পশ্চিমবঙ্গে আরএসএসের মোহন ভাগবতের এত দীর্ঘ সফর কেন
Published: 25th, February 2025 GMT
এ মাসের শুরুতে দিল্লিতে কেজরিওয়ালের দলের পরাজয়ের কথা জেনেছি আমরা। এ সংবাদের আড়ালে একই সপ্তাহে একই শহরে ঘটে যাওয়া আরেক সামাজিক ঘটনার সংবাদ হয়তো অনেকের নজর এড়িয়ে গেছে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) দিল্লিতে নতুন অফিসে উঠল ৮ ফেব্রুয়ারি, বিধানসভা নির্বাচনের কমবেশি ৭২ ঘণ্টা পর। ১৫০ কোটি রুপিতে তৈরি চার একর জায়গায় এই দপ্তর। তাতে আছে ১২ তলাবিশিষ্ট তিনটি ভবন। ৩০০ কক্ষের ‘কেশব কুঞ্জ’ বানানো হয়েছে শতবর্ষী পুরোনো এই দল তাদের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগওয়ারের নামে।
১৯৩৯ সালে দিল্লিতে প্রথম ছোট্ট একটা দপ্তর খুলেছিল আরএসএস। ৮৬ বছরে তারা আজকের এই অবস্থায় এল। তিন দিন আগে কেজরিওয়ালের দলকে বিধ্বস্ত করে নতুন বাড়িতে ওঠার উদ্যাপনটা অনন্য এক উচ্চতায়ও নিয়ে গেল সংঘ পরিবার।
ফেব্রুয়ারির শুরুতে দিল্লিতে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা শীতল এক অনুভূতি ছড়িয়েছে সুদূর কলকাতার মেরুদণ্ডজুড়েও। ভারতীয় এই প্রধান দুই শহরের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব। এর মাঝে আছে বহু জনপদ। কিন্তু কেজরিওয়ালের পতনের পর পুরো ভারতের মনোযোগ এখন কলকাতার দিকে।
আর এটা বোধ হয় কাকতালীয় নয়, দিল্লি নির্বাচনের পরদিনই আরএসএসের প্রধান মোহন ভাগবত এলেন পশ্চিমবঙ্গে। বিস্ময়করভাবে এটা দীর্ঘ এক সফর তাঁর। ১০ দিন থাকলেন এই রাজ্যে তিনি। উঠেছিলেন কলকাতার কেশব ভবনে, এখনো যা দিল্লির মতো গগণচুম্বী হয়নি।
ভাগবতের কাছে বাংলা কেন এত গুরুত্ববহ হয়ে উঠল, এ প্রশ্নের উত্তর সবার জানা। কিন্তু সংঘ পরিবার কীভাবে কাজটা করতে চাইছে, রহস্যঘেরা সেই জাদুবিদ্যাই ভাবাচ্ছে সবাইকে।
মমতা আঞ্চলিক রাজনীতিবিদ হলেও এলাকাটা বাংলা, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির বিপুল ঐতিহ্য রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পছন্দ-অপছন্দের বাইরেও সেই সংস্কৃতির একটা জোর আছে। মোহন ভাগবতকে তাই এখানে ব্যাপক শক্তি সমাবেশ করে আগামী মার্চ-এপ্রিলে নামতে হবে।দিল্লির পর আর তিনটি বড় লক্ষ্য
দিল্লিতে নির্বাচনে আম আদমি পার্টির আসন কমেছে ৪০টি। বিজেপির বেড়েছে ঠিক ওই ৪০টিই। ভোট যে খুব বেশি বেড়েছে তাদের, সে রকম নয়। মাত্র ৭ ভাগ ভোট বাড়িয়ে ৪০টি বাড়তি আসন পেয়ে গেছে তারা। ছিল ৮, হলো ৪৮। আরএসএসের ডেটা বিশ্লেষকেরা জানতেন, কীভাবে রাজধানীতে তাদের ভোট বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে গত এক দশক দিল্লি অগ্রাধিকারে ছিল। এ জয়ে নাগপুরের কেন্দ্রীয় অফিসে তাই তেমন বিস্মিত হয়নি কেউ। দিল্লিতে লোকসভার আসনও এত বেশি নয় যে সংঘ পরিবার এই বিজয়ে ব্যাপক উদ্যাপনে নামবে। কিন্তু কেজরিওয়াল ও আম আদমি পার্টিকে উদীয়মান অবস্থা থেকে থামানো তাদের জন্য জরুরি ছিল।
বাংলা বিজয়ের প্রতীকী মূল্য নিশ্চিতভাবেই আরও বেশি। সেটার ব্যাপক উদ্যাপন হবে। মোহন ভাগবত জানেন, কাজটি সহজ নয়। সে জন্য হয়তো ১০ দিন সময় নিয়ে এসেছিলেন। জেনে রাখা ভালো, দিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গ শেষে আরএসএস পরিবারের পরের লক্ষ্য নিশ্চিতভাবেই কেরালা, এরপর তামিলনাড়ু।
অতঃপর আরএসএসের বাংলা অভিযান
দিনক্ষণের হিসাবে বাংলায় নির্বাচন ২০২৬ সালের মার্চে। এখন থেকে বছরখানেক পর। নির্বাচনের হোমওয়ার্ক এখনই শুরু হয়ে গেছে বলা যায়। আগের নির্বাচনে তৃণমূল আর বিজেপিতে ভোটের ব্যবধান ছিল ১০ শতাংশ—৪৮ শতাংশ আর ৩৮ শতাংশ। সংঘ পরিবার ভাবছে, এই ব্যবধান এবার অনেক কমানো সম্ভব। ৬-৭ শতাংশ কমালেও আসনের হিসাব দিল্লির মতো এলোমেলো হয়ে যাবে।
