ভারতের নরেন্দ্র মোদির সরকার ‘ফ্যাসিস্ট’ বা ‘নিও ফ্যাসিস্ট’ কি না, তা নিয়ে কেরালায় শুরু হয়েছে তীব্র রাজনৈতিক বিতর্ক। সিপিএমের ২৪তম পার্টি কংগ্রেসের প্রাক্কালে দলের পক্ষে রাজ্যে রাজ্যে রাজনৈতিক প্রস্তাবের যে খসড়া পাঠানো হয়েছে, বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে তা নিয়েই।

প্রস্তাবে বলা হয়েছে, মোদি সরকারের ১১ বছরের কাজকর্মে নব্য ফ্যাসিস্ট বৈশিষ্ট্যের বিচ্ছুরণ ঘটলেও সরকারকে ফ্যাসিস্ট আখ্যা দেওয়া হচ্ছে না। প্রস্তাব অনুযায়ী, বিরোধীদের দমানো ও গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধে কর্তৃত্ববাদী মোদি সরকারের চাপ ও প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দুত্ববাদের প্রসারের মধ্য দিয়ে নব্য ফ্যাসিবাদী বৈশিষ্ট্যগুলোর বিচ্ছুরণ দেখা দিচ্ছে। সিপিএমের আদর্শগত মুখপত্র বলে পরিচিত চিন্তা সাপ্তাহিকে প্রস্তাবের ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছে, বিজেপি ও আরএসএসের কাজকর্মে নব্য ফ্যাসিবাদী লক্ষণ থাকলেও মোদি সরকারকে ফ্যাসিস্ট বা নব্য ফ্যাসিস্ট বলা হচ্ছে না। ভারত সরকারকে ওভাবে চিত্রায়িতও করা হচ্ছে না।

রাজ্যে রাজ্যে ওই প্রস্তাব আলোচনার পর পার্টি কংগ্রেসে তা বিবেচিত হবে। তামিলনাড়ুর মাদুরাইয়ে পার্টি কংগ্রেস চলবে এপ্রিল মাসের ২ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত। দলের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন সীতারাম ইয়েচুরির সময় যে সিপিএমের চোখে বিজেপি ও আরএসএস ছিল ‘ফ্যাসিবাদী’, তাঁর মৃত্যুর পর পলিটব্যুরোর ‘কো-অর্ডিনেটর’ প্রকাশ কারাতের প্রভাবে সেই রাজনৈতিক লাইন থেকে দল সরে আসতে চাইছে কি না, বিতর্ক শুরু হয়েছে তা নিয়েই।

সিপিএমের এই ‘বিচ্যুতি’ কেরালার বাম ফ্রন্টের শরিক সিপিআইকেও বিস্মিত করেছে। সিপিআই রাজ্য সম্পাদক বিনয় বিশ্বম বলেছেন, রাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিশ্বাসকে কীভাবে কাজে লাগাতে হয়, ফ্যাসিবাদ সেটাই শেখায়। বিজেপি ঠিক সেটাই করে চলেছে। সিপিআই ও সিপিআই (এমএল) বিজেপিকে ফ্যাসিবাদী দল মনে করে। সেই লাইন থেকে সরে এসে পার্টি কংগ্রেসের আগে সিপিএম এখন ‘নব্য ফ্যাসিবাদী চরিত্রের বিচ্ছুরণ’ নিয়ে কথা বলায় দুই দলই বিস্মিত।

একই রকম বিস্মিত কংগ্রেসও। জাতীয় স্তরে বিজেপির মোকাবিলায় তৈরি ইন্ডিয়া জোটের শরিক হয়েও সিপিএম হঠাৎ কেন মোদি সরকারকে ফ্যাসিবাদী না বলে সরে আসতে চাইছে, সেই চর্চা কংগ্রেসেও চলছে। ২৩তম পার্টি কংগ্রেসের গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, মোদি সরকার আরএসএসের ফ্যাসিস্ট কর্মসূচিগুলো রূপায়ণ করছে। সেই সিপিএমের এবার কেন মোদি সরকারকে ফ্যাসিবাদী বলতে অনীহা?

কেরালা বিধানসভার বিরোধী নেতা কংগ্রেসের ভি ডি সতীশন এর উত্তরে বলেছেন, সিপিএম চাইছে রাজ্য চালাতে বিজেপির সহায়তা পেতে। বহু বছর ধরেই কেরালায় বিজেপির সঙ্গে সিপিএম গোপন সম্পর্ক রেখে চলেছে।

কেরালার শীর্ষ কংগ্রেস নেতা রমেশ চেন্নিথালার ব্যাখ্যায়, রাজ্য শাখাগুলোয় পাঠানো সিপিএমের এই রাজনৈতিক প্রস্তাব ওদের রাজনৈতিক কৌশল। লক্ষ্য, ২০২৬ সালের এপ্রিল মাসে বিধানসভা নির্বাচনে জেতা। জিততে গেলে তাদের বিজেপির পরোক্ষ সমর্থন প্রয়োজন। ২০২১ সালেও এভাবে ওরা জিতেছিল। চেন্নিথালা বলেন, মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন আজ পর্যন্ত বিজেপি অথবা নরেন্দ্র মোদির সমালোচনা করেননি। এই রাজনৈতিক প্রস্তাব সংঘ পরিবারের কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া আর কিছু নয়।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: স প এম র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

