বিশ্বের অন্যতম এবং দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত, বাংলাদেশের সর্বাধিক আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজারের পরিবেশ-প্রতিবেশ লইয়া উদ্বেগ দীর্ঘদিন যাবৎ জনমনে বিরাজমান। একদিকে এই জেলার নদী-খাল-জলাশয়, তৎসহিত পর্বত ও বন দখল-দূষণে বিপর্যস্ত। এমনকি সমুদ্রও রক্ষা পাইতেছে না; অন্যদিকে আইনের তোয়াক্কা না করিয়া বিশেষত সমুদ্রের তীর ঘেঁষিয়া যথেচ্ছভাবে হোটেল-মোটেলসহ ক্ষুদ্র-বৃহৎ স্থাপনা গড়িয়া উঠিয়াছে। মঙ্গলবার প্রকাশিত সমকালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের প্যাঁচার দ্বীপ সৈকতে মারমেইড বিচ রিসোর্ট এমনই এক স্থাপনা। ইহাকে ‘ইকো রিসোর্ট’ বা ‘পরিবেশবান্ধব’ দাবি করা হইলেও খাল ও সরকারি জমি দখল এবং বৃক্ষ কর্তন করিয়া ইহা নির্মিত হইতেছে। বাঁকখালী নদীতে পরিবেশ অধিদপ্তর সৃজিত বন ধ্বংস করিয়াও স্থাপনা নির্মাণ করা হইয়াছে। প্রশাসনের নাসিকার অগ্রভাগে এই প্রকার পরিবেশ-বিধ্বংসী তৎপরতা দুর্ভাগ্যজনক।
প্রতিবেদনের সহিত প্রকাশিত আলোকচিত্রেও স্পষ্ট দৃশ্যমান, কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের প্রতিবেশগতভাবে সংকটাপন্ন এলাকায় নদী ও বালিয়াড়ি দখল করিয়া রিসোর্টটি নির্মাণ করা হইতেছে। প্যাঁচার দ্বীপ এলাকাটি লাল কাঁকড়ার বিচরণক্ষেত্র এবং কচ্ছপের ডিম পাড়িবার আবাসস্থল হইবার কারণে উচ্চ শব্দ ও আলোকায়ন তথায় নিষিদ্ধ। বাস্তবে প্রায় প্রতি রাত্রিতেই উক্ত এলাকায় অনুরূপ বিবিধ অনুষ্ঠান হইতেছে। যাহার কারণে কচ্ছপের পদক্ষেপ এখন আর তথায় দৃশ্যমান নয়। হারাইয়া গিয়াছে লাল কাঁকড়াও। যাহা বিস্ময়কর, সরকারি ভূমি দখল করিয়া নির্মিত মারমেইড বিচ রিসোর্টের স্থাপনাসমূহ এক সপ্তাহের মধ্যে অপসারণে পরিবেশ অধিদপ্তর নোটিশ দিবার পর দুই সপ্তাহের অধিক সময় অতিক্রান্ত হইলেও পরিস্থিতির কোনো ইতরবিশেষ ঘটে নাই।
আমরা জানি, কক্সবাজারব্যাপী এই প্রকার পরিবেশ-বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড চলমান। তথায় অবৈধভাবে বৃক্ষ নিধন এবং পাহাড় কর্তন হইতেছে। বালি উত্তোলনও থামিয়া নাই। পর্যটন নগরীর এহেন নাজুক পরিস্থিতি হতাশাজনক। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণেই কক্সবাজারে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হইতে পর্যটকরা আগমন করেন। তাহাদের আতিথেয়তার সুব্যবস্থাপনা নিঃসন্দেহে জরুরি। কিন্তু পরিবেশ উপেক্ষা করিয়া উন্নয়ন চলিতে পারে না। কক্সবাজারে কোনো প্রকল্প, শিল্পপ্রতিষ্ঠান কিংবা হোটেল-মোটেল স্থাপনের জন্য নূতন করিয়া বৃক্ষ কর্তনের অনুমতি দেওয়া যাইবে না। তথায় পর্বতের সুরক্ষাও জরুরি। কারণ ইতোমধ্যে বৃক্ষ ও পর্বত নিধন করিয়া পরিবেশের যথেষ্ট ক্ষতিসাধন করা হইয়াছে। নূতন করিয়া পরিবেশ-বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড চলিতে দেওয়া যাইবে না।
স্মর্তব্য, ২০২৩ সালের ১৮ মে সমকালের তরফ হইতে ‘বিপর্যস্ত কক্সবাজারের পরিবেশ ও প্রতিবেশ: করণীয় নির্ধারণ’ শীর্ষক সেমিনারের আয়োজন করা হইয়াছিল। তথায় বক্তারা কক্সবাজারের পরিবেশের জন্য জরুরি কিছু পরামর্শ দিয়াছিলেন। উক্ত সুপারিশমালা আমলে লইলেও পরিস্থিতির উন্নতি হইত বলিয়া আমাদের বিশ্বাস। কিন্তু তৎকালীন সরকার উহাতে কর্ণপাত করে নাই। অবশ্য উহার কারণও অজ্ঞাত নহে। বিশেষত অতীতের সকল সরকারের সময় দেখা গিয়াছে, পরিবেশ ধ্বংসের হোতারা সাধারণত ক্ষমতাসীনদের আশীর্বাদপুষ্ট। বিগত সরকারও এই ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম ছিল না। তবে বর্তমানে যেহেতু শিক্ষার্থী-জনতার আন্দোলনের ফলস্বরূপ নির্দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতাসীন, সেহেতু পরিবেশ ধ্বংসকারীদের সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পাইবার অবকাশ নাই। তাই পরিবেশ অধিদপ্তর স্বীয় দায়িত্ব পালনে দ্রুত তৎপর হইবে– এই প্রত্যাশা করাই যায়। আমরা মনে করি, কেবল প্যাঁচার দ্বীপ সৈকতের অবৈধ মারমেইড বিচ রিসোর্ট নহে, কক্সবাজারের পরিবেশ-বিধ্বংসী সকল অপতৎপরতার বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। নামকাওয়াস্তে নহে, এহেন বেআইনি স্থাপনার বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালাইতে হইবে। নচেৎ জাতীয় অর্থনীতির জন্যও গুরুত্বপূর্ণ শহরটিকে রক্ষা করা কঠিন হইবে। এই লক্ষ্যে প্রশাসনের পক্ষ হইতে কোনো হটলাইন চালু করা যায় কিনা, যথায় পর্বত কর্তন, নদী দখল কিংবা অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করিলে দ্রুততার সহিত তথ্য দেওয়া যাইবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগও জরুরি।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পর ব শ ব ধ ব স ন কর য় হইত ছ সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