৭০ আসনের দিল্লিতে এক নির্বাচনে বিজেপি ৮ থেকে ৪৮ হতে পারলে ২৯৪ আসনের পশ্চিমবঙ্গে ৭৭ থেকে দেড় শ হওয়া টার্গেট হিসেবে অনেক কম চ্যালেঞ্জিং। দিল্লির চেয়ে এখানে সুবিধাজনক নির্বাচনী ইস্যুও আছে অনেক। বিশেষ করে সংঘ পরিবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রচার জমাতে চায় এবার।
গত আগস্ট থেকে চলমান ‘আরজি কর হত্যা’ ইস্যুও জীবন্ত আছে। মোহন ভাগবত আরজি করে খুন হওয়া চিকিৎসকের মা–বাবার সঙ্গেও বসেছিলেন। দুপুরের খাবারও খেলেন একসঙ্গে। মনে হচ্ছে, সব পরিকল্পনামতো এগোচ্ছে।
বাংলাকে কেন্দ্রে রেখে নতুন ভৌগোলিক বিন্যাস
উত্তর ভারতীয় রাজ্যগুলোর তুলনায় বাংলায় সংঘের সংগঠন তত শক্তিশালী ছিল না অতীতে। কিন্তু এখন সেই দুর্বলতা অতীতের বিষয়। বিশেষ করে বাংলাদেশে গণ–অভ্যুত্থানের পর সত্য-অসত্য মেশানো নানা প্রচারে সংঘ এমন অনেক গোষ্ঠীর মধ্যে ঢুকে ‘শাখা’ খুলতে পারছে, যা এক-দুই বছর আগে সহজ ছিল না। বাংলাদেশে হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের আটক এবং জামিনে বিলম্ব সংঘকর্মীদের ভালো প্রচার-রসদ দিয়েছে প্রান্তিক এলাকাগুলোতে।
তবে পশ্চিমবঙ্গের আরএসএস এখন আর কেবল হিন্দুত্ব ও বাংলাদেশ আঁকড়ে নেই। তারা পরিবেশ সুরক্ষা থেকে বর্ণপ্রথার অবসানসহ নানা বিষয় সামনে আনছে। ভাগবত চাইছেন, সংঘ সাংগঠনিকভাবে শহরে ওয়ার্ড এবং গ্রামে পঞ্চায়েতকে খুঁটি করুক। হিন্দুদের ভোটের পুরোটা এক বাক্সে চান তিনি।
লক্ষ্য ২০২৬ হলেও আগামী কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গজুড়ে সাংগঠনিক একটা নবতরঙ্গও তৈরি করতে চায় ‘টিম ভাগবত’। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরায় আরএসএস কৌশলগতভাবে বাড়তি মনোযোগ দেওয়ার নীতি নিয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ আবার বাড়তি অগ্রাধিকারে।
ওডিশা ও আসামে দৃঢ় অবস্থানের পর বাংলাকে আরএসএস পূর্ব ভারতের শেষ লক্ষ্য ভাবছে। তাদের ভাষায়, ‘অঙ্গ’ (বাগলপুর-মুঙ্গের সন্নিহিত বিহার-আসাম) এবং ‘কলিঙ্গ’ (ওডিশা ও অন্ধ্রের কিছু অঞ্চল) জয়ের পর ‘বঙ্গ’ না জয় করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এই তিন পৌরাণিক অঞ্চলকে তারা একক চরিত্র দিতে ইচ্ছুক, জোড়া লাগাতে না পারলেও।
পূর্ব ভারতের ‘অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ’কে ঘিরে আরএসএস অভিনব এক সাংস্কৃতিক প্রচারাভিযান ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে মোহন ভাগবতের এবারের সফরে বিশেষ করে বাংলার আদিবাসী এলাকাগুলোতে সংগঠন বাড়ানোর ছক কষা হয়। তারা বাংলার ‘সমাজ’ ও আরএসএসের ‘শাখা’সমূহ একাকার করে তুলতে ইচ্ছুক। শাখা ও সদস্যসংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্য দিয়েছেন মোহন ভাগবত পুরোনো কর্মীদের।
মন্দিরের রাজনীতিতে তৃণমূল
প্রধানমন্ত্রীর পরই অনানুষ্ঠানিকভাবে ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি মনে করা হয় আরএসএসের প্রধানকে। বিশাল এক রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শিক সংস্থার ব্যস্ত কর্তা তিনি। এ ছাড়া আরএসএস–সংশ্লিষ্ট অন্তত ৫৩টি সংস্থার কাজকর্ম আছে পশ্চিমবঙ্গে।
এ রকম একজন ব্যক্তি যখন পশ্চিমবঙ্গে ০-১১ দিন কাটাতে আসেন, তখন প্রতিপক্ষ শিবির নার্ভাস না হয়ে পারে না। মোহন ভাগবতের দীর্ঘ সফরকালে মমতার তৃণমূলের সে রকম অবস্থা হয়েছিল এবং সেটা অস্বাভাবিক নয়।
বর্ধমানে আরএসএসের মিছিল থামাতে রাজ্য সরকার মাধ্যমিক পরীক্ষার দোহাই দেয়। কলকাতার হাইকোর্ট এই ইস্যুতে আরএসএসের পক্ষে রায় দিয়ে ভাগবতের সফরকে নৈতিকভাবে শক্তি জুগিয়েছে। আদালতের রায় স্থানীয় আরএসএস কর্মীদের চাঙা করেছে। বলা যায়, প্রথম রাউন্ডে তৃণমূল হোঁচট খেল।
