পাঠ্যবই হাতে পেতে দেরি হলে কি পড়াশোনা বন্ধ থাকে
Published: 26th, February 2025 GMT
আমাদের শিক্ষা পরিকল্পনায় যে নানা মাত্রায় গলদ থেকে যায়, তার প্রমাণ এই শিক্ষাবর্ষের শুরুতে আরেকবার পাওয়া গেল। প্রায় দেড় মাস পার হলেও এখনো শিক্ষার্থীরা সব বই পায়নি। অবস্থা দেখে মনে হয় না এ মাসের মধ্যেও শিক্ষার্থীদের হাতে সব বই পৌঁছানো সম্ভব হবে।
এনসিটিবি কর্তৃপক্ষ এই বাস্তবতা আগে থেকে অনুমান করতে পেরেছে, কিন্তু কোনো ধরনের পরিপূরক কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেনি। পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও যে পাঠদান এগিয়ে নেওয়া সম্ভব, এটি বুঝি তাদের মাথাতেইও আসেনি।
শিক্ষার্থীদের বই পাওয়া নিয়ে গত দুই বছরও সমস্যা ছিল। তবে সে সমস্যা এত প্রকট ছিল না। এর পেছনে অবশ্য কারণও ছিল। পরিবর্তিত শিক্ষাক্রম অনুসারে পাঠ্যবই তখন সম্পূর্ণ নতুন করে তৈরি করা হয়। ফলে কিছু বই নির্ধারিত সময়ে ছাপানো সম্ভব হয়নি। এরপরও জানুয়ারি মাসের ১ তারিখে স্কুলগুলোতে বই উৎসব পালন করা হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, করোনার সময়টি বাদ দিলে গত ১৫ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম এ উৎসব হলো না। অথচ যথাযথ পদক্ষেপ নিলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই বেশির ভাগ বই প্রকাশ করা যেত।
পাঠ্যবই রচনা থেকে শুরু করে শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেওয়া পর্যন্ত কাজের কয়েকটি ধাপ রয়েছে। এর মধ্যে প্রথম কাজ রচনা ও সম্পাদনা। এরপর বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে বইয়ের প্রয়োজনীয় সংশোধনের কাজ করা হয়। এ দুটি কাজ শেষ করার আগেই বইয়ের সম্ভাব্য পৃষ্ঠাসংখ্যা নির্ধারণ করে ছাপানোর কার্যাদেশ চূড়ান্ত করা যায়। তাহলে সম্পাদনা বা সংশোধনের কাজে একটু বেশি সময় পাওয়া যায়। এ বছর বেশির ভাগ বইয়ে কেবল পরিমার্জন বা সংশোধন করা হয়েছে, নতুন করে কোনো বই তৈরি হয়নি। এরপরও কেন যথাসময়ে বই ছাপার কাজ শেষ করা গেল না, তার ব্যাখ্যা এনসিটিবি কর্তৃপক্ষই ভালো দিতে পারবে।
নতুন বছরে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বই তুলে দেওয়ার জন্য আগের বছরের জুলাই-পরবর্তী মাসগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ মাসগুলোতে পাঠ্যবইয়ের সর্বশেষ সংশোধন-পরিমার্জনের কাজ করা হয়, ছাপার কাজের দরপত্র বাছাইও চূড়ান্ত করতে হয়।
গত বছর এ সময়ে স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের পতন ও তার পরের ঘটনাপ্রবাহের কারণে এসব কাজ ব্যাহত হয়। তা ছাড়া যখন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় পুরোনো শিক্ষাক্রমেই ফিরে যাওয়া হবে, তখন হাতে সময়ও বেশি ছিল না। কিন্তু এনসিটিবি কর্তৃপক্ষের তো জানা ছিল, কোন কাজে ন্যূনতম কতটুকু সময় লাগে। ফলে সে অনুযায়ী আগে থেকেই ব্যবস্থা নেওয়ার দরকার ছিল।
যেমন পাঠ্যবইয়ের যেসব পাঠ, অধ্যায় বা অংশ নিয়ে আপত্তি ছিল, সেগুলো সরাসরি ফেলে দিলেই হতো। নতুন কিছু যোগ করা কিংবা বড় ধরনের পরিমার্জনের কাজগুলো পরের বছরের জন্য রেখে দেওয়া যেত। তা ছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানের মতো এত বড় আন্দোলনকে ধরতে পারে, এত অল্প সময়ের মধ্যে তেমন লেখা তৈরি করার কাজটিও সহজ ছিল না। মোটকথা নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই সব কাজ শেষ করার জন্য একটি রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা করতে হতো।
