নতুন দল কি নতুন রাজনীতি হাজির করতে পারবে
Published: 26th, February 2025 GMT
নানা জল্পনাকল্পনার পর নতুন একটি রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে। রক্তাক্ত এক বিপ্লবের ফল হিসেবে এই দলটি গঠিত হতে যাচ্ছে। তাই সবার প্রত্যাশা হচ্ছে, দেশের রাজনীতিতে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করবে দলটি। গ্রহণযোগ্য কর্মসূচি দিয়ে সাধারণ মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করবে। নতুন দলের কাছে সবাই নতুন রাজনীতিই প্রত্যাশা করছে।
বেশ কিছুটা সময় বিলম্ব হলেও শেষ পর্যন্ত এ মাসের শেষ দিনে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ হচ্ছে। নতুন দল গঠনে মতভেদ ও মতভিন্নতা কর্মীদের মধ্যে থাকবে। গণতান্ত্রিক রীতিনীতিতে এটা খুবই স্বাভাবিক আচরণ। মতভিন্নতাকে অতিক্রম করে শেষ পর্যন্ত আত্মপ্রকাশ করাই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ঠিক এই মুহূর্তে নতুন একটি দলের আত্মপ্রকাশ দেশের রাজনীতির জন্য জরুরি। আওয়ামী লীগ পালিয়ে গেছে গণবিপ্লবের মুখে। রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের শূন্যতা পূরণে নতুন দলের আত্মপ্রকাশ আমাদের আশা জোগাবে।
আমরা যদি বাংলা বা সুনির্দিষ্ট করে বললে পূর্ব বাংলার ইতিহাসের দিকে তাকাই, তাহলে দেখা যাবে, সব সময়ই দুটি প্রধান দলের উপস্থিতি ছিল রাজনীতিতে। ব্রিটিশ আমলে কংগ্রেস গঠিত হওয়ার পর খুব বেশি দিন দলটি একক রাজত্ব করতে পারেনি। কয়েক বছর পর মুসলিম লীগ রাজনীতিতে চলে আসে। ১৯৪৭-এ দেশভাগের দুই বছরের মধ্যেই মুসলিম লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ, পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর মুসলিম লীগ বিলুপ্ত হয়ে যায়। আওয়ামী লীগের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যায় জাসদ। কিন্তু হঠকারী রাজনীতির জন্য বেশি দিন টিকতে পারেনি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলা দলটি। রাজনীতিতে গুরুত্ব হারায় জাসদ। পরবর্তী সময়ে বিএনপি দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দলে পরিণত হয়। ফলে দেখা যাচ্ছে, ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ, ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগ ও ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ—প্রতিটি বড় ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তন বা বিপ্লবের পরপরই একটি নতুন দল গঠিত হয়েছে এবং একটি দল রাজনীতিতে গুরুত্ব হারিয়েছে বা বিলুপ্ত হয়েছে।
২৪-এর বিপ্লবের পর আওয়ামী লীগ পালিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিকভাবে গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধকারী হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার পর রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ফিরতে পারবে কি না, তা নিয়ে বড় প্রশ্ন আছে। ইতিহাসের ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ন রাখতে এবারের নতুন দল হতে পারে ছাত্রদের দলটি।
নতুন বন্দোবস্তের কথা বলে ছাত্ররা নতুন দিনের রাজনীতি করতে চান। কিন্তু আদৌ কি তাঁরা নতুন বন্দোবস্ত করতে পারবেন? নাকি পুরোনো দিনের রাজনীতিতেই ফিরে যাবেন। আপাতত তাঁদের দল গঠন-পূর্ব রাজনীতি দেখে মনে হচ্ছে, মুখে নতুন বন্দোবস্তের কথা বললেও তাঁরা পুরোনো রাজনৈতিক চর্চাই অনুশীলন করছেন।
অনেকেই বলাবলি করছেন, নতুন দলটি হচ্ছে এ সময়ের ‘কিংস পার্টি’। বিএনপির নেতারা বেশ কয়েকবারই এ অভিযোগ করেছেন। কারণ, সরকারে ছাত্রদের তিনজন উপদেষ্টা রয়েছেন। এ অবস্থায় ছাত্রদের দিয়ে দল গঠন করে উপদেষ্টারা (যদিও একজন উপদেষ্টা পদত্যাগ করেছেন।) নেতৃত্বে এলে কিংস পার্টির তকমা পাওয়া স্বাভাবিক। তাঁরা একবারেই যে সরকারের সুবিধা পাচ্ছেন না এটা হলফ করে বলা কঠিন। বরং ছাত্ররা শুরু থেকেই সরকারে যোগদান না করে রাজনৈতিক দল গঠনে মনোযোগী হতে পারতেন। তাহলে এত দিনে দল মোটামুটি দাঁড়িয়ে যেত। সম্ভবত তাঁরা একদিকে সরকারে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ রাখতে চেয়েছেন, আবার রাজনীতির মাঠেও নিজেদের দল গঠন করতে চেয়েছেন। একই সঙ্গে দুই জায়গায় নিজেদের উপস্থিতি ধরে রাখতে গিয়ে তাঁরা এখন ‘কিংস পার্টি’ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছেন।
