দূরদূরান্ত থেকে ভাবির হোটেলে যে কারণে খেতে আসেন লোকজন
Published: 25th, February 2025 GMT
চট্টগ্রামে আসা অনেক পর্যটক ঘুরে বেড়ানোর পাশাপাশি এখানকার খাবার স্বাদ নেওয়ার জন্য বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় ঢুঁ মারেন। নামী রেস্তোরাঁর পাশাপাশি অনেকের তালিকায় থাকে ভাবির হোটেলের নামও। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আর ফুড ব্লগারদের কল্যাণে এখন অনেকেই ভাবির হোটেলের নাম জানেন। সীতাকুণ্ডে মহাসড়কের পাশে জৌলুশহীন একটা ছোট খাবার হোটেলের এমন নাম ছড়িয়ে পড়ার পেছনে রয়েছে এখানকার চুইঝালে রান্না মাংস, বিশেষ করে গরুর মাংসের অতুলনীয় স্বাদ।
যে ভাবির হোটেল নিয়ে এত কথা, এত রিভিউ ফুড ব্লগারদের—সেটা যে নেহাতই আলগা উচ্ছ্বাস নয়। সেখানকার খাবার একবার চেখে দেখলেই বোঝা যাবে সেটা। যাঁরা ভাবির হোটেলে খেয়েছেন তাঁদের মতে, এখানকার রান্না খেলে মুখে লেগে থাকে। একবার যিনি খেয়েছেন, তিনি স্বজন ও বন্ধুদের নিয়ে ফের আসেন।
গত শনিবার সীতাকুণ্ডের পৌর সদরের বায়তুশ শরফ মসজিদের বিপরীতে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ঢাকামুখী লেনের ধারে ভাবির হোটেলে ঢুকতেই পাওয়া গেল শিল-পাটায় মসলা বাটার শব্দ। এক পাশে দুটো বড় হাঁড়িতে রান্না হচ্ছিল গরু ও খাসির মাংস। যার নামে হোটেলটি পরিচিতি পেয়েছে, সেই ভাবিকে খুঁজে পেতেও সময় লাগল না। মসলাবাটা, কোটা-বাছা, রান্নায় কোনো মসলা যোগ করা—সব কাজেই নির্দেশনা দিচ্ছিলেন তিনি। আর তিনিই যে ভাবি, তা রেস্তোরাঁর কর্মীদের দেখিয়ে দিতে হলো না। নাম শরিফা বেগম। ১৬ বছর আগে সাতক্ষীরা জেলা থেকে স্বামীর হাত ধরে চট্টগ্রামে আসেন। অনেক উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে গেছেন। তবে সাফল্য ধরা দিয়েছে শেষমেশ।
সকাল ১০টার দিকে হোটেলে তখনো ‘কাস্টমাররা’ আসেনি কেউ। রান্নার কাজ চলছিল পুরোদমে। লাকড়ির চুলার গনগনে তাপে খুন্তি নাড়তে নাড়তে ভাবি শরিফা বেগম কথা বলে যান। হাঁড়ি থেকে বলক ছড়িয়ে উঠছিল মাংসের সুঘ্রাণ।
শরিফা বেগম বললেন, শিলপাটায় বাটা পেঁয়াজ, মরিচ, চুইঝাল, বিশেষ মসলা আর রান্নার নিজস্ব কৌশলের কারণে এখানকার গরু ও খাসির মাংস লোকে পছন্দ করেছে। কথা বলতে বলতে শরিফা টুকরা করে কাটা চুইঝাল ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন মাংসের হাঁড়িতে। পাশাপাশি দুটি লাকড়ির চুলার একটিতে বড় কড়াইয়ে ২০ কেজি গরুর মাংস, অন্যটিতে ৮ কেজি খাসির মাংস রান্না হচ্ছিল।
সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার পাটকেলঘাটা গ্রামে ভাবি ও তাঁর স্বামীর বাড়ি। বর্তমানে যেখানে হোটেল রয়েছে, সেখানে তিনি দোকান দেন ৯ বছর আগে। প্রথম দিকে দোকানের কোনো নাম ছিল না। তখন এক কেজি গরুর মাংস রান্না করলে তিন দিনেও শেষ হতো না। কিছু কিছু গাড়ির চালকেরা গাড়ি থামিয়ে খেতেন। তাঁরা একবার খেয়ে গেলে আবারও আসতেন।
