বাংলাদেশকে ২৯ মিলিয়ন ডলার দেওয়া বিষয়ে ট্রাম্পের তথ্য ভুল: ডিসমিসল্যাব
Published: 25th, February 2025 GMT
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবেশ শক্তিশালী করতে যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া ২৯ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা প্রকল্প নিয়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ভুল তথ্য দিয়েছেন বলে দাবি করেছে তথ্য যাচাইকারী প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাব। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বাংলাদেশের মাত্র দুজন ব্যক্তি মিলে চালানো একটি ছোট প্রতিষ্ঠানকে ২৯ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার খবরটি শুধু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেই নয়, ভারত ও বাংলাদেশেও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ বিনিয়োগের ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়েছে। তা ছাড়া এ ঘটনায় অনেকের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে বলে মনে করে ডিসমিসল্যাব।
প্রতিষ্ঠানটি বলছে, বাংলাদেশে মার্কিন করদাতাদের ২৯ দশমিক ৯ মিলিয়ন ডলার খরচ হওয়ার আগেই ‘স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ’ (এসপিএল) নামের একটি প্রকল্পের অর্থায়ন বাতিল করেছে বলে যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব গভর্নমেন্ট ইফিসিয়েন্সি (ডজ) যে খবর প্রকাশ করেছে, সেটি বিভ্রান্তিকর। কারণ, ২৯ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশি দুজন ব্যক্তির প্রতিষ্ঠানের কাছে যায়নি। মূলত এসপিএল প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল, যাদের বিভিন্ন দেশে ২১৮টি প্রকল্প আছে। বাংলাদেশেও প্রতিষ্ঠানটির ১২টি প্রকল্প রয়েছে বলে জানিয়েছে ডিসমিসল্যাব।
ইউএস স্পেন্ডিং ডট গভের ওয়েবসাইট ঘেঁটে ডিসমিসল্যাব বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ইউএসএআইডির অর্থায়নে ২০০১ সাল থেকে বাংলাদেশে সুশাসন, রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও নাগরিক সমাজের উন্নয়নে যত প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে ২৯ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি একটি প্রকল্পই আছে। ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল ২০১৭ সাল থেকে স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ প্রকল্পটির আওতায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করেছে। এর মধ্যে পলিটিকস ম্যাটার্স বাংলাদেশ নামক ই–লার্নিং প্ল্যাটফর্ম, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট, পিস প্রেশার গ্রুপ, ইয়াং লিডারস ফেলোশিপ প্রোগ্রাম অন্যতম। ইয়ং লিডারস ফেলোশিপ প্রোগ্রামের আওতায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির ৫৩৬ জন তরুণ নেতাকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
দ্য হাঙ্গার প্রজেক্টের ২০২০ সালের একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়, এসপিএলের অধীনে ২৩৬টি কর্মশালার মাধ্যমে ৫ হাজার ৪১০ জন রাজনৈতিক নেতা–কর্মী অংশগ্রহণমূলক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সিদ্ধান্ত গ্রহণ, ভিন্নমত সহনশীলতা এবং দলীয় পরিচয়ের বাইরে একসঙ্গে কাজ করার দক্ষতা অর্জন ও অনুশীলন করেছে এবং এরা মূলত তিনটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে জানিয়েছে ডিসমিসল্যাব।
মিডিয়া গবেষণা প্ল্যাটফর্ম ডিসমিসল্যাব বলছে, যুক্তরাজ্য সরকারের প্রতিশ্রুত টাকার একটি অংশ প্রায় ২ মিলিয়ন পাউন্ড যায় আরেক মার্কিন সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেকটোরাল সিস্টেমসের (আইএফইএস) কাছে। প্রতিষ্ঠানটি স্টুডেন্টস এগেইনস্ট ভায়োলেন্স এভরিহোয়ার বা সেভ কর্মসূচির অধীনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রো গভর্ন্যান্স রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে সারা দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনা করে।
সেভ প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, যেখানে তারা সংঘাতের গতিপ্রকৃতি বুঝতে পারবে, শান্তিপূর্ণ রাজনীতির ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন হবে এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারবে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
আদালতের রায় পক্ষে যায়নি, বিজেপি দলীয় উপরাষ্ট্রপতি থেকে সংসদ সদস্য আক্রমণ করছেন সুপ্রিম কোর্টকে
শুরু করেছিলেন ভারতের উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়। তারপর সুপ্রিম কোর্টের কড়া সমালোচনায় মুখর হয়েছেন বিজেপির দুই সংসদ সদস্য নিশিকান্ত দুবে ও দীনেশ শর্মা। বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা শুধু বলেছেন, দল ওই মন্তব্য সমর্থন করে না। কিন্তু ওই পর্যন্তই। সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা করা থেকে বিরত থাকার কোনো নির্দেশ দলীয় নেতাদের দেওয়া হয়নি। সবচেয়ে বড় কথা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নির্বাক। তাঁকে নিশানা করে বিরোধীরা তাই সরাসরি জানতে চেয়েছেন, এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান কী।
তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল আর এন রবি ১০টি বিলে সই না করে বছর চারেক কাটিয়ে দেওয়ায় রাজ্য সরকার সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছিল। বিচারপতি জেবি পর্দিওয়ালা ও বিচারপতি আর মহাদেবনের বেঞ্চ সেই মামলার রায়ে বলেছেন, প্রথমবার প্রত্যাখ্যাত বিল রাজ্য বিধানসভা দ্বিতীয়বার পাঠালে রাজ্যপাল সম্মতি দিতে বাধ্য থাকবেন। তিন মাসের মধ্যে সেই বিল সম্পর্কে তাঁকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দ্বিতীয়বার পাঠানো বিল রাজ্যপাল বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠাতে পারবেন না।
ওই রায়েই সুপ্রিম কোর্ট জানান, রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রেও তিন মাসের সময়সীমা প্রযোজ্য। রাষ্ট্রপতিও অনির্দিষ্টকাল সিদ্ধান্ত না নিয়ে থাকতে পারবেন না। কোনো ক্ষেত্রে বিলম্ব হলে সেই কারণ তাঁকে জানাতে হবে।
ভারতের সংবিধানে বিলে সই করার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি বা রাজ্যপালের জন্য সময়সীমা নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়নি। সুপ্রিম কোর্টের ওই রায় সেই দিক থেকে যুগান্তকারী। সেই রায়ের মধ্য দিয়ে সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে দিলেন, জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকারই ‘সুপ্রিম’।
সুপ্রিম কোর্টের ওই রায় পর্যালোচনার জন্য রিভিউ পিটিশন দাখিল করা নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। কিন্তু একেবারে সরাসরি সমালোচনায় নামেন উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখড়। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে সুপ্রিম কোর্টকে ‘সুপার পার্লামেন্ট’ তকমা দিয়ে তিনি বলেন, সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ সুপ্রিম কোর্টকে যে বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে তা ‘পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র’ হয়ে উঠেছে।
সুপ্রিম কোর্টের প্রতি কটাক্ষ করে উপরাষ্ট্রপতি বলেন, বিচারপতিরা আইনসভার কাজ করবেন। আইন পাস করবেন। সরকারের কাজও করবেন। তাঁরাই সুপার পার্লামেন্ট। অথচ তাঁদের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। কারণ, কোনো আইনই তাঁদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
উপরাষ্ট্রপতি বলেছিলেন, দেশের রাষ্ট্রপতির জন্য সুপ্রিম কোর্ট সময়সীমা বেঁধে দেবেন, এমন হতে পারে না। এসব মেনে নেওয়া যায় না। রাষ্ট্রপতিকে নির্দেশ দেওয়ার এখতিয়ার সুপ্রিম কোর্টের আদৌ আছে কি না, সেই প্রশ্নও তিনি তুলে দিয়েছেন।
উপরাষ্ট্রপতির মন্তব্যের সুরেই সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা করেছেন বিজেপির দুই সংসদ সদস্য নিশিকান্ত দুবে ও দীনেশ শর্মা। নিশিকান্ত ঝাড়গ্রামের গোড্ডা কেন্দ্র থেকে লোকসভায় নির্বাচিত। দীনেশ শর্মা উত্তর প্রদেশ থেকে রাজ্যসভার সদস্য। ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত তিনি উত্তর প্রদেশের উপমুখ্যমন্ত্রী ছিলেন।
সুপ্রিম কোর্টের সমালোচনা করে দীনেশ বলেন, মনে রাখতে হবে রাষ্ট্রপতিই সুপ্রিম। তাঁকে চ্যালেঞ্জ করা বা নির্দেশ দেওয়ার এখতিয়ার কারও নেই। লোকসভা ও রাজ্যসভাকে নির্দেশ দেওয়ার ক্ষমতা ভারতের সংবিধান কাউকে দেয়নি।
তবে নিশিকান্ত দুবের মতো এত কড়া ভাষায় সুপ্রিম কোর্ট ও প্রধান বিচারপতির সমালোচনা কেউ করেননি। সুপ্রিম কোর্টের উদ্দেশে গোড্ডার সংসদ সদস্য বলেন, ‘আপনাদের যাঁরা নিয়োগ করেছেন, তাঁদের আপনারা কী করে নির্দেশ দেন? কটাক্ষ করে তিনি বলেন, বিচার বিভাগ যখন আইন প্রণয়ন করছে, তখন সংসদ ও বিধানসভা তুলে দেওয়া হোক।’
দুবে সরাসরি আক্রমণ করেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নাকেও। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে শুনানি হয়েছে ওয়াক্ফ মামলার। তাঁর পর্যবেক্ষণের দরুণ কেন্দ্রীয় সরকার পরবর্তী শুনানি পর্যন্ত নতুন ওয়াক্ফ আইনের বিতর্কিত বিষয় কার্যকর না করার সিদ্ধান্ত নেয়। সুপ্রিম কোর্টের ওই মনোভাবের সমালোচনা করে দুবে বলেন, প্রধান বিচারপতি দেশে গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছেন।
বিচার বিভাগের প্রতি এই ধারাবাহিক আক্রমণের মুখে সরকারের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিয়েছে বিরোধী দলের নেতারা। কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, তৃণমূল কংগ্রেসসহ বিভিন্ন বিরোধী দলের নেতারা মনে করছেন, উপরাষ্ট্রপতির পাশাপাশি বিজেপির সংসদ সদস্যরা সুপ্রিম কোর্ট ও বিচারপতিদের সমালোচনা করা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী নীরব।
বিরোধীদের অভিযোগ, ধারাবাহিকভাবে সংবিধানের ওপর আঘাত হানা হচ্ছে। অথচ সরকার চুপ। দলীয় সংসদ সদস্যদের মন্তব্য তাঁদের ব্যক্তিগত অভিমত বলে শাসক দলও দায় এড়াচ্ছে। এটা একধরনের কপটতা। সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে দল ও সরকার তাঁদের পাশে দাঁড়িয়েছে। তাঁদের আড়াল করা হচ্ছে।
বিজেপি নেতাদের মন্তব্যে আইনজীবীদের একাংশও ক্ষুব্ধ। ওয়াক্ফ মামলার অন্যতম মামলাকারী আইনজীবী আনাস তানভির বিজেপি দলীয় সংসদ সদস্য নিশিকান্ত দুবের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার মামলা করতে উদ্যোগী হয়েছেন। সে জন্য তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলকে চিঠি লিখেছেন।