আজ সেই হিমবাহ ৫০০ মিটার পেছিয়ে গেছে। সেতুর প্রয়োজন ফুরিয়েছে।
সরকারকে সতর্ক করে সোমন বলেছেন, হিমালয় থেকে উৎপত্তি গঙ্গা, যমুনার মতো নদীগুলো হিমবাহ–নির্ভর। হিমবাহ বাঁচানো না গেলে এসব নদী বর্ষানির্ভর হয়ে পড়বে। তেমন হলে ১৪৪ বছর পর সঙ্গমে হাঁটুজলও থাকবে না। মহাকুম্ভর আসরে মানুষকে বালুতে ডুব দিতে হবে। সোমন বলেছেন, হিমবাহ রক্ষায় সচেতনতা বাড়াতে জাতিসংঘ ২০২৫ সালকে ‘হিমবাহ বছর’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে তাঁর অনুরোধ, হিমালয়ের হিমবাহ এলাকাগুলো যাতে সব দেশ সেনাহীন অঞ্চল বা ‘নো মিলিটারি জোন’ ঘোষণা করে, সে জন্য তিনি সচেষ্ট হন। হিমবাহ রক্ষায় কমিশন গঠন করার প্রস্তাবও তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে রেখেছেন।
৬৫ কোটি মানুষের স্নান?
এবার মহাকুম্ভ শুরুর আগে থেকেই উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ জানিয়েছিলেন, দেশ–বিদেশের ৪০ কোটি পুণ্যার্থী সঙ্গমে ডুব দেবেন। বুধবার শেষ দিনের স্নান শুরুর আগে সরকারি ঘোষণায় জানা যায়, প্রয়াগরাজে উপস্থিত জনতার সংখ্যা ৬৫ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এই বিশাল উদ্যাপন পুরোপুরি কুসুমকোমল না হলেও উত্তর প্রদেশের যোগী আদিত্যনাথ অবশ্যই সাফল্যের দাবি করতে পারেন। বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ববাদী এই নেতা এই সফল উদ্যাপনের কৃতিত্ব দাবির পাশাপাশি বুধবার বলেছেন, ‘সঙ্গমে আসা সাধু, সন্ন্যাসী ও ভক্তদের আন্তরিক শুভেচ্ছা। ভগবান শিব ও মা গঙ্গা সবার কল্যাণ করুন, এটাই একমাত্র কামনা।’
১২ বছর অন্তর মহাকুম্ভ অনুষ্ঠিত হলেও এবার গ্রহ–নক্ষত্রের অবস্থান মহাকুম্ভকে অনন্য করে তুলেছে। শেষবার এমন হয়েছিল ১৪৪ বছর আগে। সেই কারণে ধর্মপ্রাণ হিন্দুদের কাছে এবারের মহাকুম্ভের আকর্ষণ ছিল দুর্নিবার। কেন্দ্র ও রাজ্যের বিজেপি সরকার তাই এবার চেষ্টায় কোনো ত্রুটি রাখেনি। এত বছর ধরে মহাকুম্ভের আয়োজন হলেও এই প্রথম তা হলো উত্তর প্রদেশ ও কেন্দ্রে বিজেপি সরকারের আমলে। ফলে হিন্দুত্ববাদী বিজেপি সফল হতে সতর্ক ছিল।
গঙ্গা–যমুনার সঙ্গমস্থলে পন্টুন সেতু দিয়ে পুণ্যার্থীরা যাচ্ছেন মহাকুম্ভের স্নানে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর ব শ হ মব হ বল ছ ন র পর ব সরক র সতর ক
এছাড়াও পড়ুন:
হাত জোড় করছি, ফিরিয়ে দিন সন্তানদের
‘কোনো মায়ের বুক যেন খালি না হয়। দোষ থাকলে, অন্যায় করলে উপযুক্ত শাস্তি দিন। তবু সন্তান হারানোর বেদনা যেন কারও বুকে না লাগে। আমি হাত জোড় করছি, আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে দিন।’
গতকাল বৃহস্পতিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে এমন আকুতিই জানান অপহৃত দিব্যি চাকমার মা ভারতী দেওয়ান। বিজু উৎসব শেষে খাগড়াছড়ির কুকিছড়া থেকে ফেরার পথে গত বুধবার ভোর ৬টার দিকে পাহাড়ি পাঁচ শিক্ষার্থী অপহৃত হন। এ অপহরণের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) সশস্ত্র গোষ্ঠী ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট- ইউপিডিএফকে (প্রসীত) দায়ী করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, অপহৃতদের উদ্ধরে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে।
