রমজান মাসে সঠিক খাদ্যাভ্যাস অনুসরণ করা উচিত। কারণ, এ সময় আপনার শরীর দীর্ঘসময় ধরে ক্ষুধার্ত থাকে। তাই রমজান মাসে আপনি কী খেতে পারেন আর কী খেতে পারেন না– তার দিকে নজর দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
আসুন জেনে নেওয়া যাক রোজায় কীভাবে সুস্থ থাকা যায়।
প্রথমত, রমজান মাসে বাংলাদেশে প্রচলিত খাবারগুলো বেশির ভাগ তেলে ভাজা ও গুরুপাক হয়। যেমন– পিঁয়াজু, বড়া, বেগুনি, ডিমের বড়া ইত্যাদি। এ ছাড়া অনেক জায়গায় ইফতারে বিরিয়ানির মতো খাবারের প্রচলন রয়েছে। এগুলো নিয়মিত অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দিতে পারে। ফলে শরীর ডিহাইড্রেট হওয়ার পাশাপাশি মুখ শুকিয়ে যাবে, তৃষ্ণা অনুভূতি হবে এবং মাথাব্যথার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই ইফতার থেকে শুরু করে সেহরি পর্যন্ত পর্যাপ্ত পানি ও পানিযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে ভুলবেন না। এছাড়া ইফতারের শুরুতে সহজ ও নরম খাবার গ্রহণ করুন। এতে সারাদিন রোজা রাখার পর পরিপাকতন্ত্রে কোনো গোলযোগ সৃষ্টি করবে না।
দ্বিতীয়ত, সারাদিন রোজা রাখার পর অনেকেই খাবার পেয়ে সব খাবার একসঙ্গে খেতে শুরু করেন, যা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। খুব তাড়াতাড়ি খাবার হজমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। ধীরে ধীরে পরিমিত পরিমাণে খাবার গ্রহণ করুন।
তৃতীয়ত, রমজানে আমরা খাবার সময় পাই দিনরাতে তিনবার। অল্প সময়ে অধিক খাবার গ্রহণ করলে, খাবার হজম করতে যেমন কষ্টকর হয়, তেমনি এটি স্বাস্থ্যের ওপর বিশাল প্রভাব পড়বে। এটি হরমোনের ভারসাম্য, ওজন বৃদ্ধি ও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে।
চতুর্থত, অনেকেরই বিভিন্ন রোগ থাকে। রমজানে রোজা রাখার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শে রোজা রাখবেন এবং খাবার নিয়ে সচেতন থাকবেন। বিশেষ করে ডায়াবেটিক রোগী, উচ্চ রক্তচাপজনিত সমস্যা, অন্তঃসত্ত্বা নারী, আর্থ্রাইটিসজনিত সমস্যা, আইবিএস ইত্যাদি। ডায়াবেটিক রোগীদের রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবেন এবং মেডিসিন এবং ইনসুলিন ডোজ ঠিক রেখে রোজা রাখবেন।
উচ্চ রক্তচাপজনিত রোগীরা অতিরিক্ত ভাজাপোড়া, লবণাক্ত খাবার, সসজাতীয় খাবার গ্রহণ করবেন না। সুষম সহজপাচ্য খাবার গ্রহণ করুন। খাবারের তালিকায় মাছ, ডাল, শাকসবজি, ফল, বাদামকে গুরুত্ব দিন। এ ছাড়া খাবারের সালাদকে গুরুত্ব দিন।
অন্তঃসত্ত্বা নারী
রমজানে অন্তঃসত্ত্বা মায়েরা চিকিৎসকের পরামর্শে রোজা রাখুন।
কিডনি রোগী
কিডনিতে আক্রান্ত ব্যক্তি ডাল ও ডালের তৈরি খাবারগুলো এড়িয়ে চলুন। বিশেষ করে রোজায় বেসন দিয়ে বড়া, হালিম, ডালের বড়া ইত্যাদি। লবণাক্ত খাবার, শাকসবজি, ফল ও পানির ব্যাপারে সতর্ক হোন।
বয়স্ক রোগী
পরিবারে অনেক বয়স্ক ব্যক্তি আছেন। তাদের খাদ্যতালিকায় নরম, পাতলা, সহজপাচ্য খাবার যেমন স্যুপ, হালিম, দুধ দিয়ে সুজি, সেমাই খাবার দিন। ভাজাপোড়া খাবার পরিমিত খাবেন। আইবিএস ব্যক্তিরাও এ ধরনের খাবার খেতে পারেন। দুধজাতীয় খাবারে সমস্যা হলে দুধের পরিবর্তে পানি দিয়ে সুজি, সেমাই খেতে পারেন কিংবা ল্যাকটোজমুক্ত দুধ হাতের কাছে থাকলে তা দিয়ে খেতে পারেন। প্রতিদিন একটি ডিম সেদ্ধ, কলা, পাকা পেঁপে, খেজুর দিয়ে ইফতার করবেন।
সতর্কতা
১.
