দিন দিন অসংক্রামক ব্যাধির সংখ্যা বেড়েই চলছে, ক্যান্সার তার মধ্যে অন্যতম। ক্যান্সারের চিকিৎসাও আর অজেয় নয়। শুরুতেই দ্রুত শনাক্ত করতে পারলে, এ রোগের চিকিৎসা এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভ সম্ভব। শুধু দরকার সময়মতো সঠিকভাবে রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা গ্রহণ।
ক্যান্সার বলতে সাধারণভাবে জীবকোষের অনিয়ন্ত্রিত ও অস্বাভাবিক বৃদ্ধিকেই বোঝায়। এ কোষগুলো স্বাভাবিক নয়, বরং পরিবর্তিত বিধায় দেহের সাধারণ নিয়মে এদের সংখ্যা বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। ফলে খুব দ্রুত এসব কোষের পরিমাণ বাড়তে পারে, কখনও কখনও এগুলো টিউমার বা চাকার মতো তৈরি করে এবং একপর্যায়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। এ অস্বাভাবিক কোষগুলো সুস্থ স্বাভাবিক কোষগুলোকে ধ্বংস করে ও শরীরের স্বাভাবিক কার্যকলাপে বাধার সৃষ্টি করে। এগুলো ধীরে ধীরে দেহের প্রয়োজনীয় অঙ্গগুলোকে অকেজো করে দেয় এবং রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
ক্যান্সারের কারণ: সাধারণত বয়স্কদের মধ্যেই ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি। তবে ক্যান্সার যে কোনো বয়সেই হতে পারে। আবার কিছু কিছু ক্যান্সার অল্প বয়সেই হয়। আধুনিক যুগে বিজ্ঞানের অভাবনীয় উন্নতির মধ্যেও ক্যান্সারের পুরোপুরি কারণ এখনও জানা নেই। কিছু কিছু পারিপার্শ্বিক, পেশা, এমনকি জীবনযাত্রার পদ্ধতি বা কুঅভ্যাস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে, যেমন :
(১) প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ধূমপান, তামাক জাতীয় দ্রব্য যেমন সাদা পাতা, জর্দা, গুল সেবন।
(২) দীর্ঘদিন মদ্যপানের অভ্যাস, শিরায় ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ এবং অন্য সব ধরনের নেশা।
(৩) খাদ্যাভ্যাস, যেমন– খাদ্যে ফাইবারের অভাব, ভিটামিন বা অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের অভাব, প্রিজারভেটিভ, কেমিক্যাল বা রংযুক্ত খাবার এবং আর্সেনিকযুক্ত পানি পান।
(৪) পরিবেশ দূষণ এবং কেমিক্যালের সংস্পর্শে আসা।
(৫) বিভিন্ন ধরনের বিকীরণ– যেমন সূর্যরশ্মি, অতি বেগুনি রশ্মি, এক্স-রে, কসমিক-রে ইত্যাদি।
(৬) কর্মস্থল বা পেশাগত কারণে অনেকের ক্যান্সার হতে পারে। যেমন রেডিয়েশন বা কেমিক্যাল নিয়ে কাজ করা, অনেকক্ষণ রোদে থেকে কাজ করা, জাহাজ ভাঙার শ্রমিক, রং ও রাবার কারখানার কর্মী ইত্যাদি।
(৭) বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা অন্যান্য জীবাণুর দ্বারা ইনফেকশনের ফলে ক্যান্সার হতে পারে। যেমন হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস, এপস্টিন বার ভাইরাস, হ্যালিকোব্যাক্টর পাইলোরি, হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস, এইডস ভাইরাস ইত্যাদি। সিস্টেসোমা জাতীয় জীবাণু মধ্যপ্রাচ্য বা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে মূত্রাশয় ক্যান্সারের কারণ হিসেবে বিবেচিত।
(৮) অতিরিক্ত শারীরিক ওজন বা স্থূলতা।
(১১) কিছু কিছু ওষুধ বা চিকিৎসা ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
(৯) অনিয়ন্ত্রিত যৌন সম্পর্ক, একাধিক যৌনসঙ্গী, পেশাদার যৌনকর্মীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক ইত্যাদি।
(১০) ক্রোমোজম বা জিনের কারণেও ক্যান্সার হতে পারে।
(১১) নারীর সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি ব্রেস্ট বা স্তন ক্যান্সার। নির্দিষ্টভাবে কোনো কারণ জানা না থাকলেও কিছু কিছু ফ্যাক্টর স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকিকে বাড়িয়ে দেয়, যেমন– স্তন ক্যান্সারের পারিবারিক ইতিহাস, হরমোন রিপ্লেসমেন্ট থেরাপি, কম বয়সে মাসিক চক্র আরম্ভ বা তাড়াতাড়ি ঋতুস্রাব এবং দেরিতে মেনোপজ, জীবনে বাচ্চা না নেওয়া বা কখনও গর্ভবতী হয়নি বা অধিক বয়সে শিশু জন্ম দেওয়া যেমন ৩০ বছর বয়সের পরে যাদের প্রথম সন্তান হয়েছে, বা যারা বুকের দুধ পান করাননি তাদের স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি কিছুটা বেশি। বিকিরণের প্রভাব যেমন মহিলারা বুকের এলাকায় অন্য ক্যান্সারের কারণে বিশেষ করে মাথা, ঘাড় বা বুকে রেডিওথেরাপি নিয়েছেন, বিশেষ করে অল্প বয়সে, তাদের পরবর্তী জীবনে স্তন ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। v
[বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক]
উৎস: Samakal
এছাড়াও পড়ুন:
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মন্তব্য করে চাকরি হারানোর ঝুঁকি কতটা?