তবে টুকটাক এসব ভুলের পাশাপাশি মমতাও কোমরে আঁচল শক্ত করে বাঁধছেন বলেই মনে হয়। আগামী দিনে আর কেবল মুসলমান ভোটব্যাংকে ভরসা করছেন না তিনি। ইতিমধ্যে প্রচার কৌশলে মোড় বদলের স্পষ্ট বার্তা দিলেন বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু’দের রক্ষায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মোতায়েন চেয়ে। আবার দিঘায় বিশাল আয়তনের জগন্নাথ মন্দির গড়ছে তাঁর সরকার। পূর্ব মেদিনীপুরে এপ্রিলের শেষে উদ্বোধন হবে এটার। সবাই ভাবছে, এই মন্দির দিয়েই মমতার ‘অভিযান-২০২৬’ শুরু হবে।
১৪ বছর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা। ভোটের গণিতে বেশ দক্ষতা আছে তাঁর। পাশে আছে লোকসভার ২৯ জন সদস্য। নির্বাচনী মাঠে
থাকবেন তাঁরাও।
মমতা নিজে নির্বাচনী প্রচারক হিসেবে নিত্যনতুন কৌশল নিতে পারঙ্গম। একসময় মাথায় কাপড় দিয়ে ইসলামি জলসায়ও গেছেন। বিনিময়ে মুসলমানরা তাঁকে আস্থায় নিয়ে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু সংঘের সংগঠন যত বাড়ছে, সংখ্যালঘুবান্ধব হওয়া তত মুশকিলের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একালে ‘পপুলার’ হতে হয় সংখ্যাগুরুর মধ্যে। আধুনিক ‘পপুলিজমের’ এটাই ফর্মুলা। নীতি-আদর্শের রাজনীতি বাংলায় বামপন্থীদের অনেক ভুগিয়েছে। মমতা সেসব ‘ভুল’ করতে চান না। দিঘায় তাই ২০০ কোটি রুপি খরচ করছেন ‘ধর্মীয় পর্যটন’ বাড়াতে মন্দিরসহ কমপ্লেক্স গড়ে। মন্দির-কমপ্লেক্স গড়ার কাজের প্রতি পর্যায়ে মমতা যে খোঁজখবর রাখছিলেন, তাঁর সমর্থক মিডিয়াগুলো সেসব জানাতে দেরি করেনি কোনো দিন।
পূর্ব মেদিনীপুরের মানুষও মন্দির দেখে খুশি। একসময় ঝড়বৃষ্টি আর দুর্যোগের জন্য উপকূলীয় এ অঞ্চলের কুখ্যাতি ছিল। এখন সবাই এখানকার মার্বেল পাথরের জগন্নাথ মন্দিরের কথাও বলবে, যদিও সরকারি হিসাবে প্রায় ১৩ শতাংশ মানুষ এখানে খুব দরিদ্র। দুই শত কোটি রুপি সমান কোনো প্রকল্প তাদের দারিদ্র্যমুক্তির পথ করে দিতে পারত। কিন্তু মমতার আরেকবার প্রধানমন্ত্রী হতে মন্দিরই জরুরি আপাতত!
জগন্নাথ মন্দির উদ্বোধনের দিন হিসেবে ‘অক্ষয় তৃতীয়া’কে বেছে নেওয়া হয়েছে। বলা হয়, এই দিন সত্য যুগের শেষ আর ত্রেতা যুগের শুরু। বৈদিক বিশ্বাসানুসারে, এই পবিত্র তিথিতে কোনো শুভকার্য সম্পন্ন হলে তা অনন্তকাল অক্ষয় হয়ে থাকে। মমতা নির্বাচনী গণিতকে যে বেশ মুনশিয়ানার সঙ্গে সাজাচ্ছেন, সেটা বোঝা কঠিন নয়।
কিন্তু হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিকে রোখার কৌশল হিসেবে মন্দিরভিত্তিক কর্মসূচিতে কোনো লাভ হয় কি না? কেজরিওয়ালের উত্থান-পতন কিন্তু সেটা বলে না।
সুশাসনের নীতি-লক্ষ্য নিয়ে আম আদমির জন্ম ও বিকাশ। কেজরিওয়াল প্রায় ১০ বছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। একসময় অনেকে তাঁকে ভারতের হবু প্রধানমন্ত্রীও ভাবছিল। স্বভাবত আরএসএস ও কংগ্রেস উভয়ে তাঁকে প্রতিপক্ষের তালিকায় রেখেছিল। আরএসএসের সুনামি থামাতে একসময় কেজরিওয়ালও দিল্লিতে হিন্দুত্ববাদের নমনীয় এক সংস্করণের চর্চা শুরু করেন।
আম আদমির লক্ষ্য ছিল বিজেপিকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করা; কিন্তু আরএসএসের কর্মসূচিগুলোর চর্চা চালিয়ে যাওয়া। এই কৌশলে কেজরিওয়াল রাহুল গান্ধীর সঙ্গেও দূরত্ব বাড়ান। রাহুল বিজেপির পাশাপাশি আরএসএসকেও আক্রমণ করে কথা বলেন প্রায়ই।
কিছুদিন আগে হিন্দুত্ববাদীদের খুশি করতে কেজরিওয়াল দিল্লির স্কুলগুলোকে বলেছিলেন নাগরিকত্বের কাগজপত্র নেই, এমন পিতামাতাদের সন্তানদের ভর্তি না করতে। এরা নাকি ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বা ‘রোহিঙ্গা’। অনেক ভারতীয় মানবাধিকারকর্মী শিশুদের এ রকম হেনস্তায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। কেজরিওয়াল থামেননি। কিন্তু এ রকম বেপরোয়া কৌশল কি শেষ পর্যন্ত তাঁর দলকে প্রত্যাশিত ফল দিয়েছে?