ছাত্রদের নতুন দলকে বিএনপির অনেক নেতা কিংস পার্টি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এর জবাবে ছাত্ররা বলেছেন, বিএনপিও তাহলে কিংস পার্টি। কারণ, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় বিএনপি গঠন করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, জিয়াউর রহমান যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন দেশে কোনো রাজনৈতিক দল সক্রিয় ছিল না। এর আগেই সবাই বাকশালে যোগ দিয়ে নিজেদের বিলুপ্তি ঘটিয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাকশালও কার্যত বিলুপ্তই হয়ে যায়। ওই সময় শুধু বিএনপিই গঠন করেননি জিয়াউর রহমান, সঙ্গে সঙ্গে বহুদলীয় রাজনীতি প্রতিষ্ঠা করে আওয়ামী লীগ, জামায়াতে ইসলামী, জাসদ, সিপিবিসহ সব দলকেই রাজনীতিতে স্বনামে ফিরিয়ে আনেন। যদি এমন হতো যে দেশে অন্যান্য দল সক্রিয় থাকা অবস্থায় বিএনপি গঠিত হয়েছে, তাহলে বিএনপিকে অবশ্যই কিংস পার্টি বলা যেত। যেহেতু সব দলের সঙ্গে বিএনপিও রাজনীতি করার অনুমোদন পেয়েছে, তাই বিএনপিকে পুরোপুরি কিংস পার্টি বলা যায় না।
এ ক্ষেত্রে ছাত্রদের নতুন দলকে রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টির জন্মলগ্নের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জেনারেল এরশাদ যখন ক্ষমতায় আসেন, তখন অন্যান্য দল রাজনীতির মাঠে ছিল। কিন্তু তিনি একটি দল করলেন রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকা অবস্থায়।
নতুন বন্দোবস্তের কথা বললেও চর্চাগত দিক থেকে ছাত্ররা পুরোনো দিনের রাজনীতি থেকে কতটা বের হতে পারছেন, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ৫ আগস্টের পরপরই তাঁরা নানাভাবে বিএনপির সমালোচনা ও অহেতুক বিরোধিতার নীতি নিয়েছেন। এখনো যদি আমাদের রাজনীতিতে আগের মতোই অসহিষ্ণুতা ও সহনশীলতার অভাব থাকে, তবে তাকে নতুন বন্দোবস্ত বলা কঠিন।
রাজনীতিতে তর্ক–বিতর্ক থাকবেই। কিন্তু তার মানে এই নয় বিএনপি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় এসে কী করবে বা অতীতে কী করেছিল, তা নিয়ে সব সময় মুখর থাকা। বিএনপির কাজকর্মের হিসাব ভোটে জনসাধারণ বিচার করবে। ছাত্ররা বরং তাঁদের নতুন দলের কর্মসূচি নিয়ে জনসাধারণের কাছে যেতে পারেন। গঠনমূলক রাজনীতির রূপকল্প তুলে ধরতে পারেন।
এখন পর্যন্ত ছাত্রদের রাজনীতির দার্শনিক ও আদর্শিক জায়গাটা পরিষ্কার নয়। মুসলিম লীগ মুসলমানের পরিচয়কে সামনে রেখে রাজনীতি করেছে। আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদ ধরে রাজনীতি করেছে। বিএনপির রাজনীতির মূল ভরকেন্দ্র হচ্ছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ। এখন তারা বলছে সবার আগে বাংলাদেশ। তারও আগে জাসদ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কথা বলে রাজনীতিতে সবাইকে আকৃষ্ট করেছিল। জামায়াতে ইসলামীসহ ইসলামপন্থীরা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করে। বামপন্থীরা মার্ক্স, লেনিন ও মাও সে–তুংয়ের রাজনীতি করে। কিন্তু ছাত্রদের রাজনীতির সুনির্দিষ্ট কোনো আদর্শিক ও দার্শনিক আলাপ আমার নজরে পড়েনি।
তাঁরা মধ্যপন্থী হতে চান বলে বাজারে কথা আছে। কিন্তু তাঁদের রাজনৈতিক আচরণে ডানপন্থাচর্চার লক্ষণ দেখা যায়। একাত্তর প্রশ্নে উপদেষ্টা মাহফুজ আলম তাঁদের অবস্থান পরিষ্কার করলেও এই দলে এমন অনেকেই রয়েছেন, যঁারা ৭১-কে ২৪ দিয়ে আড়াল করতে চান। বিশালসংখ্যক ৭১-বিরোধী বা ৭১ সম্পর্কে বিরূপ মনোভাবসম্পন্ন কর্মীকে নিয়ে তাঁরা রাজনীতি কতটা এগিয়ে নিতে পারবেন, তা বলা মুশকিল। শিবির থেকে বেরিয়ে আসা নেতা-কর্মীদের কারণে একাত্তর নিয়ে নতুন দলের অনেকেরই বিরূপ মনোভাব থাকতে পারে। নতুন দলে তাঁরা কতটা শিবিরের প্রভাব থেকে মুক্ত থাকবেন, তা সময়ই নির্ধারণ করবে। দলটি আদৌ মধ্যপন্থী হবে নাকি ডান বা ইসলামপন্থার দিকে ঝুঁকবে, সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
রাজনীতিতে লম্বা সময়ের জন্য টিকে থাকতে হলে নিজস্ব বয়ান তৈরি করতে হবে। জনগণ যদি সেই বয়ান গ্রহণ করে, তবে মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মতো লম্বা সময় রাজনীতিতে ভূমিকা রাখতে পারবে তারা। আর হঠকারী রাজনীতি করলে জাসদ হতে হবে। জাসদও আওয়ামী লীগের উদর থেকে বেরিয়ে এসে রীতিমতো যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিল। তরুণদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা থাকার পরও হারিয়ে যেতে হয়েছে। তাই বিএনপিকে প্রতিপক্ষ হিসেবে বিবেচনা না করে ছাত্রদের নতুন দলটির উচিত খুব সাবধানে পা ফেলা। আশপাশে রাজনীতির জটিল ফাঁদ পাতা আছে। সেই ফাঁদে পা দিলেই সর্বনাশ হবে।
ড.
