আওয়ামী লীগের ‘ঘুরে দাঁড়ানোর’ আট উপায়
Published: 24th, February 2025 GMT
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের অর্ধবছর পার হয়ে গেল। সরকারের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলটিরও পতন ঘটেছে, বললে ভুল হবে না। দলটির শীর্ষ পর্যায়ের প্রায় সব নেতা হয় দেশত্যাগী, না হয় দেশেই আত্মগোপনে অথবা কারাগারে। এর মধ্যে দলটি নিষিদ্ধের দাবিও উঠেছে। সর্বশেষ, অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেছেন, ‘গণহত্যায় জড়িত নয়– আওয়ামী লীগের এমন কেউ নির্বাচন করতে চাইলে বাধা নেই’ (সমকাল, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)।
তার মানে, আওয়ামী লীগের সামনে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ এখনও রয়েছে। শুধু এবারই নয়; ১৯৪৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে দলটি বারবার পরীক্ষার মধ্যে পড়েছে; বিপদের খাদে গিয়ে ঠেকেছে। সেই খাদ থেকে আবার ঠিক ঠিক সাংগঠনিক কৌশল দিয়ে দলের কর্মী-সমর্থককে সংগঠিত করে ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
একইভাবে বিএনপি, জামায়াত ও জাতীয় পার্টিরও ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস রয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে এর নেতৃত্বের যেমন, তেমনি অপরাপর দলেরও শেখার আছে। কারণ সময়ের পালাবদলে স্রোতের অনুকূলে যত কথাই চলুক, ইতিহাস বিজয়ী এবং পরাজিত উভয় পক্ষকেই পরীক্ষার মধ্যে রাখে। প্রশ্ন হচ্ছে, এবার কি আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াতে পারবে? পারলে, সেটা কীভাবে সম্ভব?
১.
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের দরকার আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মশুদ্ধির প্রত্যয়। ১৫ বছর ভালো বা মন্দ যা-ই করেছেন; অকপটে অতীতের সব ভুলের জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। কেবল বিবৃতি নয়; ভুল স্বীকারের জন্য মানুষের কাছে যেতে হবে। মানুষের কাছে যেতে হলে গণতান্ত্রিক আবহের জন্য অপেক্ষা করতে হবে, তা যেমন ঠিক; তাই বলে বসে থাকাও চলবে না। বিশেষত গণতন্ত্রের পক্ষের দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে। তাদের সঙ্গে কিছু বিষয়ে সমঝোতায় আসতে হবে। মনে রাখতে হবে, দেশ ও দলের স্বার্থে আপসরফা ইতিবাচক রাজনীতিরই অংশ। রাজনীতিকে মনে করা হয় ‘আপসরফা শিল্পের চূড়ান্ত রূপ’। রাজনৈতিক বৈরিতা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত সম্পর্কের মাধ্যমে বরফ গলানোর দৃষ্টান্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনেও অনেক রয়েছে।
১৯৭৫ সালের পর ক্ষমতার বাইরে থাকা আওয়ামী লীগের জন্য প্রথম নির্বাচনী রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন প্রয়াত মেয়র হানিফ। ১৯৯৪ সালে ঢাকা নগর সংস্থার প্রথম নির্বাচনে ক্ষমতাসীন বিএনপি প্রার্থী মির্জা আব্বাসকে হারিয়ে জয়ী হয়েছিলেন। মানুষ আওয়ামী লীগ এবং তাঁর কথায় আস্থা রেখেছিল। তিনিও সেই বিশ্বাস রেখেছিলেন। অতীতের সব ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে ঢাকাবাসীর কাছে একটি সুযোগ চেয়েছিলেন।