ধরা যাক, এরপরও এই বিলম্ব এড়ানো সম্ভব ছিল না। এ পরিস্থিতিতে এনসিটিবি কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব ছিল এ সময়ের পাঠদান পদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দেওয়া। কারণ, পাঠ্যবই দেরিতে আসার কারণে কোনোভাবেই শিক্ষা কার্যক্রম থেমে থাকতে পারে না। শিক্ষা বিশেষজ্ঞেরাও জানেন পাঠ্যবই একমাত্র শিখন উপকরণ নয়। প্রতিটি বিষয়ের শিক্ষকদের নিয়ে পরিকল্পনা করার দরকার ছিল পাঠ্যবই ছাড়া প্রথম দু-তিন মাসে কীভাবে শ্রেণিকার্যক্রম চালানো হবে। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে আগের শ্রেণির বই থেকেও পড়ানো যেতে পারত।
আমাদের দেশে প্রত্যেক শিক্ষার্থীই কমবেশি শিখন-ঘাটতি নিয়ে পরবর্তী শ্রেণিতে ওঠে। গত বছর এই ঘাটতি আরও বেশি ঘটেছে। শিক্ষাবর্ষের গুরুত্বপূর্ণ সময়ে আন্দোলন ও অস্থিরতার কারণে ঠিকমতো ক্লাস-পরীক্ষা হতে পারেনি। এরপরও বছর শেষে প্রায় সব শিক্ষার্থীকে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করা হয়েছে। পুরোনো বইয়ে শিক্ষার্থীদের দুর্বলতা চিহ্নিত করেও যদি নতুন বছরে পাঠদান চালু রাখা হতো, তবে নতুন শ্রেণির পরবর্তী পাঠদানের কাজটিও সহজ হয়ে যেত।
এনসিটিবি ও স্কুল কর্তৃপক্ষ যখন সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে, তখন কোচিং সেন্টারগুলো কিন্তু ঠিকই কৌশল নির্ধারণ করে নিয়েছে! তারা পুরোনো বই ও শিক্ষাক্রমের আলোকে নোট তৈরি করে পাঠদান শুরু করে দিয়েছে। ফলে অভিভাবকেরা তাঁদের সন্তানকে নিয়ে আরও বেশি কোচিংমুখী হয়েছেন। এ সময় কিছু পুরোনো বইও চড়া দামে বইয়ের দোকানে বিক্রি হতে দেখা গেছে। প্রকাশকেরা এদিক থেকে আরও এক ধাপ এগিয়ে। বাজারে পাঠ্যবই আসার অনেক আগেই তারা গাইড বই বাজারে নিয়ে এসেছে।
কিছুদিন পর আবার রোজা, ঈদ ও গ্রীষ্মকালীন ছুটি শুরু হবে। ফলে বই হাতে এলেও এ সময়ে পাঠদান ব্যাহত হবে। ছুটির মধ্যে কেবল বাড়ির কাজ আর অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে শিক্ষকেরা তাঁদের আসল দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। একেকজন শিক্ষার্থীর দুর্বলতা চিহ্নিত করে যদি সেগুলো পূরণ করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তবে বই প্রকাশের এই বিলম্বও বড় ক্ষতির কারণ হবে না। এনসিটিবি কর্তৃপক্ষের উচিত, বই মুদ্রণ ও স্কুলে পৌঁছানোর কাজটি দ্রুত সম্পন্ন করার ব্যাপারে জোর দেওয়া। প্রয়োজনে অভিজ্ঞ শিক্ষকদের ডেকে নিয়ে এ সময়ে পাঠদানের বিষয় ও কৌশল নির্ধারণ করা।
তারিক মনজুর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন র ধ র ত সময় প ঠ যবই এনস ট ব পরবর ত ন ত কর এ সময় বইয় র
এছাড়াও পড়ুন:
৬২০ ফিলিস্তিনি কারাবন্দীর মুক্তি ছাড়া কোনো আলাপ নয়: হামাস
আগে ফিলিস্তিনি কারাবন্দীদের মুক্তি দিতে হবে। তাহলেই কেবল গাজায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে আলোচনা করবে হামাস।
হামাস নেতা বাসেম নাঈম গতকাল রোববার এ কথা বলেন।
হামাসের রাজনৈতিক শাখার সদস্য নাঈম রয়টার্সকে বলেন, ‘মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে শত্রুদের সঙ্গে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে কোনো ধরনের আলোচনার শর্ত হচ্ছে আগে ৬২০ বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে, যাদের ৬ ইসরায়েলি জিম্মির মুক্তি এবং ৪ জিম্মির মৃতদেহ ফেরত দেওয়ার বিনিময়ে মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল। ছয় জিম্মিকে ও চার মৃতদেহ গত শনিবারই হস্তান্তর করা হয়েছে।’