হিন্দুত্ববাদী ভাবাদর্শ চর্চা করে হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিকে মোকাবিলা করা যায় কি না, তার প্রমাণ দিল্লিতে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনী ফলাফল। প্রশ্ন উঠেছে, মমতাও একই ভুল করছেন কি না?
মমতার পাশে ইসকন?
তৃণমূলের যুক্তি হলো বিজেপি গত বিধানসভার ভোট থেকে ৪-৫ শতাংশ বাড়াতে পারলে আসনের হিসাবে বড় ধরনের অদলবদল ঘটে যেতে পারে। সুতরাং সব উপায়ে গেরুয়া–ঢেউ থামাতে চায় তারা। সে জন্যই মুসলমানদের ভোট, যা প্রায় ২৭ শতাংশ, সেটাকে ‘নিশ্চিত’ ধরে বাকি ৭২ শতাংশ হিন্দুভোটের বড় অংশে মমতার বাজি ধরা।
আরজি কর ইস্যু শহুরে নাগরিক সমাজের কিছু হিন্দু ভোট তাঁর কাছ থেকে ছুটিয়ে নেবে বলে শঙ্কার মুখেই মমতা হিন্দু পুরাণের দিকে চোখ ফিরিয়েছেন। ইতিমধ্যে এ ঘোষণাও এসেছে, তৃণমূল ২০২৬-এ একা লড়বে। আর এটাও বাস্তবতা, দিল্লির মতো বাংলায়ও ভোট হবে বিজেপি বনাম তৃণমূলেই। কংগ্রেস বা বামপন্থীরা ভোটের হিসাবে বড় কোনো আঁচড় বসাতে পারবে বলে মনে হয় না। এর মানে তো এটাই, মমতাকে একাই মোহন ভাগবতদের সামলাতে হবে এবং কাজটি সহজও নয়।
মমতা আঞ্চলিক রাজনীতিবিদ হলেও এলাকাটা বাংলা, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির বিপুল ঐতিহ্য রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পছন্দ-অপছন্দের বাইরেও সেই সংস্কৃতির একটা জোর আছে। মোহন ভাগবতকে তাই এখানে ব্যাপক শক্তি সমাবেশ করে আগামী মার্চ-এপ্রিলে নামতে হবে।
কৌতূহলোউদ্দীপক দৃশ্য হলো, ইসকনকে এবার মমতার পাশে দেখা যাচ্ছে। ইসকনের এমন একজন বড় কর্তাকে দিঘা মন্দিরের ট্রাস্টি করা হলো, যিনি বাংলাদেশের চিন্ময় প্রভুর গ্রেপ্তার বিষয়ে লাগাতার প্রতিবাদ আন্দোলন করছেন। তবে কলকাতায় নির্মোহ ভাষ্যকারদের এ রকমও মত আছে, আগামী ভোটে মমতাকে দীর্ঘ শাসনের হিসাবপত্র দিতে হতে পারে।
মন্দির ও বাংলাদেশ ইস্যুর সম্ভাব্য সাজানো ছকে খেলা না–ও হতে পারে, যেমনটি মোহন ভাগবত কিংবা মমতা ব্যানার্জি চাইছেন। হয়তো ‘হিন্দু-মুসলমান’ হিসেবে আর নয়, পশ্চিম বাংলার ভোটাররা এবার ‘নাগরিক’ হয়ে উঠতে পারেন।
আলতাফ পারভেজ লেখক ও গবেষক
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: স ঘ পর ব র র র জন ত র জন ত ক ম সলম ন কলক ত র মন দ র ন র পর আসন র অবস থ এ রকম করছ ন মমত র
এছাড়াও পড়ুন:
পশ্চিমবঙ্গে আরএসএসের মোহন ভাগবতের এত দীর্ঘ সফর কেন
এ মাসের শুরুতে দিল্লিতে কেজরিওয়ালের দলের পরাজয়ের কথা জেনেছি আমরা। এ সংবাদের আড়ালে একই সপ্তাহে একই শহরে ঘটে যাওয়া আরেক সামাজিক ঘটনার সংবাদ হয়তো অনেকের নজর এড়িয়ে গেছে।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) দিল্লিতে নতুন অফিসে উঠল ৮ ফেব্রুয়ারি, বিধানসভা নির্বাচনের কমবেশি ৭২ ঘণ্টা পর। ১৫০ কোটি রুপিতে তৈরি চার একর জায়গায় এই দপ্তর। তাতে আছে ১২ তলাবিশিষ্ট তিনটি ভবন। ৩০০ কক্ষের ‘কেশব কুঞ্জ’ বানানো হয়েছে শতবর্ষী পুরোনো এই দল তাদের প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগওয়ারের নামে।