আওয়ামী লীগ নেতাদের নিজের ঢোল পেটানোর চর্বিতচর্বণ বক্তৃতা যথেষ্ট হয়েছে। এসব বক্তৃতার কারণে বরং নবীন প্রজন্মের বড় অংশের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। তাদের কথা, মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে আওয়ামী লীগের ফারাক দূর করার জন্য বরং করণীয় নির্ধারণ করতে হবে।
২. পুঁজিপতিদের খপ্পর থেকে মুক্তি
মনে রাখতে হবে, আওয়ামী লীগ ছিল মূলত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের দল। কিন্তু গত দেড় দশকের সুসময়ে এক দল অলিগার্ক বা লুটেরা পুঁজিপতি দলটিতে নেতাগিরি ফলিয়েছে। দলের বিপদের সময় এই ধনিক চক্র নিরাপদে চলে গেছে বা নতুন প্রতিপক্ষ দলের সঙ্গে আলগোছে ভিড়ে গেছে। গরিব কর্মী-সমর্থকই মার খাচ্ছে; জেল-জুলুমের মুখে পড়েছে; মারাও পড়ছে। বিপদ কেটে গেলে সেই ধনিক শ্রেণি যদি আবার দলের নিয়ন্ত্রণ নেয়, তাহলে দলটির ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দেখি না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই গত সাড়ে চার দশকে দলের মধ্যে ধনিক শ্রেণির নিয়ন্ত্রণ ক্রমান্বয়ে বেড়েছে এবং শেষতক কুৎসিত পর্যায়ে চলে এসেছিল, যা সরকার ও দলের বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ। এ চর্চা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
আমরা আমআদমি যা জানি, আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তা জানে না, এমন নয়। আম আদমিদের কথা ধরে দলটি কর্মপরিধি ও করণীয় ঠিক করবেন, তা মনে করার কারণ নেই। কিন্তু মনে করিয়ে দিতে চাই, রাজনীতিতে ‘আমি’ আর ‘আমার’ আত্মঘাতী আত্মকেন্দ্রিক চেতনা এক ধরনের বালাই। রাজনীতি হচ্ছে সমষ্টিকে নিয়ে চলা। সমষ্টিকে নিয়ে চলতে হলে অন্যের ভাবনার সঙ্গে আত্তীকরণ বা কাছাকাছি আসার কৌশল রপ্ত করতে হয়।
৩. নেতৃত্বের বিকেন্দ্রীকরণ
রাজনৈতিক দল ও সরকার যদি এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক আর গোয়েন্দানির্ভর হয়, তার পরিণতি যে আখেরে ভালো হয় না– আওয়ামী লীগ তার সর্বসাম্প্রতিক উদাহরণ। দেশে দেশে এমন নজির ভূরি ভূরি।
একজন মানুষ বা একজন নেতা সব সমস্যার সমাধান করতে পারেন; সমাধান দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন– তাতে দোষের কিছু না। তিনি সব কৃতিত্বের ভারও নিতে পারেন। কিন্তু সব দোষ ও ব্যর্থতার ভার প্রকারান্তরে অবস্থা বুঝে যখন সেই একজনের ওপর এসে বর্তায়, তখন তিনি সেই ভার সইতে পারেন না। এই অবস্থায় সবকিছু ভেঙে পড়ে। আওয়ামী লীগের এমন বাস্তবতা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দলীয় কাঠামো নিয়ে ভাবার দরকার। তবে প্রথম যে কাজটি করতে হবে তা হলো, একজন মুখপাত্র বেছে নেওয়া।
গত ছয় মাসে একজন মুখপাত্র থাকলে দেশ-বিদেশের কূটনীতিকসহ নানা পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক প্রতিনিধিত্বের সুযোগ কাজে লাগানো যেত। এতে দলটি আস্তে আস্তে পরিস্থিতির পক্ষে অনুকূল আবহ সৃষ্টি করে রাজনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে পারত। এর বদলে দলটি হয়ে পড়েছে সামাজিক মাধ্যমনির্ভর। এটি আওয়ামী লীগের জন্য আত্মঘাতী হচ্ছে। কারণ সামাজিক মাধ্যমের অনিশ্চয়তায় যে কোনো সময় দলটি যোগাযোগের শেষ হাতিয়ারও হারিয়ে ফেলতে পারে।
