ইউক্রেনের বিরল খনিজ কী, এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কেন চুক্তিতে যাচ্ছে দেশটি
Published: 26th, February 2025 GMT
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের চাহিদা অনুযায়ী ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের ভূগর্ভস্থ মজুতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে দুই দেশ একটি চুক্তি সইয়ের দ্বারপ্রান্তে আছে বলে জানিয়েছেন ইউক্রেনীয় উপপ্রধানমন্ত্রী ওলহা স্টেফানিশিনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে তিনি লিখেছেন, চুক্তি নিয়ে এ পর্যন্ত সব আলাপ-আলোচনা গঠনমূলক হয়েছে। প্রধান প্রায় সব বিবরণ চূড়ান্ত হয়েছে।
ওলহা স্টেফানিশিনা আরও বলেন, ‘আমরা এটি (আলোচনা) দ্রুত সম্পন্ন করে চুক্তি সইয়ের কাজ এগিয়ে নিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
খনিজ চুক্তি সইয়ের জন্য মার্কিন প্রশাসনের অব্যাহত চাপের মুখে রয়েছে ইউক্রেন। আর এ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের মধ্যে ক্রমবর্ধমান দ্বন্দ্বের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
একুশ শতকের অর্থনীতির ভিত্তি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ। এসব সম্পদ নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সামরিক শক্তি ও শিল্প অবকাঠামোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভূরাজনীতি ও অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান কৌশলগত ভূমিকা পালন করছে এসব খনিজ।রবার্ট মুগাহ, কানাডাভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেকডেভের প্রধানইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তাঁর তথাকথিত ‘বিজয় পরিকল্পনায়’ প্রথমে খনিজ চুক্তির প্রস্তাবটি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে তাঁর এ পরিকল্পনা তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ট্রাম্পের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছিল। মূলত ইউক্রেনের প্রতি ট্রাম্পের সমর্থন আদায় বজায় রাখতে একটি বাস্তবসম্মত কারণ হিসেবে এ পরিকল্পনা উপস্থাপন করা হয়।
যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন কিয়েভে বিবিসিকে বলেছেন, এ ধরনের একটি চুক্তি অনেক বড় পুরস্কারের সমান। কারণ, এটি ট্রাম্প প্রশাসনের আমলে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম ও নিরাপদ ইউক্রেনের মার্কিন প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করবে।
জিওলজিক্যাল ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের জন্য একটি চুক্তি করতে আগ্রহী হওয়ার কারণ, দেশটি চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে চায়। চীন বিশ্বের বিরল খনিজ ভান্ডারের ৭৫ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে।ইউক্রেনের খনিজ সম্পদকিয়েভের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ‘গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামালের’ ৫ শতাংশই রয়েছে ইউক্রেনে। এর মধ্যে রয়েছে প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ টন গ্রাফাইটের সুনির্দিষ্ট মজুত, যা খনিজ সরবরাহে ইউক্রেনকে বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ দেশের একটিতে পরিণত করেছে বলে জানিয়েছে ইউক্রেনের রাষ্ট্রীয় ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষা সংস্থা। গ্রাফাইট বৈদ্যুতিক গাড়ি তৈরিতে ব্যবহৃত হয়।
ইউরোপের মোট লিথিয়াম ভান্ডারের এক-তৃতীয়াংশই রয়েছে ইউক্রেনে। বর্তমানে ব্যাটারি তৈরির মূল উপাদান লিথিয়াম। এদিকে যুদ্ধ শুরুর আগে টাইটানিয়াম উৎপাদনে ইউক্রেনের বৈশ্বিক হিস্যা ছিল ৭ শতাংশ। উড়োজাহাজ থেকে শুরু করে বিদ্যুৎকেন্দ্র—সবকিছুতে ব্যবহৃত হয় এ হালকা ধাতু।
আরও কিছু খনিজের উল্লেখযোগ্য মজুত রয়েছে ইউক্রেনে। সম্মিলিতভাবে ১৭টি উপকরণের এ বিরল খনিজ অস্ত্র, বায়ুবিদ্যুতের টারবাইন, ইলেকট্রনিক ও আধুনিক বিশ্বের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পণ্য উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়।
