মামলা করেও জাফলং, ভোলাগঞ্জ ও শারফিন টিলা রক্ষা করতে পারছে না সিলেটের প্রশাসন। গত বছরের ৫ থেকে ৭ আগস্ট দুটি কোয়ারি থেকে লুট হয়েছে অন্তত ৫০ কোটি টাকার পাথর। এরই মধ্যে ভোলাগঞ্জের বাঙ্কার ও শারফিন টিলা ধ্বংস করা হয়েছে।

সম্প্রতি বিভিন্ন মহাল পরিদর্শন করে দেখা গেছে, বিজিবি ও আনসার সদস্যদের সামনে বালু-পাথর তোলা হচ্ছে। জাফলং কোয়ারির ডাউকি নদীর জিরো পয়েন্টের পাশ থেকে দেড় কিলোমিটার দক্ষিণ পর্যন্ত শত শত নৌকা দিয়ে শ্রমিকরা বালু তুলছেন। শারফিন টিলায় অর্ধশতাধিক মেশিন লাগিয়ে মাটি খুঁড়ে তোলা হচ্ছে পাথর। জৈন্তাপুরের সারি নদীতে দেখা গেছে একই দৃশ্য।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১৩ জানুয়ারি খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো পাথর ও বালুমহাল বন্ধের আদেশ বাতিল করে। এর পর ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা বেপরোয়া হয়ে ওঠে। সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী মনে করেন, সরকার পরিবর্তনের পর প্রশাসনের দুর্বলতা ও ইজারাবিহীন থাকার কারণে তাদের ঠেকানো যাচ্ছে না। সঠিক ব্যবস্থাপনায় ইজারা দিলে সরকার রাজস্ব পাবে এবং যত্রতত্র উত্তোলন বন্ধ হবে।

ভোলাগঞ্জ ও বাঙ্কার
কোম্পানীগঞ্জের ভোলাগঞ্জ ছাড়াও উৎমা, শারফিন টিলা, ধলাই নদী ও সাদা পাথর পর্যটন কেন্দ্রের অবস্থান। কোয়ারির পাশে রেলওয়ের মালিকানাধীন বদ্বীপ আকারের রোপওয়ের (বাঙ্কার) সংরক্ষিত এলাকা। সরকার পরিবর্তনের পর কয়েক দিনে সাদা পাথর লুট করা হয় ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকার। সম্প্রতি অভিযোগ উঠেছে, বাঙ্কার থেকে রাতে চুরি করা পাথর থেকে নৌকাপ্রতি ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা করে নিচ্ছে বিজিবি। ভোলাগঞ্জ বাঙ্কার থেকে পাথর তোলায় মদদ দিচ্ছেন বিএনপিসহ স্থানীয় কয়েকজন সমন্বয়ক। পাথর চুরির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গত ২৭ জানুয়ারি বাঙ্কারে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) উপপরিদর্শক মঞ্জুরুল ইসলামসহ চারজনকে বরখাস্ত করা হয়েছে।
আরএনবি ইনচার্জ আরিফুল ইসলাম জানান, তারা দিনে দায়িত্ব পালন করেন। রাতে থাকেন না।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ আবুল হাসনাত বলেন, নিয়মিত টাস্কফোর্সের অভিযানেও কাজ হচ্ছে না।

শারফিন টিলা
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার পশ্চিম ইসলামপুর ইউনিয়নের শারফিন টিলা থেকে সরকার পতনের পর প্রায় ৫০ কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে। ১৩৭ দশমিক ৫০ একরের শারফিন টিলাকে কয়েক বছর আগে পরিবেশ অধিদপ্তর ‘মরা কঙ্কাল’ বলেছিল। গত ২৫ জানুয়ারি পরিবেশ আদালতে অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক বদরুল হুদা মামলা করেন। মামলায় প্রধান আসামি করা হয় কোম্পানীগঞ্জের বিএনপিকর্মী ও কাঁঠালবাড়ি গ্রামের মোহাম্মদ আলীকে। এ মামলায় সাক্ষী করা হয় তাঁর বাবা ইউপি চেয়ারম্যান জিয়াদ আলীকে। এর পর গত ২৭ জানুয়ারি পরিবেশ আদালতে ৪০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া চাঁদা আদায়ের অভিযোগে গত ১১ ফেব্রুয়ারি ১৩ পুলিশ সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়।

