তখন ছিল করোনাকাল। সেই সময় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন রওনক মাহমুদ। তাঁর করোনা আক্রান্ত মায়ের সেবা-শুশ্রূষায় মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের ২৪ কর্মকর্তাকে নিয়োজিত করে সচিব বেশ শোরগোল ফেলেছিলেন। সচিবের মায়ের সেবা দিয়ে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) তখনকার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড.

মো. আশাদুল আলম পেয়ে যান মওকা। সচিবের আশীর্বাদে বাগিয়ে নেন মহিষ গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালকের পদ। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ‘পুরস্কার’ পাওয়া ওই কর্মকর্তা রাজনৈতিক পালাবদলের পর নিজেও পাল্টিয়েছেন জার্সি। সেজেছেন বিএনপিপন্থি কর্মকর্তা। ফলও পেয়েছেন নগদে। এখন তিনি গবেষণা খামারের ফার্ম সুপার। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা যেখানে সার্বক্ষণিক গাড়ি সুবিধা পান না, সেখানে জুনিয়র কর্মকর্তা আশাদুল গাড়ি হাঁকান। কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে বেপরোয়া আচরণেও রয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধা নেওয়া এই কর্মকর্তার দুর্নাম।

শুধু আশাদুল নন, শেখ হাসিনার শাসনামলে দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে বিএলআরআইর কর্তৃত্ব দখল করলেও এখন খোলস পাল্টে অনেক কর্মকর্তাই সাচ্চা বিএনপিপন্থি হয়েছেন। বিএলআরআইর একসময়ের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা বর্তমান মহাপরিচালক ড. শাকিলা ফারুক আওয়ামী লীগপন্থি পাঁচ কর্মকর্তার মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্য, পদোন্নতি, টেন্ডারবাজিসহ সব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করছেন। নিজেদের আখের গোছানো সচল থাকলেও এক রকম অচল হয়ে পড়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা। এতে লেজেগোবরে পরিস্থিতি মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রমে। 

ভাগ্যবান মহাপরিচালক
সাভারের বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে তৃতীয় গ্রেডের কর্মকর্তা আছেন মাত্র দু’জন। তারা হলেন– সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক ড. এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন ও তাঁর স্ত্রী ড. নাসরিন সুলতানা। এর পর চতুর্থ গ্রেডের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আছেন ১৮ জন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করা জাহাঙ্গীর হোসেনকে সরিয়ে ওই পদে বসানো হয় পোলট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান ড. শাকিলা ফারুককে। অথচ নাসরিন সুলতানা জ্যেষ্ঠ হয়েও ‘স্বামীর কারণে দোষী’ হয়ে বঞ্চিত হন। আগে তিনি পরিচালক (গবেষণা) থাকলেও গত ১০ নভেম্বর তাঁকে পাঠানো হয় সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীতে। এতে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার মধ্যে তালিকায় শীর্ষে থাকা শাকিলা ফারুকের ভাগ্য ফেরে। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও তিনি প্রকল্প পরিচালক থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। কিশোরগঞ্জে বাড়ি হওয়ার সুবাদে সাবেক রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের ছেলের স্ত্রী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শামছুন নাহার নেলীর মাধ্যমে অতীতে বিএলআরআইয়ে প্রভাব তৈরি করেন শাকিলা। শাকিলার ভাই ও ভাবি সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় নিয়েছেন বাড়তি সুবিধা। পেয়েছেন সরকারের শুদ্ধাচার পুরস্কারও। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ডিঙিয়ে ‘দেশী মুরগি সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্পে’র পরিচালক পদ বাগিয়ে নেন। প্রকল্পটি শেষ হয় ২০১৮ সালের জুনে। চাকরি জীবনের পুরো সময় দেশি মুরগি নিয়ে গবেষণা করেছেন। কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে এ খাতে। তবে দেশি মুরগি এখনও গবেষণাগারেই বন্দি। খামারির কাছে দেশি মুরগি পাওয়া না গেলেও সফলতা দেখিয়ে ২০১৮ সালে তখনকার কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর কাছ থেকে নেন স্বর্ণপদক! 