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কর্মস্থল নিয়ে মন্তব্য করার আগে চিন্তাভাবনা করা জরুরি। যদিও কর্মীদের কিছু নির্দিষ্ট আইনি সুরক্ষা রয়েছে, তবে বাস্তবতা বেশ জটিল। সম্প্রতি টেসলার এক ব্যবস্থাপক লিংকডইনে ইলন মাস্ক সম্পর্কে সমালোচনামূলক মন্তব্য করার পর চাকরি হারিয়েছেন।
দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কর্মস্থল নিয়ে মন্তব্য করা কর্মীদের জন্য কতটা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। নিয়োগকর্তারা সাধারণত কর্মস্থল সম্পর্কে প্রকাশ্যে সমালোচনা পছন্দ করেন না। অনেক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নীতিমালা রয়েছে, যা লঙ্ঘন করলে কর্মী চাকরিচ্যুত হতে পারেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমনকি সহকর্মীর কোনো সমালোচনামূলক পোস্টে ‘লাইক’ দিলেও চাকরির ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।
তবে আইন অনুযায়ী কিছু সুরক্ষা কর্মীদের জন্য প্রযোজ্য। তাই চাকরির চুক্তিপত্র ও প্রতিষ্ঠানের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নীতিমালা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখা জরুরি।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কর্মস্থল নিয়ে মন্তব্য করার কারণে চাকরি হারানোর আশঙ্কা নির্ভর করে কয়েকটি বিষয়ের ওপর। বিশেষ করে, যদি কেউ অ্যাট-উইল (ইচ্ছানুযায়ী চাকরিচ্যুত করা যেতে পারে) চুক্তির আওতায় কাজ করেন, তাহলে নিয়োগকর্তা যেকোনো সময়, যেকোনো কারণে তাকে বরখাস্ত করতে পারেন। তবে কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন, বৈষম্যবিরোধী আইন বা নির্দিষ্ট শর্তযুক্ত চুক্তি। যেখানে চাকরিচ্যুতির নির্দিষ্ট কারণ উল্লেখ থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সব অঙ্গরাজ্যে অ্যাট-উইল কর্মসংস্থানের নিয়ম কার্যকর। তবে মন্টানা একমাত্র ব্যতিক্রম। এ অঙ্গরাজ্যে কর্মী ছাঁটাইয়ের জন্য যৌক্তিক কারণ দেখাতে হয় বলে জানিয়েছে ন্যাশনাল কনফারেন্স অব স্টেট লেজিসলেচারস। এ ছাড়া দেশটির ন্যাশনাল লেবার রিলেশনস অ্যাক্ট অনুযায়ী, কর্মীদের একত্র হয়ে কর্মপরিবেশ ও চাকরির শর্তাবলি নিয়ে আলোচনা করার অধিকার রয়েছে এবং এটি আইনি সুরক্ষার মধ্যে পড়ে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মসংস্থান আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ক্যাথরিন ফিস্ক বলেন, যদি কোনো কর্মী যুক্তি দিতে পারেন যে তিনি সহকর্মীদের সঙ্গে আলোচনা করছিলেন, তাঁদের প্রতিনিধিত্ব করছিলেন বা তাঁদের স্বার্থে কথা বলছিলেন, তাহলে তাঁর বক্তব্য আইনের আওতায় সুরক্ষিত হতে পারে। অধ্যাপক জেফ্রি হির্শের মতে, এমনকি সহকর্মীর কোনো পোস্টে ‘লাইক’ দেওয়া পর্যন্ত আইনি সুরক্ষার মধ্যে পড়তে পারে। তবে পোস্টটি অবশ্যই কর্মপরিবেশ বা প্রতিষ্ঠানের নীতিমালার মতো বিষয়ে হতে হবে এবং পোস্টটি একাধিক কর্মীর ওপর প্রভাব ফেলে এমন হতে হবে।