যাহোক, ইউক্রেনে খনিজ সম্পদের ভূগর্ভস্থ কিছু মজুত এরই মধ্যে দখল করে নিয়েছে রাশিয়া। ইউক্রেনের অর্থমন্ত্রী জুলিয়া স্ভিরিডিয়াঙ্কার মতে, বর্তমানে রাশিয়ার দখলে আছে ইউক্রেনের ৩৫ হাজার কোটি ডলারের খনিজ সম্পদের ভান্ডার।
ভূরাজনৈতিক ঝুঁকিবিষয়ক কানাডাভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান সেকডেভ ২০২২ সালে এক মূল্যায়নে প্রমাণ করে দেখিয়েছে যে রাশিয়া ইউক্রেনের ৬৩ শতাংশ কয়লাখনি এবং ম্যাঙ্গানিজ, সিজিয়াম, ট্যানটালাম ও বিরল খনিজ ভান্ডারের অর্ধেক দখল করেছে।
সেকডেভের প্রধান রবার্ট মুগাহ বলেন, এ ধরনের খনিজ সম্পদ ইউক্রেনে রাশিয়ার অব্যাহত আক্রমণের ক্ষেত্রে এক ‘কৌশলগত ও অর্থনৈতিক মাত্রা’ যোগ করেছে। খনিজ সম্পদের ভান্ডার দখল করে মস্কো ইউক্রেনের আয়ের উৎসে প্রবেশাধিকার বন্ধ করে দিয়েছে এবং নিজস্ব সম্পদের ভিত্তি প্রসারিত করেছে। এতে খনিজ সরবরাহের বৈশ্বিক শৃঙ্খলে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র কেন খনিজ চুক্তি করতে চায়রবার্ট মুগাহ বলেন, একুশ শতকের অর্থনীতির ভিত্তি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদ। এসব সম্পদ নবায়নযোগ্য জ্বালানি, সামরিক শক্তি ও শিল্প অবকাঠামোর ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভূরাজনীতি ও অর্থনীতিতে ক্রমবর্ধমান কৌশলগত ভূমিকা পালন করে এসব খনিজ।
জিওলজিক্যাল ইনভেস্টমেন্ট গ্রুপের মতে, যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনের খনিজ সম্পদের জন্য চুক্তি করতে আগ্রহী হওয়ার কারণ, দেশটি চীনের ওপর নির্ভরতা কমাতে চায়। চীন বিশ্বের বিরল খনিজ ভান্ডারের ৭৫ শতাংশই নিয়ন্ত্রণ করে।
গত বছরের ডিসেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রে কিছু বিরল খনিজের রপ্তানি নিষিদ্ধ করে চীন। দেশটি এর আগের বছর যুক্তরাষ্ট্রে খনিজ রপ্তানি সীমিত করেছিল।
ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর ওয়াশিংটন সফরের আগে গত সোমবার হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়ালৎজ মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউজনেশনকে বলেন, ‘অর্থনীতিকে আরও সম্প্রসারিত করার পাশাপাশি ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেনকে এক সুতায় গাঁথার জন্যই এ চুক্তি।’
এর আগে গত সপ্তাহে ইউক্রেনের বিরল খনিজ সম্পদে যুক্তরাষ্ট্রকে ৫০ শতাংশ ভাগ দেওয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করেন প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছিলেন, রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনকে যে পরিমাণ সহায়তা দিয়েছিল, এ ভাগ সেটির প্রতিফলন ঘটাবে। জবাবে জেলেনস্কি বলেছেন, ‘আমি আমাদের দেশকে বিক্রি করে দিতে পারি না।’
ট্রাম্প এ মাসের শুরুতে বলেছিলেন, ইউক্রেনে মার্কিন সামরিক ও অর্থনৈতিক সহায়তার পরিমাণ প্রায় ৫০ হাজার কোটি ডলার। আর তিনি ইউক্রেনের খনিজ সম্পদে সমমূল্যের প্রবেশাধিকার চান।
আরও পড়ুনখনিজ নিয়ে চুক্তির দ্বারপ্রান্তে ইউক্রেন–যুক্তরাষ্ট্র২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫তবে জেলেনস্কি বলেছেন, এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ১০ হাজার কোটি ডলারের সহায়তা দিয়েছে। কিয়েভ আরও জোর দিয়ে বলেছে, তারা এ পর্যন্ত যে সহায়তা পেয়েছে তা ঋণ নয়, বরং অনুদান ছিল। তাই ইউক্রেনের কোনো কিছু ফেরত দেওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই। তিনি যেকোনো চুক্তিতে নিরাপত্তার নিশ্চয়তা চান বলেও জানা গেছে।
সোমবার যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন ইউক্রেনের খনিজ সম্পদে মার্কিন প্রবেশাধিকারের চুক্তিকে ‘মহাপুরস্কার’ বলে অভিহিত করেছেন।