৪. থিঙ্ক ট্যাঙ্ক পুনর্গঠন
ক্ষমতার দেড় দশকে দলটির ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ হিসেবে পরিচিত সেন্টার ফর রিসার্চ অ্যান্ড ইনফরমেশন (সিআরআই) যথেষ্ট তৎপর ছিল ইংরেজিনির্ভর ভাবনা উৎপাদন করতে। অথচ গরিব মানুষের সমর্থননির্ভর দলটির কয়জন মানুষ ইংরেজি পড়ে– সুসময়ের ঠিকাদাররা খোঁজ রাখেন? ভাষা আন্দোলনের গর্বিত ইতিহাসের অধিকারী দলটির থিঙ্ক ট্যাঙ্কারদের বাংলা ভাষায় বিরাগ ছিল কেন? সিআরআই টানা ছয় মাস ধরে ঘুমন্ত। এর কুশীলবরা সম্ভবত অপেক্ষায় আছেন– আবার দল কবে ক্ষমতায় ফিরবে; তখন তারা স্যুট-টাই পরে ইংরেজি ফলাতে ক্যামেরার সামনে হাজির হবেন।
আওয়ামী লীগকে নতুন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক গঠন করতে হবে এবং দেশের ভাষা, সমাজ, রাজনীতি ও কূটনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ও দক্ষ মানুষকে দিয়ে তা সাজাতে হবে।
৫. দলের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি দূর
আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দুর্নীতির বিরুদ্ধে গত দেড় দশক ধরে বক্তৃতা করলেও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। দুর্নীতি সরকারি পর্যায়ে যেমন ছিল, তেমনি দলীয় পদ-পদবি ও কমিটি গঠনেও ছিল। দলীয় কমিটি গঠনে ছিল স্বজনতোষণ-পোষণ ও ঘুষ বাণিজ্য। এসব প্রবণতা বন্ধ করে সবার মাঝে আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। দলের ভেতরে দুর্নীতির জন্যও দলীয় পর্যায়ে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক পরিবারতন্ত্র নয়; জেলায় জেলায় এমনকি উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে যে পরিবারতান্ত্রিক দাপট, সেসব থেকেও দলকে যথাসম্ভব উদ্ধার করতে হবে।
দলীয় ফোরামে ও বাইরে কে বলল, তার চেয়ে কী বলল, সেই বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে। নেতাদের তৈলমর্দন আর চামচামি ত্যাগ করে কর্মীদের বক্তব্য দেওয়ার পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে হবে। এভাবে স্থানীয় পর্যায়ে সৎ, যোগ্য ও দুর্নীতিমুক্ত নেতা তুলে আনতে হবে। সৎ নেতৃত্বকে দল পরিচালনায় স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য দলীয় তহবিল এবং দলীয় সদস্যদের নিয়মিত চাঁদা ও স্বচ্ছ অনুদান প্রথা চালু করতে হবে।
৬. দলের ভেতরে বিতর্কে উৎসাহ
দলের মধ্যে বিতর্কের চর্চা থাকতে হবে। দ্বিমত পোষণকে উৎসাহিত করার উষ্ণ পরিবেশ থাকতে হবে। এই পরিবেশ নিশ্চিত করা একান্তই নির্ভর করে শীর্ষ নেতৃত্বের ওপর। সাড়ে চার দশকে শেখ হাসিনার মত ও সিদ্ধান্তের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেছেন তেমন কারও দলের ভেতরে পরিণতি ভালো হয়েছে– এমন কোনো আভাস নেই। এ অবস্থার পরিবর্তন হতে হবে।