১৯৩৯ সালে দিল্লিতে প্রথম ছোট্ট একটা দপ্তর খুলেছিল আরএসএস। ৮৬ বছরে তারা আজকের এই অবস্থায় এল। তিন দিন আগে কেজরিওয়ালের দলকে বিধ্বস্ত করে নতুন বাড়িতে ওঠার উদ্যাপনটা অনন্য এক উচ্চতায়ও নিয়ে গেল সংঘ পরিবার।
ফেব্রুয়ারির শুরুতে দিল্লিতে ঘটে যাওয়া দুটি ঘটনা শীতল এক অনুভূতি ছড়িয়েছে সুদূর কলকাতার মেরুদণ্ডজুড়েও। ভারতীয় এই প্রধান দুই শহরের মধ্যে প্রায় দেড় হাজার কিলোমিটারের দূরত্ব। এর মাঝে আছে বহু জনপদ। কিন্তু কেজরিওয়ালের পতনের পর পুরো ভারতের মনোযোগ এখন কলকাতার দিকে।
আর এটা বোধ হয় কাকতালীয় নয়, দিল্লি নির্বাচনের পরদিনই আরএসএসের প্রধান মোহন ভাগবত এলেন পশ্চিমবঙ্গে। বিস্ময়করভাবে এটা দীর্ঘ এক সফর তাঁর। ১০ দিন থাকলেন এই রাজ্যে তিনি। উঠেছিলেন কলকাতার কেশব ভবনে, এখনো যা দিল্লির মতো গগণচুম্বী হয়নি।
ভাগবতের কাছে বাংলা কেন এত গুরুত্ববহ হয়ে উঠল, এ প্রশ্নের উত্তর সবার জানা। কিন্তু সংঘ পরিবার কীভাবে কাজটা করতে চাইছে, রহস্যঘেরা সেই জাদুবিদ্যাই ভাবাচ্ছে সবাইকে।
মমতা আঞ্চলিক রাজনীতিবিদ হলেও এলাকাটা বাংলা, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির বিপুল ঐতিহ্য রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পছন্দ-অপছন্দের বাইরেও সেই সংস্কৃতির একটা জোর আছে। মোহন ভাগবতকে তাই এখানে ব্যাপক শক্তি সমাবেশ করে আগামী মার্চ-এপ্রিলে নামতে হবে।দিল্লির পর আর তিনটি বড় লক্ষ্য
দিল্লিতে নির্বাচনে আম আদমি পার্টির আসন কমেছে ৪০টি। বিজেপির বেড়েছে ঠিক ওই ৪০টিই। ভোট যে খুব বেশি বেড়েছে তাদের, সে রকম নয়। মাত্র ৭ ভাগ ভোট বাড়িয়ে ৪০টি বাড়তি আসন পেয়ে গেছে তারা। ছিল ৮, হলো ৪৮। আরএসএসের ডেটা বিশ্লেষকেরা জানতেন, কীভাবে রাজধানীতে তাদের ভোট বাড়ছে।
কেন্দ্রীয় নীতিনির্ধারকদের কাছে গত এক দশক দিল্লি অগ্রাধিকারে ছিল। এ জয়ে নাগপুরের কেন্দ্রীয় অফিসে তাই তেমন বিস্মিত হয়নি কেউ। দিল্লিতে লোকসভার আসনও এত বেশি নয় যে সংঘ পরিবার এই বিজয়ে ব্যাপক উদ্যাপনে নামবে। কিন্তু কেজরিওয়াল ও আম আদমি পার্টিকে উদীয়মান অবস্থা থেকে থামানো তাদের জন্য জরুরি ছিল।
বাংলা বিজয়ের প্রতীকী মূল্য নিশ্চিতভাবেই আরও বেশি। সেটার ব্যাপক উদ্যাপন হবে। মোহন ভাগবত জানেন, কাজটি সহজ নয়। সে জন্য হয়তো ১০ দিন সময় নিয়ে এসেছিলেন। জেনে রাখা ভালো, দিল্লি ও পশ্চিমবঙ্গ শেষে আরএসএস পরিবারের পরের লক্ষ্য নিশ্চিতভাবেই কেরালা, এরপর তামিলনাড়ু।
অতঃপর আরএসএসের বাংলা অভিযান
