রপ্তানি উৎসাহিত করতে প্রণোদনা নীতি পরিবর্তনের সুপারিশ
Published: 24th, February 2025 GMT
বাংলাদেশের অর্থনীতি রপ্তানিমুখী ছিল না। উৎপাদকেরা রপ্তানি বাজারের বিষয়ে যতটা আগ্রহী ছিলেন, তার চেয়ে বেশি আগ্রহ দেখাতেন দেশি বা স্থানীয় বাজারের বিষয়ে। তার কারণ হলো, পণ্য রপ্তানি করতে হলে অনেক নিয়মকানুন মানতে হয়। দেশের বাজারে পণ্য বিক্রি করতে এত নিয়মকানুনের বালাই নেই।
বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের শিল্প ও বিনিয়োগ নীতি বলতে কিছু নেই। বিচ্ছিন্ন বা ছাড়া ছাড়াভাবে কিছু নিয়মকানুন আছে, কিন্তু এগুলোর মধ্যে সমন্বয় নেই। অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এ সমন্বয়হীনতা কাটাতে হবে। প্রণোদনাকাঠামোও এমন করতে হবে যেন রপ্তানি উৎসাহিত হয়।
আজ সোমবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে ‘রিকমেন্ডেশনস বাই দ্য টাস্কফোর্স অন রিস্ট্র্যাটেজাইজিং দ্য ইকোনমি’ শীর্ষক দুই দিনব্যাপী এক সম্মেলনের প্রথম দিনে বক্তারা এ কথাগুলো বলেন। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন টাস্কফোর্সের সভাপতি কে এ এস মুরশিদ। তিনি টাস্কফোর্সের সুপারিশ নিয়ে আলোকপাত করেন। গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ও টাস্কফোর্স যৌথভাবে এ সম্মেলনের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে সিপিডির চেয়ারম্যান রেহমান সোবহান বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির সমস্যা কী, সে বিষয়ে আমরা সবাই কমবেশি অবগত। অনেক দিন ধরেই এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।’ তিনি নিজে অন্তত এক হাজার অনুষ্ঠানে এ কথা বলেছেন বলে জানান। বলেন, কেন সমস্যার সমাধান হয় না বা কোথায় গিয়ে সব আটকে যায়, তার ব্যাখ্যা দরকার। টাস্কফোর্সের কাছে তাঁর প্রত্যাশা ছিল, সংস্কার কেন আটকে যায়, তার ব্যাখ্যা থাকবে।
বিশ্ববাণিজ্যে বহুপক্ষীয় বা বিধিবদ্ধ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন রেহমান সোবহান। তিনি মনে করেন, ট্রাম্প দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যব্যবস্থা বা চুক্তি করতে হবে।
দেশের অর্থনীতির সমস্যা কী, সে বিষয়ে আমরা সবাই কমবেশি অবগত। অনেক দিন ধরেই এসব নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু কেন সমস্যার সমাধান হয় না বা কোথায় গিয়ে সব আটকে যায়, তার ব্যাখ্যা দরকার।—রেহমান সোবহান, চেয়ারম্যান, সিপিডিপ্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, গত সরকারের আমলে বাংলাদেশের অর্থনীতির দুর্বৃত্তায়ন হয়েছে। ওই সময় বিভিন্ন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে। সেই ধারা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, একসময় যেভাবে তৈরি পোশাকশিল্পের বিকাশ হয়েছিল, এখন সেভাবে তা হবে না। সে জন্য তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য ও রপ্তানি সম্প্রসারণে জোর দেন।
অনুষ্ঠানে টাস্কফোর্সের সুপারিশ নিয়ে উপস্থাপনা দেন টাস্কফোর্সের দুই সদস্য গবেষণা সংস্থা সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান ও র্যাপিডের চেয়ারম্যান আবদুর রাজ্জাক। তাঁরা রপ্তানি খাতের সম্প্রসারণে যথাযথ নীতি প্রণয়নে জোর দেন। তাঁরা বলেন, দেশের তৈরি পোশাক খাতের পাশাপাশি অন্যান্য খাতেরও বিকাশের সুযোগ আছে।
আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের পরিমাণ অতটা বেশি নয়। এক তৈরি পোশাক খাতের প্রবৃদ্ধি হয়, কিন্তু চামড়াসহ কিছু খাতের রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হলেও শেষমেশ রপ্তানি কাঙ্ক্ষিত হারে বাড়ে না। বস্তুত, বাংলাদেশের সমপরিমাণ জনসংখ্যা আছে এমন দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। দেশের রপ্তানি আয়ের ৭৩ শতাংশ এলডিসি সুবিধা সংশ্লিষ্ট। ফলে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর বড় ধাক্কা আসতে পারে। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) জিএসপি প্লাস পেলেও আমরা তৈরি পোশাকে শুল্কমুক্ত সুবিধা পাব না। সে জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।’
এমনকি দেশের রপ্তানি-জিডিপির অনুপাত গত ১২ বছরে কমেছে। ২০১২ সালে রপ্তানি-জিডিপির অনুপাত ছিল ২০ শতাংশ, যা ২০২৩ সালে নেমে এসেছে ১৩ দশমিক ১৬ শতাংশে। এর মূল কারণ হলো, বাংলাদেশের ব্যবসায়ী–উদ্যোক্তারা রপ্তানি করার ঝক্কি নিতে চান না। অভ্যন্তরীণ বাজারে নানা সুরক্ষা থাকায় তাঁদের পক্ষে দেশের বাজারে ব্যবসা করাই অনেক সহজ। সে ক্ষেত্রে মানের বালাই নেই; শ্রম অধিকার রক্ষার বালাই নেই। এমনকি দেশে যে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) আসছে, তা থেকে উৎপাদিত পণ্য দেশের বাজারেই বেশি বিক্রি হচ্ছে, রপ্তানি হচ্ছে না।