২. অতিরিক্ত মিষ্টিজাতীয় খাবার গ্রহণ করবেন না।
৩. অতিরিক্ত চা বা কফি পান করবেন না। বিশেষ করে সেহরিতে। এটি প্রস্রাবের উৎপাদন বৃদ্ধি করে; যার ফলে খনিজ পদার্থের ক্ষয় হবে।
৪. মাসজুড়ে সুষম বৈচিত্র্যময় খাবার গ্রহণ করুন। ফলমূল, শাকসবজি গ্রহণ করুন। লাল মাংস, মাছ, মুরগি, ডাল পরিমিত গ্রহণ করুন। চর্বিহীন দুধ বা টকদই গ্রহণ করুন। জটিল কার্বোহাইড্রেটযুক্ত খাবার যেমন গোটা শস্য, বাদামি স্টার্চযুক্ত খাবার গ্রহণ করুন। বাদাম, কিশমিশ, খেজুরের মতো শুকনো খাবার গ্রহণ করুন পরিমাণমতো।
৫. কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা ঘুমান। তারাবির পর একটু বিশ্রাম নিন। এতে শরীরের ক্লান্তি দূর হবে।
৬. যারা নিয়মিত নামাজ, তারাবির নামাজ আদায় করেন, তাদের ব্যায়ামের প্রয়োজন নেই। যারা তারাবির নামাজ পড়তে পারেন না কিংবা শারীরিক সমস্যা তারা ইফতার, সেহরিতে খাবারের পর একটু হাঁটুন। v
লেখক: পুষ্টিবিদ, রাইয়ান হেলথ কেয়ার হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার, দিনাজপুর
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: রমজ ন র পর ম পর ম ণ করব ন রমজ ন ইফত র সমস য
এছাড়াও পড়ুন:
জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী উৎসব–ভাবনা কেমন হবে
রুশো, হেগেল ও উৎসব
জুলাই গণ–অভ্যুত্থান সবকিছুকেই আমাদের নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করছে। উৎসব-ভাবনাকেও নতুনভাবে ভাববার দরকার আছে। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সংক্ষেপে ধরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব, যেন আগামিতে প্রয়োজনে আরও বিস্তারিত লিখতে পারি।
উৎসব সম্পর্কে আমাদের প্রথম পাঠ এই যে ‘জাতীয় উৎসব’ নামের ধারণা বাদ দিতে হবে। এর কারণ আমরা জাতিবাদের যুগ পার হয়ে এসেছি। সেক্যুলার কিংবা ধর্মীয় সব প্রকার জাতিবাদ আমাদের যেভাবে বিভক্ত করে রাখে, বিরোধ তৈরি করে, তাতে বিশ্বব্যবস্থায় শক্তিশালী অবস্থান আদায় করে নেওয়া আমাদের পক্ষে কখনোই সম্ভব হবে না।
আমরা বাস করছি পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালপর্বে। যারা মার্ক্সের দুই-এক পাতা উল্টিয়ে দেখেছেন, তাঁরা জানেন, পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক প্রচণ্ড গতিশীল। মানুষের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে বাজারের প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেমন প্রবলভাবে উৎসাহিত করে, তেমনি ব্যক্তিস্বাধীনতা ও ব্যক্তির প্রণোদনাকেও প্রবলভাবে উৎসাহিত করে।
স্বাধীন ব্যক্তির এই উত্থান ও শক্তির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো অ্যাবসার্ড, মার্ক্সের ভাষায় প্রতিক্রিয়াশীল। পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের বিকাশ একটি সমাজে ঘটা শুরু হলে তার বিরুদ্ধে নানা প্রতিক্রিয়াশীল ‘সমাজতান্ত্রিক’ ধারণাও প্রবল হয়। যাঁরা আমার কথা বিশ্বাস করবেন না, তাঁরা ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’-এর শেষে যুক্ত ‘প্রতিক্রিয়াশীল সমাজতন্ত্র’ অধ্যায় পড়ে আসতে পারেন। আমাদের জেনারেশনের বিপ্লবী তরুণদের বিশাল একটি অংশ অকাতরে যে ‘সমাজতান্ত্রিক’ স্বপ্নের জন্য শহীদ হয়েছেন, জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তাঁদের করুণ ইতিহাস শুনলে মার্ক্স ও এঙ্গেলস আফসোস করতেন।
