ইরানের ওপর ট্রাম্পের ‘সর্বোচ্চ চাপ’ আবার ব্যর্থ হবে?
Published: 25th, February 2025 GMT
গত ১১ ফেব্রুয়ারি ইরান তার ইসলামি বিপ্লবের ৪৬তম বার্ষিকী উদ্যাপন করেছে। আর এই সময়েই দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তেজনা আবারও বেড়েছে। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত বৃহস্পতিবার নতুন যে নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করেছেন, তা মূলত তেহরানের তেল রপ্তানিকে নিশানা করেছে। এটি ইরানের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞাকে আরও কঠোর করবে।
যদিও ট্রাম্প বলেছেন, এ বিষয়ে তিনি দ্বিধায় রয়েছেন এবং তিনি আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর পক্ষপাতী। কিন্তু তার আগের মেয়াদের প্রশাসনই একতরফাভাবে ইরান পরমাণু চুক্তি থেকে সরে গিয়েছিল। এখন আবার আলোচনার কথা বলাটা স্ববিরোধিতা ছাড়া কিছুই নয়।
অন্যদিকে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি আলোচনাকে ‘অযৌক্তিক ও অসম্মানজনক’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে এই সংকট শিগগিরই শেষ হওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।
এই নতুন ‘সর্বোচ্চ চাপ’ নীতি ইরানের দুর্বলতাকে কাজে লাগানোর কৌশলের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের পতন, হিজবুল্লাহর নেতৃত্বে ধাক্কা ও ইরানের অভ্যন্তরে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ দেশটিকে দুর্বল করে ফেলেছে। তাই ইরানের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। এই নীতির অংশ হিসেবে আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করার মাধ্যমে একটি ‘বিরোধী জোট’ গঠন এবং ইরানকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন করতে কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
‘সর্বোচ্চ চাপ’ দেওয়ার এই নীতির পেছনে দুটি প্রধান ধারণা ছিল। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্র মনে করেছিল, ইরানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে তা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির ওপর বড় কোনো প্রভাব ফেলবে না। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান আরও বেশি চীন ও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করেছে।
দ্বিতীয়ত, ধারণা করা হয়েছিল, নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা এতটাই কঠিন হয়ে পড়বে যে তারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এতে হয় সরকার পতন হবে, না হলে সরকার নীতি পরিবর্তনে বাধ্য হবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ইরানের সরকার অভ্যন্তরীণ ব্যবস্থার মাধ্যমে সংকট মোকাবিলা করেছে এবং নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও জনগণের ক্ষোভ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। অর্থাৎ এই দুই ধারণার ওপর ভিত্তি করে নেওয়া ‘সর্বোচ্চ চাপ’ নীতি কাজ করেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশার বিপরীতে ‘সর্বোচ্চ চাপ’ নীতি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে কমানোর বদলে উল্টো আরও ত্বরান্বিত করেছে। পরমাণু চুক্তির (জেসিপিওএ) অধীন ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণের মাত্রা ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ। সেটি এখন ৬০ শতাংশে পৌঁছেছে। ইরানের সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের মজুত ২০০ কেজি থেকে বেড়ে ৬ হাজার ৬০৪ কেজি হয়েছে এবং উন্নত সেন্ট্রিফিউজের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে।
এ ছাড়া নিষেধাজ্ঞা ইরানকে যুক্তরাষ্ট্রের পরিবর্তে চীন ও রাশিয়ার দিকে আরও ঘনিষ্ঠ করেছে। এটি ওয়াশিংটনের কৌশলগত অবস্থানকে দুর্বল করেছে। চীন ইরানের কাছ থেকে তেল কেনা চালিয়ে যাচ্ছে। এটি নিষেধাজ্ঞার কার্যকারিতাকে নষ্ট করছে। একই সঙ্গে ইরান রাশিয়াকে অস্ত্র সরবরাহ করছে, যা ইউক্রেন যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করছে। ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের মাধ্যমে ইরান লোহিত সাগরের বাণিজ্যপথেও বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। এটি বৈশ্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।