পাশের দেশ ভারতে কংগ্রেস সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে ছিলেন গান্ধী পরিবারের পছন্দের প্রার্থী। বিপরীতে প্রার্থী ছিলেন শশী থারুর। শেষতক সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন খাড়গে। তাই বলে দলের ভেতরে নিগৃহীত হননি থারুর। অন্যদিকে রাহুল গান্ধী দলীয় ব্যর্থতার দায় নিয়ে নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগ করে দেশের এবং দলের দুঃসময়ে সারা ভারতে পদযাত্রা করেছেন, মানুষের সঙ্গে মিশেছেন। মানুষ এবং দেশকে বোঝার চেষ্টা করেছেন। শেষতক দলকে মর্যাদাপূর্ণ একটি কাঠামোর ভেতরে ফিরিয়ে আনতে পেরেছেন।
আওয়ামী লীগের নতুন প্রজন্মের সম্ভাব্য নেতাদের মধ্য থেকে এ রকম একাধিক মুখ তুলে ধরার সুযোগ কাজে লাগানো আওয়ামী লীগে বিদ্যমান শীর্ষ নেতৃত্বের আখেরি দায় এখন।
৭. সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভ্রাতৃত্ববোধ
একটি গণমুখী রাজনৈতিক দলের জন্য কর্মী-সমর্থকই শেষ কথা নয়। এর বাইরেও থাকতে পারে অগণিত শুভাকাঙ্ক্ষী। আওয়ামী লীগকে সেই শুভাকাঙ্ক্ষীদের ভাবনাকেও সম্মান করার ইচ্ছা থাকতে হবে। দম্ভের তুড়ি মেরে এতকাল তা উড়িয়ে দিয়েই এই বিপর্যয়কর অবস্থা ডেকে আনা হয়েছে। ইতিহাস পরিক্রমায় যার যার প্রাপ্য অবদানকে স্বীকার করে নেওয়া ও তুলে ধরার মতো উদারতা প্রয়োজন হবে।
সারাদেশে অগণিত প্রতিষ্ঠান বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যদের নামে ঢালাওভাবে নামকরণ দূরদর্শিতার পরিচায়ক নয়। এ বিষয়ও বিবেচনায় নিতে হবে। টাঙ্গাইল জেলা সদরের মেডিকেল কলেজের নাম কোন যুক্তিতে শেখ হাসিনার নামে রাখা হয়েছিল? এতে কারও জন্যই তা মঙ্গল বয়ে আনেনি। যে জেলায় আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী, প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক ছিলেন। এসব বিষয় দলীয় পর্যায়ে পর্যালোচনা দরকার অতীব গুরুত্বের সঙ্গে।
অতীতে না শুনলেও আওয়ামী লীগকে এবার তরুণ প্রজন্মের কথা শুনতে হবে। প্রান্তিক জনপদের দরিদ্র পরিবারের সন্তান তরুণ থেকে রাজধানীর বড়লোকের সন্তান পর্যন্ত তরুণদের মনের প্রশ্নগুলো সংগ্রহ করতে হবে। শুনতে হবে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর কথা। তারপর ঠিক করতে হবে– দলীয় নীতি ও কর্মসূচি কী হবে। ঠিকাদারিনির্ভর সাংস্কৃতিক সংগঠনের বিকল্প উদ্ভাবন প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে অন্য দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সমীক্ষার সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যেতে পারে। বিশেষত, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশ এবং শ্রীলঙ্কার জনকল্যাণমুখী কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে। পরিবর্তিত বাস্তবতায় আওয়ামী লীগের প্রয়োজন জাতীয় সংস্কৃতির ম্যানিফেস্টো রচনা করা। এটি হতে পারে সত্যেন সেনের উদীচী ম্যানিফেস্টোর আলোকে।
৮. ঘুরে দাঁড়ানো মানে ক্ষমতা নয়