এটা সেই সময়, যখন পাশাপাশি আমরা প্রবল জাতিবাদীও হয়ে উঠেছিলাম। আমরা মেনে নিতে চাইনি যে ভাষা ও সংস্কৃতি যেমন আমার অস্তিত্বের অংশ, তেমনি আমাদের ধর্ম, ইতিহাস, ঐতিহ্য, প্রাণ-প্রকৃতি-পরিবেশ, গ্রহ–নক্ষত্রের সঙ্গে বিশেষ সম্বন্ধের ধরনও একান্তই আমাদের। কিন্তু আমরা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধর্মের বিপরীতে স্থাপন করেছি, আবার উল্টো দিকে ধর্মকে আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছি। দুই প্রকার জাতিবাদের জন্ম দিয়েছি আমরা। একদিকে সেক্যুলার জাতিবাদ, আর তার বিপরীতে ধর্মীয় জাতিবাদ। এর জন্য আমাদের অতীতে অনেক মূল্য দিতে হয়েছে। এখনই সাবধান না হলে সামনে আরও মূল্য দিতে হবে।
পুঁজির আত্মস্ফীতি ও বিচলনের জগতে ‘জাতিবাদ’ নয়, আমাদের দরকার নতুন ‘রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী’ হিসেবে নিজেদের কল্পনা করতে ও ভাবতে শেখা। কেন? যেন পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় আমরা আমাদের জন্য শক্ত একটা আসন আদায় করে নিতে পারি। জুলাই গণ–অভ্যুত্থান আমাদের বৈশ্বিকভাবে ভাবার তৌফিক দিয়েছে।
নিজেদের রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী হিসেবে ভাববার অর্থনৈতিক মর্ম হচ্ছে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য দ্রুত শক্তিশালী অর্থনৈতিক বিকাশ নিশ্চিত করা। কিন্তু সেটা রাজনৈতিকভাবে নতুন ও শক্তিশালী বাংলাদেশ গঠন ছাড়া সম্ভব নয়। তাই জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের রাজনৈতিক মর্ম হচ্ছে গণসার্বভৌমত্বের (Peoples’s Sovereignty) ভিত্তিতে নতুন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলা। এই আলোকে আমরা চৈত্রসংক্রান্তি ও বাংলা নববর্ষকে কেন্দ্র করে উৎসব নিয়ে দুয়েকটি কথা পেশ করছি।
উৎসব গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক তৎপরতাসরকার এবার চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষ একসঙ্গে পালন করার জন্য জনগণকে উৎসাহিত করেছে। সমাজে পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশ যখন ঘটে, তখন ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির প্রতিযোগিতা ও দ্বন্দ্ব ব্যক্তিকে তার সামষ্টিক বোধ উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সে ক্ষেত্রে গণ-উৎসব বা যেকোনো সামাজিক মিলনমেলা ব্যক্তির মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবোধ থেকে সামাজিক বা সামষ্টিক বোধ উপলব্ধির শর্ত তৈরি করে। একে অনেকে ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ বলছেন।
