ভাষাবৈচিত্র্য ও বাংলা ভাষার চ্যালেঞ্জ
Published: 25th, February 2025 GMT
ডিজিটাল দুনিয়ায় আমরা নিরন্তর যোগাযোগের মধ্যে আছি। এ বিচরণের প্রধান বাহন ইংরেজি ভাষা। ইংরেজি বিশ্বায়ন, ক্ষমতা ও কেন্দ্রের ভাষা। ইংরেজির ঔপনিবেশিক ঘোর থেকে আমরা কখনোই মুক্ত হইনি। একই সঙ্গে স্থানীয় ও বৈশ্বিক হয়ে উঠেছি; যুগপৎ বাস্তব ও ভার্চুয়াল জগতের বাসিন্দা। ডিজিটাল যুগে বাংলা ভাষার সামনে বিপদ ও সুযোগ উভয়ই তৈরি হয়েছে। আমাদের সীমিত ডিজিটাল সক্ষমতা এখনও বাংলা ভাষার জন্য প্রতিকূল। বাংলায় সফটওয়্যার ও অ্যাপ্লিকেশন কম। ওয়েবসাইটও সে অর্থে অপ্রতুল। ডিজিটাল গ্লোবাল প্ল্যাটফর্মে বাংলার সঙ্গে ইন্টারফেস অপ্রতুল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও ভাষা প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে বাংলা অনেক পিছিয়ে।
যোগাযোগ ও অনলাইনে ইংরেজি কনটেন্টের আধিপত্যের ফলে নতুন প্রজন্মের কাছে বাংলা দক্ষতা ও আগ্রহ হ্রাস পেতে পারে। অন্যদিকে এখন সামাজিক মাধ্যমে প্রতিদিন অনেক বাংলা লেখা হয়, যা আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেশি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনুভূতির বিরাট অংশ ইংরেজি অথবা আরবিতে বলতে দেখা যায়। বাংলায় ধন্যবাদ বা অভিনন্দন না লিখে আমরা এখন ইংরেজি অথবা আরবিতে বলি। আমরা বাংলা, ইংরেজি ও আরবির মিশ্রণে একটি হাইব্রিড বা সংকর ভাষা তৈরি করছি, যা বাংলা ভাষার চরিত্রকে বদলে বিকৃত ভাষা তৈরি করছে।
আমরা আঞ্চলিকতা দিয়ে প্রমিত বাংলাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছি। জাতিরাষ্ট্রের উদ্ভবের সঙ্গে মানভাষা গড়ে ওঠা সম্পর্কিত। মানভাষা গঠন প্রক্রিয়ায় আমরা অনেক আঞ্চলিক শব্দ ও রীতি বর্জন করেছি। ডিজিটাল যুগে যোগাযোগে ও প্রযুক্তিগত কথোপকথনের জন্য মানভাষা গুরুত্বপূর্ণ। মানভাষা আঞ্চলিক ভাষার সঙ্গে একটা টানাপোড়েন এবং গ্রাম ও শহরের মধ্যে ভাষাগত পার্থক্য তৈরি করেছে। মানভাষা ভাষাগত সমরূপতা তৈরি করলেও আমাদের ভাষাবৈচিত্র্য হ্রাস করেছে। এই প্রমিত বাংলাকে ভাঙার চেষ্টায় অনেকেই এক ধরনের উদ্ভট ভাষারীতি চালু করছেন।
সম্প্রতি বাংলা ভাষার মধ্যে কৃত্রিমভাবে আরবি-ফার্সি শব্দ ঢোকানোর প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বাংলা ভাষা অনেক আরবি, ফার্সি, পর্তুগিজ ও ইংরেজি শব্দ আত্তীকরণ করেছে। ধর্মের কারণে অনেক আরবি শব্দ স্বাভাবিকভাবেই বাংলায় প্রবেশ করেছে। ফার্সি ১৮৩৫ সাল পর্যন্ত এখানকার রাষ্ট্রভাষা ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেককে অনুভূতি আরবি ও ইংরেজিতে লিখতে দেখি। আমরা কি আমাদের আবেগ-অনুভূতি বাংলায় প্রকাশ করতে পারি না? ইংরেজির বদলে বাংলায় প্রকাশ করলে কি আমাদের মর্যাদা কমে যাবে? আরবিতে না বললে আমরা কি ধর্মভ্রষ্ট হবো? ধর্মে কি এমন কোনো নির্দেশ আছে যে, অনুভূতি মাতৃভাষায় প্রকাশ করা যাবে না? অথচ বাংলার সঙ্গে বৈরিতা না করেও ধর্মনিষ্ঠ হতে কোনো অসুবিধা নেই।