পিসিপির কেন্দ্রীয় শাখার সভাপতি নিপন ত্রিপুরা বৃহস্পতিবার সমকালকে বলেন, ‘আমরা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পেরেছি, ইউপিডিএফ অপহৃতদের অভিভাবকদের একটি স্থানে ডেকেছে। বিকেলে অভিভাবকরা সেখানকার উদ্দেশে রওনা হন। পরে আর তাদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়নি।’ তিনি অবিলম্বে অপহৃতদের সুস্থ শরীরে নিঃশর্ত মুক্তির দাবি জানান।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি অন্বেষ চাকমা বলেন, অপহরণকারীরা সকালে একটি স্থানের নাম বলেছিল অভিভাবকদের। পরে পরিবর্তন করে আরেকটি স্থানে ডাকে। বিকেল থেকে আর যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। ফোন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
অপহৃতরা হলেন– চবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী ও পিসিপির চবি শাখার সদস্য রিশন চাকমা, চারুকলা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী অলড্রিন ত্রিপুরা, একই বিভাগের মৈত্রীময় চাকমা, নাট্যকলা বিভাগের শিক্ষার্থী দিব্যি চাকমা ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থী লংঙি ম্রো। তাদের মধ্যে রিশন চাকমার বাড়ি রাঙামাটির জুরাছড়ির মৈদং ইউনিয়নের জামেরছড়িতে। লংঙি ম্রোর বাড়ি বান্দরবানের আলীকদমের কুরুকপাতা ইউনিয়নে; একই জেলায় বাড় অলড্রিন ত্রিপুরার; রাঙামাটির বরকল সদরের চাইল্যাতুলিতে দিব্যি চাকমা ও একই জেলার বাঘাইছড়ির বটতলায় মৈত্রীময় চাকমার।
এর আগে অপহৃত পাঁচ শিক্ষার্থী বিজু উৎসব উপলক্ষে রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে বেড়াতে যান। উৎসব শেষে গত মঙ্গলবার তারা চট্টগ্রামে ফেরার উদ্দেশ্যে বাঘাইছড়ি থেকে দীঘিনালা হয়ে খাগড়াছড়ি সদরে আসেন। সেখানে বাসের টিকিট না পাওয়ায় খাগড়াছড়ি শহর থেকে কিছুদূরে পানছড়ি সড়কের কুকিছড়ায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে রাতযাপন করেন। গত বুধবার ভোরে কুকিছড়া থেকে অটোরিকশায় খাগড়াছড়ি সদরে আসার পথে গিরিফুল নামক জায়গায় দুর্বৃত্তরা অস্ত্রের মুখে তাদের অপহরণ করে।
এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা ও অপহৃতদের দ্রুত মুক্তির দাবি জানিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে অধ্যয়নরত ১৮৩ আদিবাসী শিক্ষার্থী যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাথী ভুবন চাকমার স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়, অপহৃত পাঁচ শিক্ষার্থী বিজু উৎসব শেষে খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাওয়ার পথে অপহরণের শিকার হলেও তাদের খোঁজ এখনও পাওয়া যায়নি। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এমন অপহরণের ঘটনা পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে মানবাধিকারবিরোধী ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ রক্ষার পরিপন্থি। অপহৃতদের উদ্ধারে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে প্রশাসনের প্রতি জোর দাবি জানানো হয় বিবৃতিতে।
ইতোমধ্যে অপহৃতদের উদ্ধারে জোর তৎপরতা শুরু করেছেন নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। গতকাল ঢাকা সেনানিবাসে এক সংবাদ সম্মেলনে সেনাসদর মিলিটারি অপারেশনস ডাইরেক্টরেটের স্টাফ কর্নেল মো. শফিকুল ইসলাম এ বিষয়ে বলেন, খাগড়াছড়ি থেকে অপহরণের শিকার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষার্থীকে উদ্ধারে বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। তাদের অবস্থান কিছুটা শনাক্ত করা গেছে।
খাগড়াছড়ির পুলিশ সুপার মো. আরেফিন জুয়েল বলেন, বিভিন্নভাবে জানার চেষ্টা করা হচ্ছে আসলে ঘটনাটি কী, কাদের হেফাজতে তারা রয়েছে। যৌথ অভিযানে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।