জার্মানির পার্লামেন্ট নির্বাচনে যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সমালোচনা করেছেন সম্ভাব্য চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মের্ৎস। সোমবার সন্ধ্যায় বার্লিনে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের সভাপতি ও সম্ভাব্য চ্যান্সেলর ফ্রেডরিখ মের্ৎস নির্বাচনোত্তর অনুষ্ঠানে এ সমালোচনা করেন। তাঁর দল ছাড়াও সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টির নেতা বর্তমান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ যুক্তরাষ্ট্রের নেতাদের এমন আচরণের নিন্দা করেছেন।

জার্মানির নির্বাচনী প্রচারে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাপক হস্তক্ষেপের সমালোচনা করে মের্ৎস বলেছেন, প্রসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং তাঁর পরামর্শদাতা ইলন মাস্ক কতৃ৴ক জার্মানির নির্বাচনী প্রচারে হস্তক্ষেপকে রাশিয়ার কর্মকাণ্ডের মতোই মনে করেন। তিনি বলেন, ‘ওয়াশিংটনের হস্তক্ষেপগুলো মস্কোর হস্তক্ষেপের চেয়ে কম নাটকীয় ছিল না। তবে শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থ হয়েছে।’

মের্ৎস মনে করেন, নির্বাচন নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তাঁর সহযোগীদের নানা মন্তব্য ও উসকানি থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, বর্তমান মার্কিন সরকার ইউরোপের ভাগ্যের প্রতি উদাসীন। বিশেষ করে তিনি প্রযুক্তি ধনকুবের ইলন মাস্কের বক্তব্যের সমালোচনা করেন। মাস্ক বারবার প্রকাশ্যে জার্মানির কট্টরবাদী অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) দলটির পক্ষে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

মের্ৎস বলেন, জার্মানি এখন চাপের মধ্যে রয়েছে। তবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাঁদের প্রথম কাজ হবে ইউরোপে ঐক্য তৈরি করা এবং ইউরোপকে শক্তিশালী করা।

জার্মানির এই নেতা আরও বলেন, ধাপে ধাপে যুক্তরাষ্ট্রের চাপ থেকে বের হতে হবে। সে জন্য আগামী জুন মাসের শেষে ন্যাটো শীর্ষ সম্মেলনের জন্য তিনি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন। মের্ৎস ধারণা করছেন, ন্যাটো সামরিক জোট এমন থাকবে না। দ্রুত ইউরোপীয় নিজস্ব প্রতিরক্ষা সক্ষমতা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজন হবে এবং তা সময় বলে দেবে।

সম্প্রতি কিয়েভ এবং ইউরোপীয় নেতাদের বাদ দিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেন নিয়ে শান্তি আলোচনা এগিয়ে নেওয়ার জন্য ট্রাম্পের প্রচেষ্টায় ইউরোপজুড়ে রাজনীতিকেরা হতবাক হয়ে যান। ফলে ইউরোপীয় নেতারা তাঁদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনা করেন।

জোট সরকার গঠিত হতে পারে

জার্মানির পার্লামেন্টের নির্বাচনে সর্বশেষ ফলাফলে ৬৩০ আসনের মধ্যে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ ও সিএসইউ) দলটি ২০৮টি আসন, কট্টরবাদী অল্টারনেটিভ ফর ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) ১৫২টি আসন, সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসপিডি) ১২০টি আসন, পরিবেশবাদী গ্রিন পার্টি ৮৫টি আসন এবং বাম দল দ্য লিংকে পেয়েছে ৬৪ আসন।

জোট বেঁধে সরকার গড়ার ঐতিহ্য অনুযায়ী, সিডিইউ ও সিএসইউ ও এসপিডির সঙ্গে পরিবেশবাদী গ্রিন পার্টি মিলে জোট গঠিত হতে পারে। গ্রিন পার্টিকে বাইরে রেখেও জোট সরকার গঠনের কথা আলোচনায় রয়েছে।

তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মান গণতন্ত্র এই প্রথম পার্লামেন্টে ১৫২টি আসন নিয়ে  কট্টরবাদী এএফডি প্রধান বিরোধী দল হতে যাচ্ছে।