উনিশ শতকের শুরুতে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজকে কেন্দ্র করে যে বাংলা গদ্য গড়ে ওঠে, তাতে বাংলার সংস্কৃতায়ন ঘটে। তারা সংস্কৃতকে বাংলার ভিত্তি হিসেবে নিয়ে বাংলা ভাষাকে তৎসম শব্দে ভারাক্রান্ত করেন এবং আরবি-ফার্সি, দেশি শব্দ এবং অনেক বাংলা ক্রিয়াপদ বর্জন করেন। অনেকেই একে মুসলমানবিরোধী ষড়যন্ত্র বলে মনে করেন। ভাষার এই বিভক্তিকে কেন্দ্র করে পরে হিন্দু-মুসলিম ভাষা সাম্প্রদায়িকতা দেখা যায়। ন্যাথানিয়েল হ্যালহেড বাংলা ভাষার সংস্কৃতায়নের পথিকৃৎ। তিনি মনে করতেন, আরবি-ফার্সি শব্দের ব্যবহার বাংলার বিশুদ্ধতা নষ্ট করবে। এই দলের হেনরি ফরস্টার ও উইলিয়াম কেরি কেউই হিন্দু ছিলেন না। হ্যালহেড তাঁর ব্যাকরণে আরবি-ফার্সি শব্দ বাদ দেন। ফস্টার তাঁর অভিধানে আরবি-ফার্সি শব্দ বর্জন করেন। কারও কারও মতে, হ্যালহেড সংস্কৃতের সঙ্গে গ্রিক ও লাতিনের সাদৃশ্য আছে বলে মনে করতেন এবং বাংলা ভাষা সংস্কৃত উৎসজাত ভেবে বাংলার সংস্কৃতায়নের পক্ষে ছিলেন।
সাম্প্রতিক সময়ে এক দল বাংলার মধ্যে কৃত্রিমভাবে আবারও আরবি-ফার্সি শব্দ প্রবেশ করানোয় সচেষ্ট।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আরবি হরফে বাংলা লেখারও চেষ্টা হয়েছিল। এর বিপরীতে ষাটের দশকে পাকিস্তানবিরোধী ভাষাভিত্তিক সেক্যুলার ভাবধারারও প্রসার ঘটে। বাংলা ভাষা তার শৈশব অতিক্রম করে সংস্কৃতের প্রভাব কাটিয়ে নিজস্ব ভিত্তি তৈরি করে নিয়েছে। এ কথাও মানতে হবে, সংস্কৃত ভাষার বিপুল শব্দভান্ডার থেকে বাংলা নিয়েছে অনেক। আনিসুজ্জামানের মতে, এ যাত্রায় অনেক বিত্ত সংগৃহীত হয়েছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু ঘরের অনেক দিনের সঞ্চয়ও হারিয়ে গিয়েছিল।
ভাষা সাম্প্রদায়িকরা বাংলা ভাষার শরীরকে হিন্দু ও মুসলিম বাংলায় ভাগ করতে চায়। এই দ্বিখণ্ডীকরণের পথে রবীন্দ্রনাথকে বিদ্বেষভাজন করে তোলা হচ্ছে, যিনি কিনা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষাকে প্রমিত বাংলায় তুলে এনে বাংলাকে সংস্কৃতমুক্ত করেছেন; ভাষার চলিত রূপের ব্যবহার সম্ভব করেছেন। ষাটের দশকে মওলানা আকরম খাঁ, ফজলুর রহমান, আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, গোলাম মোস্তফা ও আজাদ পত্রিকা ইসলামী বাংলা ভাষার পক্ষে বলেছেন। এদের সম্পর্কে ১৯৫৪ সালে সাহিত্য সম্মেলনে মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ বলেন, ‘আরবি হরফে বাংলা লেখা, বাংলা ভাষায় অপ্রচলিত আরবি-ফার্সি শব্দের আমদানি, প্রচলিত বাংলা ভাষাকে গঙ্গাতীরের ভাষা বলে তার পরিবর্তে পদ্মাতীরের ভাষা প্রচলনের খেয়াল প্রভৃতি বাতুলতা আমাদের একদল সাহিত্যিককে পেয়ে বসল।’
