‘সারাদিন কষ্ট করে যে টাকা পাই, তা নিয়ে বাড়ি ফিরতে ভয় হয়’
Published: 24th, February 2025 GMT
সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি হওয়ায় সবার মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে রাজধানীতে ছিনতাই, চুরি, ডাকাতি বেড়ে যাওয়ায় চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে মানুষ। রাতের আলো ঝলমলে রাস্তায় জনসমক্ষে পিস্তল, রিভলবার বের করে গুলি চালিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে লুটে নেওয়া হচ্ছে স্বর্ণালংকার, টাকা। ব্যাংক থেকে টাকা তোলা, টাকা পরিবহন, মূল্যবান সামগ্রী বহন করা যে কারও জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। ছোট ব্যবসায়ী, দোকানিদেরও দেখার যেন কেউ নেই।
গতকাল সোমবার রাজধানীতে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমন অবস্থা চলতে থাকলে জীবন-জীবিকা মারাত্মক ব্যাহত হবে। এমনিতেই ব্যবসায় মন্দা চলছে। ফুটপাতসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ছোট দোকানিরা সারাদিন বিক্রি করে যে টাকা পান, তা নিয়ে রাতে বাসায় ফেরাই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, ছিনতাইকারীরা চাকুসহ নানা ধরনের অস্ত্র ঠেকিয়ে মুহূর্তেই সব লুটে নিয়ে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হিমশিম খাচ্ছে।
বিভিন্ন এলাকা ঘুরে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের আতঙ্ক, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার কথা জানা গেছে। গুলিস্তানের ফুটপাতের দোকানি মো.
রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মার্কেটের ভেনাস জুয়েলার্সের বিপ্লব পাল সমকালকে বলেন, পরিস্থিতি ভালো না। সব দিকেই নিরাপত্তাহীনতা। এই জুয়েলার্সের অন্য একজন জানান, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণে ক্রেতারা টাকা নিয়ে দোকানে আসতে চান না। এ কারণে বিক্রি কমে গেছে। ব্যবসায় চলছে মন্দা।
এলিফ্যান্ট রোডে বাটা শো-রুমের ম্যানেজার রাজীব হোসেন বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির যথেষ্ট অবনতি হয়েছে। সে কারণে পরিবেশ-পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। এখন মানুষ আতঙ্কে থাকে। কারওয়ানবাজারের ছোট দোকানি আবদুর রহিম বলেন, এমনিতেই বেচাকেনা কমে গেছে। এ সময় কষ্ট করে সারাদিনে নানা পণ্য বিক্রির পর যে টাকা পাওয়া যায়, তা নিয়ে বাসায় ফিরতে ভয় হয়। আতঙ্কের মধ্যে বাড়ি ফিরতে হয়। কখন, কে রাস্তায় দাঁড় কারিয়ে ছুরি ঠেকিয়ে ব্যবসার পুঁজিটুকু কেড়ে নেয়, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এমন পরিস্থিতিতে বেশি দিন চলা যায় না।
ভোলা থেকে রাজধানীতে আসা ভ্যানচালক মো. নয়ন সমকালকে বলেন, ‘হঠাৎ করেই চারদিকে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই বেড়ে গেছে। ভ্যানচালক হলেও আমাদের মাঝে আতঙ্ক আছে। আমরা মানুষের মূল্যবান জিনিসপত্র এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে যাই। ভ্যান দাঁড় করিয়ে কখন কে অস্ত্র ঠেকিয়ে জিনিসপত্র লুটে নিয়ে যায়, তার নিশ্চয়তা নেই।’ তিনি আরও বলেন, নিজের পকেটে যে পরিমাণ টাকাই থাকুক, ছিনতাইকারী চাইলে দিতে হবে। মানুষ এখন সন্ত্রাসীদের কাছে জিম্মি হয়ে গেছে। দিনে দিনে এসব বাড়ছেই। পুলিশ আগের মতো ভূমিকা রাখে না। আগে কোথাও কিছু হলে পুলিশ দৌড়াদৌড়ি করে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি সামাল দিত। এখন তারা তাদের মতো দাঁড়িয়ে থাকে, টহল দেয়; এটুকুই।
মোতালিব প্লাজার কাছে হাতিরপুল মোড়ে কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা মো. আলমগীর সমকালকে বলেন, ‘প্রতিদিন নানা কিছু সামলাতে হয়। কেউ বলে আমি সমন্বয়ক, কেউ বলে চেয়ারম্যান, কেউ বলে আমি ওমুক দলের ওমুক কমিটির সভাপতি, আবার কেউ বলে আমি এলাকার প্রভাবশালী। তারা খেয়াল-খুশিমতো কাজ করতে চায়। বাধা দিলেই ঘটে বিপত্তি। হিমশিম খেতে হয় পুলিশকে। এরাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাচ্ছে। কোনো না কোনো প্রভাবশালীর সঙ্গে এদের যোগসাজশ আছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়নে পুলিশের শতভাগ সদিচ্ছা, প্রচেষ্টা আছে। পুলিশ যে কোনো মূল্যে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে চায়।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ছ নত ই পর স থ ত র ব যবস য় ক উ বল আতঙ ক
এছাড়াও পড়ুন:
আইনের হাত বনাম নিজের হাত