কিন্তু জুলাই গণ–অভ্যুত্থান মূলত ছিল ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রব্যবস্থা বিলোপের লড়াই। ফলে অন্তর্ভুক্তির নামে যেকোনো প্রকার ফ্যাসিবাদী প্রবণতা বা ফ্যাসিস্ট শক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করা নীতি হতে পারে না। সেই জন্যই ‘জাতিবাদ’ বা যেকোনো পরিচয়সর্বস্বতা সম্পর্কে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। বিভিন্ন, বিচিত্র ও অনেককে নিয়েই আমরা ‘রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী’ হয়ে উঠি। কারণ, বিশ্বসভায় আমরা আমাদের স্থান নিশ্চিত করতে চাই। সেটা রাজনৈতিক ঐক্য ও সংহতি ছাড়া অর্জন সম্ভব নয়।
এই বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য ও সংহতির মূল্য বুঝতে জালাল উদ্দীন খাঁর বিখ্যাত গান মনে পড়ছে—‘এ বিশ্ববাগানে সাঁই নিরঞ্জনে মানুষ দিয়া ফুটাইল ফুল’। আমাদের গণ-উৎসব হবে মানুষের উদ্যাপন। আগামী দুনিয়ায় ‘বিশ্ববাগান’-এর রূপ কেমন হতে পারে, বাংলাদেশে তার রূপ আমাদের হাজির করে জগৎকে নতুন দুনিয়ার আগমনের জন্য প্রস্তুত করতে হবে।
শহুরে অভিজাতেরা ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ নামে যা গড়ে তুলেছে, তা প্রকৃতপক্ষে গণবিরোধী। এর নজির পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা। এটা শুধু এলিট ও ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণির আধিপত্য প্রদর্শনের জায়গা নয়, শ্রেণি–ধর্ম–লিঙ্গনির্বিশেষে জনগণকে একত্র না করে বরং বিভেদ, পার্থক্য ও বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছে।জাঁ-জাক রুশোর ‘সামাজিক চুক্তি’ তত্ত্বে ‘চুক্তি’ বা ‘বন্দোবস্ত’–সংক্রান্ত ধারণা আসলে গণ–অভিপ্রায়ের (General will) ধারণার সঙ্গে যুক্ত। গণ–অভিপ্রায় জনগণের ইচ্ছাকে বর্তমান রাখতে পারার প্রক্রিয়া। এ প্রক্রিয়াই গণতন্ত্র, গণতন্ত্রের ভিত্তি। রুশো শুধু রাজনৈতিক তত্ত্বই দেননি, উৎসব নিয়ে তাঁর তত্ত্বও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি উৎসবকে গণতান্ত্রিক চেতনা বিকাশের হাতিয়ার হিসেবে দেখেছেন। সেই তর্ক করতে গিয়ে তিনি এলিট বা অভিজাতদের নাটক-থিয়েটারকে অনুমোদন করেননি। কারণ, তা শ্রেণির বিভেদ বা বিভাজন তৈরি করে। তাই এলিট সংস্কৃতি নয়, দরকার গ্রামীণ মেলা।
সাধারণ মানুষের গণ-উৎসব, জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণ, যেখানে সব শ্রেণি-ধর্মের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয় এবং নেবে। এই অংশগ্রহণের মধ্য দিয়েই ব্যক্তি বুঝতে পারে, সে ‘সমষ্টির অংশ’, আর এই সামষ্টিক উপলব্ধির চর্চার মধ্য দিয়েই আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ধারণা জনগণ অনুমান করতে পারে এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র জন্মলাভ করে। দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক জনগোষ্ঠী ও গণ–উৎসব পরস্পরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
