সিঙ্গারের নতুন কারখানায় বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু
Published: 26th, February 2025 GMT
গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য ইলেকট্রনিক সামগ্রীর প্রস্তুতকারী বহুজাতিক কোম্পানি সিঙ্গার বাংলাদেশের নতুন কারখানায় পরীক্ষামূলক উৎপাদন শেষে গত সোমবার থেকে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু হয়েছে। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারের বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (এসইজেড) এই কারখানা অবস্থিত।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি সিঙ্গার বাংলাদেশ নতুন কারখানায় উৎপাদন শুরুর তথ্য গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের জানিয়েছে। কোম্পানিটি জানায়, নতুন কারখানাটায় হোম অ্যাপ্লায়েন্স বা গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য নানা সামগ্রী উৎপাদিত হবে। এটি পরিবেশবান্ধব কারখানা হিসেবে লিড গোল্ড সনদপ্রাপ্ত।
কোম্পানির সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, নতুন কারখানায় টেলিভিশন, রেফ্রিজারেটর বা ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) উপাদিত হবে। এ কারখানা তৈরিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে ৭ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার, যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ৯৩৬ কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১২০ টাকা ধরে। ২০২২ সালের ১০ অক্টোবর নতুন কারখানাটি উদ্বোধন করা হয়েছিল। সেই হিসাবে উদ্বোধনের প্রায় আড়াই বছর পর এতে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু হলো। এত দিন কোম্পানিটি সাভারের দুটি কারখানায় পণ্য উৎপাদিত করত।
জানা গেছে, নতুন কারখানা স্থাপনের জন্য ২০২২ সালে সিঙ্গার ৩৪ একর জায়গা ইজারা নেয়। কারখানাটি পুরোদমে চালু হলে তাতে চার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। আপাতত দুই হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। ২০১৯ সালের আগে সিঙ্গার বাংলাদেশের মালিকানার সঙ্গে যুক্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্রের একটি কোম্পানি। ২০১৯ সালে সেই কোম্পানির কাছ থেকে সিঙ্গার বাংলাদেশের মালিকানা কিনে নেয় তুরস্কভিত্তিক কোম্পানি আর্চেলিক। এটি তুরস্কের অন্যতম বৃহত্তম শিল্প গ্রুপ কচ হোল্ডিংয়ের একটি ফ্ল্যাগশিপ কোম্পানি। বিশ্বের ৫২টি দেশে ১২টি ব্র্যান্ডের পণ্য বিক্রি করে আর্চেলিক।
সিঙ্গারের নতুন কারখানায় বছরে বিভিন্ন ধরনের ১৫ লাখের বেশি ইলেকট্রনিক সামগ্রী উৎপাদিত হবে। এসব পণ্য প্রথমে দেশেই বাজারজাত করা হবে। এরপর সুযোগ থাকলে রপ্তানির উদ্যোগ নেওয়া হবে। বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি হওয়া সিঙ্গারের সামগ্রীর ৯০ শতাংশই এই কারখানায় উৎপাদিত হবে বলে কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে। কোম্পানিটির পণ্য তালিকায় রয়েছে রেফ্রিজারেটর, টেলিভিশন, এসি, ওয়াশিং মেশিন, সেলাই মেশিন, ওভেনসহ গৃহস্থালিতে ব্যবহার্য নানা ইলেকট্রনিক সামগ্রী।
একনজরে সিঙ্গার বাংলাদেশ✧ ১২০ বছরের পুরোনো কোম্পানি, যাত্রা শুরু ১৯০৫ সালে।