তবে সাধারণত, যদি কেউ শুধু ‘আমার বস খারাপ’ বা ‘আমার অফিসে কাজের পরিবেশ বাজে’–এর মতো ব্যক্তিগত মন্তব্য করেন, তাহলে তা আইনি সুরক্ষা পাবে না বলে জানিয়েছেন শ্রম আইন বিশেষজ্ঞ মার্ক ক্লুগার।
সরকারি কর্মচারীরা (যেমন ফেডারেল, স্টেট ও স্থানীয় সরকারি কর্মী) যদি ব্যক্তিগত সময়ে কর্মস্থলের বাইরে থেকে কোনো সামাজিক ইস্যু নিয়ে মতপ্রকাশ করেন এবং সেটি গুরুতরভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না করে তবে তারা প্রথম সংশোধনী আইনের আওতায় সুরক্ষিত থাকেন। ফিস্ক বলেন, ‘শিক্ষক বা পুলিশ কর্মকর্তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেওয়ার কারণে শাস্তির মুখোমুখি হয়েছেন এমন বহু ঘটনা রয়েছে। যেখানে তারা প্রথম সংশোধনীর অধীনে সুরক্ষা পেয়েছেন।’
প্রতিষ্ঠান কর্মীদের মিথ্যা তথ্য প্রচার করা থেকে বিরত রাখতে পারে। তবে সরাসরি সমালোচনামূলক পোস্ট নিষিদ্ধ করতে পারে না বলে জানিয়েছেন ক্লুগার।
‘ন্যাশনাল লেবার রিলেশনস বোর্ড (এনএলআরবি) অতীতে এমন নীতিমালা পর্যালোচনা করে বলেছে, এগুলো খুব কঠোর। কারণ, এতে কর্মীরা কর্মপরিবেশ নিয়ে মতপ্রকাশের অধিকার হারাতে পারেন।’ তবে কর্মীদের ছাঁটাই না করেও প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য বা সেবার বিরুদ্ধে নেতিবাচক মন্তব্য করতে নিরুৎসাহিত করতে পারে। ক্লুগার বলেন, ‘আমি যখন কোনো প্রতিষ্ঠানের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নীতিমালা তৈরি করি, তখন তাদের পরামর্শ দিই—কর্মীদের বোঝানো জরুরি যে তাদের ব্যক্তিগত পোস্ট কীভাবে প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি প্রভাবিত করতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, নীতিমালায় সাধারণত প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অপমানজনক মন্তব্য থেকে বিরত থাকা, প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক গোপনীয়তা ফাঁস না করা এবং কর্মীরা যেন স্পষ্ট করেন যে তাঁদের মতামত প্রতিষ্ঠানের অফিশিয়াল মতামত নয়—এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকে।
যদি কোনো কর্মী মনে করেন, তাঁকে অন্যায়ভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে, তবে তিনি ন্যাশনাল লেবার রিলেশনস বোর্ডে (এনএলআরবি) অভিযোগ দায়ের করতে পারেন।
অধ্যাপক হির্শ বলেন, ‘সমস্যা হলো, বেশির ভাগ মানুষ এ বিষয়ে জানেন না, এমনকি অনেক আইনজীবীও বুঝতে পারেন না যে কোনো কর্মী এই সুরক্ষা পেতে পারেন।’ অভিযোগ দায়েরের পরে এনএলআরবির একটি আঞ্চলিক অফিস এ বিষয়ে তদন্ত চালাবে এবং নিয়োগকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করবে। যদি নিয়োগকর্তা বিরোধ নিষ্পত্তি না করে, তবে এনএলআরবি বিনা মূল্যে মামলাটি পরিচালনা করবে। যদিও প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ, তবে বিচারক যদি কর্মীর পক্ষে রায় দেন, তাহলে তিনি তার চাকরিতে ফিরে যেতে পারবেন এবং বকেয়া বেতন পাবেন।
সূত্র: সিএনএন