সেলিম রায়হান বলেন, রপ্তানি খাত হিসেবে তৈরি পোশাকশিল্পেরও সম্প্রসারণের সুযোগ আছে। দেশে যে পোশাক তৈরি হয়, তা মূলত তুলাভিত্তিক। যদিও বিদেশে কৃত্রিম সুতাভিত্তিক পোশাকের বাজার আছে। একই সঙ্গে তৈরি পোশাক খাতকে যে ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, অন্যান্য খাতেও তা দেওয়া হোক। দেশের উদ্যোক্তাদের মধ্যে রপ্তানিবিমুখতা আছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। বলেন, এ বিমুখতা দূর করতে শুল্কনীতির সঙ্গে অন্যান্য নীতির সমন্বয় দরকার।
এ ছাড়া রপ্তানি খাতের সম্প্রসারণের অংশ হিসেবে দেশে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) সহজীকরণে জোর দেন সেলিম রায়হান। বলেন, দেশে যে এফডিআই আসছে, তার ৭০ শতাংশই পুনর্বিনিয়োগ হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, দেশ থেকে মুনাফা নিয়ে যাওয়া কঠিন। সে জন্য তিনি মুনাফা নিয়ে যাওয়া সহজ করার কথা বলেন। এফডিআই আনা সহজ করতে ওয়ান–স্টপ সার্ভিস উন্নত করার পরামর্শ দেন তিনি। বলেন, বর্তমানে এর হাল হলো, সবকিছু সেখানে স্টপ (বন্ধ) হয়ে যায়।
এদিকে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণে টাস্কফোর্স গত ৩০ জানুয়ারি যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তা এখনো হাতে পাননি বলে জানান বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
ক্ষমতায় এলে কথা ঠিক থাকবে?অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী বিএনপির নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বাণিজ্য উদারীকরণের উদাত্ত আহ্বান জানান। বলেন, বাংলাদেশে যে সুরক্ষাবাদী বাণিজ্যিক পরিবেশ বিরাজ করছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি পদে পদে বাধা। ফলে তিনি মনে করেন, নিয়মকানুনের ফাঁস শিথিল করতে দেশে বড় ধরনের উদ্যোগ দরকার।
এ পরিপ্রেক্ষিতে রেহমান সোবহান আমীর খসরুকে জিজ্ঞাসা করেন, পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে বা বিএনপি ক্ষমতায় এলে তাঁর এসব কথার কতটা বাস্তবায়িত হবে। একই সঙ্গে তাঁর যেসব খাতে ব্যবসা আছে, সেগুলোয় বাজার উদারীকরণ হবে কি না। জবাবে আমীর খসরু জানান, এ ক্ষেত্রে তাঁর আপত্তি নেই। বাজারে প্রতিযোগিতা আসুক, সেটাই তিনি চান।
বিশ্ববাণিজ্যের উদারীকরণ হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান। বলেন, ‘প্রথম জমানায় ট্রাম্প চীনের পণ্যে ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছিলেন। এবার আরও ১০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছেন। একই সঙ্গে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) বিরোধ নিষ্পত্তি ইউনিট অকার্যকর করে রেখেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফলে পৃথিবীটা আদর্শ জায়গা নয়, সবখানেই কমবেশি একই পরিস্থিতি চলছে। এই বাস্তবতা মোকাবিলা করে আমাদের এগোতে হবে।’
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ইউনিলিভারের চেয়ারম্যান ও এমডি জাভেদ আখতার। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অন ষ ঠ ন পর স থ ত সমস য ব যবস দরক র
এছাড়াও পড়ুন:
তিন শিক্ষকের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখার সিদ্ধান্ত ঢাবি সাদা দলের
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সাদা দল’ নামে একটিই সংগঠন আছে। সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গ করে একই নামে সংগঠনের যে তিনজন নিজেদের আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন, তাদের সঙ্গে সাদা দলের কোনো ধরনের সম্পর্ক থাকবে না। এ তিনজন শিক্ষক হলেন- পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আমিনুল ইসলাম, তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ মেজবাহ-উল-ইসলাম এবং উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আল মোজাদ্দেদী আলফেছানী।’ সোমবার বিকেলে জাতীয়তাবাদী শিক্ষকদের সংগঠন সাদা দলের সাধারণ সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের শিক্ষক লাউঞ্জে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় সিদ্ধান্ত হয়, এখন থেকে এ তিন শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাদা দলের হিসেবে পরিচয় দিতে পারবেন না। ওই তিনজন শিক্ষকের সঙ্গে ঢাবি সাদা দলের হয়ে কোনো ধরনের সম্পর্ক না রাখার জন্য সভায় সবাইকে পরামর্শ দেওয়া হয়। দলের এ সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে তাদের সঙ্গে কেউ যুক্ত হলে তাদের ব্যাপারেও পরবর্তীতে দলীয় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে জানানো হয়।
সংগঠনের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খানের সভাপতিত্বে সভায় প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলেন- সাদা দলের যুগ্ম আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আবদুস সালাম, অধ্যাপক ড. আবুল কালাম সরকার, অধ্যাপক আখতার হোসেন খান, অধ্যাপক ড. এবিএম ওবায়দুল ইসলাম, অধ্যাপক লুৎফর রহমান, অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খান, অধ্যাপক মহিউদ্দিন প্রমুখ।