গত সাড়ে পাঁচ মাসে সেখানে পাঁচটি অভিযান ও ৯টি মামলা করা হয়েছে। শারফিন ওয়াক্‌ফ এস্টেটের মোতাওয়াল্লি আনোয়ার হোসেন আনাই সমকালকে বলেন, ‘বাধা দিয়েও টিলাটি রক্ষা করা যায়নি। লিস্টার মেশিন দিয়ে পাথর তোলা হচ্ছে।’
থানার ওসি উজায়ের আল মাহমুদ বলেন, ‘পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় গত ১৮ ফেব্রুয়ারি মামলা হয়েছে। গত বুধবার অভিযান চালানো হয়েছে। তবু কেউ থামছে না।’

জাফলং পাথর কোয়ারি
গোয়াইনঘাটের জাফলং জিরো পয়েন্ট থেকে সরকার পতনের পর ১২০ কোটি টাকার পাথর লুট করা হয় বলে সে সময় উপজেলা প্রশাসন জানায়। সম্প্রতি প্রকাশ্যে বিভিন্ন স্থান থেকে শুরু হয়েছে বালু তোলা।

সরেজমিন দেখা গেছে, জাফলং পাথর কোয়ারি, জিরো পয়েন্ট, পিয়াইন ও ডাউকি নদী এবং এর আশপাশ এলাকা থেকে কয়েক হাজার শ্রমিক নির্বিচারে বালু ও পাথর উত্তোলন করছেন। রাতে জাফলংয়ের নয়াবস্তি, কান্দুবস্তির জুমপাড় ও মন্দিরের জুম এলাকায় গর্ত করে পাথর উত্তোলন করতে দেখা গেছে। সেখানে চালানো হচ্ছে এক্সক্যাভেটর। গত পাঁচ মাসে সেখানে ১৫-১৬টি অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে। সর্বশেষ গত শনিবার আরেকটি অভিযান চালানো হয়। থানায় মামলা হয়েছে ৮-৯টি। সম্প্রতি দখলদারিত্ব নিয়ে একাধিক মারামারি হয়েছে বিএনপি নেতাকর্মীর মধ্যে।
জাফলং নিয়ন্ত্রণ করছেন কয়েক বছর আগে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতা ও অপসারিত গোয়াইনঘাট উপজেলা চেয়ারম্যান শাহ আলম স্বপন। রয়েছেন পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্স, সাধারণ সম্পাদক মাসুদ রানা, কোষাধ্যক্ষ আবদুর রাজ্জাক, বিএনপি নেতা আবদুস সাত্তার, গোয়াইনঘাট উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মিজানুর রহমান হেলোয়ার, উপজেলা ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ইউসুফ আহমেদসহ কয়েকজন। শারফিন টিলা ধ্বংসের নেপথ্যে রয়েছেন মাজারের সাবেক খাদেমের ছেলে মনির মিয়া, তাঁর ভাই রফিক মিয়া, ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক সভাপতি ফয়জুর রহমান, বিএনপিকর্মী সেবুল আহমেদ, ইব্রাহিম, ইসমাইলসহ স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা। জাফলংয়ে ক্যাশিয়ারের ভূমিকা পালন করছেন পূর্ব জাফলং ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আমজাদ বক্স।

সারি নদী ও শ্রীপুর
জৈন্তাপুরের পাথর ও বালুমহাল শ্রীপুর ও সারি নদী। নদীতে কাজ করা শ্রমিকের সংখ্যা চার হাজারের বেশি। শ্রমিকদের কাছ থেকে প্রতিদিন চাঁদা ওঠে প্রায় ৮ লাখ টাকা। অভিযোগ রয়েছে, সপ্তাহে বিভিন্ন দপ্তরে টাকা পাঠান হয়। এগুলোসহ কানাইঘাটের লোভাছড়া, গোয়াইনঘাটের বিছনাকান্দি কোয়ারি ও মহাল থেকে প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার বালু-পাথর তোলা হচ্ছে। গত পাঁচ মাসে সাতটি অভিযান ও তিনটি মামলা হয়েছে। জব্দ করা পাথর গত ২৮ ডিসেম্বর নিলামের জন্য দরপত্র ডেকেছিল খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ব্যুরো। গত ১৬ জানুয়ারি লুট করে নেওয়া হয়েছে সেই পাথরও।
সারি নদী নিয়ন্ত্রণ করছেন বৃহত্তর সারি বারকি শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি আমির আলী, সাধারণ সম্পাদক নজির আহমদ, চারিকাটা ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান সামসুজ্জামান সেলিম, নিজপাট ইউনিয়নের ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রহিম উদ্দিন ও তাঁর ভাই তাজউদ্দিনসহ কয়েকজন।

সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়ক শাহ সাহেদা বলেন, পাথর ও বালুখেকোরা প্রকাশ্যে আদালত ও সরকারকে অমান্য করছে।
অভিযোগ অস্বীকার করে বিএনপির সাবেক নেতা শাহ আলম স্বপন সমকালকে বলেন, বালু-পাথরের কোনো ব্যবসা নেই। শারমিন টিলার মনির মিয়া টিলা ধ্বংসের পেছনে জড়িত নন।
বৃহত্তর সারি বারকি শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি আমির আলী শ্রমিক চাঁদা ১০০ টাকা তোলেন বলে স্বীকার করেন। জাফলংয়ে বিএনপি নেতা আমজাদ বক্সের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি ধরেননি।
সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, উপজেলা বা জেলা প্রশাসনের টাস্কফোর্স ও মোবাইল কোর্টের অভিযানে থানা-পুলিশ সহায়তা করে। খবর পেলে পুলিশও অভিযান চালায়।
বিজিবি সিলেট সদরদপ্তরের সেক্টর কমান্ডার কর্নেল সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, সীমান্তের ১৫০ গজের ভেতর থেকে বালু-পাথর তুললে আমরা বাধা দিই। এর বাইরে অবৈধভাবে কেউ কাজ করলে সেটা উপজেলা প্রশাসন দেখে।
সিলেটের জেলা প্রশাসক শের মাহবুব মুরাদ বলেন, বারবার অভিযান হচ্ছে। মামলাও করা হচ্ছে। পরিস্থিতিরও উন্নতি হচ্ছে।

 

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: পর ব শ ল ট কর ব এনপ সরক র ইসল ম উপজ ল করছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

ইউক্রেনে ট্রাম্পের ১০০ দিনের ব্যর্থতা

ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ফিরে আসার প্রায় ১০০ দিন পার হয়ে গেছে। কিন্তু এখনো রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ইউক্রেনের সাধারণ মানুষের ওপর আঘাত হানছে। ট্রাম্প ‘প্রথম দিনেই’ যুদ্ধ বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনো কোনো শান্তির লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। প্রশ্ন হলো, ট্রাম্প প্রশাসন কবে স্বীকার করবে যে তারা ব্যর্থ হচ্ছে?

শুরুতে ট্রাম্পের দাবি ছিল খুব সহজ, ‘যুদ্ধ থামাও, আলোচনায় বসো।’ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে প্রথম ফোনালাপের পর তিনি বলেছিলেন, খুব দ্রুত যুদ্ধ বন্ধ হবে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও সেই সম্ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।

কিন্তু এরপর যা ঘটেছে, তা হলো পুতিন ও তাঁর ক্রেমলিনের ছোট একটি দল ট্রাম্পের অনভিজ্ঞ আলোচক স্টিভ উইটকফকে এমন এক জটিল ও অসম্ভব শর্তের গোলকধাঁধায় ফেলেছেন, যেখান থেকে বেরোনো কঠিন। এত দিন ধরে এই নাটক চলার পর এমনকি সবচেয়ে বোকা আলোচকেরও বোঝার কথা, পুতিনের যুদ্ধ থামানোর কোনো ইচ্ছা নেই। তিনি ট্রাম্পের পরিকল্পনা বা সময়সূচিও মানবেন না।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে পুতিন যখন ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় হামলা শুরু করেন, তখন থেকেই তিনি মূলত রুশ সামরিক শক্তির ওপর ভরসা করেছিলেন, যাতে তিনি ইউক্রেনের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেন। প্রথমে তাঁর সেনাবাহিনীতে প্রায় দুই লাখ ভাড়াটে সৈনিক ছিলেন। এরপর তিনি কয়েক দফা আংশিক মোতায়েন এবং বিশাল আর্থিক প্রণোদনার মাধ্যমে সেনাসংখ্যা বাড়িয়ে তা প্রায় ছয় লাখে নিয়ে যান।