নির্বাচনে জার্মান ভোটারদের বিপুল অংশগ্রহণ ছিল। ৮৩ শতাংশ ভোটার উপস্থিত ছিলেন। মেৎর্সের দল ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন (সিডিইউ) এবং তাদের জোটভুক্ত দল ক্রিশ্চিয়ান সোশ্যাল ইউনিয়ন (সিএসইউ) ২৮ দশমিক ৬ শতাংশের বেশি ভোট আশা করেছিল। তবে এত ভোটার উপস্থিতির পরও তারা তা পায়নি।

এএফডির সঙ্গে কাজ করার সম্ভাবনা খারিজ করে দিয়েছেন মের্ৎস। জার্মানিতে সাধারণত মূলধারার দলগুলোকে কট্টর ডানপন্থীদের সঙ্গে জোট করতে দেখা যায় না।

সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের মের্ৎসের জোটে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকলেও এ দল নির্বাচনে তাদের এযাবৎকালের সবচেয়ে খারাপ ফল করেছে। সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট নেতা ও বিদায়ী চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ বলেন, নির্বাচনের ফলাফল তাঁর দলের জন্য একটি তিক্ত পরাজয়। তিনি জোট গঠনের আলোচনায় অংশ নেবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

৬৯ বছর বয়সী মের্ৎস কখনো মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেননি। তবে প্রচারকালে তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, জার্মান চ্যান্সেলর হলে ইউরোপে নেতৃত্ব দেখাবেন এবং ইউক্রেনের প্রতি সমর্থন জোরদার করবেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প মের্ৎসের বিজয়কে স্বাগত জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এতে এটাই প্রমাণিত হয় যে জার্মানরাও মার্কিন নাগরিকদের মতো করেই কাণ্ডজ্ঞানহীন এজেন্ডা, বিশেষ করে জ্বালানি ও অভিবাসন নিয়ে ক্লান্ত।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ইউর প সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

জার্মানির উগ্র ডানপন্থী দলের চ্যান্সেলর প্রার্থী ভাইডেল চীনা ভাষায় অনর্গল কথা বলেন

জার্মানির রাজনৈতিক দল অলটারনেটিভ ফর জার্মানির (এএফডি) সহনেতা অ্যালিস ভাইডেল বিভিন্ন কারণেই ব্যতিক্রমী একজন ব্যক্তি। একদিকে তাঁর উগ্র ডানপন্থী দলে রয়েছে পুরুষের আধিপত্য। অন্যদিকে, অভিবাসনবিরোধী দলটি নিজেকে প্রথাগত পারিবারিক মূল্যবোধ ও সাধারণ মানুষের রক্ষাকর্তা হিসেবে তুলে ধরে থাকে। তবে আপাতদৃষ্টিতে ভাইডেলের সঙ্গে এসব সাংঘর্ষিক।

৪৬ বছর বয়সী ভাইডেলের জীবনসঙ্গী শ্রীলঙ্কায় জন্মগ্রহণকারী এক নারী। তাঁরা দত্তক নেওয়া দুই সন্তানকে একসঙ্গে লালন-পালন করছেন।

ভাইডেলের চলচ্চিত্রকার হিসেবেও পরিচিতি রয়েছে। অর্থনীতি নিয়ে পিএইচডি করেছেন চীনে। ইংরেজি ও মান্দারিন ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতে পারেন তিনি।

ভাইডেলের জন্ম পশ্চিম জার্মানিতে। কিন্তু তাঁর নেতৃত্বাধীন এএফডি সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় সাবেক পূর্ব জার্মানিতে, যা সাবেক কমিউনিস্ট জার্মানি হিসেবেও পরিচিত। রাজনীতি শুরুর আগে ভাইডেল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিনিয়োগ ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস ও জার্মানির অ্যালিয়ানজ গ্লোবাল ইনভেস্টরসে চাকরি করেছেন। তা ছাড়া কিছুদিন ফ্রিল্যান্স বাণিজ্য পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।

ব্যতিক্রমী কর্মজীবনের কারণেই ভাইডেল এএফডির জন্য ‘সম্পদে’ পরিণত হয়েছেন বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। তাঁদের মতে, জার্মানির কর্তৃপক্ষগুলো এএফডিকে গণতন্ত্রবিরোধী মনে করে। কিন্তু ভাইডেলের উদার মনোভাবের কারণে দলটি সমাজের বহু মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারছে।