যেভাবে শুরু ভাবির হোটেলতাঁর দোকানে আনিসুর রহমান নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা নিয়মিত চুইঝালের মাংস খেতেন। তিনি একদিন খাবারের ভিডিও করে ফেসবুকে ও ইউটিউবে ছাড়েন। এরপর ভিডিওগুলো তিনি বিভিন্ন পর্যটকের ফেসবুক গ্রুপে ছড়িয়ে দেন। এরপর এক গ্রুপ, দুই গ্রুপ করে পর্যটকেরা আসতে শুরু করেন। হোটেলটিও জনপ্রিয়তা পায়। পর্যটকেরা নিজেরাই হোটেলটির নাম দেন ভাবির হোটেল। এরপর থেকে বিভিন্ন ইউটিউবার এসে ভিডিও করেন।
তবে হোটেল খোলার কাজটি এত সহজ ছিল না। শরিফা বেগম বলেন, ২০০৯ সালে সাতক্ষীরা থেকে তিনি ও তাঁর স্বামী–সন্তান নিয়ে কাজের সন্ধানে সীতাকুণ্ডে আসেন। শুরুতেই কয়েক মাস দৈনিক ভিত্তিতে বিভিন্ন স্থানে কাজ করেন। পরে একটি হোটেলে কাজ নেন। সেখানে চার মাস কাজ করার পর সীতাকুণ্ড পৌর সদরের কলেজ রোড এলাকায় নিজেরাই একটি হোটেল খোলেন।
ওই এলাকাটি হিন্দু অধ্যুষিত হওয়ায় সেখানে গরুর মাংস চলে না। দুপুরের খাবার হিসেবে ভর্তা, শুঁটকি, ডাল, মাছ ও মুরগির মাংস রান্না করা হতো। তবে ভাতের খাওয়ার গ্রাহক তেমন পাওয়া যেত না। ওই এলাকায় বেশি চলত বিভিন্ন ধরনের নাশতার আইটেম। সাত বছর সেখানে কোনোমতে দোকান চালান। এরপর তাঁরা একটা প্রতারকের খপ্পরে পড়ে পুঁজিসহ সব হারিয়ে ফেলেন। ফিরে যান সাতক্ষীরায়। এরপর কয়েক মাস সাতক্ষীরায় থেকে আবারও সীতাকুণ্ডে আসেন।
এবার নতুন করে বায়তুশ শরফ মসজিদ এলাকায় দোকান দেন। সাতক্ষীরা থেকে চুইঝাল এনে সীতাকুণ্ডের মানুষকে পরিচয় করানোর চেষ্টা করেন। শুরুতেই তাঁর সঙ্গে সীতাকুণ্ডের মানুষের বাগ্বিতণ্ডা হতো। বেচাকেনাও তেমন ভালো হতো না।
এরপর ফেসবুকে প্রচারণার পর ক্রেতা বেড়ে যায়। এখন তিনি গড়ে প্রতিদিন ৮০ কেজি গরুর মাংস রান্না করেন। এ ছাড়া খাসির মাংস রান্না করেন অন্তত ১৬ কেজি। এখন তাঁর কর্মচারী আছেন ১০ জন। রান্না সহকারীর বেতন মাসে ২১ হাজার টাকা।
চুইঝালে মাংসভাবির হোটেলে শুধু মরিচের গুঁড়া ছাড়া বাকি সব মসলা শিলপাটায় বেটে নেওয়া হয়। মাংসের বিশদ রেসিপি তুলে ধরতে গিয়ে শরিফা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, গরু–খাসির মাংসের চুইঝাল রান্নায় আহামরি কৌশল নেই। ঐতিহ্যগতভাবে গ্রামের মানুষ যেভাবে রান্না করেন, তিনিও ঠিক সেভাবে রান্না করেন। এখন যুগ পাল্টে গেছে। রান্নায় এখন আর কেউ কষ্ট করে বাটা মসলা ব্যবহার করতে চান না। সবাই গুঁড়া মসলা ব্যবহার করেন। ফলে স্বাদ অনেকটা কমে গেছে। তিনি নিজে বাটা মসলা ব্যবহার করেন বলে তাঁর তরকারির স্বাদটা অন্যদের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন হয়। এ ছাড়া গতানুগতিক হোটেলে যে পরিমাণ মসলা দেয়, তিনি তত মসলা ব্যবহার করেন না।
ভাবির হোটেলের সব রান্নাই হয় বাটা মসলায়। গত শনিবার চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়কে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর
এছাড়াও পড়ুন:
শেখ মুজিবকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করে এসি ল্যান্ডের পোস্ট, তোপের মুখে দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক দাবি করে পোস্ট দেওয়ার জেরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সিরাজুম মুনীরা কায়ছানকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। আজ বুধবার বেলা একটার দিকে তাঁকে সরাইল থেকে প্রত্যাহার করা হয়।