উপযুক্ত নেতৃত্ব ও কৌশলে বিপুল কর্মী-সমর্থকপুষ্ট আওয়ামী লীগের মতো রাজনৈতিক দল ঘুরে দাঁড়াতেই পারে। তবে এই ঘুরে দাঁড়ানোর মানে এই নয়– দলটি এক লাফে ক্ষমতায় বসে যাবে। ঘুরে দাঁড়ানোর অর্থ মানুষের কাছে যাওয়া, তাদের আস্থা ফেরানোর কার্যক্রমে শামিল হওয়া ও রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী শক্তি হিসেবে দলের অস্তিত্বের জানান দেওয়া। পরিবেশ যদি গণতান্ত্রিক হয়, তাহলে সব বাধা উতরে গণতান্ত্রিকভাবেই আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াবে। এর ব্যত্যয় হলে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা নেওয়ার মতো গণভিত্তি দলটির আছে; নেতৃত্বের গলদ কাটিয়ে ওঠা সদিচ্ছার ব্যাপার মাত্র।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব গত পাঁচ দশকে বারবার ভুল করলেও, সেসব ভুল থেকে শিক্ষা নেয়নি। প্রকারান্তরে কর্তৃত্বপরায়ণ হয়েছে; গোয়েন্দানির্ভর হয়েছে। এবারও যদি ভুল থেকে শিক্ষা না নিতে পারে, আখেরে মুসলিম লীগের পরিণতি হলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
আনিসুর রহমান: কবি ও নাট্যকার, সুইডিশ লেখক সংঘের পরিচালনা পরিষদ সদস্য
anisur.rahman@studieframjandet.se
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র জন ত র জন ত ক র জন য পর ব র কর ছ ন পর ব শ র পর ব পর য য় র র জন ন করত দলট র আওয় ম অবস থ সরক র ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
‘ মেয়েটাকে সবার সামনে ধর্ষণ করে দুজন’
‘বাসের ৬ নম্বর সিটে ছিলেন এক মেয়ে। তিনি গানের অনুষ্ঠান থেকে ফিরছিলেন। তাঁর মাথায় সিঁদুর ছিল। সঙ্গে ছিলেন স্বামী ও ভাই। দুই ডাকাত ওই মেয়েকে টেনেহিঁচড়ে বাসের পেছনের সিটে নিয়ে যায়। ওই দুইজনের একজনকে শ্যামল বলে ডেকেছিল তাদের এক সঙ্গী। সে পাতলা গড়নের। নীল কোট পরা ছিল। আরেকজন ছিল সাদা চেক শার্ট পরা। এই দুইজন সবার সামনে মেয়েটাকে ধর্ষণ করে। অন্য নারীদের শরীরের স্পর্শকাতর স্থানেও স্পর্শ করে ডাকাতরা। আর ওই মেয়ের শরীরের বিভিন্ন স্থান রক্তাক্ত করে। তাঁর মুখের দিকে তাকানোর মতো অবস্থা ছিল না।’
গলার স্বর একটু নিচুতে নামিয়ে কথাগুলো বললেন রাজশাহী জেলার এক নারী। তিনি গত সোমবার রাতে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী চলন্ত বাসে ডাকাতি ও শ্লীলতাহানি ঘটনার বর্ণনা দিচ্ছিলেন। কথা বলতে গিয়ে ভয়ে কাঁপছিলেন। কারণ, সেদিন রাতে ওই বাসে তিনিও ছিলেন। ডাকাতরা তাঁর শরীরও স্পর্শ করে এবং টাকা ও গহনা ছিনিয়ে নেয়।
ওই নারীর বর্ণনা অনুযায়ী, সোমবার রাতে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে বাসে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলেও গত শনিবার সংবাদ সম্মেলনে টাঙ্গাইলের এসপি মিজানুর রহমান বলেছেন, ‘নারী যাত্রীদের প্রাথমিকভাবে ধর্ষণের আলামত পাওয়া যায়নি। তবে শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে।’ গতকাল রোববার রাজশাহীর ওই নারী সাংবাদিকদের ধর্ষণের বিষয়টি জানালে এসপি মিজানুরের সঙ্গে কথা বলার জন্য মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি।
রাজশাহীর নারী ঘটনার বর্ণনায় জানান, তিনি সাভারে মেয়ের বাসায় গিয়েছিলেন। সঙ্গে ছিলেন মেয়ের শাশুড়ি। ইউনিক রয়েল রোড পরিবহনের বাসে বাসটি রাত ১১টার দিকে ঢাকার গাবতলী থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ওই নারী ও তাঁর বেয়াইন ১২টার দিকে সাভাবের হেমায়েতপুর থেকে বাসটিতে ওঠেন।