বিএলআরআইয়ের প্রবিধানমালা অনুযায়ী, পরিচালনা ও প্রশাসন একটি বোর্ডের অধীন ন্যস্ত। এই একটি বোর্ডের সদস্য হিসেবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে ২০২২ সালে ১০ জানুয়ারি এক আদেশে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে (গ্রেড-৩) বাদ দিয়ে অজানা কারণে ড. শাকিলাকে (গ্রেড-৪) পরিচালনা বোর্ডের সদস্য মনোনয়ন দেওয়া হয়। ২০২১ সালে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হওয়ার পরই তাঁকে এক আদেশে দপ্তরপ্রধান, পোলট্রি রিসার্চ সেন্টারের বিভাগীয় প্রধান, পোলট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগ ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে।

মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে গত চার মাসে বিএলআরআইয়ে অজনা রোগে বহু প্রাণী মারা গেলেও কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তা ধামাচাপা দেন। দু’জন কর্মকর্তা এ নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলায় তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন শাকিলা।

পঞ্চপাণ্ডব
বিএলআরআইয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সাদেক আহমেদ ও ড. মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ এবং ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আশাদুল আলম, মো. ইউসুফ আলী ও ড. মো. খায়রুল বাশার মহাপরিচালককে ঘিরে রেখেছেন। বিএলআরআইয়ে তারা ‘পঞ্চপাণ্ডব’ হিসেবে পরিচিত। গত সরকারের পুরো সময়ে ড. সাদেক অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জাত সংরক্ষণ ও উন্নয়ন গবেষণা’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) হন। একই সঙ্গে তিনি ছাগল উৎপাদন গবেষণা বিভগের বিভাগীয় প্রধান পদেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৩ সালের জুনে শেষ হওয়া ওই প্রকল্পের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো ৫ আগস্টের পর আগের পদের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা ও প্রযুক্তি পরীক্ষণ বিভাগেরও প্রধান হন তিনি। এখন তিনি ‘বিএনপির বঞ্চিত’ খাতায় নাম লিখিয়েছেন।

ড. মুহাম্মদ আব্দুস সামাদের রয়েছে একসঙ্গে দুটি প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের ‘বিরল অভিজ্ঞতা’! ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ জিএইচএসএর লক্ষ্য অর্জনে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স এবং জুনোসিস প্রতিরোধ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন। এই প্রকল্প বাস্তবায়নকালেই ২০১৯ সালের জুলাই থেকে বিএলআরআইয়ের আরেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ‘জুনোসি ও আন্তঃসীমান্তীয় প্রাণী রোগ গবেষণা’ প্রকল্পেরও পরিচালক হন। অথচ আওয়ামী লীগপন্থি এই কর্মকর্তা এখন নিজেকে বিএনপিপন্থি পরিচয় দেন। গত জুনে জুনোসি ও আন্তঃসীমান্তীয় প্রাণী রোগ গবেষণা প্রকল্পটি শেষ হয়। তবে গত সপ্তাহে রাজধানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলে এই প্রকল্পের আওতায় উদ্ভাবিত এলএসডি (লাম্পি স্কিন ডিজিজ) টিকাবীজ হস্তান্তর করা হয়। প্রকল্প শেষ হলেও তারকা হোটেলে ব্যয়বহুল এই খরচের জোগান কীভাবে এলো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও গত বছরই এই টিকাবীজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে তা গ্রহণ করেননি তখনকার প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. রেয়াজুল হক। টিকাবীজ উদ্ভাবনের জন্য বাছুর কেনা নিয়েও ওঠে অনিয়মের অভিযোগ। বিএলআরআইয়ে তদন্ত কমিটি অভিযোগের প্রমাণ পেলেও নেওয়া হয়নি ব্যবস্থা। ড. আব্দুস সামাদ এখন ট্রান্সভাউন্ডারি অ্যানিম্যাল ডিজিজ রিসার্স সেন্টারের প্রধানের পাশাপাশি একাধিক দায়িত্বে আছেন।