শহুরে অভিজাতেরা ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ নামে যা গড়ে তুলেছে, তা প্রকৃতপক্ষে গণবিরোধী। এর নজির পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভাযাত্রা। এটা শুধু এলিট ও ঢাকা শহরের মধ্যবিত্ত শ্রেণির আধিপত্য প্রদর্শনের জায়গা নয়, শ্রেণি–ধর্ম–লিঙ্গনির্বিশেষে জনগণকে একত্র না করে বরং বিভেদ, পার্থক্য ও বিচ্ছিন্নতা তৈরি করেছে।
ঋতুকেন্দ্রিক চেতনার প্রত্যাবর্তন ও উপস্থিতি জারি রাখাবাংলার ঐতিহ্যবাহী চৈত্রসংক্রান্তি বা গ্রামীণ মেলা ও উৎসবের সময়কে কখনোই সরলরৈখিক কল্পনা করা হয়নি। সময় আমাদের সংস্কৃতিতে ইংরেজদের গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নয়। বাংলায় সময় বা কাল মানে ঋতু, যা বৃত্তের মতো ফিরে ফিরে আসে। ঋতু চক্রাবর্ত, কিন্তু আমরা পশ্চিমা ‘লিনিয়ার’ বা সরলরৈখিক সময়ের ধারণা মুখস্থ করেছি, সেটাকেই অভ্যাস বানিয়েছি। আমরা এখন আর ঋতু বুঝি না, ক্যালেন্ডার বুঝি। এ অবস্থা থেকে আমাদের বের হয়ে আসতে হবে।
তার মানে আমরা নববর্ষ করব না, তা নয়; কিন্তু তাকে চৈত্রসংক্রান্তি থেকে আলাদা ভাবব না। কারণ, যে মূহূর্তে চৈত্র শেষ হলো, সেই একই বিন্দুতে নতুন বছরেরও শুরু। তবে এই নতুন কিন্তু ‘নতুন’ নয়। পুরানা ঋতুই বৃত্তের বিন্দুতে ফিরে আসে আবার। আমাদের ভাব ও সংস্কৃতির এই গভীরতা যেন আমরা হারিয়ে না ফেলি।
আমরা ভুলে গিয়েছি যে বাংলাদেশের গ্রামীণ মেলাগুলো তার চরিত্র, আদর্শ ও স্বাভাবিকতার সূত্রেই সেক্যুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ। উৎসব মানে ধর্ম-নির্বিশেষে যেখানে সবাই অংশগ্রহণ করতে পারে। এখানে ধর্মের ভেদ নেই। কারণ, ধর্মভেদটা কলোনিয়াল ইংরেজের তৈরি এবং আধুনিক জাতিবাদ তাকে আরও প্রবল করেছে। আমরা তাই বিশ্বাস করতে শিখেছি, ধর্মভিত্তিক ‘জাতি’ হয়। তাই মুসলমান একটা জাতি, হিন্দু একটা জাতি ইত্যাদি। এই কলোনিয়াল ভেদবুদ্ধি থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে।
সংস্কৃতি সরলরৈখিক বা কালকেন্দ্রিক নয়, ঋতুকেন্দ্রিক—এর মানে কী? ঋতুর বৃত্তে শেষ বলে কিছু নেই। প্রতিটি বিন্দু একই সঙ্গে বৃত্তের শেষ এবং আবার একই বৃত্তের শুরুও বটে। ঔপনিবেশিক শাসনের আগে উৎসবের ঋতুকেন্দ্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল প্রবল ও শক্তিশালী। ক্যালেন্ডার ধরে আমরা নববর্ষ পালন করিনি। চিত্রা নক্ষত্রের সৌরযাত্রা অনুসরণ করে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করেছি, যা একই সঙ্গে নববর্ষেরও শুরু। তথাকথিত ‘পুরাতন’কে বৈশাখী ঝড়ে ‘আবর্জনা’ জ্ঞান করে উড়িয়ে ফেলে দেওয়া কাজের কথা নয়। ‘আধুনিকতা’র নামে আমরা পাশ্চাত্যকে নির্বিচারে গ্রহণ করতে পারি না।
কৃষি-সংস্কৃতি: প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশকৃষি-সংস্কৃতিতে চৈত্রসংক্রান্তি পালনের বিষয়টি বছর শেষ ঘোষণার জন্য নয় কিংবা পরদিন নতুন বছর শুরু হচ্ছে বলে ‘নববর্ষের’ প্রস্তুতিও নয়। দিনটি গ্রামের কৃষক পরিবারগুলোতে পালিত হয় মানুষের শরীর ও প্রকৃতির মধ্যে সম্বন্ধ রচনার চর্চা হিসেবে। আমরা তো একালে গ্রহ–নক্ষত্রের কথা ভুলে গিয়েছি। সংক্রান্তি মানে কোনো না কোনো গ্রহের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত থেকে প্রতি মাসে ঋতুর ক্ষণ উদ্যাপন। তার মানে অন্যান্য মাসেও সংক্রান্তি আছে।