দিনক্ষণের হিসাবে বাংলায় নির্বাচন ২০২৬ সালের মার্চে। এখন থেকে বছরখানেক পর। নির্বাচনের হোমওয়ার্ক এখনই শুরু হয়ে গেছে বলা যায়। আগের নির্বাচনে তৃণমূল আর বিজেপিতে ভোটের ব্যবধান ছিল ১০ শতাংশ—৪৮ শতাংশ আর ৩৮ শতাংশ। সংঘ পরিবার ভাবছে, এই ব্যবধান এবার অনেক কমানো সম্ভব। ৬-৭ শতাংশ কমালেও আসনের হিসাব দিল্লির মতো এলোমেলো হয়ে যাবে।
৭০ আসনের দিল্লিতে এক নির্বাচনে বিজেপি ৮ থেকে ৪৮ হতে পারলে ২৯৪ আসনের পশ্চিমবঙ্গে ৭৭ থেকে দেড় শ হওয়া টার্গেট হিসেবে অনেক কম চ্যালেঞ্জিং। দিল্লির চেয়ে এখানে সুবিধাজনক নির্বাচনী ইস্যুও আছে অনেক। বিশেষ করে সংঘ পরিবার বাংলাদেশ প্রসঙ্গে প্রচার জমাতে চায় এবার।
গত আগস্ট থেকে চলমান ‘আরজি কর হত্যা’ ইস্যুও জীবন্ত আছে। মোহন ভাগবত আরজি করে খুন হওয়া চিকিৎসকের মা–বাবার সঙ্গেও বসেছিলেন। দুপুরের খাবারও খেলেন একসঙ্গে। মনে হচ্ছে, সব পরিকল্পনামতো এগোচ্ছে।
বাংলাকে কেন্দ্রে রেখে নতুন ভৌগোলিক বিন্যাস
উত্তর ভারতীয় রাজ্যগুলোর তুলনায় বাংলায় সংঘের সংগঠন তত শক্তিশালী ছিল না অতীতে। কিন্তু এখন সেই দুর্বলতা অতীতের বিষয়। বিশেষ করে বাংলাদেশে গণ–অভ্যুত্থানের পর সত্য-অসত্য মেশানো নানা প্রচারে সংঘ এমন অনেক গোষ্ঠীর মধ্যে ঢুকে ‘শাখা’ খুলতে পারছে, যা এক-দুই বছর আগে সহজ ছিল না। বাংলাদেশে হিন্দু সন্ন্যাসী চিন্ময়কৃষ্ণ দাসের আটক এবং জামিনে বিলম্ব সংঘকর্মীদের ভালো প্রচার-রসদ দিয়েছে প্রান্তিক এলাকাগুলোতে।
তবে পশ্চিমবঙ্গের আরএসএস এখন আর কেবল হিন্দুত্ব ও বাংলাদেশ আঁকড়ে নেই। তারা পরিবেশ সুরক্ষা থেকে বর্ণপ্রথার অবসানসহ নানা বিষয় সামনে আনছে। ভাগবত চাইছেন, সংঘ সাংগঠনিকভাবে শহরে ওয়ার্ড এবং গ্রামে পঞ্চায়েতকে খুঁটি করুক। হিন্দুদের ভোটের পুরোটা এক বাক্সে চান তিনি।
লক্ষ্য ২০২৬ হলেও আগামী কয়েক বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গজুড়ে সাংগঠনিক একটা নবতরঙ্গও তৈরি করতে চায় ‘টিম ভাগবত’। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরায় আরএসএস কৌশলগতভাবে বাড়তি মনোযোগ দেওয়ার নীতি নিয়েছে। এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ আবার বাড়তি অগ্রাধিকারে।
ওডিশা ও আসামে দৃঢ় অবস্থানের পর বাংলাকে আরএসএস পূর্ব ভারতের শেষ লক্ষ্য ভাবছে। তাদের ভাষায়, ‘অঙ্গ’ (বাগলপুর-মুঙ্গের সন্নিহিত বিহার-আসাম) এবং ‘কলিঙ্গ’ (ওডিশা ও অন্ধ্রের কিছু অঞ্চল) জয়ের পর ‘বঙ্গ’ না জয় করার কোনো কারণ থাকতে পারে না। এই তিন পৌরাণিক অঞ্চলকে তারা একক চরিত্র দিতে ইচ্ছুক, জোড়া লাগাতে না পারলেও।
পূর্ব ভারতের ‘অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ’কে ঘিরে আরএসএস অভিনব এক সাংস্কৃতিক প্রচারাভিযান ইতিমধ্যে শুরু করে দিয়েছে। তারই অংশ হিসেবে মোহন ভাগবতের এবারের সফরে বিশেষ করে বাংলার আদিবাসী এলাকাগুলোতে সংগঠন বাড়ানোর ছক কষা হয়। তারা বাংলার ‘সমাজ’ ও আরএসএসের ‘শাখা’সমূহ একাকার করে তুলতে ইচ্ছুক। শাখা ও সদস্যসংখ্যা দ্বিগুণ করার লক্ষ্য দিয়েছেন মোহন ভাগবত পুরোনো কর্মীদের।
মন্দিরের রাজনীতিতে তৃণমূল