তিনি বলেন, ‘বাসের ভেতরেই ডাকাত ছিল। হেমায়েতপুর থেকে ওঠে আরও দুইজন। অন্যরা গাবতলী থেকেই আসে। তাদের গেটআপ-সেটআপ ছিল ভালো– টাই, স্যুট, কোট, সানগ্লাস পরা। দেখে কেউ বুঝতে পারবে না তারা ডাকাত। আমরা সবাই বসে ছিলাম। সাভারের নন্দন পার্কে গাড়ি এলে হঠাৎ তিনজন দাঁড়িয়ে ড্রাইভারকে ছুরি ধরে বলে, বস, আপনি তো অনেকক্ষণ চালালেন এখন চাবি আমাদের দিয়ে দেন। ড্রাইভার এক কথাতেই চাবি দিয়ে দেন। এর পর গাড়ি নন্দন পার্কের রাস্তা থেকে গাজীপুরের রাস্তায় নিয়ে যায় ডাকাতরা। তখন জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি গাজীপুর, কোনাবাড়ী, সাফারি পার্কের ওই সাইড দিয়ে গাড়ি নিয়ে চলে আসছে। ভাবলাম, সামনে আরও বিপদ আছে বোধহয়।’
সেদিন বাসে চালকের পেছনের আসনে ছিলেন ওই নারী ও তাঁর বেয়াইন। ডাকাতদের একজন প্রথমে তাঁর মাথায় পিস্তল ধরে, আর একজন ছুরি উল্টো করে গলায় ধরে বলে, ‘তোর কাছে কী আছে দে।’ এরপর গলায় থাকা চেইন ও হাতের চুড়ি নিয়ে নেয় ডাকাতরা। মোবাইল ফোনটা আগেই নিয়ে নেয়। ব্যাগে ১০ হাজার টাকা থাকলেও প্রথমে তারা সেটা পায়নি। তাঁকে গালি দিয়ে একজন মাথায় থাপ্পড় মেরে বলে, ‘তোর কাছে টাকা আছে, দে।’ প্রথমে না দিলেও পরে সেই টাকা দিয়ে দেন। তবে ১০ হাজার টাকা পাওয়ার পরও এক ডাকাত সদস্য বলতে থাকে, ‘তোর কাছে আরও টাকা আছে।’ এ কথা বলে তাঁর শরীরের স্পর্শকাতর স্থানে স্পর্শ করে।
তিনি জানান, ডাকাত দলে ৯ জন ছিল। তাদের একজন দক্ষ চালক। মূল চালককে সরিয়ে সে দ্রুত গতিতে দক্ষতার সঙ্গে বাস চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। চালকের সহকারীসহ সবাইকে ছুরি ধরে ছিল। সুপারভাইজারের পায়ের ওপর পা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল একজন। তাঁকে নড়াচড়া করতে দেয়নি। পিস্তল ছিল তিনজনের কাছে। বাকি সবার কাছে ছুরি। ডাকাত দলের নেতা সবার পরে উঠে দাঁড়িয়ে যাত্রীদের শরীর ও ব্যাগ তল্লাশি করে টাকা বের করে নেয়।
ওই নারী বলেন, ‘বাস তখন চলছেই। আমরা মোট ছয়জন মেয়ে ছিলাম। তিনজন বাদে সবাই বয়স্ক। ৬ নম্বর আসনে থাকা নারী ধর্ষণের শিকার হন। বাসের সব সিটে তখন যাত্রী ছিলেন। দাঁড়ানো ছিল ৭-৮ জন। পুরো তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা বাস চলে। এই সময় সব যাত্রীর কাছ থেকে টাকা, গহনা, মোবাইল ফোন নিয়ে নেয় ডাকাতরা। কারও কাছে পানি কিনে খাওয়ার মতো ১০ টাকাও ছিল না। সবাই আহাজারি করছিলেন।’
তিনি জানান, প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা এভাবে ঘোরার পর আবার নন্দন পার্কের তেল পাম্পের সামনে বাস থামায় ডাকাতরা। একজন-একজন করে নামতে থাকে এবং পিস্তল ও ছুরি যাত্রীদের দিকে তাক করে রাখে। আটজন নামার পর চক্রের সর্বশেষ সদস্য দৌড়ে চলে যায়।