✧১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে প্রথম কারখানা স্থাপন।
✧ ১৯২০ সালে প্রথম ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি বিক্রয়কেন্দ্র চালু।
✧দেশজুড়ে নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র প্রায় ৪৫০টি।
✧ পণ্য তালিকায় রয়েছে রেফ্রিজারেটর, টিভি, এসি, ওয়াশিং মেশিন, সেলাই মেশিন, ওভেনসহ গৃহস্থালি নানা ইলেকট্রনিক সামগ্রী
✧ গত বছরের জানুয়ারি-সেপ্টেম্বরে ১,৫৪৬ কোটি টাকার ব্যবসা।
✧ ২০২৩ সালে মুনাফা করেছিল ৫২ কোটি টাকার বেশি।
গত বছরের জানুয়ারি–সেপ্টেম্বর ৯ মাসে কোম্পানিটি ১ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকার ব্যবসা করেছে, যা ২০২৩ সালের একই সময়ের ১ হাজার ৪২৬ কোটি টাকার চেয়ে সাড়ে ৮ শতাংশ বা ১২০ কোটি টাকা বেশি। তবে আগের বছরের চেয়ে ব্যবসা বাড়লেও মুনাফা কমেছে।
সেলাই মেশিন বিক্রির মধ্য দিয়ে ১৯০৫ সালে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে সিঙ্গার। সেই হিসাবে এটি দেশে ১২০ বছরের পুরোনো প্রতিষ্ঠান। সারা দেশে কোম্পানিটির ৪৪৬টি নিজস্ব বিক্রয়কেন্দ্র ও ৯০০টি পরিবেশক কেন্দ্র রয়েছে। ১৯২০ সালে কোম্পানিটি প্রথম ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি বিক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করে। ১৯৭৯ সালে এসে এটি পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয়। এটি ১৯৮৩ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ও ২০০১ সালে চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) তালিকাভুক্ত হয়।
কোম্পানিটি বাংলাদেশে প্রথম কারখানা চালু করে ১৯৯৩ সালে, সেটি ছিল টেলিভিশন তৈরির কারখানা। এরপর ১৯৯৬ সালে ওয়াশিং মেশিন তৈরির কারখানা স্থাপন করে। আর ১৯৯৮ সালে কোম্পানিটির সমন্বিত কারখানার যাত্রা শুরু হয়।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, সিঙ্গারের ৫৭ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা রয়েছে উদ্যোক্তা–পরিচালকদের হাতে। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে আছে প্রায় ২৯ শতাংশ শেয়ার। আর ১৩ শতাংশ শেয়ার রয়েছে সাধারণ শেয়ারধারীদের হাতে। বাকি ১ শতাংশ শেয়ার বিদেশি বিনিয়োগকারীদের হাতে রয়েছে।
এদিকে নতুন কারখানায় বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর খবরে গতকাল মঙ্গলবার শেয়ারবাজারে কোম্পানিটির শেয়ারের দাম বেড়েছে। এদিন কোম্পানিটির প্রতিটি শেয়ারের দাম ২ টাকা ৭০ পয়সা বা প্রায় আড়াই শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৭ টাকা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব ক রয়ক ন দ র উৎপ দ ত বছর র প রথম ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
বাড়ছে আমদানিনির্ভর কৃষিপণ্যের উৎপাদন