মহিষ কিনতে ভারত সফরে
মহিষ গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ৯৫টি মুরাহ জাতের মহিষ কিনতে গত শনিবার ভারতে গেছেন মহাপরিচালক শাকিলা ফারুকসহ পাঁচ কর্মকর্তা। মহিষের দরপত্রের স্পেসিফিকেশন করে দিয়েছিলেন প্রাণী প্রজনন বিশেষজ্ঞ প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. পারভীন মোস্তারি। নিয়ম অনুযায়ী, এই সফরে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ড. পারভীন মোস্তারির যাওয়ার কথা থাকলেও পোলট্রি বিশেষজ্ঞ হয়ে মহাপরিচালক শাকিলাই গেছেন ভারতে। তিনি ছাড়াও এই সফরে আছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. হেমায়েত হোসেন, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ, প্রকল্প পরিচালক ড. গৌতম কুমার দেব ও উপপ্রকল্প পরিচালক ড. মো. আশাদুল আলম। তাদের আজ বৃহস্পতিবার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।

উপপ্রকল্প পরিচালক ড. মো. আশাদুল আলমের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে সমকাল। তবে তিনি ভারতে অবস্থান করায় কথা বলা যায়নি।

অভিযোগের ব্যাপারে মহাপরিচালক ড. শাকিলা ফারুক ফোনে সমকালকে বলেন, সরকার যখন যে দায়িত্ব দিয়েছে, তা পালন করেছি। কখনও কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা দূর করার চেষ্টা করছি। এখানে কাউকে বাড়তি কোনো সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না।
 

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জ য ষ ঠ কর মকর ত ল গ সরক র র কর মকর ত র প রকল প র ব যবস থ মন ত র কর ত র আওয় ম ব এনপ

এছাড়াও পড়ুন:

কর্তারা ব্যস্ত আখের গোছাতে গবেষণা কার্যক্রম অচল

তখন ছিল করোনাকাল। সেই সময় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব ছিলেন রওনক মাহমুদ। তাঁর করোনা আক্রান্ত মায়ের সেবা-শুশ্রূষায় মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের ২৪ কর্মকর্তাকে নিয়োজিত করে সচিব বেশ শোরগোল ফেলেছিলেন। সচিবের মায়ের সেবা দিয়ে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) তখনকার বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আশাদুল আলম পেয়ে যান মওকা। সচিবের আশীর্বাদে বাগিয়ে নেন মহিষ গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালকের পদ। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ‘পুরস্কার’ পাওয়া ওই কর্মকর্তা রাজনৈতিক পালাবদলের পর নিজেও পাল্টিয়েছেন জার্সি। সেজেছেন বিএনপিপন্থি কর্মকর্তা। ফলও পেয়েছেন নগদে। এখন তিনি গবেষণা খামারের ফার্ম সুপার। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা যেখানে সার্বক্ষণিক গাড়ি সুবিধা পান না, সেখানে জুনিয়র কর্মকর্তা আশাদুল গাড়ি হাঁকান। কর্মকর্তা-কর্মচারীর সঙ্গে বেপরোয়া আচরণেও রয়েছে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধা নেওয়া এই কর্মকর্তার দুর্নাম।

শুধু আশাদুল নন, শেখ হাসিনার শাসনামলে দলীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে বিএলআরআইর কর্তৃত্ব দখল করলেও এখন খোলস পাল্টে অনেক কর্মকর্তাই সাচ্চা বিএনপিপন্থি হয়েছেন। বিএলআরআইর একসময়ের সুবিধাভোগী কর্মকর্তা বর্তমান মহাপরিচালক ড. শাকিলা ফারুক আওয়ামী লীগপন্থি পাঁচ কর্মকর্তার মাধ্যমে নিয়োগ বাণিজ্য, পদোন্নতি, টেন্ডারবাজিসহ সব বিষয় নিয়ন্ত্রণ করছেন। নিজেদের আখের গোছানো সচল থাকলেও এক রকম অচল হয়ে পড়েছে গবেষণা প্রতিষ্ঠানটির গবেষণা। এতে লেজেগোবরে পরিস্থিতি মাঠ পর্যায়ের কার্যক্রমে। 