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। বিশেষত বাংলাদেশে গত ২৬ জুলাই-পরবর্তী আট মাসের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা ক্রমাগত ঊর্ধ্বমুখী। গণপিটুনি, স্থানীয়ভাবে বিচারকাজ পরিচালনা, মিথ্যা অভিযোগের মাধ্যমে ব্যক্তিগত প্রতিশোধ গ্রহণ এসব অনিয়ন্ত্রিত প্রবণতা সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে এবং আইনশৃঙ্খলার ভিত্তি দুর্বল করে দিচ্ছে।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকারিতা ও বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ব্যাহত হলে জনমনে অবিশ্বাস দানা বাঁধে, যা দীর্ঘ মেয়াদে রাষ্ট্রকে ভয়াবহ সংকটের দিকে ঠেলে দিতে পারে। জনগণ যখন ন্যায়বিচার পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে না, তখন তারা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে উদ্বুদ্ধ হয়। এর ফলে সামাজিক স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হয় এবং অপরাধপ্রবণতা বাড়ে।
এ সমস্যা নিরসনে যথাযথ আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করা, বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে তার কার্যকারিতা বৃদ্ধি এবং মিথ্যা অভিযোগ ও গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। একই সঙ্গে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। কার্যকর ও দায়িত্বশীল পদক্ষেপের মাধ্যমে একটি সুস্থ, ন্যায়ভিত্তিক ও স্থিতিশীল সমাজ গঠন সম্ভব।
অনেক সময় অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করতে ভুক্তভোগীদের দীর্ঘ সময় এবং অর্থ ব্যয় করতে হয়। অতীতে বহু অপরাধের বিচার হয়নি; প্রকৃত অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছে এবং অপরাধীরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব ব্যবহার করে অথবা আইন ও পুলিশি ব্যবস্থার দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে বিচার কার্যক্রম প্রভাবিত বা অসম্পূর্ণ করে তোলে। অনেক সময় পুলিশের গাফিলতি ও প্রশাসনিক দুর্নীতির কারণে অনেক অপরাধী বিচারের আওতার বাইরে থেকে যায়, যা জনগণের আইনের প্রতি আস্থা হ্রাস করে। অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত অভিযোগকারীরা ন্যায়বিচার পান না। বরং মিথ্যা অভিযোগকারীরা রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত স্বার্থ হাসিল করতে সক্ষম হয়। আমরা দেখেছি, পুলিশের কাছ থেকে আসামি ছিনিয়ে নিয়ে জনগণ গণপিটুনির মাধ্যমে বিচার সম্পন্ন করছে। এটি মূলত সমাজে ন্যায়বিচার প্রক্রিয়া ও প্রশাসনের প্রতি মানুষের ক্ষোভের ইঙ্গিত দেয়।
সাধারণ মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়। তারা মনে করে, প্রশাসন বা পুলিশ তাদের কাজ সঠিকভাবে করছে না। ফলে তারা নিজেদের উদ্যোগে শাস্তি দিয়ে প্রশাসনকে শেখাতে চায়– কীভাবে ন্যায়বিচার করতে হয়। প্রশাসনকে বিচার শেখানোর উদ্দেশ্যে এটি করা হলেও যদি বারবার তা ঘটতে থাকে, তা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য শুভ লক্ষণ নয়। এভাবে সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার চেষ্টা কোনোভাবেই আইনি বা ন্যায্য পদ্ধতির অংশ নয়।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যকারিতা ও বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ব্যাহত হলে জনমনে অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়, যা দীর্ঘ মেয়াদে রাষ্ট্রকে ভয়াবহ সংকটের দিকে ঠেলে দিতে পারে। যখন জনগণ ন্যায়বিচার পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হতে পারে না, তখন তারা আইন নিজের হাতে তুলে নিতে উদ্বুদ্ধ হয়। ফলে সামাজিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত হয় এবং অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধি পায়।
একটি সুস্থ সমাজ গঠনে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন অপরিহার্য। জনগণের মধ্যে আইন হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতা রোধ এবং মিথ্যা অভিযোগকারীদের শাস্তির আওতায় আনা হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা সহজ হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলোর দক্ষতা বৃদ্ধি, দ্রুত বিচার নিশ্চিত করা এবং আইন সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে পারলে দেশ আরও নিরাপদ ও ন্যায়ভিত্তিক হবে। আইনের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানো এবং বিচার প্রক্রিয়া কার্যকর করার মধ্য দিয়েই একটি আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠা সম্ভব।
উছমান গনি: শিক্ষক
usmgoni@gmail.com