এই যুদ্ধে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার সাত–আট লাখ সেনা হতাহত হয়েছেন, যার মধ্যে দুই লাখের বেশি নিহত হয়েছেন। এত বড় ক্ষয়ক্ষতির পরও কথিত শক্তিশালী রুশ সেনাবাহিনী এখন ইউক্রেনের আগের চেয়ে কম ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণ করছে। সুনির্দিষ্টভাবে বললে, মাত্র ১৮ দশমিক ৩ শতাংশ ভূখণ্ড রুশ সেনারা নিয়ন্ত্রণ করছে।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে সামরিকভাবে পুতিনের যুদ্ধকে এক ভয়াবহ ব্যর্থতা বলা যেতে পারে। হয়তো তিনি এখনো বিশ্বাস করেন, তাঁর বাহিনী ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে কোনো না কোনো বড় সাফল্য অর্জন করবে। কিন্তু নিরপেক্ষ বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এর সম্ভাবনা খুবই কম।

রাশিয়া হয়তো ইউক্রেনের তুলনায় যুদ্ধে বেশি সংখ্যায় সেনা পাঠাতে পারবে, বেশি বোমাও ফেলতে পারবে, কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে থাকা সেনাদের মধ্যে লড়াই করার মানসিকতা জাগিয়ে তুলতে পারবে না। এখন পর্যন্ত দেখা গেছে, আত্মরক্ষা যত সহজ, আক্রমণ করা ঠিক ততটাই কঠিন। এর মানে দাঁড়ায়, শেষ পর্যন্ত পুতিন কোনো ধরনের বিজয়ের ছবি তুলে ধরতে চাইলে তাঁকে রুশ সেনাবাহিনীর চেয়ে ট্রাম্পের ওপর বেশি ভরসা করতে হবে।

তাত্ত্বিকভাবে ট্রাম্প চাইলে নিজেই নিজের অবস্থান বদলে পুতিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন এবং ইউক্রেনকে আরও সহায়তা দিতে পারেন। যদি তিনি এটা করেন, তাহলে হয়তো সেই যুদ্ধবিরতি আদায় করতে পারবেন, যার প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। তা না হলে তিনি ব্যর্থই হবেন, আর পুতিন ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা তাঁর পেছনে বসে হেসেই যাবেন।

এ কারণে ট্রাম্পকে প্রভাবিত করার জন্য পুতিন তাঁর হাতে থাকা সব কৌশল কাজে লাগাচ্ছেন। সবাই জানে, ট্রাম্প প্রশংসায় দুর্বল হয়ে পড়েন। আর সেই সুযোগ নিয়েই পুতিন বাড়াবাড়ি রকমের চাটুকারিতা করছেন। তিনি দাবি করেছেন, ২০২০ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ‘চুরি’ হয়েছিল এবং যদি ট্রাম্প তখন ক্ষমতায় থাকতেন, তাহলে এই যুদ্ধ কখনোই হতো না।

এমনকি পুতিন বলেছেন, ২০২৪ সালে ট্রাম্পের ওপর হামলার পর তিনি তাঁর ব্যক্তিগত প্রার্থনাকক্ষে গিয়ে ট্রাম্পের জন্য প্রার্থনা করেছেন। শুধু তা–ই নয়, তিনি ক্রেমলিনের দরবারি শিল্পীকে দিয়ে ট্রাম্পের একটি প্রতিকৃতি আঁকিয়ে তা উপহার হিসেবে পাঠিয়েছেন।

শুধু প্রশংসা নয়, পুতিন ট্রাম্প ও তাঁর প্রতিনিধি স্টিভ উইটকফকে ব্যবসার প্রলোভনও দেখাচ্ছেন। রিয়াদে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার প্রথম আলোচনায় পুতিনের দল একটি বিশাল বিনিয়োগ সম্ভাবনার তালিকা নিয়ে আসে, যেগুলো নাকি বাস্তবায়ন করা হবে যদি ট্রাম্প ইউক্রেনকে ছেড়ে দেন এবং রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা তুলে নেন।

উইটকফ জানিয়েছেন, পুতিনের সঙ্গে তাঁর সাম্প্রতিক বৈঠকের একটি বড় অংশ এই বিনিয়োগ পরিকল্পনা নিয়েই আলোচনা হয়েছে।

