রাষ্ট্র ও রাজনীতির পুরোনো ক্ষতের পুনরাবৃত্তি
Published: 24th, February 2025 GMT
চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের পর দেশের সমাজ ও রাজনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন হবে– এটি মানুষের ন্যূনতম প্রত্যাশা। শাসন কাঠামোতে যে আওয়ামী লীগের কর্তৃত্ববাদ জগদ্দল পাথরের মতো গেড়ে বসেছিল, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সেখান থেকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তরণ সম্পূর্ণ হবে– এই বিবেচনা নিয়েও দ্বিমত থাকবার কথা নয়। সরকার ইতোমধ্যে নির্বাচন ও আইন-সংবিধানসহ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে ৬টি সংস্কার কমিটির রিপোর্ট নিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের কাজও শুরু করেছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনে পুরোনো ক্ষতের পুনরাবৃত্তি আমাদের শঙ্কিত করে তুলছে। সমকাল জানাচ্ছে, “জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি যেভাবে নেওয়া হচ্ছে, তাতে নতুনত্বের কিছু নেই। শেষ তিন সংসদ নির্বাচন বিতর্কিত হওয়ার পেছনে যারা ‘বড় অনুঘটক’ হিসেবে কাজ করেছে, সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আর মাঠ প্রশাসনের ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের নেই কোনো পরিকল্পনা” (২৪.
অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা বাহুল্য। কার্যত আমরা দেখছি, সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে আছে নির্বাচন কমিশন। প্রধান উপদেষ্টা বা উপদেষ্টাদের ভাষা অনুসরণে তাদের কথাবার্তা আমরা শুনছি। রোববার কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার একেএম নাসিরউদ্দীন বলেছেন, ঈদের মতো আনন্দময় উৎসবের মতো করে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
প্রাতিষ্ঠানিক, আইনি ও কাঠামোগত সংস্কার না করে নির্বাচনে আনন্দ উৎসবের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে আওয়ামী লীগ আমলের নির্বাচন কমিশনের কোনো পার্থক্য আমরা দেখি না। সর্বশেষ ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ যখন প্রধান বিরোধী বিএনপিকে ছাড়াই যে কোনো উপায়ে ছলচাতুরীর নির্বাচন আয়োজনের বন্দোবস্ত চূড়ান্ত করছিল, তখন প্রতিবাদ-প্রতিরোধের মুখে ৯ নভেম্বর, ২০২৩ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের পর বঙ্গভবনের সামনে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, ‘যে কোনো মূল্যে আগামী ২৯ জানুয়ারির আগেই দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন করতে হবে’ (সমকাল, ১০ নভেম্বর, ২৩)।
প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে বাইরে রেখে নির্বাচনের আয়োজন চূড়ান্ত করবার জন্য এই ধনুর্ভঙ্গ পণ কেন করতে হয় সিইসি-কে? কেন তিনি বলতে পারেন না, সব দলের অংশগ্রহণে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরিতে বাধ্য সরকার। তখন আওয়ামী লীগের দুঃশাসন চলছিল। সিইসি তাদের হাতের পুতুল ছিলেন; তাই পারেননি। এখন? বর্তমান সিইসি নিশ্চয়ই অন্তর্বর্তী সরকারের ইশারায় চলেন না; তিনি বা তাঁর পরিষদের কেউই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যেসব আইনি শৃঙ্খলার প্রয়োজন, তা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিচ্ছেন না। কেন? পুলিশ বাহিনীর তৎপরতা আগের তিনটি নির্বাচনে সরকারপক্ষের ছলচাতুরী বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে। এবার পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রম কোন প্রকারে নিরপেক্ষ রাখা হবে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যারা নিজেরাই নির্বাচনে আইন ভঙ্গ করবেন, তাদের শনাক্ত করে বিচারের আওতায় নিয়ে আসবার প্রক্রিয়া নিয়ে নির্বাচন কমিশন আদৌ চিন্তিত? আমরা এই নিয়ে তাদের কোনো উদ্বেগের খবর পর্যন্ত জানি না।
আর নির্বাচনে একটি দলের প্রভাব? আওয়ামী লীগের বদলে অন্য কোনো দল যে এবারের নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারবে না– সেটি নিশ্চিত করবার পদক্ষেপের কথাও আমরা জানি না। নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ পত্রিকায় বলেছেন, ‘অতীতের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তির কোনো সুযোগ নেই। আগের তিন নির্বাচনে যারা মাঠের দায়িত্বে ছিলেন, তাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’ মাঠ প্রশাসনকে ইসির নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য রদবদল একমাত্র উপায় নয়; এর জন্য প্রয়োজন সুনির্দিষ্ট আইনি কাঠামো। সেটি নির্ধারণ না করে ‘তার’ লোকের বদলে ‘আমার’ লোক বসালে নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠু হবে? ভোটার তালিকা চূড়ান্ত, রাজনৈতিক দল নিবন্ধন, সীমানা নির্ধারণসহ নির্বাচনী আইন সংশোধন ছাড়া নির্বাচনের দিন ‘ঈদ উৎসবের মতো আনন্দ’ সৃষ্টির বক্তব্য গত এক দশকে তিন নির্বাচনের সিইসির প্রগল্ভতা মনে করিয়ে দেয়। ঘরপোড়া গরুর সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় পাওয়ারই কথা অবশ্য।
২.