ওই নারী বলেন, ‘তখন গভীর রাত, এলাকা নির্জন। কোনো দোকানপাট নেই। আমরা কিছুদূর গিয়ে সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে ঘটনা বললাম, সেখানে তিন সেনাসদস্য ছিলেন। তারা বললেন, এখন রাত, আপনারা যে যার মতো নিরাপদে বাড়ি চলে যান। আমরা যেহেতু তিন সদস্য আছি, আমাদের ওপরও অ্যাটাক হতে পারে। ওরা কোনো পদক্ষেপ নেননি। এর পর আমরা টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানায় গেছি। সেখানে ওসি বলেন, এখন আমরা কেস নিতে পারব না, আপনারা সকাল ৯টায় আসেন। কিন্তু আমাদের তো সকাল ৯টা পর্যন্ত বসে থাকা সম্ভব না। তখন আমরা কাছাকাছি হাইওয়ে থানায় গেলাম। সেখানেও মামলা নেয়নি। হাইওয়ে পুলিশ বলে, যেখানকার ঘটনা সেখানে যেতে হবে, মির্জাপুরেই আবার যান।’
কোথাও মামলা না নেওয়ায় এবং ঘটনাটিকে গুরুত্ব না দেওয়ায় বাড়ি ফেরার সিদ্ধান্ত নেন যাত্রীরা। ওই নারী বলেন, ‘বাসে নাটোরের বড়াইগ্রাম থানার দুই ব্যবসায়ী ছিল। একজন গুড় বিক্রেতা আর একজন মাছ ব্যবসায়ী। একজনের কাছে ছিল ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা, আরেকজনের কাছে দেড় লাখ টাকা। ওরা গরিব মানুষ। গাড়ির ভেতরে খুব কান্নাকাটি করছিল। আমরা সবাই-ই কান্নাকাটি করছিলাম, তবে ওরা বেশি। ওই ব্যবসায়ীদের একজন ফোন সেভ করেছিল। সে তার মাকে কল করে। পরে তার মা বড়াইগ্রাম থানার ওসিসহ পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়ান। আমরা পৌঁছানোর পর ওখান থেকে গাড়ি থানার মধ্যে নেওয়া হয়। সেখানে পুলিশদের বলার পর পকেটের টাকা দিয়ে সবাইকে বাড়িতে পাঠানোর ব্যবস্থা করে। এরপর যে যার মতো বাড়ি ফেরে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাটোরের এসপি আমজাদ হোসাইন সমকালকে বলেন, ‘নিয়ম হলো যেখানে ঘটনাস্থল, সেখানেই মামলা করতে হবে। এজন্য তাদের মির্জাপুর থানায় যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। তবে বড়াইগ্রাম থানায়ও মামলা নেওয়া যেত। এটা করলে যাত্রীরা উপকৃত হতো। এজন্য দায়িত্বে অবহেলা পাওয়ায় বড়াইগ্রাম থানার ওসি সিরাজুল ইসলামকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। একই কারণে মির্জাপুর থানার ডিউটি অফিসারও বরখাস্ত হয়েছেন।’
এদিকে টাঙ্গাইল প্রতিনিধি জানান, বাসে ডাকাতি ও শ্লীলতাহানির ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিরা মাদকাসক্ত। মাদকের টাকা জোগাড় করতে তারা সাভার ও আশুলিয়া এলাকায় ডাকাতি, ছিনতাই ও চাঁদাবাজি করে থাকে। সম্প্রতি বাস থেকে লুট করা একটি মোবাইল ফোনের বিনিময়ে তারা গাঁজা নেয়। ওই গাঁজা বিক্রেতার সূত্র ধরেই সন্ধান মেলে ডাকাত চক্রের সদস্যদের। পরে অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। গতকাল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা টাঙ্গাইল জেলা গোয়েন্দা পুলিশের এসআই মো. আহসানুজ্জামান এসব তথ্য জানিয়েছেন।
রাজশাহীর নারীর বক্তব্যের বিষয়ে টাঙ্গাইলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, এক যাত্রীর সাক্ষাৎকারের বিষয়টি আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে। বিষয়টি আমরা খতিয়ে দেখছি। গ্রেপ্তার তিনজনের মধ্যে দু’জন আদালতে সাক্ষী দিয়েছে। জড়িত অন্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তাদের গ্রেপ্তার করতে পারলে আরও বিস্তারিত জানা যাবে।