আলু উৎপাদনে বাংলাদেশ ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ। চাহিদার তুলনায় উৎপাদন ছিল বেশি। চাহিদার বাড়তি আলু রপ্তানি হতো বিশ্বের ১৬টি দেশে। তিন বছর আগে দুই লাখ টন আলু রপ্তানির রেকর্ড গড়ে বাংলাদেশ। আলু রপ্তানির এসব গল্প ধীরে ধীরে ইতিহাস হয়ে যায়। কারণ, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চাহিদা মেটাতে প্রথমবারের মতো ৯৮ হাজার ৭৩১ টন আলু আমদানি হয়। শুধু আলু নয়, কাঁচামরিচ, টমেটো, গাজর, পেঁয়াজ, সবজিসহ বেশ কিছু কৃষিপণ্য গত দেড় দশকে ধীরে ধীরে আমদানিনির্ভর হয়ে যায়। কমে রপ্তানি। তবে এবার আলুর এত বাম্পার ফলন হয়েছে যে, হিমাগারে রাখার জায়গা নেই। এতে কৃষক দুর্ভোগে পড়লেও ভোক্তা আছেন স্বস্তিতে। বাজারে আলুর দাম কমার কারণে বাড়ছে রপ্তানি। চলতি অর্থবছরের ১৫ মার্চ পর্যন্ত সাড়ে সাত মাসে ২৪ হাজার টন আলু রপ্তানি করা হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই)। এটি গত অর্থবছরের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। গত ফেব্রুয়ারিতে প্রায় ১২ হাজার টন আলু রপ্তানি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের মোট রপ্তানির সমান।
অন্যদিকে পেঁয়াজে দীর্ঘদিনের ভারতনির্ভরতা কমতে শুরু করেছে। প্রতিবছর দেশে প্রায় ১০ লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি করতে হতো। এবার যে পরিমাণ পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে, তাতে কৃষক ন্যায্য মূল্য পেতে হিমশিম খাচ্ছেন। দেশে বছরে শস্যটির চাহিদা ৩৫ থেকে ৩৬ লাখ টন। এবার চাহিদার চেয়ে এটি বেশি উৎপাদনের আশা করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।
শুধু আলু, পেঁয়াজ নয় সবজি উৎপাদনে এবার রেকর্ড ফলনের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাজারে এর প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। এবারের রোজা স্বস্তিতে কাটিয়েছেন ভোক্তা। এ বাস্তবতার বিপরীতে রপ্তানিতে আশা জাগাচ্ছে কৃষিপণ্য। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে এ খাতে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে রপ্তানি আয় ৮ শতাংশ বেশি হয়েছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে রপ্তানি বেড়েছে ১০ শতাংশের মতো। কৃষি মন্ত্রণালয় এখন আমদানিনির্ভর ফসল উৎপাদন বাড়াতে জোর দিচ্ছে। বিশেষ করে তেল, দানা ও মসলাজাতীয় ফসলের উৎপাদন বাড়াতে নেওয়া হয়েছে নানা পরিকল্পনা।
মসলাজাতীয় ফসল
দেশে হলুদ, মরিচ, মৌরি, মেথি, কালিজিরা, তেজপাতা, আদা-রসুন-পেঁয়াজ, সরিষা, ধনিয়াসহ অধিকাংশ গরম মসলার বাজার আমদানিনির্ভর। ফলে আমদানি স্বাভাবিক না থাকলে দেশের বাজারে পণ্যগুলোর দাম অস্থিতিশীল হয়ে পড়ে। বিশ্বের ১০৯ ধরনের মসলার মধ্যে বাংলাদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে ৪৪টি। দেশে চাষ হচ্ছে মাত্র ৩৪টি। এমন পরিস্থিতিতে দেশের মসলা ফসলের উৎপাদন বাড়ানো এবং আমদানি ব্যয় কমাতে ‘মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ’ শীর্ষক প্রকল্প নিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। এর মাধ্যমে পেঁয়াজের উৎপাদন বাড়ানো হচ্ছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজের আবাদ এলাকা ও উৎপাদনশীলতা বাড়ানো এবং সংরক্ষণ প্রযুক্তির ওপর মানসম্মত প্রশিক্ষণ ইত্যাদি কার্যক্রমের ফলে আমদানির পরিমাণ বেশ কমছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে পেঁয়াজ আমদানি হয় ৭ দশমিক ৪৩ লাখ টন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমদানি হয় ছয় লাখ টনের সামান্য বেশি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সম্প্রসারণ উন্নত জাত ও নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগ করে সারা দেশে প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ বস্তায় আদা চাষ করা হয়। এতে ৯ হাজার টন আদা উৎপাদন হয়েছে। শতভাগ আমদানিনির্ভর জিরা মাঠ পর্যায়ে সফলভাবে উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। বীজ সংরক্ষণেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। উল্লেখ্য, প্রতিবছর জিরাতে প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা আমদানি ব্যয় হয়। এ ছাড়া রসুনে আগের তুলনায় বার্ষিক আমদানি কমেছে প্রায় দুই হাজার টন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, দেশে বছরে ৩০ হাজার কোটি টাকার মসলার বাজার আছে। তবে এ মসলার চাহিদার একটা বড় অংশ পূরণ হচ্ছে বিদেশ থেকে আনার মাধ্যমে।
মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক রাসেল আহমেদ বলেন, ‘আমরা মসলার আমদানি নির্ভরতা কমাতে কাজ করছি। উন্নত জাতের মসলা ফসলের বছরব্যাপী উৎপাদন বাড়ানো হবে। আমদানি ব্যয় কমাতে এবং মসলাজাতীয় ফসল চাষে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে গতিশীলতা আনতে মসলার উন্নত জাত ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ধান, গম বা অন্য শাকসবজির চেয়ে মসলার দাম বেশি। এটা দীর্ঘসময় রেখে দেওয়া যায়। ফলে কৃষকরা যখন দেখবে, এটা লাভজনক এবং অল্প জায়গায় চাষ করতে পারছেন, তখন অবশ্যই এটার উৎপাদন বাড়বে।’
মসলা গবেষণা কেন্দ্রের তথ্যমতে, এ পর্যন্ত ২২টি মসলাজাতীয় ফসলের ওপর মোট ৪৭টি জাত উদ্ভাবন হয়েছে। তা ছাড়া উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্যে উৎপাদন প্রযুক্তি, মৃত্তিকা ও পানি ব্যবস্থাপনা, পোকামাকড় ও রোগবালাই ব্যবস্থাপনা, পোস্ট-হারভেস্ট প্রযুক্তিসহ আরও ৬৬টি উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন হয়েছে। এসব জাত ও প্রযুক্তি মাঠ পর্যায়ে সম্প্রসারণ হলে একদিকে বাড়বে উৎপাদন, অন্যদিকে কমবে সংগ্রহ-পরবর্তী ক্ষতির পরিমাণ। আয়ুর্বেদিক, খাদ্য এবং শিল্পে মসলার ব্যবহার বাড়বে বহুগুণ।
তেলজাতীয় ফসল উৎপাদনে বিপ্লব
দেশে প্রায় সময় ভোজ্যতেলের দাম ও সরবরাহের ঘাটতি নিয়ে হইচই পড়ে। প্রতিবছর রমজানে এ শোরগোল আরও বাড়ে। চাহিদার তুলনায় স্থানীয় উৎপাদন কম হওয়ার বিপরীতে অতিমাত্রার আমদানির কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। প্রাপ্ত তথ্যমতে, চাহিদার ৯০ শতাংশ ভোজ্যতেল আমদানি হয়। এতে প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৪৬ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বিভিন্ন তথ্য বলছে, এ খাতে বছরে ব্যয় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা।
এমন অবস্থায় কৃষি মন্ত্রণালয় ভোজ্যতেলের দেশেই উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। এ জন্য ভোজ্যতেলের স্থানীয় উৎপাদন বাড়িয়ে ডলার সাশ্রয়ের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। দেশেই সরিষা, তিল, বাদাম, সয়াবিন, সূর্যমুখীসহ সব ধরনের তেলজাতীয় ফসলের আবাদ বাড়ানোর মাধ্যমে আমদানি চাহিদার অন্তত ৪০ শতাংশ কমিয়ে আনতে চায় সরকার, যার কার্যক্রম শুরু হয় ২০২২ সালে। লক্ষ্য অর্জনের এ দৌড়ে মাঠপর্যায়ে পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মাত্র দুই বছরেই পৌঁছে গেছে ২৫ শতাংশের দ্বারপ্রান্তে। অন্যদিকে আমদানি হিসাব বলছে, এতে দেশের ২৭ শতাংশ ভোজ্যতেল আমদানি কমেছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, ভোজ্যতেলের চাহিদার ৪০ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করতে ২০২২ সাল থেকে তিন বছর মেয়াদি কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে কৃষি মন্ত্রণালয় এবং এর আওতাধীন অধিদপ্তরগুলো। এর অংশ হিসেবে ২০২৩ সালে দেশে দুই লাখ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ বাড়ানো হয়েছে। উৎপাদন বেড়েছে আগের তুলনায় ৩ লাখ ৩৫ হাজার টন। তেলের হিসাবে বিবেচনা করলে ১ লাখ ২১ হাজার টন তেল বেশি উৎপাদন হয়েছে। আর প্রতি লিটার তেলের মূল্য ২৫০ টাকা হিসাব করলে এক বছরে উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকার, যা কমিয়েছে আমদানি ব্যয়ের চাপ।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ছাইফুল আলম বলেন, তিন বছর আগেও দেশে সরিষা উৎপাদিত হতো প্রায় ছয় লাখ টন। কিন্তু এখন দেশে গড়ে প্রতিবছর ১৭ লাখ টন সরিষা উৎপাদন হচ্ছে, যা থেকে প্রায় ছয় লাখ টন তেল উৎপাদিত হয়। এটি দেশের ভোজ্যতেলের চাহিদার ২৫ শতাংশ। কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের উৎপাদন মৌসুম শেষে সরিষা, তিল, বাদাম, সয়াবিন, সূর্যমুখীসহ তেলজাতীয় ফসলের আবাদ তিন গুণ বেড়ে ৮ লাখ ৬০ হেক্টর জমি থেকে ২৩ লাখ ৬০ হাজার হেক্টরে উন্নীত করা হবে। এতে তেলের উৎপাদনও একই হারে বাড়বে।
দানাদার খাদ্য উৎপাদনে রেকর্ড
দেশে গত বছর দানাদার খাদ্যের উৎপাদনে আগের সব রেকর্ড ভেঙেছে। ধান, গম, ভুট্টা মিলিয়ে মোট উৎপাদিত হয়েছে ৬ লাখ ৪৩ হাজার টন। বন্যা-ঘূর্ণিঝড়সহ নানা দুর্যোগ সত্ত্বেও এ বছর বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদন আরও বাড়তে পারে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশে যে ৬ কোটি ৪৩ লাখ টন দানাদার খাদ্য উৎপাদিত হয়েছে, এর মধ্যে ধানই ৫ কোটি ৮৬ লাখ টন; ভুট্টা ৪৭ লাখ টন। আর গম ১১ লাখ টন উৎপাদিত হয়েছে, যা দেশে মোট দানাদার খাদ্য উৎপাদনে রেকর্ড।
এফএওর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে দেশে ৬ কোটি ৯ লাখ ২১ হাজার টন দানাদার খাদ্য উৎপাদিত হয়। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে হয় ৬ কোটি ৩১ লাখ ৩০ হাজার টন। গত এপ্রিলে গম ঘরে তুলেছেন কৃষকরা। এবার ১১ লাখ টন গম উৎপাদন হয়েছে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. রিপন কুমার মণ্ডল বলেন, ‘আমরা তো শুধু ভাত খেয়ে বেঁচে থাকি না। শস্যজাতীয় খাদ্যের উৎপাদন ভালো হলেও অন্য সব পণ্যই আমদানি করতে হয়। তবে আমদানিনির্ভরতা কমাতে হলে দীর্ঘ পরিকল্পনার প্রয়োজন। এখানে প্রতিনিয়ত আবাদি জমি কমছে। বিপরীতে জনসংখ্যা বাড়ছে। তাই বিপুল মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘যেসব কৃষিপণ্য আমরা সহজে উৎপাদন করতে পারি, সেসবের উৎপাদন বাড়াতে হবে। এজন্য চালিয়ে যেতে হবে গবেষণা। যেসব পণ্য সহজে উৎপাদন হবে না, তার জন্য আমদানির পথও খোলা রাখতে হবে। আলুর মতো যেসব পণ্যের উৎপাদন বেশি হয়, সেসব পণ্য রপ্তানির ব্যবস্থা করা যায়।’