গভীর রাতে সংবাদ সম্মেলন করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম দুষলেন ‘আওয়ামী দোসরদের’– এই খবর বিডিনিউজ জানিয়েছে ২৪ ফেব্রুয়ারি। ভিডিওতে দেখতে পেলাম, মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলছেন, দেশ থেকে প্রচুর টাকা নিয়ে গেছে আওয়ামী লীগাররা। তারা দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য এসব অর্থ ব্যয় করছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কণ্ঠে আওয়ামী লীগ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মতো ‘কেষ্টা ব্যাটাই চোর’ বলার সেই পুরোনো কায়দা দেখতে পাই। সরকারের চেয়েও আওয়ামী লীগ লুটেরাদের দাপট বেশি? একজন উপদেষ্টা– দায়িত্বে বসে এ ধরনের কথা কোন যুক্তিতে বলেন? সরকার কি তাদের শনাক্ত করতে পেরেছে? কোনো প্রমাণ উপস্থিত করতে পেরেছেন?
রাজধানীতে ছিনতাই, রাহাজানি বেড়েছে। সামাজিক মাধ্যমে সাধারণ মানুষ লিখছেন, রাস্তায় বেরুতে তারা এটিএম কার্ড বহন করবার মতো সাহস পাচ্ছেন না! সন্ধ্যার পর বাসা থেকে বেরুতে ভয় পান বলেও অনেকে উল্লেখ করছেন। যেসব ধর্ষণকাণ্ডের কথা আমরা জানতে পারছি, তা সভ্য মানুষের মাথা নত করে দেয়। ধর্ষণ, নারী নির্যাতন ও আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রতিবাদে রাজধানীসহ দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল ও মানববন্ধন করছেন। ধর্ষণ, ছিনতাই, খুন নিয়ন্ত্রণ ও বিচারের আওতায় নিয়ে আসতে না পারা সরকারের ব্যর্থতা। এটা স্বীকার করে সেই মতে পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ‘সব দায় আওয়ামী দোসরদের’ উচ্চারণকে নিতান্ত ‘অসহায়ের আর্তনাদ’ বললেও কম বলা হয়। কথা নয়, কাজেই প্রকৃত সমাধান।
৩.
সমাজ ও রাজনীতির এসব পুরোনো ক্ষতের কি উপশম নেই? ছাত্র-জনতার ক্ষমতার অভ্যুত্থান হয়েছে দেশের ক্ষমতা কাঠামোয় পালাবদলসহ সাধারণ মানুষের জীবনযাপনে ইতিবাচক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষায়। নির্বাচন কমিশন বা উপদেষ্টাদের অনেকের কথা-আচরণ সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই মেলে না।
রাজপথে সুযোগ সন্ধানও করছেন অনেকে। কথায় কথায় আন্দোলন, ভাঙচুরের মাধ্যমে অরাজকতা সৃষ্টির পেছনে কেবল পলাতক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীকে দোষ দেওয়া সমাধান নয়। অধ্যাপক রওনক জাহান শনিবার সায়েমের সম্মেলনে বলেছেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্যাগিং আর নানা কারণে লোকজন স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারছে না। তাহলে আমরা সত্য কীভাবে প্রতিষ্ঠা করব?’