এ চুক্তিতে ‘প্রতারণার’ যেসব ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে, তা প্রত্যাখ্যান করেছেন বরিস। তিনি বলেন, এ চুক্তির ফলে ইউক্রেনের মানুষ যা পাবে তা হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে একটি মুক্ত, সার্বভৌম ও নিরাপদ ইউক্রেনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি।’
কেউ কেউ যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তির প্রস্তাবকে ‘ঔপনিবেশিক’ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু কিয়েভ দেশটির খনিজ সম্পদ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করতে আগ্রহী।
আরও পড়ুনবিরল খনিজ সম্পদের উন্নয়ন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত রাশিয়া: পুতিন২১ ঘণ্টা আগে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ইউক র ন র প র র জন য ত কর ছ
এছাড়াও পড়ুন:
কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে বাজেট বরাদ্দে অগ্রাধিকার দিতে হবে
বাজেটে বরাদ্দের ক্ষেত্রে দারিদ্র নিরসন, কর্মসংস্থান তৈরি, নারী ও শিশু উন্নয়ন, জলবায়ু অভিঘাত মোকাবেলায় সহায়ক কার্যক্রমে অগ্রাধিকার দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থবিভাগ। আগামী ২০২৫–২৬ অর্থবছর বাজেট প্রণয়ন নিয়ে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের উদ্দেশে বুধবার এক পরিপত্র জারি করে এসব পরামর্শ দেওয়া হয়।
পরিপত্রে বলা হয়, বাজেটে অর্থ বরাদ্দের ক্ষেত্রে সরকারের কৌশলগত উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়ক হয়, এমন সুনির্দিষ্ট কার্যক্রমের বিপরীতে অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয়ের প্রাক্কলন এমনভাবে তৈরি করতে হবে, যেন তা মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজেট ব্যবস্থাপনা কমিটি কর্তৃক অনুমোদিত ব্যয়সীমার মধ্যেই হয়। এছাড়া সাধারণভাবে বাজেটে কোনো প্রকার থোক বরাদ্দ প্রস্তাব করা যাবে না।
এতে মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামো পদ্ধতির আওতাভুক্ত সকল মন্ত্রণালয় বা বিভাগকে বাজেট প্রণয়নের দ্বিতীয় পর্যায়ে আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বিস্তারিত বাজেট প্রাক্কলন এবং একইসঙ্গে পরবর্তী ২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ অর্থবছরের প্রক্ষেপণ প্রণয়নের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ বাজেট প্রস্তাব আগামী ২৪ এপ্রিলের মধ্যে অর্থ বিভাগের বাজেট অনুবিভাগ, পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগ, সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ ও সংশ্লিষ্ট বিভাগে পাঠাতে বলা হয়।
পরিপত্রে বাজেট প্রাক্কলন ও প্রক্ষেপণের ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে চারটি নীতি অনুসরণ করতে বলা হয়েছে। এর অন্যতম হচ্ছে– মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোতে বর্ণিত কৌশলগত উদ্দেশ্য, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা, ‘রি-স্ট্রাটেজিসিং দ্য ইকোনমি অ্যান্ড মবিলাইজিং রিসোর্সেস ফর ইক্যুয়িটেবল অ্যান্ড সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট’ বিষয়ক টাস্কফোর্স রিপোর্ট এবং মন্ত্রণালয় বা বিভাগের নিজস্ব নীতিমালায় অন্তর্ভূক্ত সরকারের নীতি ও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে কার্যক্রম পরিচালনা।
এছাড়া সরকারের মৌলিক নীতি নির্ধারণী দলিলগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দারিদ্র নিরসন, কর্মসংস্থান তৈরি, নারী ও শিশু উন্নয়ন, জলবায়ু অভিঘাত মোকাবেলায় সহায়ক কার্যক্রমে অগ্রাধিকার ভিত্তিক বরাদ্দ দিতে হবে। জিডিপি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে পরিচালন ও উন্নয়ন ব্যয় বাড়ার সামঞ্জস্য রাখা, যাতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা করা।
এতে আরও বলা হয়, উন্নয়ন ব্যয়ের বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ কর্তৃক বৈদেশিক ঋণ বা অনুদানের যে প্রাক্কলন ও প্রক্ষেপণ তৈরি করেছে প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে এর প্রতিফলন নিশ্চিত করতে হবে।