প্রধানমন্ত্রীর পরই অনানুষ্ঠানিকভাবে ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি মনে করা হয় আরএসএসের প্রধানকে। বিশাল এক রাজনৈতিক ও ভাবাদর্শিক সংস্থার ব্যস্ত কর্তা তিনি। এ ছাড়া আরএসএস–সংশ্লিষ্ট অন্তত ৫৩টি সংস্থার কাজকর্ম আছে পশ্চিমবঙ্গে।
এ রকম একজন ব্যক্তি যখন পশ্চিমবঙ্গে ০-১১ দিন কাটাতে আসেন, তখন প্রতিপক্ষ শিবির নার্ভাস না হয়ে পারে না। মোহন ভাগবতের দীর্ঘ সফরকালে মমতার তৃণমূলের সে রকম অবস্থা হয়েছিল এবং সেটা অস্বাভাবিক নয়।
বর্ধমানে আরএসএসের মিছিল থামাতে রাজ্য সরকার মাধ্যমিক পরীক্ষার দোহাই দেয়। কলকাতার হাইকোর্ট এই ইস্যুতে আরএসএসের পক্ষে রায় দিয়ে ভাগবতের সফরকে নৈতিকভাবে শক্তি জুগিয়েছে। আদালতের রায় স্থানীয় আরএসএস কর্মীদের চাঙা করেছে। বলা যায়, প্রথম রাউন্ডে তৃণমূল হোঁচট খেল।
তবে টুকটাক এসব ভুলের পাশাপাশি মমতাও কোমরে আঁচল শক্ত করে বাঁধছেন বলেই মনে হয়। আগামী দিনে আর কেবল মুসলমান ভোটব্যাংকে ভরসা করছেন না তিনি। ইতিমধ্যে প্রচার কৌশলে মোড় বদলের স্পষ্ট বার্তা দিলেন বাংলাদেশে ‘সংখ্যালঘু’দের রক্ষায় জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মোতায়েন চেয়ে। আবার দিঘায় বিশাল আয়তনের জগন্নাথ মন্দির গড়ছে তাঁর সরকার। পূর্ব মেদিনীপুরে এপ্রিলের শেষে উদ্বোধন হবে এটার। সবাই ভাবছে, এই মন্দির দিয়েই মমতার ‘অভিযান-২০২৬’ শুরু হবে।
১৪ বছর পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা। ভোটের গণিতে বেশ দক্ষতা আছে তাঁর। পাশে আছে লোকসভার ২৯ জন সদস্য। নির্বাচনী মাঠে
থাকবেন তাঁরাও।
মমতা নিজে নির্বাচনী প্রচারক হিসেবে নিত্যনতুন কৌশল নিতে পারঙ্গম। একসময় মাথায় কাপড় দিয়ে ইসলামি জলসায়ও গেছেন। বিনিময়ে মুসলমানরা তাঁকে আস্থায় নিয়ে সমর্থন দিয়েছে। কিন্তু সংঘের সংগঠন যত বাড়ছে, সংখ্যালঘুবান্ধব হওয়া তত মুশকিলের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একালে ‘পপুলার’ হতে হয় সংখ্যাগুরুর মধ্যে। আধুনিক ‘পপুলিজমের’ এটাই ফর্মুলা। নীতি-আদর্শের রাজনীতি বাংলায় বামপন্থীদের অনেক ভুগিয়েছে। মমতা সেসব ‘ভুল’ করতে চান না। দিঘায় তাই ২০০ কোটি রুপি খরচ করছেন ‘ধর্মীয় পর্যটন’ বাড়াতে মন্দিরসহ কমপ্লেক্স গড়ে। মন্দির-কমপ্লেক্স গড়ার কাজের প্রতি পর্যায়ে মমতা যে খোঁজখবর রাখছিলেন, তাঁর সমর্থক মিডিয়াগুলো সেসব জানাতে দেরি করেনি কোনো দিন।
পূর্ব মেদিনীপুরের মানুষও মন্দির দেখে খুশি। একসময় ঝড়বৃষ্টি আর দুর্যোগের জন্য উপকূলীয় এ অঞ্চলের কুখ্যাতি ছিল। এখন সবাই এখানকার মার্বেল পাথরের জগন্নাথ মন্দিরের কথাও বলবে, যদিও সরকারি হিসাবে প্রায় ১৩ শতাংশ মানুষ এখানে খুব দরিদ্র। দুই শত কোটি রুপি সমান কোনো প্রকল্প তাদের দারিদ্র্যমুক্তির পথ করে দিতে পারত। কিন্তু মমতার আরেকবার প্রধানমন্ত্রী হতে মন্দিরই জরুরি আপাতত!
