চট্টগ্রামে পেশাজীবীদের নির্বাচন লেজেগোবরে
Published: 25th, February 2025 GMT
সহস্রাধিক ব্যবসায়ীর সংগঠন চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচন এই ফেব্রুয়ারিতে হওয়ার কথা থাকলেও নানামুখী চাপে তা হয়নি। হয়েছে সমঝোতার কমিটি।
একই কায়দায় ভোট ছাড়া নেতা নির্বাচন করা হয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনেও। গত ৯ ফেব্রুয়ারি বিএনপি ও আওয়ামী লীগ মিলেমিশে সংগঠনটির নেতৃত্ব দখলে নিয়েছে। অথচ ভোট দিয়ে নেতৃত্ব নির্বাচন করতে মুখিয়ে ছিলেন চট্টগ্রাম কাস্টমস ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়ার্ডিং এজেন্টদের প্রায় আড়াই হাজার সদস্য। স্বাধীনতার পর এবারই প্রথম বিনা ভোটে পদ ভাগাভাগির ঘটনা ঘটল এই অ্যাসোসিয়েশনে।
এদিকে প্রতিষ্ঠার ১৩২ বছরের মধ্যে এবারই প্রথম নির্বাচন পণ্ড হয়েছে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির। এখানে ছিলেন ৫ হাজার ৪০৪ ভোটার।
ব্যালট বাক্স ছিনতাই অভিযোগের কারণে ফল ঘোষণা করা যাচ্ছে না খাদ্য পরিবহন ঠিকাদার সমিতির নির্বাচনের। শতবর্ষী চিটাগং চেম্বারের নির্বাচন নিয়েও তৈরি হয়েছে শঙ্কা। সেখানেও ভোটহীন সমঝোতার কমিটি করার দাবি তোলা হয়েছে।
চাপ, ভয় আর আতঙ্ক তৈরি করে পেশাজীবী সংগঠনের একের পর এক নির্বাচন এভাবে পণ্ড হওয়ায় ক্ষুব্ধ অনেক ভোটার। নতুন বাংলাদেশ দেখার প্রত্যাশা করা পেশাজীবী অনেকেই এখন হতাশ।
জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-চট্টগ্রাম জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবীর চৌধুরী বলেন, কোনো চাপের কাছে নতি স্বীকার করে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো ভিন্ন কিছুর ইঙ্গিত বহন করে। গত ৫ আগস্টের পর আমরা সবাই নতুন বাংলাদেশ চেয়েছি। সেখানে এমন চিত্র বেমানান। চরম হতাশারও।
পদ ভাগাভাগি
চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের ২৯ পদের মধ্যে বিএনপি ১৩টি, আওয়ামী লীগ ১০টিসহ অন্যরা ৬টি পদ ভাগাভাগি করে নিয়েছে। আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে কখনও এ সংগঠনে সমঝোতার নির্বাচন হয়নি। অ্যাসোসিয়েশনের এক সদস্য ভোটার নাম প্রকাশ না করে বলেন, ৫০ বছরের ইতিহাসে এবারই প্রথম বিনা ভোটে পদ ভাগাভাগির ঘটনা ঘটল। অথচ আমরা ভেবেছিলাম, নতুন বাংলাদেশে এবার ভিন্ন কিছু হবে। হয়েছে ঠিক এর উল্টো। এ সংগঠনের নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ২৬ ফেব্রুয়ারি। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন ছিল ৯ ফেব্রুয়ারি। ভোটাররা অভিযোগ করেন, সেদিনই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ২৯ প্রার্থীকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হয়। নগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক এএসএম সাইফুল আলম সভাপতি ও বিএনপি সমর্থক মো.