আরও পড়ুনট্রাম্পকে রুখতে চীন-ইউরোপ কি হাত মেলাবে১৯ এপ্রিল ২০২৫

দুই ধরনের কৌশলই স্পষ্টভাবে কাজ করেছে। পুতিন জানেন, কীভাবে কাজ করতে হয় এবং তিনি জানেন, কার সঙ্গে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়। এখন পর্যন্ত কোনো যুদ্ধবিরতি হয়নি এবং পুতিন যে এমন কিছুতে রাজি হবেন, তার কোনো লক্ষণও নেই। তিনি নির্দ্বিধায় ইউক্রেনের শহরগুলোতে বেসামরিক লক্ষ্যে হামলা চালিয়ে যাচ্ছেন।

এই তথাকথিত আলোচনায় ক্রেমলিন মূলত দুটি দাবি তুলেছে। প্রথম দাবি হলো, ইউক্রেন যেন লুহানস্ক, দোনেৎস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন—এই চারটি অঞ্চল রাশিয়ার হাতে তুলে দেয়। উইটকফ এ বিষয়ে ইতিমধ্যে একপ্রকার রাজিও হয়ে গেছেন: যুক্তরাষ্ট্র নাকি রাশিয়ার দখল করা এই চার অঞ্চলের ওপর রাশিয়ার মালিকানা মেনে নিতে প্রস্তুত।

কিন্তু রাশিয়া এখনো এ চার অঞ্চলের পুরোটা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেনি।

জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসনের আঞ্চলিক রাজধানীগুলোতে (যেখানে যুদ্ধের আগে এক মিলিয়ন লোকের বসবাস ছিল) এখনো ইউক্রেনীয় পতাকা উড়ছে। কিয়েভের কোনো সরকার এসব শহর হেলায় ছেড়ে দিলে টিকে থাকতে পারবে না। হয়তো ইউক্রেন বর্তমান যুদ্ধরেখাকে কেন্দ্র করে একধরনের ‘জমে থাকা’ সংঘাত মেনে নিতে পারে, কিন্তু এর চেয়ে বেশি নয়।

রাশিয়ার দ্বিতীয় দাবি হলো, ইউক্রেনের ওপর নিরাপত্তাগত কর্তৃত্ব বজায় রাখা। অর্থাৎ ভবিষ্যতে ইউক্রেনে পশ্চিমা সামরিক উপস্থিতি বা সহায়তা যেন না থাকে। ট্রাম্প ইতিমধ্যেই ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ ন্যাটো সদস্য পদ প্রশ্নে হার মানিয়েছেন এবং তিনি সম্ভবত পুতিনকে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে সহায়তা পুরোপুরি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতিও দিতে যাচ্ছেন।

কিন্তু এখানেই ইউরোপীয়দের ভূমিকা শুরু হয়। পুতিন ও ট্রাম্প—দুজনেই ইউরোপীয়দের আলোচনার টেবিলে আনতে চাননি। কিন্তু এটাই ভালো হয়েছে। ইউরোপীয়রা যদি ইউক্রেনকে আর্থিক ও সামরিক সহায়তা অব্যাহত রাখার ব্যাপারে দৃঢ় অবস্থানে থাকেন, তাহলে পুতিন ও ট্রাম্প যা-ই নিয়ে নিজেদের মধ্যে একমত হোন না কেন, তা বাস্তব মাটিতে কোনো প্রভাব ফেলবে না।

এ অবস্থায় ইউরোপের হাতে রয়েছে সবচেয়ে বড় তাস। যদি তারা রাজনৈতিক সদিচ্ছা দেখাতে পারে, তাহলে ইউক্রেনকে ‘মিউনিখ চুক্তি’র মতো লজ্জাজনক বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হওয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব। ইউরোপীয় নেতাদের স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া উচিত, যেভাবেই হোক তাঁরা ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা ও সার্বভৌমত্বের পক্ষে তাদের সহায়তা অব্যাহত রাখবেন।

তাত্ত্বিকভাবে ট্রাম্প চাইলে নিজেই নিজের অবস্থান বদলে পুতিনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারেন এবং ইউক্রেনকে আরও সহায়তা দিতে পারেন। যদি তিনি এটা করেন, তাহলে হয়তো সেই যুদ্ধবিরতি আদায় করতে পারবেন, যার প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন। তা না হলে তিনি ব্যর্থই হবেন, আর পুতিন ও তাঁর ঘনিষ্ঠরা তাঁর পেছনে বসে হেসেই যাবেন।

কার্ল বিল্ডট সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