আরেকটি ভুল ধারণা হলো, নিষেধাজ্ঞা ইরানে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ সৃষ্টি করবে এবং প্রশাসন দুর্বল হয়ে পড়বে। তবে ইতিহাস বলছে, নিষেধাজ্ঞা বরং ইরানকে আরও কঠোর অবস্থানে নিয়ে গেছে।
১৯৭৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত নিষেধাজ্ঞাগুলো ইরানের অর্থনীতিতে তেমন প্রভাব ফেলেনি। ২০১০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে কিছু নিষেধাজ্ঞার কারণে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিলেও ইরান সরকার নগদ সহায়তা কর্মসূচি চালু করে দারিদ্র্যের হার নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। আশ্চর্যের বিষয়, ২০১৭ সালে যখন ইরানের অর্থনীতি ভালো চলছিল, তখনই সবচেয়ে বড় সরকারবিরোধী বিক্ষোভ হয়।
অর্থাৎ অর্থনৈতিক মন্দা সরাসরি সরকার পতনের কারণ হয় না।
২০২০ সালে কোভিড-১৯ মহামারির সময় নিষেধাজ্ঞাগুলো ইরানের অর্থনীতির ওপর বড় আঘাত হানে। তবে সরকার ভেঙে পড়েনি, বরং তারা তাদের নিজস্ব অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলেছে। বর্তমানে ইরানে উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বাজেট–ঘাটতি এবং মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলেও সরকার এখনো স্থিতিশীল রয়েছে।
নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান সামাজিক সংস্কার, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পশ্চিমাদের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। তাঁর সরকার ইতিমধ্যে বিতর্কিত হিজাব আইন স্থগিত করেছে এবং ইন্টারনেট স্বাধীনতা বাড়ানোর পরিকল্পনা করছে। তিনি আবার পরমাণু চুক্তির আলোচনার জন্য প্রস্তুত বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নীতি আলোচনা ও সমঝোতার বদলে আগের মতো ‘চাপ বাড়িয়ে রাখার’ কৌশল গ্রহণ করেছে, যা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। ইরান অতীতেও নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছে, তাই শুধু চাপ সৃষ্টি করে দেশটির নীতি পরিবর্তন সম্ভব নয়।
● হাদি কাহলজাদেহ ব্র্যান্ডাইস বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রাউন সেন্টার ফর মিডল ইস্ট স্টাডিজের জুনিয়র রিসার্চ ফেলো
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ইয়েমেনে যুক্তরাষ্ট্রের ভয়াবহ বিমান হামলা, নিহত ৫৮
ইয়েমেনের রাস ইসা বন্দরে মার্কিন ভয়াবহ বিমান হামলা চালিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এতে অন্তত ৫৮ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১২৬ জন। সাম্প্রতিক সময়ে দেশটিতে যুক্তরাষ্ট্রের চালানো ভয়াবহ হামলাগুলোর মধ্যে এটি একটি। খবর আল জাজিরার।
মার্কিন সেনাবাহিনী জানিয়েছে, হুথি যোদ্ধাদের জ্বালানির উৎস বন্ধ করার জন্যই এই হামলা চালানো হচ্ছে।
ওয়াশিংটন জানিয়েছে, ইয়েমেনের হুথিদের অবস্থানগুলোতে তারা হামলা চালিয়ে যাবে যতক্ষণ না লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচলের ওপর এই গোষ্ঠীর আক্রমণ বন্ধ হয়।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে করা এক পোস্টে মার্কিন সেন্ট্রাল কমান্ড জানিয়েছে, এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল হুথিদের অর্থনৈতিক শক্তির উৎস কমানো।
অন্যদিকে গাজায় প্রাণঘাতী হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল। এতে বৃহস্পতিবার ৩২ ফিলিস্তিনি প্রাণ হারিয়েছেন। তবে শুক্রবার সকালে চালানো হামলায় অবরুদ্ধ উপত্যকাটির খান ইউনিসে এক পরিবারের ১৩ জন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
ত্রাণ সংস্থাগুলো জানিয়েছে, গাজা আমাদের প্রজন্মের সবচেয়ে খারাপ মানবিক ব্যর্থতাগুলোর মধ্যে একটি।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত মোট ৫১ হাজার ৬৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন এক লাখ ১৬ হাজার ৫০৫ জন।
যদিও গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, নিহতের সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০। কারণ ধ্বংসস্তূপের নিচে যারা চাপা পড়েছে তাদেরও নিহতের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।