ভাগ্যবান মহাপরিচালক
সাভারের বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটে মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে তৃতীয় গ্রেডের কর্মকর্তা আছেন মাত্র দু’জন। তারা হলেন– সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক ড. এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন ও তাঁর স্ত্রী ড. নাসরিন সুলতানা। এর পর চতুর্থ গ্রেডের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আছেন ১৮ জন। আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করা জাহাঙ্গীর হোসেনকে সরিয়ে ওই পদে বসানো হয় পোলট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান ড. শাকিলা ফারুককে। অথচ নাসরিন সুলতানা জ্যেষ্ঠ হয়েও ‘স্বামীর কারণে দোষী’ হয়ে বঞ্চিত হন। আগে তিনি পরিচালক (গবেষণা) থাকলেও গত ১০ নভেম্বর তাঁকে পাঠানো হয় সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীতে। এতে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার মধ্যে তালিকায় শীর্ষে থাকা শাকিলা ফারুকের ভাগ্য ফেরে। অথচ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেও তিনি প্রকল্প পরিচালক থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। কিশোরগঞ্জে বাড়ি হওয়ার সুবাদে সাবেক রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের ছেলের স্ত্রী জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শামছুন নাহার নেলীর মাধ্যমে অতীতে বিএলআরআইয়ে প্রভাব তৈরি করেন শাকিলা। শাকিলার ভাই ও ভাবি সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় নিয়েছেন বাড়তি সুবিধা। পেয়েছেন সরকারের শুদ্ধাচার পুরস্কারও। জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের ডিঙিয়ে ‘দেশী মুরগি সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্পে’র পরিচালক পদ বাগিয়ে নেন। প্রকল্পটি শেষ হয় ২০১৮ সালের জুনে। চাকরি জীবনের পুরো সময় দেশি মুরগি নিয়ে গবেষণা করেছেন। কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে এ খাতে। তবে দেশি মুরগি এখনও গবেষণাগারেই বন্দি। খামারির কাছে দেশি মুরগি পাওয়া না গেলেও সফলতা দেখিয়ে ২০১৮ সালে তখনকার কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর কাছ থেকে নেন স্বর্ণপদক! 

বিএলআরআইয়ের প্রবিধানমালা অনুযায়ী, পরিচালনা ও প্রশাসন একটি বোর্ডের অধীন ন্যস্ত। এই একটি বোর্ডের সদস্য হিসেবে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে ২০২২ সালে ১০ জানুয়ারি এক আদেশে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে (গ্রেড-৩) বাদ দিয়ে অজানা কারণে ড. শাকিলাকে (গ্রেড-৪) পরিচালনা বোর্ডের সদস্য মনোনয়ন দেওয়া হয়। ২০২১ সালে প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হওয়ার পরই তাঁকে এক আদেশে দপ্তরপ্রধান, পোলট্রি রিসার্চ সেন্টারের বিভাগীয় প্রধান, পোলট্রি উৎপাদন গবেষণা বিভাগ ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তার দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে।

মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালনকালে গত চার মাসে বিএলআরআইয়ে অজনা রোগে বহু প্রাণী মারা গেলেও কার্যকর ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো তা ধামাচাপা দেন। দু’জন কর্মকর্তা এ নিয়ে গণমাধ্যমে কথা বলায় তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেন শাকিলা।

পঞ্চপাণ্ডব
বিএলআরআইয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা বলেন, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সাদেক আহমেদ ও ড. মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ এবং ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. আশাদুল আলম, মো. ইউসুফ আলী ও ড. মো. খায়রুল বাশার মহাপরিচালককে ঘিরে রেখেছেন। বিএলআরআইয়ে তারা ‘পঞ্চপাণ্ডব’ হিসেবে পরিচিত। গত সরকারের পুরো সময়ে ড. সাদেক অনেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাকে ডিঙিয়ে ‘ব্ল্যাক বেঙ্গল ছাগলের জাত সংরক্ষণ ও উন্নয়ন গবেষণা’ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) হন। একই সঙ্গে তিনি ছাগল উৎপাদন গবেষণা বিভগের বিভাগীয় প্রধান পদেও দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৩ সালের জুনে শেষ হওয়া ওই প্রকল্পের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো ৫ আগস্টের পর আগের পদের পাশাপাশি প্রশিক্ষণ পরিকল্পনা ও প্রযুক্তি পরীক্ষণ বিভাগেরও প্রধান হন তিনি। এখন তিনি ‘বিএনপির বঞ্চিত’ খাতায় নাম লিখিয়েছেন।