বাসেম নাঈম জোর দিয়ে আরও বলেন, চুক্তিতে সেসব শর্ত থাকে, শত্রুরাও যেন তা মেনে চলে, তা মধ্যস্থতাকারীদের নিশ্চিত করতে হবে।
শনিবার ছয় ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেয় হামাস। তাদের সঙ্গে চার জিম্মির মৃতদেহও হস্তান্তর করা হয়। বিনিময়ে ৬২০ ফিলিস্তিনি কারাবন্দীকে মুক্তি দেওয়ার কথা ছিল ইসরায়েলের। কিন্তু ইসরায়েল ফিলিস্তিনি কারাবন্দীদের মুক্তি পিছিয়ে দিয়েছে।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় থেকে গতকাল বলা হয়েছে, ‘পরবর্তী জিম্মিদের মুক্তির বিষয়টি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত এবং জিম্মি মুক্তির সময় অসম্মানজনক অনুষ্ঠান বাতিল না করা পর্যন্ত ৬২০ ফিলিস্তিনি কারাবন্দী ও বন্দীদের হস্তান্তর করার অপেক্ষা করবে ইসরায়েল।’
ইসরায়েলের অভিযোগ, সম্প্রতি জিম্মি মুক্তি দেওয়ার সময় হামাস জিম্মিদের সঙ্গে ‘অসম্মানজনক আচরণ’ করছে। জাতিসংঘের কর্মকর্তারাও বলেছেন, জিম্মিদের সম্মান রক্ষা পায়নি, যা আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থী।
হোয়াইট হাউস থেকেও ইসরায়েলের সিদ্ধান্তে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। গতকাল হোয়াইট হাউস থেকে বলা হয়, ‘হামাস ইসরায়েলি জিম্মিদের সঙ্গে বর্বর আচরণ করেছে। (ফিলিস্তিনি কারাবন্দীদের মুক্তি) পিছিয়ে দেওয়া এর যথাযথ জবাব হয়েছে।’
এক বিবৃতিতে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র ব্রায়ান হিউস বলেন, ‘হামাস সম্পর্কে ইসরায়েল যে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেবে, প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাতেই সমর্থন দিতে প্রস্তুত আছেন।’
হামাস জিম্মিদের মুক্তির সময় বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে। ওই অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে মুখোশ পরা হামাসের যোদ্ধারা জিম্মিদের একটি মঞ্চে নিয়ে যান। এ সময় সেখানে উপস্থিত গাজাবাসীর উদ্দেশে জিম্মিদের হাত নাড়াতে এবং বক্তব্যও দিতে দেখা যায়। জিম্মিদের মৃতদেহের কফিনগুলোও ভিড়ের ভেতর দিয়ে আনা হয়।
ইসরায়েল ফিলিস্তিনি বন্দী মুক্তি পিছিয়ে দেওয়ায় বন্দীদের পরিবারগুলোর মধ্য হতাশা নেমে এসেছে।
আরও পড়ুনছয় জিম্মিকে ফেরত পেয়েও ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দিলেন না নেতানিয়াহু২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ইসরায়েলের কারাগার থেকে শনিবার মুক্তি পাবেন ভাই, গাজায় সেই অপেক্ষায় ছিলেন ঘাসান ওয়াশাহি। তিনি বলেন, ‘প্রতিবার কারাগার থেকে কে কে মুক্তি পাচ্ছেন, তার একটি তালিকা দেওয়া হয়। আমরা অপেক্ষা করি, আশায় থাকি, এবার হয়তো আমার ভাই ইসলামের নাম আসবে, কিন্তু কখনো তাঁর নাম তালিকায় থাকে না।’
তাঁর মা ছেলের মুক্তির আশা প্রায় ছেড়েই দিয়েছিলেন বলেও জানান ঘাসান ওয়াশাহি। তিনি বলেন, ‘শেষ পর্যন্ত যখন মুক্তির তালিকায় তাঁর নাম এল, ইসরায়েল চুক্তিই স্থগিত করে দিল।’
গত ১৯ জানুয়ারি থেকে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি চলছে। যুদ্ধবিরতির প্রথম ধাপের ৪২ দিনে হামাসের মোট ৩৩ ইসরায়েলি জিম্মিকে মুক্তি দেওয়ার কথা। বিনিময়ে ইসরায়েলি কারাগার থেকে ১ হাজার ৯০০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়ার কথা রয়েছে।