মারুফ মল্লিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: দ র র জন ত ন র র জন ত র র জন ত ত র র জন ত র র জন ত ক উপদ ষ ট অবস থ য় ক ষমত য় ব এনপ র দল গঠন ত হয় ছ আওয় ম সরক র ইসল ম
এছাড়াও পড়ুন:
‘অসহায়’ শহীদির চাওয়া আফগান নারীরা মাঠে ফিরুক
চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে আজ মুখোমুখি ইংল্যান্ড ও আফগানিস্তান। এই সেই ম্যাচ, যে ম্যাচটি বয়কট করতে ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলকে অনুরোধ করেছিলেন দেশটির রাজনীতিবিদেরা।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কয়েক শ সদস্য লিখিত চিঠি লিখে করেছিলেন সেই অনুরোধ। কেন, সেটি তো জানাই। আফগানিস্তানে নারীদের চাকরি-বাকরি, পড়াশোনা ও খেলাধুলা থেকে বিরত রাখার তালেবান শাসনের নীতির বিরুদ্ধে বার্তা দিতেই এমন আহ্বান জানিয়েছিলেন তাঁরা।
সেই দুই দেশ যখন মুখোমুখি ক্রিকেট মাঠে, ক্রিকেটের চেয়ে মাঠের বাইরের ঘটনা নিয়েই তো বেশি কথাবার্তা হওয়ার কথা। বাস্তবে হয়েছেও তাই। ম্যাচ–পূর্ববর্তী সংবাদ সম্মেলনে আফগানিস্তানে নারীদের দুর্দশা, নারী ক্রিকেট দল কেন নেই, এ ব্যাপারে ক্রিকেটারদের কী অবস্থান—সেসব নিয়েই বেশি প্রশ্ন হলো।
আফগানিস্তান অধিনায়ক হাশমতউল্লাহ শহীদির কাছে জানতে চাওয়া হয়, আপনি কি আফগান মেয়েদের ক্রিকেট মাঠে দেখতে চান? মতামত জানাতে দ্বিধা না করলেও তাঁদের যে কিছুই করার নেই, সেটিও বললেন শহীদি, ‘সবাই খেলুক, এটা তো সবারই চাওয়া। তবে এখানে রাজনীতি একটা বিষয়, আর যেটি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। আমরা তো সামান্য ক্রিকেটার, আমরা শুধু মাঠের বিষয়গুলোই নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখি।’
আফগানিস্তানের ব্রিটিশ কোচ জোনাথন ট্রটকেও কথা বলতে হয়েছে এ নিয়ে। বিবিসিকে ট্রট বলেছেন, আফগান খেলোয়াড়দের হাত-পা বাঁধা এ ব্যাপারে, ‘ছেলেগুলো দারুণ সাহসী। কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক নয়, সেটি তারা জানে। ওদের জন্য পুরো ব্যাপারটা খুবই বিব্রতকর।’
ট্রট অবশ্য আশাবাদী একদিন আফগানিস্তানে অবস্থা বদলাবে, ‘পুরো বিশ্ব যে উদ্বিগ্ন, সেটি আমি জানি। আমি নিজেও এ নিয়ে চিন্তিত। আমার মেয়েরা তো ক্রিকেট খেলে। আশা করছি, একদিন আফগানিস্তানেও এমন কিছু দেখতে পাব।’
ইংল্যান্ড অধিনায়ক জস বাটলারও কথা বলেছেন এ নিয়ে। ট্রটের মতো বাটলারও আশা করছেন একদিন বদলাবে পরিস্থিতি, ‘আফগানিস্তানে নারী ও শিশুদের দুর্দশায় আমরা মর্মাহত। তবে আশা করছি কঠিন এই সময়ে এই ম্যাচ একটু হলেও আশা ও বিনোদন জোগাবে।’