তাহলে চৈত্রসংক্রান্তি হচ্ছে প্রকৃতি ও গ্রহ–নক্ষত্রের সঙ্গে আমাদের সম্বন্ধ ঝালিয়ে নেওয়ার দিন। আমরা জীব হিসেবে বিশ্বপ্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন নই, এটা উপলব্ধি করা, জানা এবং সেই উপলব্ধিকে চরিতার্থ করার জন্য নানা আচার, উৎসব ও উদ্যাপন। খাদ্যব্যবস্থা তার অন্যতম দিক। চৈত্রসংক্রান্তির দিনে বিশেষ বিশেষ খাবার পরিকল্পিতভাবে খাওয়া নিয়ম। এই দিন প্রাণিজ আমিষ নিষিদ্ধ। এ ছাড়া আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চর্চা রয়েছে: আবাদি ফসল তো আমরা সারা বছরই খাই, চৈত্রসংক্রান্তিতে তাই অনাবাদি শাকসবজি খাওয়াই রীতি। অর্থাৎ চাষের শাকসবজি নয়, বরং কুড়িয়ে এনে চৌদ্দ রকমের শাক এবং চৈতালি মৌসুমের সবজি, পাতা, মুড়া ইত্যাদি খেয়ে চৈত্রসংক্রান্তি পালন করতে হয়।
গ্রামের কৃষকের স্মৃতি ও জ্ঞানচর্চার দিবস হিসেবে সবারই প্রায় অলক্ষ্যে দিনটি পালিত হয়ে যায়। চৈত্রসংক্রান্তির মহিমা এখানেই। এখনো গ্রামের মানুষ তার জ্ঞান অনুযায়ী যেসব অনাবাদি লতাপাতা-শাকসবজি পাওয়ার কথা ছিল, তা খুঁজে না পেলে আফসোস করেন। আমাদের বাপ-দাদার সময়ে যা দেখেছি কিংবা মায়েরা যেসব শাকসবজি দিয়ে চৈত্রসংক্রান্তি করতেন, তা এখন নেই। রাস্তাঘাট হয়েছে, বড় বড় দালানকোঠা হয়েছে, তাই অনাবাদি শাকসবজি আর খুঁজে পাওয়া যায় না। এসব আছে কি নেই, সেটা জেনে আমাদের কেমন সতর্ক হতে হবে, সেটা নির্ধারণের জন্য হলেও চৈত্রসংক্রান্তি পালন খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলার কৃষক নারী চৈত্রসংক্রান্তিতে ঘরের পাশে আলান-পালান মাঠের আনাচেকানাচে শাক কুড়াতে বের হন। নিয়ম আছে, তাঁকে চৌদ্দ রকম শাক কুড়াতে হবে। আবাদি নয় কিন্তু, অনাবাদি। অর্থাৎ রাস্তার ধারে, খেতের আলে, চকে আপনজালা শাক তুলতে হবে। যে শাক–লতাপাতা কেউ আবাদ করেনি, আপনা থেকেই গজিয়েছে—নিজে থেকে হয়ে ওঠা শাক, এই মৌসুমে যা টিকে থাকে। এই শাক তোলার অধিকার কৃষক নারীর থাকে। তাঁর দেখার বিষয় হচ্ছে, যে শাক তাঁরা খুঁজছেন, সেই শাক গ্রামে আছে কি না। সচ্ছল পরিবারের নারীরা নিজে শাক তুলতে বের না হলেও তার আশপাশের গরিব নারীদের মাধ্যমে শাক তুলিয়ে আনেন। মনে রাখতে হবে, বলা হয় শাক ‘তোলা’, শাক ‘কাটা’ নয়। কখনোই তারা পুরো গাছটি উপড়ে ফেলে শাক আনবেন না। অতি যত্ন করে পাতাটি তুলে আনবেন। গাছ যেমন আছে, তেমনই থাকবে।
কৃষক নারী খবর নিতে চান, প্রকৃতির যে অংশ অনাবাদি, যে অংশ কৃষি-সংস্কৃতির সংরক্ষণ করে রাখার কথা, নইলে প্রাণের সংরক্ষণ ও বিকাশ অসম্ভব—সেই অনাবাদি প্রকৃতি ঠিক আছে কি না। যেসব গাছপালা, প্রাণ ও প্রাণী আবাদ করতে গিয়ে আবাদি জায়গায় কৃষক তাঁদের দমন করেছেন, উঠতে দেননি, থাকতে দেননি, কিষানি মেয়ে এই দিন খবর নেন, তাঁরা সব ঠিকঠাক আছে তো?