১৬ বছর ভোট নেই
আওয়ামী লীগের শাসনামলে অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ীরা। এবারও ভোটের সব আয়োজন করে শেষ পর্যন্ত বিনা ভোটে নেতা বাছাই করা হয়। সমঝোতার মাধ্যমে ‘নেতা’ হয়েছেন ৪১ জন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় বসার পর ২০০৯ সাল থেকে এই অ্যাসোসিয়েশনে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে মাহবুবুল আলম ও ছৈয়দ ছগীর আহমেদ। মাহবুবুল আলম চার দফায় চিটাগং চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি থাকার পরও খাতুনগঞ্জ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির পদ ছাড়েননি। এবার ব্যতিক্রম কিছু হবে বলে ধারণা করেছিলেন ভোটাররা। কিন্তু বিধি বাম! ১২ ফেব্রুয়ারি চূড়ান্ত প্রার্থী তালিকা প্রকাশের কথা ছিল। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো প্রার্থী না থাকার ছুতায় সেদিনই চূড়ান্ত নির্বাচিত তালিকা প্রকাশ করে নির্বাচন কমিশন। মীর গ্রুপের মালিক মোহাম্মদ আবদুস সালাম সভাপতি ও মো. আমিনুর রহমান বিনা ভোটে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
ব্যালট বাক্স ছিনতাই
চট্টগ্রামে ব্যালট বাক্স ছিনতাই ঘটনায় স্থগিত রয়েছে বাংলাদেশ খাদ্য পরিবহন ঠিকাদার সমিতির ভোটের ফল। করণীয় ঠিক করতে জেলা প্রশাসন, শ্রম অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থায় চিঠি দিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এখানে নির্বাচন হয় ৩০ নভেম্বর। খাদ্য পরিবহন ঠিকাদার সমিতির দ্বিবার্ষিক নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার ইউছুপ খান মাহাবুব এর আগে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ভোট থেকে শুরু করে গণনা পর্যন্ত সব কিছু ঠিকভাবে হয়েছে। তবে ভোট গণনার শেষ দিকে একজন সভাপতি প্রার্থী দলবল নিয়ে ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের চেষ্টা চালান। তাই ফল স্থগিত আছে।
হোঁচট খেল ১৩২ বছরের আইনজীবী সমিতি
‘চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির ১৩২ বছরের ঐতিহ্য এবার হোঁচট খেল। প্রথমবারের মতো আমরা তা হারালাম। এটা দুঃখজনক। এর জন্য রাজনীতিবিদ আইনজীবীরাই অনেকাংশে দায়ী।’ গত ১০ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন পণ্ড হওয়ার পর এভাবেই নিজের প্রতিক্রিয়া জানান চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন চৌধুরী। বিএনপি-জামায়াত ও আওয়ামীপন্থি আইনজীবীর মধ্যে চরম উত্তেজনা দেখা দিলে নির্বাচনের ৬ দিন আগে গত ৪ ফেব্রুয়ারি একযোগে পদত্যাগ করেন ৫ নির্বাচনী কর্মকর্তা, যা এর আগে কখনোই হয়নি। পদত্যাগপত্রে উল্লেখ করা হয়, উত্তেজনা বাড়তে থাকায় নির্বাচনের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছিল। আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ সেনাবাহিনী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিয়োগের প্রস্তাব করে একটি আবেদন দেয়। অন্যদিকে বিএনপিপন্থি ঐক্য পরিষদ ফ্যাসিস্ট সরকারের সমর্থক আইনজীবী সমন্বয় পরিষদের মনোনয়ন বাতিলের জন্য আবেদন করে। দুটি আবেদনই সমিতির গঠনতন্ত্রবহির্ভূত। চিঠিতে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ না থাকার পাশাপাশি বিভিন্নভাবে তারা হেনস্তা, ভয়ভীতি ও হুমকির সম্মুখীন হয়েছেন বলে উল্লেখ করা হয়।
এদিকে নির্বাচন প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু করতে অ্যাডভোকেট মকবুল কাদের চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি পাঁচ সদস্যের অ্যাডহক কমিটি গঠন করে চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতি। আগামী ৬০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করতে বলা হয়েছে তাদের।
শতবর্ষী চট্টগ্রাম চেম্বারের নির্বাচনও হুমকির মুখে