ঢেকে রাখা সেই মুক্তিযুদ্ধের ম্যুরালে শেখ মুজিবের স্মৃতিচিহ্ন ভেঙে ফেলা হলো   

লালমনিরহাট শহরের শিশুপার্ক সংলগ্ন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিমঞ্চে স্থাপিত ম্যুরালের কিছু অংশ ভেঙে ফেলেছে জেলা প্রশাসন। ২৬ মার্চ জেলা প্রশাসন ওই ম্যুরালটি কাপড় দিয়ে ঢেকে অনুষ্ঠান পরিচালনা করে। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখি ও গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কাপড় দিয়ে ম্যুরাল ঢেকে দেওয়ার ঘটনায় মুখোমুখি অবস্থান নেয় জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম পার না হতেই রোববার জেলা প্রশাসন মুক্তিযুদ্বের স্মৃতিচিহ্ন  ম্যুরাল ভাঙার কাজে হাত দেয়। 

এর আগে শনিবার দুপুুরে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি মঞ্চে দু’টি পক্ষ একই সময়ে সংবাদ সম্মেলনের ডাক দিলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন দুপুর সাড়ে ১১টায় ওই এলাকায় সংবাদ সম্মেলন করলেও জাতীয় নাগরিক পার্টি করতে পারেননি। 

মুক্তিযুদ্ব স্মৃতি মঞ্চে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লালমনিরহাট শাখার প্রধান সমন্বয়ক হামিদুর রহমান ম্যুরাল অপসারণ ও শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি সরাতে ৪৮ ঘণ্টার সময় বেঁধে দেন। এ সময় তিনি দাবি করে বলেন, ‘এই ম্যুরালটি স্বাধীন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস বহন করে না। বাকশাল প্রতিষ্ঠাকারী স্বৈরাচার শেখ মুজিবুর রহমানকে অতিরঞ্জিত উপস্থাপন ও ইতিহাস বিকৃতি করায় এর আগেও ১৬ ডিসেম্বর জেলা প্রশাসন ম্যুরালটি ঢেকে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিল। প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৫২, ৭১ এর সকল সত্য ইতিহাস অক্ষুণ্ণ রেখে অতিরঞ্জিত অংশ ও স্বৈরাচারের চিহ্ন ঢেকে দেওয়ার নির্দেশনা ছিল। কিন্তু ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পুরো দেয়াল ঢেকে দেয়, যা অনাকাঙ্খিত। কিছু স্বৈরাচারের দোসর তাদের ব্যক্তিগত  আক্রোশ, স্বার্থ উদ্ধার ও বর্তমান সরকারের কার্যক্রমকে বিতর্কিত করতে জেলা প্রশাসনের কার্যক্রমকে ভুলভাবে প্রচার করতে থাকে এবং বিদ্বেষবশত মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। ম্যুরাল ঢেকে দেওয়ার বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অবগত ছিল না, তাঁরা এমন কোনো দাবিও করে নাই। স্বৈরাচারের সকল চিহ্ন ও ম্যুরাল অপসারণ ছাত্রজনতার দাবি ও গণআকাঙ্খা।’ 

সংবাদ সম্মেলন শেষে জেলা মুক্তিযোদ্ধা দলের মুক্তিযোদ্ধারা স্মৃতিসৌধ এলাকায় যান। সেখানে জেলা মুক্তিযোদ্ধা দলের সভাপতি হাফিজুর রহমান হাফিজ জানান, ম্যুরালের মধ্যেই বৈষম্য রয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানে যেমন অবদান রয়েছে তেমনি স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াউর রহমানেরও অবদান রয়েছে। অথচ ম্যুরালে জিয়াউর রহমানের কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। এটা বৈষম্য। এই ম্যুরাল রাখা ঠিক নয়।   

শনিবার জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটির সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) রাসেল আহমেদ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে গেলে তোপের মুখে পড়েন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা তাঁকে ঘিরে ধরেন। এ সময় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এই ম্যুরালে ৫২ ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকার গঠন, চরমপত্র পাঠ, ৭১ এর গণহত্যা, বিজয় উল্লাসে মুক্তিযোদ্ধা, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ ও পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের স্মৃতিচিহ্ন ঢেকে দিয়ে চরম ধৃষ্ঠতা দেখিয়েছেন জেলা প্রশাসন। পরে তাঁরা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ওপর দায় চাপিয়েছেন। ৭১ ও ২৪কে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে জাতিকে বিভাজিত করে আওয়ামী এজেন্ডা বাস্তবায়নের ষড়যন্ত্র চলছে। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ৭১ এর অস্তিত্ব ধরে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি বাদ দিয়ে অন্যগুলোর সঙ্গে আমাদের কোনো মতানৈক্য নেই। 
 
২৬ মার্চ বুধবার সকালে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধে শ্রদ্বাঞ্জলি দিতে গেলে কাপড় দিয়ে মুরাল ঢেকে রাখার বিষয়টি চোখে পড়ে। সনাক সদস্যরা এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানিয়ে ফিরে যান। পরে লালমনিরহাট রেলওয়ে শহীদ স্মৃতিসৌধে শ্রদ্বাঞ্জলি দেন তাঁরা। গত ১৬ ডিসেম্বরও একই রকম ঘটনা ঘটায় জেলা  প্রশাসন। ১৪০ ফুট দীর্ঘ ওই ম্যুরালে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণ, মুজিবনগর সরকার গঠন, চরমপত্র পাঠ, উদিত সূর্য, ৭১ এর গণহত্যা, মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানি, সাতজন বীরশ্রেষ্ঠ ও পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের স্মৃতিচিহ্ন রয়েছে।  

এ ব্যাপারে লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দারের বক্তব্য জানতে তাঁর ফোনে মেসেজ এবং ফোন দিলে কোনো সাড়া মেলেনি।  

সম্পর্কিত নিবন্ধ