চৈত্রসংক্রান্তিতে চৌদ্দ রকম শাক খাওয়া তো আসলে সব রকম গাছপালা, প্রাণ ও প্রাণীর হালহকিকতের খোঁজ নেওয়া। এটা নারীর সূক্ষ্ম জ্ঞানচর্চা। এই জ্ঞান নারীদের মধ্যে মা থেকে মেয়ে, পাড়া-প্রতিবেশীরা ভাগাভাগি করে শেখেন। ‘চৌদ্দ’ সংখ্যাটা প্রতীকী। বেশি পাওয়া গেলে আরও ভালো। তবে চৌদ্দ রকম শাক পাওয়াই এখন কঠিন হয়ে গেছে।
চৈত্রসংক্রান্তিতে কৃষক নারীকে খবর নিতে হয়, ‘পুরুষ’ সারা বছর যে ‘চাষ’ করল, তাতে অনাবাদি জাতি বা প্রজাতির হালহকিকতের কী দাঁড়াল? ‘চাষ’ করার অর্থ আবাদি ফসলের দিকে মনোযোগ দেওয়া, কিন্তু অনাবাদি ফসলের বিশাল ক্ষেত্র যেন তাতে নষ্ট বা কৃষিব্যবস্থায় গৌণ না হয়ে পড়ে।
এটা তাহলে পরিষ্কার যে সাংস্কৃতিক ও ভাবগত তাৎপর্য ছাড়াও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে চৈত্রসংক্রান্তি বৈষয়িক জীবনযাপনের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। দেহ ও মনের বিচ্ছেদ নয়, ঐক্য উদ্যাপনই চৈত্রের শেষ দিনের উৎসব। সংস্কৃতি এখানে সরাসরি প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত।
চৈত্রসংক্রান্তি আমাদের অর্থনৈতিক বিকাশের দিকনির্দেশনা দেয়। আমাদের বিকাশ তখনই সম্ভব, যখন আমরা প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষার কর্তব্য কঠোরভাবে পালন করি। যদি অর্থনৈতিক বিকাশ নিশ্চিত করতে চাই, তাহলে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষার নীতিও আমাদের কঠোরভাবে পালন করতে হবে। জীব হিসেবে প্রাণ, প্রকৃতি ও পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কিত থেকে নিজের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়াকে প্রাণ ও প্রকৃতির উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন চক্রের অন্তর্গত চালিকা শক্তি হিসেবে বিকশিত করার সক্ষমতা অর্জনের দ্বারাই আমরা বিশ্বে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম। মানুষের বিকাশের সঙ্গে প্রাণ ও প্রকৃতির বিকাশ ঘটে কিংবা প্রাণ ও প্রকৃতির বিকাশ একই সঙ্গে প্রজাতি হিসেবে মানুষের বিকাশ হয়ে ওঠা।
একই বৃন্তে চৈত্রসংক্রান্তি ও নববর্ষকে গেঁথে নেওয়ার অর্থ হচ্ছে নতুন বিশ্বের স্বপ্ন দেখা এবং নিজেদের অর্থনৈতিক বিকাশ নিশ্চিত করবার মধ্য দিয়ে নতুন বিশ্বের রূপ কেমন হতে পারে, বাংলাদেশে তা চর্চা করে দেখানো।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থান আমাদের আন্তর্জাতিকভাবে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করুক। আমাদের শক্তি যেন আমরা নিজেরা উপলব্ধি করতে পারি।
ফরহাদ মজহার কবি, লেখক ও চিন্তক
শ্যামলী, ৩১ চৈত্র, ১৪৩১/ ১৩ এপ্রিল ২০২৫
(ছাপা পত্রিকায় লেখাটির শিরোনাম: ঋতুকেন্দ্রিক সংস্কৃতির সঙ্গে রাজনৈতিক জনগোষ্ঠীর সম্পর্ক)