জগন্নাথ মন্দির উদ্বোধনের দিন হিসেবে ‘অক্ষয় তৃতীয়া’কে বেছে নেওয়া হয়েছে। বলা হয়, এই দিন সত্য যুগের শেষ আর ত্রেতা যুগের শুরু। বৈদিক বিশ্বাসানুসারে, এই পবিত্র তিথিতে কোনো শুভকার্য সম্পন্ন হলে তা অনন্তকাল অক্ষয় হয়ে থাকে। মমতা নির্বাচনী গণিতকে যে বেশ মুনশিয়ানার সঙ্গে সাজাচ্ছেন, সেটা বোঝা কঠিন নয়।
কিন্তু হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিকে রোখার কৌশল হিসেবে মন্দিরভিত্তিক কর্মসূচিতে কোনো লাভ হয় কি না? কেজরিওয়ালের উত্থান-পতন কিন্তু সেটা বলে না।
সুশাসনের নীতি-লক্ষ্য নিয়ে আম আদমির জন্ম ও বিকাশ। কেজরিওয়াল প্রায় ১০ বছর মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। একসময় অনেকে তাঁকে ভারতের হবু প্রধানমন্ত্রীও ভাবছিল। স্বভাবত আরএসএস ও কংগ্রেস উভয়ে তাঁকে প্রতিপক্ষের তালিকায় রেখেছিল। আরএসএসের সুনামি থামাতে একসময় কেজরিওয়ালও দিল্লিতে হিন্দুত্ববাদের নমনীয় এক সংস্করণের চর্চা শুরু করেন।
আম আদমির লক্ষ্য ছিল বিজেপিকে কঠোরভাবে মোকাবিলা করা; কিন্তু আরএসএসের কর্মসূচিগুলোর চর্চা চালিয়ে যাওয়া। এই কৌশলে কেজরিওয়াল রাহুল গান্ধীর সঙ্গেও দূরত্ব বাড়ান। রাহুল বিজেপির পাশাপাশি আরএসএসকেও আক্রমণ করে কথা বলেন প্রায়ই।
কিছুদিন আগে হিন্দুত্ববাদীদের খুশি করতে কেজরিওয়াল দিল্লির স্কুলগুলোকে বলেছিলেন নাগরিকত্বের কাগজপত্র নেই, এমন পিতামাতাদের সন্তানদের ভর্তি না করতে। এরা নাকি ‘অবৈধ বাংলাদেশি’ বা ‘রোহিঙ্গা’। অনেক ভারতীয় মানবাধিকারকর্মী শিশুদের এ রকম হেনস্তায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন। কেজরিওয়াল থামেননি। কিন্তু এ রকম বেপরোয়া কৌশল কি শেষ পর্যন্ত তাঁর দলকে প্রত্যাশিত ফল দিয়েছে?
হিন্দুত্ববাদী ভাবাদর্শ চর্চা করে হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিকে মোকাবিলা করা যায় কি না, তার প্রমাণ দিল্লিতে ফেব্রুয়ারির নির্বাচনী ফলাফল। প্রশ্ন উঠেছে, মমতাও একই ভুল করছেন কি না?
মমতার পাশে ইসকন?
তৃণমূলের যুক্তি হলো বিজেপি গত বিধানসভার ভোট থেকে ৪-৫ শতাংশ বাড়াতে পারলে আসনের হিসাবে বড় ধরনের অদলবদল ঘটে যেতে পারে। সুতরাং সব উপায়ে গেরুয়া–ঢেউ থামাতে চায় তারা। সে জন্যই মুসলমানদের ভোট, যা প্রায় ২৭ শতাংশ, সেটাকে ‘নিশ্চিত’ ধরে বাকি ৭২ শতাংশ হিন্দুভোটের বড় অংশে মমতার বাজি ধরা।
আরজি কর ইস্যু শহুরে নাগরিক সমাজের কিছু হিন্দু ভোট তাঁর কাছ থেকে ছুটিয়ে নেবে বলে শঙ্কার মুখেই মমতা হিন্দু পুরাণের দিকে চোখ ফিরিয়েছেন। ইতিমধ্যে এ ঘোষণাও এসেছে, তৃণমূল ২০২৬-এ একা লড়বে। আর এটাও বাস্তবতা, দিল্লির মতো বাংলায়ও ভোট হবে বিজেপি বনাম তৃণমূলেই। কংগ্রেস বা বামপন্থীরা ভোটের হিসাবে বড় কোনো আঁচড় বসাতে পারবে বলে মনে হয় না। এর মানে তো এটাই, মমতাকে একাই মোহন ভাগবতদের সামলাতে হবে এবং কাজটি সহজও নয়।
মমতা আঞ্চলিক রাজনীতিবিদ হলেও এলাকাটা বাংলা, যেখানে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির বিপুল ঐতিহ্য রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পছন্দ-অপছন্দের বাইরেও সেই সংস্কৃতির একটা জোর আছে। মোহন ভাগবতকে তাই এখানে ব্যাপক শক্তি সমাবেশ করে আগামী মার্চ-এপ্রিলে নামতে হবে।
কৌতূহলোউদ্দীপক দৃশ্য হলো, ইসকনকে এবার মমতার পাশে দেখা যাচ্ছে। ইসকনের এমন একজন বড় কর্তাকে দিঘা মন্দিরের ট্রাস্টি করা হলো, যিনি বাংলাদেশের চিন্ময় প্রভুর গ্রেপ্তার বিষয়ে লাগাতার প্রতিবাদ আন্দোলন করছেন। তবে কলকাতায় নির্মোহ ভাষ্যকারদের এ রকমও মত আছে, আগামী ভোটে মমতাকে দীর্ঘ শাসনের হিসাবপত্র দিতে হতে পারে।
মন্দির ও বাংলাদেশ ইস্যুর সম্ভাব্য সাজানো ছকে খেলা না–ও হতে পারে, যেমনটি মোহন ভাগবত কিংবা মমতা ব্যানার্জি চাইছেন। হয়তো ‘হিন্দু-মুসলমান’ হিসেবে আর নয়, পশ্চিম বাংলার ভোটাররা এবার ‘নাগরিক’ হয়ে উঠতে পারেন।
আলতাফ পারভেজ লেখক ও গবেষক