বাংলা ভাষা চিরকালই আক্রান্ত হয়েছে তার শত্রুদের দ্বারা। প্রতাপের ভাষা ফার্সি, ইংরেজি ও উর্দু বাংলাকে পরাস্ত করতে চেয়েছে বারবার। কেবল বিজেতাই নয়, স্থানীয় শাসক শ্রেণি বাংলার সঙ্গে শত্রুতায় লিপ্ত ছিল, আজও আছে। বাংলা গ্রামীণ দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা। আশরাফ ও ভদ্দরলোক শ্রেণির কাছে বাংলা কখনোই স্বীকৃতি পায়নি। তারা বাংলাকে ইতর ভাষা বলে মনে করত। উনিশ শতকে বাংলার শহরবাসী অভিজাত মুসলমানদের ভাষা ছিল উর্দু। নবাব আব্দুল লতিফ বাংলাকে হিন্দু ও গ্রামের নীচু জাতের মানুষের ভাষা বলে মনে করতেন। এদের প্রসঙ্গে ড.
বাংলাদেশের শাসক শ্রেণি বাংলা ভাষাকে কখনোই পেশার ভাষা, কাজের ভাষা, জ্ঞানের ভাষা হয়ে উঠতে দেয়নি। শিক্ষা ব্যবস্থায় বাংলাকে প্রান্তিক এবং অদ্ভুতভাবে প্রাথমিক শিক্ষায় ইংরেজি ভার্সন চালু করা হয়েছে। বাংলায় জ্ঞানচর্চায় ক্লীব আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। বাংলাকে দমন করে রেখেছে ধণিক শ্রেণি। বাংলা এখন ইংরেজি, আরবি ও হিন্দি দিয়ে বিপদগ্রস্ত; ঘরের শত্রু বিভীষণেও আক্রান্ত। ইংরেজি আমাদের জানতে হবে; ধর্মের প্রয়োজনে আরবিও, কিন্তু মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে নয়। অতীতে শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলার গ্রামীণ জনগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে টিকিয়ে রেখেছিল, আজও তেমনি বাংলাভাষী মানুষ তার মাতৃভাষা বাংলাকে টিকিয়ে রাখবে। আমাদের ভাষাজ ফ্যাসিবাদ বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। বাংলাদেশে আধিপত্যশীল বাংলা ভাষা দিয়ে আমরা যেন বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভাষাকে অবদমিত না করি। ভাষাজ বৈচিত্র্য ও বহুত্ব আমাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মননকে প্রসারিত করবে। ফেব্রুয়ারি মাসকে আমরা যেন কপট ভাষাপ্রেমের ‘স্নিগ্ধ ছলনার মাসে’ পরিণত
না করি।
ড. আখতার সোবহান মাসরুর: লেখক ও নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম ছাত্রনেতা
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
‘মুক্তপ্রদীপের মতো’ জ্বলে আছে বরুণের ফুল