সব ধরনের ট্যাগিং সংস্কৃতির বাইরে বেরিয়ে আসতে হবে। গত এক যুগ জাতীয় নির্বাচনে যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড দাবি করে এসেছে বিএনপি, এখন তাদের মুখে সে দাবি নেই কেন? নাকি এখন নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আর লাগবে না? দেশের আনাচে-কানাচে প্রান্তিক গ্রামাঞ্চলে মানুষের ঘরে ঘরে মামলার আসামি। এক খুনের মামলায় দেড়শো, দুশো আসামি। অনেকেই ঘরে থাকতে পারছেন না। জুলাই-আগস্টে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও পুলিশের হাতে নৃশংসভাবে প্রায় দেড় হাজার মানুষ খুন হয়েছে, এটা যেমন সত্য; এ-ও সত্য যে, আওয়ামী লীগের কর্মী-নেতা সকলেই খুনি নন। আওয়ামী লীগ নিয়ে যৌক্তিক সমাধানে পৌঁছা তাই জরুরি। আর এসবের মাঝে সরকারের বড় এক দায়– গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের রক্ত আর আত্মার কাছে– হত্যাকাণ্ডের যথাযথ শাস্তি নিশ্চিত করা।
চতুর্মুখী চাপের মধ্যে অবাধ গণতান্ত্রিক নির্বাচনই দেশকে সুষ্ঠু পথের সন্ধান দেবে। নির্বাচন কমিশনসহ অংশী সব পক্ষ যার যার কাজ সততার সঙ্গে পালন করলেই কেবল তা সম্ভব।
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত সরক র র উপদ ষ ট র জন য ন ত কর র জন ত আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
ঈদ উদযাপনে বাড়ি ফিরে প্রাণ হারাল শিশু সুমাইয়া
সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলায় মহাসড়ক পারাপার হওয়ার সময় নূর পরিবহনের বাসের চাপায় সুমাইয়া আক্তার (৮) নামে এক শিশু প্রাণ হারিয়েছে। পরিবারের সাথে ঈদ উদযাপনের জন্য মা-বাবার সাথে ঢাকা থেকে বাড়িতে ফিরছিল সে। মুহূর্তে পরিবারের ঈদ আনন্দ বিষাদে রূপ নেয়।
শনিবার (২৯ মার্চ) সকালে শান্তিগঞ্জ উপজেলার জয়কলস ইউনিয়নের সিলেট-সুনামগঞ্জ আঞ্চলিক মহাসড়কের আহসানমারা এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।
নিহত সুমাইয়া জয়কলস নোয়াগাঁও গ্রামের সিরাজ উদ্দিনের মেয়ে৷
পুলিশ জানায়, শনিবার সকালে পরিবারের সাথে ঈদ উদযাপনের জন্য মা-বাবার সাথে ঢাকা থেকে বাড়ি ফেরে শিশু সুমাইয়া৷ পরে উপজেলার নোয়াগাঁও এলাকায় সড়ক পারাপারের সময় শিশটি বাসচাপায় সড়কেই প্রাণ হারায়। এসময় ক্ষুব্ধ জনতা মহাসড়কে জড়ো হয়ে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়৷ পরে স্থানীয়দের সহযোগীতায় শান্তিগঞ্জ থানা ও জয়কলস হাইওয়ে পুলিশ যানচলাচল স্বাভাবিক করে৷
জয়কলস হাইওয়ে থানা পুলিশের এসআই নাজমুল ইসলাম বলেন, “বাসচাপায় এক শিশু নিহত হয়েছে। এতে স্থানীয় এলাকার জনতা সড়কে যানচলাচল বন্ধ করে দেয়। পরে এলাকার সচেতন বাসিন্দাদের সহযোগিতায় পুলিশ যান চলাচল স্বাভাবিক করে। এ ঘটনায় ঘাতক বাসটি জব্দ করা হয়েছে৷”
ঢাকা/মনোয়ার/টিপু