আগামীকাল বৃহস্পতিবারের মধ্যে তাঁকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে যোগদান করতে বলা হয়েছে। এর আগে ওই পোস্টকে কেন্দ্র করে স্থানীয় বিএনপির নেতা-কর্মীদের তোপের মুখে পড়েন ওই কর্মকর্তা। এরপর পুলিশি প্রহরায় মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠান ত্যাগ করতে বাধ্য হন।
গত বছরের ২০ অক্টোবর সরাইলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে যোগদান করেন সিরাজুম মুনীরা কায়ছান। আজ সকালে ফেসবুকে ‘এসি ল্যান্ড সরাইল’ নামের সরকারি আইডি থেকে একটি পোস্ট দেওয়া হয়। সেখানে লেখা হয়, ‘১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নির্মম গণহত্যা চালায়। সেদিন রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ স্বাধীন। এরপর শুরু আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়। কিন্তু এর ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল ২৬ মার্চেই। তাই এই দিনটি আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক, সংগ্রামের চেতনা এবং আত্মত্যাগের মহিমায় উজ্জ্বল।’
ওই পোস্ট দেওয়ার কিছুক্ষণ পর সকাল পৌনে আটটার দিকে তিনি সরাইলের অন্নদা সরকারি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে যোগ দেন। সেখানে বিএনপির নেতাদের তোপের মুখে পড়েন তিনি। পরে পুলিশি পাহারায় অনুষ্ঠানস্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হন তিনি। মাঠ থেকে ফিরে তিনি আগের পোস্টটি মুছে দিয়ে নতুন আরেকটি পোস্ট দেন। তিনি লেখেন, ‘ফেসবুক আইডিটি সাময়িক সময়ের জন্য হ্যাকড হয়েছিল, যা পরবর্তী সময়ে পুনরুদ্ধার করা হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি বিতর্কিত স্ক্রিনশট ছড়ানো হচ্ছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং অনভিপ্রেত।’
উপজেলা বিএনপির সভাপতি আনিছুল ইসলাম ঠাকুর প্রথম আলোকে বলেন, সহকারী কমিশনার দায়িত্বশীল পদে থেকে এমনটি করতে পারেন না। তিনি ফেসবুকে আপত্তিকর কথা লিখেছেন। তাঁরা তাঁর বিচার ও প্রত্যাহারের দাবি করেছেন। শুনেছেন তাঁকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাঁরা ওই কর্মকর্তার বিচার চান।
জানতে চাইলে সহকারী কমিশনার সিরাজুম মুনীরা কায়ছান প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই আইডিটা অনেক আগেই খোলা হয়েছে। এটি আজকে হ্যাকড হয়েছিল। আমার নজরে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি পোস্টটি ডিলিট করে দিয়েছি। আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে চট্টগ্রামের পথে রওনা হয়েছি।’
সরাইল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মোশারফ হোসাইন বলেন, তাঁকে (সহকারী কমিশনার) দুপুরে প্রত্যাহার করা হয়েছে। বৃহস্পতিবারের মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে যোগদান করতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন, এসব বিষয়ে এখন পর্যন্ত তিনি কোনো লিখিত পাননি। তবে মুঠোফোনে বিষয়গুলো জেনেছেন।