ড. মুহাম্মদ আব্দুস সামাদের রয়েছে একসঙ্গে দুটি প্রকল্পের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনের ‘বিরল অভিজ্ঞতা’! ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ জিএইচএসএর লক্ষ্য অর্জনে অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স এবং জুনোসিস প্রতিরোধ শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালক ছিলেন। এই প্রকল্প বাস্তবায়নকালেই ২০১৯ সালের জুলাই থেকে বিএলআরআইয়ের আরেক গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ‘জুনোসি ও আন্তঃসীমান্তীয় প্রাণী রোগ গবেষণা’ প্রকল্পেরও পরিচালক হন। অথচ আওয়ামী লীগপন্থি এই কর্মকর্তা এখন নিজেকে বিএনপিপন্থি পরিচয় দেন। গত জুনে জুনোসি ও আন্তঃসীমান্তীয় প্রাণী রোগ গবেষণা প্রকল্পটি শেষ হয়। তবে গত সপ্তাহে রাজধানীর একটি পাঁচতারকা হোটেলে এই প্রকল্পের আওতায় উদ্ভাবিত এলএসডি (লাম্পি স্কিন ডিজিজ) টিকাবীজ হস্তান্তর করা হয়। প্রকল্প শেষ হলেও তারকা হোটেলে ব্যয়বহুল এই খরচের জোগান কীভাবে এলো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। যদিও গত বছরই এই টিকাবীজের মান নিয়ে প্রশ্ন তুলে তা গ্রহণ করেননি তখনকার প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডা. রেয়াজুল হক। টিকাবীজ উদ্ভাবনের জন্য বাছুর কেনা নিয়েও ওঠে অনিয়মের অভিযোগ। বিএলআরআইয়ে তদন্ত কমিটি অভিযোগের প্রমাণ পেলেও নেওয়া হয়নি ব্যবস্থা। ড. আব্দুস সামাদ এখন ট্রান্সভাউন্ডারি অ্যানিম্যাল ডিজিজ রিসার্স সেন্টারের প্রধানের পাশাপাশি একাধিক দায়িত্বে আছেন।

মহিষ কিনতে ভারত সফরে
মহিষ গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য ৯৫টি মুরাহ জাতের মহিষ কিনতে গত শনিবার ভারতে গেছেন মহাপরিচালক শাকিলা ফারুকসহ পাঁচ কর্মকর্তা। মহিষের দরপত্রের স্পেসিফিকেশন করে দিয়েছিলেন প্রাণী প্রজনন বিশেষজ্ঞ প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. পারভীন মোস্তারি। নিয়ম অনুযায়ী, এই সফরে বিশেষজ্ঞ হিসেবে ড. পারভীন মোস্তারির যাওয়ার কথা থাকলেও পোলট্রি বিশেষজ্ঞ হয়ে মহাপরিচালক শাকিলাই গেছেন ভারতে। তিনি ছাড়াও এই সফরে আছেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. হেমায়েত হোসেন, প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ আব্দুস সামাদ, প্রকল্প পরিচালক ড. গৌতম কুমার দেব ও উপপ্রকল্প পরিচালক ড. মো. আশাদুল আলম। তাদের আজ বৃহস্পতিবার দেশে ফেরার কথা রয়েছে।

উপপ্রকল্প পরিচালক ড. মো. আশাদুল আলমের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করে সমকাল। তবে তিনি ভারতে অবস্থান করায় কথা বলা যায়নি।

অভিযোগের ব্যাপারে মহাপরিচালক ড. শাকিলা ফারুক ফোনে সমকালকে বলেন, সরকার যখন যে দায়িত্ব দিয়েছে, তা পালন করেছি। কখনও কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা দূর করার চেষ্টা করছি। এখানে কাউকে বাড়তি কোনো সুবিধা দেওয়া হচ্ছে না।
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