ভোরের আলো ফুটেছে অনেক আগেই। সেই অর্থে মানুষের জেগে ওঠার সরবতা তখনো ছড়িয়ে পড়েনি। চারপাশে সুনসান স্তব্ধতা গা এলিয়ে আছে। ছিটেফোঁটা দু-চারজন করে বিভিন্ন বাসাবাড়ি থেকে বের হয়ে আসছেন, পথে হাঁটছেন। মনু নদের পাড়টি আরও নীরব, জনমানবহীন শান্ত একটুকরা নির্মল হাওয়ার ভূমি হয়ে আছে। তখন ‘সেখানে ভোরের মেঘে নাটার রঙের মতো জাগিছে অরুণ/ সেখানে বারুণী থাকে গঙ্গাসাগরের বুকে, সেখানে বরুণ...।’
জীবনানন্দ দাশের নাটার রঙের মতো রাঙানো সূর্যের জেগে ওঠার এই মুহূর্তে একফালি মনু নদ কি আর গঙ্গাসাগরের মতো কোনো উপমার সঙ্গে সমান হতে পারে, চলতে পারে! তা না-ই হলো, তবু সেখানে গঙ্গাসাগরের বুকের কাছে যেমন বরুণ থাকে, তেমনই এখানেও এই মনু নদের পাড়ে চুপি চুপি, শাখায় শাখায় ফুলের বন্যা নিয়ে জেগে আছে বরুণের গাছ।
বসন্তের সকাল, মৃদু বাতাসে তখনো কিছুটা ঠান্ডার মতো ভাব আছে। সময় উড়ছে সকালের নরম রোদের পালকে। এ রকম একটা সময়ে পথ চলতে চলতে মৌলভীবাজার শহরের ফরেস্ট অফিস সড়কের ভৈরব থলির কাছে পৌঁছেই দেখা হয়ে যায় তার সাথে, তাহাদের সাথে। ‘বাসা তোমার সাতসাগরের ঘূর্ণী হাওয়ার বুকে!/ ফুটছে ভাষা কেউটে ঢেউয়ের ফেনার ফণা ঠুকে!/ প্রায়ণ তোমার প্রবালদ্বীপে, পলার মালা গলে/ বরুণরানি ফিরছে যেথা, মুক্তপ্রদীপ জ্বলে।’ অনেকটা তা–ই, গাছের শাখায় শাখায় সবুজ পাতার ফাঁকে মুক্তপ্রদীপের মতো জ্বলে আছে সাদা, গোলাপি, সবুজের মিশ্রণে অসংখ্য বরুণ ফুল।
ফুলটির পোশাকি নাম বরুণ হলেও আরও অনেক নাম আছে। যেমন: বৈন্যা, শ্বেতপুষ্প, কুমারক, সাধুবৃক্ষ, শ্বেতদ্রুম।বছর ঘুরে বরুণ রানির ফেরাটা এ রকমই মনে হয় রাজকীয়, এ রকমই জাঁকজমকের। গাছজুড়ে ফুটে আছে ফুল। দু-চারটা শালিক, ঘুঘু পাখি উড়ে আসছে, ফুলের ওপর বসছে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে আবার ফিরে যাচ্ছে। ফোটা ফুলের পাপড়িরা বাতাসের আহ্লাদে টুকটুক করে ঝরে পড়ছে গাছের নিচে। পাপড়ির নকশিকাঁথা যেন কেউ বিছিয়ে রেখেছে ঘাসের ওপর। বেশ বড়সড় ঝাঁকড়া মাথার গাছ। ডালগুলোও চারদিকে ডানা মেলে আছে। পাশেই মনু নদ। হয়তো কোনো একদিন এই নদের পানিতে ভেসে এসেছিল এই বরুণগাছের ফল। সেই পাকা ফলটি চরের মতো জেগে থাকা পাড়ের মাটিতে আশ্রয় পেয়ে গাছ হয়ে মাথা তুলেছে। তারপর বসন্তের মাঝামাঝি এলেই ডালে ডালে ফুলের জলসা বসছে।
ওখানেই, বরুণগাছটির কাছে এই সাতসকালে দেখা শহরের সৈয়ারপুর এলাকার বাসিন্দা সাংস্কৃতিক সংগঠক শৈলেন রায়ের সঙ্গে। তিনি জানালেন, গাছটি বেশ অনেক বছর ধরে দেখছেন। তবে গাছে যে এত ফুল ফোটে এবং এই গাছের নাম যে বরুণ, তা আগে সেভাবে খেয়াল করেননি। গাছটির বয়স ১৫ থেকে ২০ বছর বা এর আশপাশে হতে পারে। স্থানীয় লোকজন জানিয়েছেন, গাছটি এখানে কেউ রোপণ করেননি, গাছটি এমনিতেই গজিয়ে উঠেছে। গাছটি কারও হাতে কাটা পড়েনি বলে এখনো ফুলে ফুলে সাজতে পারছে।
বরুণ গাছের সবচেয়ে পছন্দের আবাসই হচ্ছে জলাভূমি এলাকা