চার গুণ গতিতে বাড়ছে সাগরের উষ্ণতা
গত চার দশকে আগের চেয়ে চার গুণ দ্রুত হারে বেড়েছে বিশ্বের মহাসাগরগুলোর উষ্ণতা। সম্প্রতি ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার (ইএসএ) পরিচালিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে এমন তথ্য, যা বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের গতি ও ভয়াবহতা নিয়ে নতুন করে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে বিজ্ঞানীদের। গতকাল রোববার দি আর্থ ডটকমের এক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে বিষয়টি।
গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত প্রতি দশকে সমুদ্রপৃষ্ঠের গড় তাপমাত্রা বেড়েছিল ০.০৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অথচ ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত এই বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ০.২৭ ডিগ্রিতে, যা আগের তুলনায় প্রায় চার গুণ।
এই দীর্ঘমেয়াদি বিশ্লেষণে বিজ্ঞানীরা ইউরোপীয় স্যাটেলাইট মিশন থেকে পাওয়া ২০টি ইনফ্রারেড রেডিওমিটার ও দুটি মাইক্রোওয়েভ সেন্সরের তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। পাশাপাশি জাহাজ ও ভাসমান বয়ার মাধ্যমে সংগৃহীত ডেটাও যাচাই-বাছাই করে একত্র করা হয়েছে। গবেষকরা বলছেন, এটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সমুদ্রপৃষ্ঠ তাপমাত্রার তথ্যভাণ্ডার।
সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা বাড়ার ক্ষেত্রে দায়ী হিসেবে বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণ বিশ্লেষণ করেছেন গবেষকরা, যেমন– আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, এল নিনো ও লা নিনা, সূর্যের চক্র। এই প্রাকৃতিক ঘটনাগুলো সাময়িক প্রভাব ফেললেও দীর্ঘমেয়াদি উষ্ণতার পেছনে এগুলোর কোনো ভূমিকা নেই বলেই দেখেছেন বিশ্লেষকরা। মূলত গ্রিনহাউস গ্যাসের কারণে সূর্য থেকে আসা তাপ পৃথিবীর উপরিভাগে আটকে গিয়ে সৃষ্টি করছে তাপের ভারসাম্যহীনতা। এই বাড়তি তাপের বড় অংশ শোষণ করছে সমুদ্র। ফলে দ্রুত বাড়ছে সমুদ্রের তাপমাত্রা।
ইউনিভার্সিটি অব রিডিংয়ের গবেষক ক্রিস মার্চেন্ট বলেন, ‘তাপমাত্রা বাড়ার এই প্রবণতা আসলে আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার এবং গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের প্রতিচ্ছবি।’
সমুদ্রের এই অতিরিক্ত উষ্ণতা শুধু পরিসংখ্যানগত বিষয়ই নয়, এর রয়েছে সরাসরি প্রভাব। ঘূর্ণিঝড়কে দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করতে সাহায্য করে গরম পানি। ফলে ঘূর্ণিঝড় হয় আরও বিধ্বংসী। উষ্ণতার কারণে মারা যাচ্ছে প্রবাল প্রাচীর। বাসস্থান পরিবর্তন করছে সামুদ্রিক প্রাণী, যার প্রভাব পড়ছে মৎস্যজীবীদের জীবিকায়। উষ্ণ পানি প্রসারিত হওয়ায় বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এতে প্লাবনের ঝুঁকিতে পড়েছে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো। বদলে যাচ্ছে বৃষ্টিপাত ও আবহাওয়ার ধারা।
গবেষকরা বলছেন, এই পরিবর্তন বুঝতে ও মোকাবিলা করতে হলে আরও নিখুঁত পর্যবেক্ষণ জরুরি। ইএসএ ইতোমধ্যে ‘মোটিকিউসোমা’ নামে একটি প্রকল্প চালু করেছে, যা পৃথিবীর তাপ ভারসাম্য বিশ্লেষণ করছে। ভবিষ্যতে উন্নত স্যাটেলাইট মিশনের মাধ্যমে এই পর্যবেক্ষণ আরও কার্যকর হবে।
নতুন এই গবেষণা আবারও প্রমাণ করেছে, মানবসৃষ্ট অতিরিক্ত তাপ শোষণ করা মহাসাগরগুলোও অতিরিক্ত দূষণে নাকাল। পরিবেশবিদদের মতে, এখনই যদি কার্যকরভাবে গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমানো না যায়, তবে ভবিষ্যতে উষ্ণতা আরও বাড়বে এবং তার ফলাফল হবে ভয়াবহ।