মাননীয় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা, ‘ও আম্মাগো’ চিৎকারটা কি শুনতে পান
Published: 24th, February 2025 GMT
এবার একুশে ফেব্রুয়ারি শহীদ মিনারে বেসরকারি একটি টেলিভিশন চ্যানেলের লাইভ সম্প্রচারে একজন তরুণী নতুন বাংলাদেশের কাছে তাঁর প্রত্যাশার কথা জানাচ্ছিলেন। খুব দ্বিধাহীনভাবে তিনি বলছিলেন, সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে গণ-অভ্যুত্থানে দায়িত্ব নেওয়া সরকারের কাছে তাঁর প্রত্যাশা হলো, তিন বেলা খেয়ে-পরে যেন ভালোভাবে থাকতে পারে, আর ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদে যাতে আবার ঘরে ফিরতে পারে। ছয় মাস বয়সী অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে শুধু এই মধ্যবিত্ত তরুণীর নয়, বাংলাদেশের সব মানুষের এখনকার সাধারণ চাওয়া এটি।
ছাত্রদের নতুন দলের নেতৃত্ব নিয়ে বিতর্ক, অভ্যুত্থানে কার কতটা ভূমিকা এবং কে কার চেয়ে বড় মাস্টারমাইন্ড, এবারের একুশে ফেব্রুয়ারি পালনে আগের চেয়ে কতটা পার্থক্য দেখা গেল, বাংলাদেশের দুজনের কোন সংস্থা যুক্তরাষ্ট্রের ২৯ মিলিয়ন ডলার পেয়েছেন, এসব বিষয় নিয়ে গত কয়েক দিন ফেসবুক সরগরম হয়ে আছে।
কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে ফেসবুকের নিউজফিডে একের পর এক খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, ডাকাতির ঘটনার পোস্ট, ফটোকার্ড, সংবাদ, ছবি, ভিডিও ভেসে আসছে। এর মধ্যে রাজধানীর বনশ্রীতে দোকান থেকে বাসায় ফেরার পথে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে মোটরসাইকেলে করে আসা ডাকাতেরা গুলি করে সোনা ও টাকা লুট করে নেওয়ার ভিডিও অসংখ্য মানুষ শেয়ার করে সবাইকে সতর্কভাবে চলার কথা বলেছেন। ভিডিওতে আক্রান্ত ব্যবসায়ী বারবার করে ‘ও আম্মাগো’ বলে চিৎকার করছিলেন। সেই চিৎকার সবার মাঝেই ভয় ছড়িয়েছে। আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
আরেকটি সিসিটিভির ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, পথের কুকুরকে খাবার দিতে যাওয়া এক দম্পতিকে রামদা হাতে কয়েকজন ছিনতাইকারী ঘিরে ধরেছে। আরেকটা ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, রামদা, চাপাতি হাতে কিশোর বয়সী দুই ছিনতাইকারী জ্যামে আটকে থাকা প্রাইভেট কারের জানালা দিয়ে কীভাবে মুঠোফোন নিয়ে সটকে পড়ছে। সবার সামনেই অস্ত্র হাতে তারা ছিনতাই করছে। সেই ছিনতাইয়ের ভিডিও ফেসবুকে আসছে। সম্প্রতি এ রকম ছিনতাই, ডাকাতি যেন স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আগে যেমন রাতে ও ভোরের দিকে ছিনতাইয়ের ঘটনা বেশি ঘটতে দেখা যেত, কিন্তু এখন সন্ধ্যায় ও দিনের বেলাতেও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। শুধু ছিনতাই নয়, সংঘবদ্ধ চুরি, ডাকাতির ঘটনাও নিয়মিত ঘটছে। সিসিটিভির কারণে সেসব ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আসছে।
একের পর এক এসব অপরাধের ঘটনা নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক ও নিরাপত্তাহীনতা বোধ তৈরি করছে। এর মধ্যে আবার ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলোও নিরাপত্তাহীনতার প্রশ্নকে আরও তীব্র করে তুলছে। বিশেষ করে ঢাকা থেকে রাজশাহীগামী বাসে ডাকাতির সময় নারী যাত্রীদের যৌন নিপীড়ন এবং এক নারীকে ধর্ষণের অভিযোগ সবার মধ্যেই আতঙ্ক তৈরি করেছে।
বাস ডাকাতির ঘটনাটি ঘটেছে ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে। মূলধারার গণমাধ্যমে এসেছে এরও দুই দিন পর। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনার তিন দিন পর পুলিশ মামলা নিয়েছে।
মোহাম্মদপুরে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে ‘গুলিবিনিময়কালে’ যে দুজন নিহত হয়েছেন, তাঁর একজন জুম্মন। টিবিএসের খবর জানাচ্ছে, সাবেক টাইলস মিস্ত্রি জুম্মন গত বছর শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর চাকরি হারান। পরে মিরাজের সঙ্গে স্থানীয় একটি গ্যাংয়ে যোগ দেন তিনি। ফলে মানুষ কাজ হারাতে থাকলে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির মতো অপরাধ কমানো কতটা সম্ভব?কল্পনা করুন তো, তিন ঘণ্টা ধরে ডাকাতেরা বাসটিতে ডাকাতি করেছে। এরপর তারা নিরাপদে নেমে গেছে। এ রকম পরিস্থিতিতে খুব স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যায়, যাঁরা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যাঁরা সর্বস্ব হারিয়েছেন, তাঁদের মানসিক ট্রমা কতটা গভীর হতে পারে। অথচ ভুক্তভোগী নারীদের এবং সর্বস্ব হারানো যাত্রীদের গভীর রাতে রাস্তার মধ্যেই ফেলে রেখে চলে আসতে চেয়েছেন বাসচালক ও তাঁর সহকারীরা। যাত্রীদের চাপে শেষমেশ বাস চালাতে রাজি হয়েছেন।
এরপর তাঁরা বাস নিয়ে দুটি থানায় গেছেন। ডাকাতির ঘটনা তাঁরা বর্ণনা করেছেন। সহযাত্রী নারীরা যৌন নিপীড়নের এবং তাঁদের একজন ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এমন বর্ণনাও তাঁরা দিয়েছেন। কিন্তু দুটি থানার কোনটিই তাঁদের মামলা নেয়নি। ভুক্তভোগীদের সহযোগিতা ও আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেনি। তৃতীয় থানায় গিয়ে তাঁরা তাদের অভিযোগ জানাতে পেরেছেন। কি অদ্ভুত নিয়ম! চলন্ত বাসে কোন থানার মধ্যে অপরাধ হয়েছে, সেটা প্রমাণের দায়িত্ব কি ভুক্তভোগী ব্যক্তিদের?