এত বছর আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি এমএ লতিফ ও সাবেক সভাপতি মাহবুবুল আলমের নিয়ন্ত্রণে ছিল শতবর্ষী চট্টগ্রাম চেম্বার। সেখানে এবার পরিবর্তনের দাবি তুলেছিলেন ব্যবসায়ীরা। তবে এখন প্রভাবশালী একটি অংশ চাইছে নিজেদের পছন্দের মানুষ নিয়ে কমিটি গঠন করতে। আবার ‘টাউন অ্যাসোসিয়েশন’ ও ‘ট্রেড গ্রুপ’; ওই দুটি শ্রেণির সদস্য বিলুপ্ত করার দাবি জানিয়েছে ‘চট্টগ্রাম সচেতন ব্যবসায়ী সমাজ’ নামে আরেকটি গ্রুপ। চট্টগ্রাম সচেতন ব্যবসায়ী সমাজের পক্ষে আহ্বায়ক এসএম নুরুল হক গত ২২ ডিসেম্বর চেম্বার প্রশাসকের কাছে এ চিঠি দেন। চেম্বার প্রশাসক চিঠিটি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। এসএম নুরুল হক বলেন, সাধারণ ও সহযোগী সদস্যরা সরাসরি ভোটের মাধ্যমে যোগ্য প্রতিনিধি নির্বাচিত করতে পারেন। তবে ট্রেড গ্রুপ ও টাউন অ্যাসোসিয়েশনে এক যুগ ধরে কারসাজির মাধ্যমে ছয়জন পরিচালক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এর মাধ্যমেই একটি গোষ্ঠী দীর্ঘদিন চেম্বার দখল করে রেখেছিল। ২০১৩ সাল থেকে এ দুই শ্রেণি সদস্য থেকে পরিচালক পদের নির্বাচনে ভোট হয়নি। বিনা ভোটেই ছয়জন পরিচালক নির্বাচিত হন। ঘুরেফিরে দুই শ্রেণির গুটিকয় ব্যবসায়ীই নির্বাচিত হয়েছেন। এখনও একই প্রক্রিয়া রাখতে চাইছে একটি পক্ষ।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের একাংশের হস্তক্ষেপ
এদিকে কয়েকটি পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ করে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীর একাংশ। চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে আওয়ামীপন্থি আইনজীবীদের প্রার্থিতা প্রত্যাহারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারীদের একাংশ ২৬ জানুয়ারি বিক্ষোভ করে চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে। এই বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তারা বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানে শহীদদের রক্তের ওপর আওয়ামীপন্থি ও ফ্যাসিবাদের দোসরদের নির্বাচনে অংশ নিতে দেওয়া হবে না।’
এ ছাড়া চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাচনে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের দোসরদের প্রত্যাখ্যানের দাবিতে ১৫ জানুয়ারি মানববন্ধন করে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের আরেক অংশ। এ সময় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসকে ফ্যাসিবাদ ও দুর্নীতিমুক্ত করার আহ্বান জানান তারা।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: পদ ভ গ ভ গ স গঠন র সমঝ ত র ব যবস য় আইনজ ব হয় ছ ন ল আলম সদস য আওয় ম বছর র ব এনপ
এছাড়াও পড়ুন:
মানবতাবিরোধী অপরাধ: জামায়াত নেতা আজহারের রিভিউ শুনানি মঙ্গলবার
মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডের রায় রিভিউ চেয়ে জামায়াত নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের করা আবেদন শুনানির জন্য ২৫ ফেব্রুয়ারি (মঙ্গলবার) দিন ধার্য করেছেন আপিল বিভাগ।
আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলামের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের আপিল বিভাগ আজ রোববার এ তারিখ ধার্য করেন।
এর আগে ২৩ জানুয়ারি আপিল বিভাগ রিভিউ শুনানির জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি দিন রাখেন। ধার্য তারিখে প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে আবেদনটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় ৯ নম্বর ক্রমিকে ওঠে। তবে ক্রম অনুসারে এর আগে থাকা মামলা শুনানি-নিষ্পত্তির মধ্য দিয়ে আদালতের কর্মঘণ্টা শেষ হওয়ায় সেদিন রিভিউ আবেদনের শুনানি হয়নি।
আজ সকালে রিভিউ আবেদন শুনানির বিষয়টি উত্থাপন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম। অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেন, শুনানি করতে তাঁদের আপত্তি নেই। আজহারুলের পক্ষে এ সময় আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির উপস্থিত ছিলেন।
পরে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিফ প্রসিকিউটর রিভিউ শুনানির জন্য বিষয়টি মেনশন করেন। এ বিষয়ে অ্যাটর্নি জেনারেলও বলেন। আপিল বিভাগ শুনানির জন্য ২৫ ফেব্রুয়ারি দিন নির্ধারণ করেছেন।’
এর আগে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আজহারুলকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালের ২৮ জানুয়ারি আপিল করেন আজহারুল। এই আপিলের ওপর শুনানি শেষে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর আপিল বিভাগ রায় দেন। ২০২০ সালের ১৫ মার্চ আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর তা পুনর্বিবেচনা চেয়ে ২০২০ সালের ১৯ জুলাই আপিল বিভাগে আবেদন করেন তিনি। এই পুনর্বিবেচনার আবেদন শুনানির জন্য ২৫ ফেব্রুয়ারি দিন নির্ধারণ করা হলো। আজহারুল কারাগারে আছেন।