১৯৮১ সালের দিকে ১৬ বছর বয়সে মুজিবর গাজী বাবার হাত ধরে সুন্দরবনে যাওয়া শুরু করেন। নৌকার দাঁড় ধরা শিখতে তাঁর আরও দুই বছর লেগে যায়। বছর যখন ২০, তখন তিনি একটি বাওয়ালি দলের নেতা। নিজেই নৌকার দাঁড় টানেন। গরান কাটা থেকে মাছ ধরা সবই করেন।

মুজিবর গাজীর বয়স এখন ৬০ বছর। দীর্ঘ চার দশকের বেশি সময় নিয়মিত জীবিকার সন্ধানে বনে গিয়ে বাঘের থাবায় সঙ্গীদের জীবন দিতে দেখেছেন মুজিবর গাজী। নিজেও বাঘের মুখে পড়লেও বেঁচে ফিরেছিলেন সাহসের জোরে। এরপরও তিনি সুন্দরবনে যাওয়া বন্ধ করেননি। কিন্তু গত সেপ্টেম্বর থেকে আর বনে যাচ্ছেন না মুজিবর গাজী। কারণ হিসেবে বলছেন, ‘বাঘের থাবার ভয় না পেলেও বনদস্যুদের মার খাওয়ার শক্তি এখন নেই।’

সাতক্ষীরা শহর থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে সুন্দরবনের চুনা নদীর পাড়ে বুড়িগোয়ালিনী গ্রামে বনজীবী মুজিবর গাজীর বাড়ি। সুন্দরবনের মধু সংগ্রহ, গোলপাতা ও গরান কাঠ কাটার পাশাপাশি নদ-নদীতে মাছ-কাঁকড়া ধরা বংশপরস্পর তাঁদের পেশা। তার বাপ–দাদাও সুন্দরবনের ওপর নির্ভরশীল ছিলেন।

গতকাল মঙ্গলবার বেলা ১১টার দিকে বাড়ির পাশে আলাউদ্দিন মার্কেটে দেখা পাওয়া যায় মুজিবর গাজীর। আলাপচারিতায় উঠে আসে শৈশব, যৌবন ও বৃদ্ধ বয়সের নানা গল্প। নিজেকে একজন পাকা বনজীবী উল্লেখ করে তিনি জানান, বাদায় মাছ ধরতে গিয়ে তাঁর সঙ্গী ইউনুস গাজী ও আকবর সরদার বাঘের খাবার হয়েছেন। তারপরও বাদায় যাতায়াত করেছেন সাহসের সঙ্গে। গরান ও গোলপাতা কেটেছেন। মাছ ও কাঁকড়া ধরেছেন। কোনো ভয় তাঁকে বাদায় যাওয়া বন্ধ করতে পারেনি।

আরও পড়ুনসুন্দরবনে অপহরণ–আতঙ্কে পেশা বদলাচ্ছেন বনজীবীরা ১৮ জানুয়ারি ২০২৫

মুজিবর গাজী বাঘের মুখে পড়েছিলেন ২০০৯ সালের জুন মাসের শেষ দিকে। তার আগের মাসেই (২৫ মে) প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলা আর জলোচ্ছ্বাসে লন্ডভন্ড হয়ে গিয়েছিল পুরো উপকূলীয় এলাকা। তখন এলাকার কারও হাতে টাকাপয়সা ছিল না উল্লেখ করে মুজিবর বলেন, ঠিক করলেন বাদায় যাবেন। পাঁচ সদস্যের দলে নিয়ে বাদায় যান। সাতক্ষীরা রেঞ্জের বুড়িগোয়ালিনী স্টেশনের বড়কিয়াখালী খালে নৌকা রেখে অন্যরা আশপাশে মাছ ধরছে যান। মুজিবর খালের কিনারে একা একা জাল বাইছিলেন।

এই নৌকা নিয়েই সুন্দরবের খাল–বিলে ছুটে বেরিয়েছেন মুজিবর গাজী। মঙ্গলবার সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার বুড়িগোয়ালিনী গ্রামের চুনা নদীর পাড়ে.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ম জ বর গ জ স ন দরবন

এছাড়াও পড়ুন:

মনটা বাড়িতে পড়ে থাকলেও তাঁদের ঈদ কাটে বনে-বাদাড়ে

সারা দেশ যখন ঈদের আনন্দে ভাসছে, সবাই পরিবারের সঙ্গে ঈদ উদ্‌যাপন করছেন, তখনো দায়িত্বের ডোরে বাঁধা একদল মানুষ। তাঁরা পরিবারের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগ করে নিতে পারেন না, বাড়ির সবার সঙ্গে বসে ঈদের সেমাই খাওয়ারও সুযোগ হয় না। এমন মানুষের দলে আছেন সুন্দরবন রক্ষায় নিয়োজিত বন বিভাগের কর্মীরা। সুন্দরবনকে ভালো রাখতে তাঁরা নীরবে নিজেদের ঈদ উৎসর্গ করেন।

সুন্দরবনের বজবজা টহল ফাঁড়ির বনকর্মী মো. মফিজুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘ভাই, মনটা পড়ে আছে পরিবারের লোকজনের কাছে আর দেহটা সুন্দরবনে। সবার ঈদ কাটে পরিবারে, আমাদের কাটে বনে-বাদাড়ে। আসলে চাকরির জন্য সবকিছু মেনে নিতে হয়। আজ ঈদের দিনেও টহল করছি। আমরা স্টাফরা মিলে একটি মুরগি জবাই করেছি। আর একটু সেমাই রান্না করে নিজেদের মতো করে ঈদ উদ্‌যাপন করছি।’

বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রতিবছর ঈদের সময় চোরা শিকারি চক্র সুন্দরবনে হরিণসহ বন্য প্রাণী শিকারের অপতৎপরতা চালায়। তাই ঈদের সময় সুন্দরবনে বন বিভাগে কর্মরত সব কর্মকর্তা ও বনরক্ষীর ছুটি সীমিত করে কর্মস্থলে থেকে সার্বক্ষণিক টহলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

সোমবার ঈদের দিন সকালে সুন্দরবনের বিভিন্ন ফরেস্ট স্টেশন ও টহল ফাঁড়ির কয়েকজন কর্মকর্তা ও বনরক্ষীর সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেন, তাঁদের ঈদ হচ্ছে সুন্দরবনের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তা ছাড়া সবাই একসঙ্গে ছুটিতে গেলে বনে নজরদারি করবে কে? পরিবারের সঙ্গে না থাকতে পারলেও বনের নিরাপত্তায় কাজ করছেন, এটাই তাঁদের জন্য বড় পাওয়া।

পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য গহিন সুন্দরবনের নীলকমল এলাকায় আছেন ফরেস্ট কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম। লোকালয় থেকে সেখানে পৌঁছাতে নৌযানে সাত থেকে আট ঘণ্টা লাগে। আটজন সহকর্মী নিয়ে সেখানেই ঈদ উদ্‌যাপন করছেন তিনি। বলেন, ‘আমার বাড়ি জামালপুরে। মা-বাবাসহ পরিবার সেখানেই থাকেন। আমার জঙ্গলে চাকরির গত পাঁচ বছরের অধিকাংশ ঈদ পরিবার ছাড়া জঙ্গলেই কেটেছে।’

ফরেস্ট কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ঈদের সময়ে সুন্দরবনে অপরাধীদের তৎপরতা বেড়ে যায়। এ কারণে ঈদের সময়টায় যাতে কেউ সুন্দরবনের ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্য সারাক্ষণ টহলে থাকতে হয়। গতকাল রোববার সারা রাত টহল দিয়েছেন। সুন্দরবনের গহিনে হলেও এখানে মুঠোফোন সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিটকের নেটওয়ার্ক আছে। এ জন্য আপনার সঙ্গে কথা বলতে পারছি। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও কথা বলেছি।’

সুন্দরবনের শাকবাড়িয়া টহল ফাঁড়ির বনকর্মী মো. জুয়েল রানা বলেন, আজ পরিবার-প্রিয়জন নিয়ে সবাই যখন ঈদ আনন্দ উপভোগ করছেন, ঠিক তখন পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে তাঁরা নির্জন বনে অবস্থান করছেন। জঙ্গলের মধ্যে বসে সেমাই খেয়েছেন। এখন আবার টহলে বের হতে হবে। পরিবার ছাড়া ঈদ করা খুবই কষ্টের। তবে মানিয়ে নিতে হয়। পরিবারের সদস্যরাও এখন বিষয়টি মেনে নিয়েছেন।

জুয়েল রানা আরও বলেন, ‘দুর্গম ও ভয়ংকর বনাঞ্চলে আমাদের সব সময় জীবন বাজি রেখে দায়িত্ব পালন করতে হয়। তবে বেতন ছাড়া অন্য তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। রেশন–সুবিধাও পাই না আমরা।’

সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশনের দায়িত্বরত কর্মকর্তা মো. আল-আমীন বলেন, তাঁর স্টেশনটি লোকালয়ের কাছাকাছি হওয়ায় ঈদের নামাজ পড়তে পেরেছেন। গহিন সুন্দরবনের মধ্যে পাতকোষ্টা, কাগাদোবেকি, গেওয়াখালী, আদাচাই, ভদ্রা, পাশাখালীসহ তাঁদের অনেক টহল ফাঁড়ি আছে। সেখানে মুঠোফোনের নেটওয়ার্কও নেই। ওই সব জায়গায় যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁরা ঈদের নামাজও পড়তে পারেন না। ঈদের কয়েক দিন আগে লোকালয়ে এসে খাবার পানি আর বাজারসদাই নিয়ে যান। পরিবার ছাড়া বনে-বাদাড়ে বসেই হয়তো তাঁরা আজ নিজেরাই সেমাই রান্না করে খাচ্ছেন।

সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা এ জেড এম হাছানুর রহমান বলেন, ঈদের ছুটিতে সুন্দরবনের বনরক্ষীদের অধিকাংশই বাড়িতে চলে গেলে সুন্দরবনের অধিকাংশ এলাকা অরক্ষিত হয়ে পড়ে। ফলে হরিণশিকারিরা ঈদের ছুটির কয়েকটা দিনকে নিরাপদ সময় মনে করছে। এ জন্য এবার ঈদে সুন্দরবনে রেড অ্যালার্ট জারি করা হয়েছে। বনরক্ষীদের ছুটি সীমিত করা হয়েছে। বিশেষ জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কাউকে ছুটি দেওয়া হয়নি। অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা পরিবারের সঙ্গে ঈদ কাটানোর সুযোগ পেলেও বন বিভাগের অধিকাংশ কর্মী বনজ সম্পদ রক্ষার তাগিদে বনের গহিনে নির্জনে পরিবারবিহীন ঈদ করছেন।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • মনটা বাড়িতে পড়ে থাকলেও তাঁদের ঈদ কাটে বনে-বাদাড়ে
  • রাঙিয়ে তোলো ঈদের ছুটি...