ভাইডেলকে প্রায় সময় কালো স্যুট, সাদা শার্ট ও গলায় মুক্তার মালা পরতে দেখা যায়। বিশ্লেষকদের মতে, নিজের কিছু সহকর্মীর চেয়ে নানা বিষয়ে তিনি বেশি দক্ষ। তবে সমালোচকেরা তাঁকে ভয়ানক সুবিধাবাদী ও ‘ভালো মানুষের মুখোশধারী’ বলে মনে করেন।

এএফডি বেশি পুরোনো দল নয়। ১২ বছর আগে যাত্রা শুরু করা দলটি জার্মানির আজ রোববারের নির্বাচনে বেশ ভালো অবস্থানে রয়েছে। এ নির্বাচনের মাধ্যমে দলটি জার্মানির রাজনৈতিক অঙ্গনে নিজেদের শক্ত অবস্থান জানান দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমনকি এ আশঙ্কাও করা হচ্ছে দলটি ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির শাসনব্যবস্থাকে জটিল করে তুলতে পারে।

জার্মানির বোখুম বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অলিভার লেম্বকে বলেন, ‘ভাইডেল এমন এক ব্যক্তি, যিনি এএফডির প্রথাগত রাজনৈতিক এলাকার বাইরে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী ও মধ্যবিত্ত বুর্জোয়া শ্রেণির কাছে আবেদন তৈরি করতে পারেন। [দলটির] উন্মাদ ও চরমপন্থীদের আখড়ায় শুধু তাঁকেই পরিপক্ব বলে মনে হয়।’

এএফডির এ নেতার আমলে গত কয়েক বছরে দলটির সমর্থক বেড়েছে। এ সময় মূলত অভিবাসনবিরোধী মনোভাব ও চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের ভঙ্গুর জোটের কার্যক্রমে সৃষ্ট হতাশা থেকে লাভবান হয়েছে দলটি। শলৎজের নেতৃত্বাধীন জোট গত নভেম্বরে ভেঙে গেছে।

জার্মানিতে সাম্প্রতিক নির্বাচনী প্রচারে বেশ কিছু সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ক্ষোভ উসকে দিয়েছেন ভাইডেল। সহিংসতার ঘটনায় একাধিক অভিবাসীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আজকের নির্বাচন নিয়ে চালানো কিছু জরিপে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ২৯ শতাংশ সমর্থন রয়েছে রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের (সিডিইউ)। ২১ শতাংশ নিয়ে এরপরই রয়েছে এএফডি। ১৬ শতাংশ নিয়ে তৃতীয় স্থানে শলৎজের নেতৃত্বাধীন সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এসপিডি)।

এএফডি এবারের আগে কখনো চ্যান্সেলর প্রার্থী দেয়নি। ভাইডেল এরই মধ্যে স্বীকার করেছেন যে এখনই তাঁর দলের সরকারের শরিক হওয়ার তেমন একটা সম্ভাবনা নেই। তাঁর এ মন্তব্যের কারণে অন্যান্য দলগুলো এএফডির সঙ্গে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। ফলে এএফডিকে ঘিরে একধরনের সহযোগিতা না করার মনোভাব গড়ে উঠেছে।

এসপিডি প্রধান ওলাফ শলৎজের (বাঁয়ে) নির্বাচনী প্রচারণার পোস্টার ও এএফডি প্রধান অ্যালিস ভাইডেলের নির্বাচনী প্রচারণার পোস্টার। জার্মানির হামবুর্গে, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৫

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জার্মানিতে নির্বাচনে জয়ী হলেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি সিডিইউ-সিএসইউ, সরকার গঠন কীভাবে
  • জার্মানির নির্বাচনে রক্ষণশীলদের জয়, চ্যান্সেলর হচ্ছেন ফ্রিডরিখ মের্ৎস
  • বুথ ফেরত জরিপে এগিয়ে সিডিইউ
  • জার্মানিতে নির্বাচনে এগিয়ে ডানপন্থি সিডিইউ
  • জার্মানির উগ্র ডানপন্থী দলের চ্যান্সেলর প্রার্থী ভাইডেল চীনা ভাষায় অনর্গল কথা বলেন