পুলিশ তাদের দুজন কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করেছে। পুলিশ বলেছে, বাসে ধর্ষণ হয়নি, শ্লীলতাহানি হয়েছে। প্রথমত, ‘শ্লীলতাহানি’ শব্দটাই আপত্তিকর ও রাজনৈতিকভাবে পুরুষতান্ত্রিক। দ্বিতীয়ত, ভুক্তভোগী নারীদের বক্তব্য না শুনে এই উপসংহারে তারা কীভাবে পৌঁছাতে পারে? ২৩ ফেব্রুয়ারি যমুনা টেলিভিশনে বাসের একজন নারী যাত্রী ঘটনার যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাতে তিনি দাবি করেছেন, একজন নারীকে তাঁর ভাইয়ের পাশ থেকে টেনেহিঁচড়ে তুলে নিয়ে গিয়ে ডাকাতেরা ‘ধর্ষণ’ করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, পুলিশ কেন ঘটনার এক সপ্তাহ পরও ভুক্তভোগী নারীদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি? নিরাপত্তা দিতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে কী ঘটেছে, সেটা বের করার ব্যাপারে তাদের এমন অনাগ্রহ কেন?
গণ-অভ্যুত্থানের পর পুলিশি ব্যবস্থা যখন একেবারে ভেঙে পড়েছিল, তখন জননিরাপত্তা নিয়ে নানা আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মানুষ ছিল তখন ঐক্যবদ্ধ। পাড়ায় পাড়ায় পাহারা দিয়ে ছাত্র-জনতা অপরাধীদের প্রতিহত করেছে। অভ্যুত্থানের ছয় মাস পর, বিশেষ করে যখন অপারেশন ‘ডেভিল হান্ট’ নামের বিশেষ অভিযানে প্রায় ১০ হাজার মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সেই সময়ে অপরাধ বেড়ে যাওয়ার কারণ কী? তাহলে কি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পুরো শক্তিকে রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তারে নিয়োজিত করা হয়েছে?
ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ বিভিন্ন জায়গায় ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন বন্ধের দাবিতে প্রতিবাদ কর্মসূচি হয়েছে। সেখানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নিষ্ক্রিয়তার সমালোচনা তাঁরা করেছেন। কেউ কেউ তাঁর পদত্যাগও দাবি করেছেন। এ অবস্থায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা গতকাল রোববার দিবাগত রাত ৩টায় জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, আওয়ামী লীগের দোসরেরা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। কিন্তু খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, ডাকাতির মতো অপরাধের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দায় দেওয়া হলে সেটা মানুষকে কতটা আশ্বস্ত করতে পারে? সবচেয়ে বড় কথা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে রাত ৩টার সংবাদ সম্মেলনে নাগরিকেরা আশ্বস্ত হওয়ার বদলে উদ্বিগ্ন হন।
গত কয়েক মাসে দেশের ব্যবসায়ী, নাগরিক সমাজ, রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে পাড়ার মোড়ের পানের দোকানি—সবার মূল উদ্বেগের বিষয় ছিল আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি। ব্যবসায়ীরা এমনটাও বলেছেন, সামগ্রিকভাবে যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে, তাতে তাঁরা কেন তাঁদের টাকা বিনিয়োগ করবেন। দেশে গত ছয় মাসে বিদেশি বিনিয়োগ ৭১ শতাংশ কমে গেছে, তারও মূল কারণ এই অনিশ্চিত পরিবেশ।
অপরাধ বেড়ে যাওয়া, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ও নাগরিকদের মধ্যে নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হওয়া—এ তিনের সঙ্গে আইনের শাসন ও অর্থনীতির প্রশ্নটি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। মোহাম্মদপুরে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে ‘গুলিবিনিময়কালে’ যে দুজন নিহত হয়েছেন, তাঁর একজন জুম্মন। টিবিএসের খবর জানাচ্ছে, সাবেক টাইলস মিস্ত্রি জুম্মন গত বছর শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর চাকরি হারান। পরে মিরাজের সঙ্গে স্থানীয় একটি গ্যাংয়ে যোগ দেন তিনি। ফলে মানুষ কাজ হারাতে থাকলে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির মতো অপরাধ কমানো কতটা সম্ভব?
মানুষের মধ্যে যে নিরাপত্তাহীনতা বোধ তৈরি হয়েছে, সেটা সরানোর দায়িত্ব সরকারের। ঘর থেকে বের হয়ে নিরাপদে ঘরে ফেরা কিংবা ঘরে ফিরে চুরি, ডাকাতির আতঙ্ক নিয়ে রাত যাতে জাগতে না হয়, সেই চাওয়াটা কি খুব বেশি?
মনোজ দে, প্রথম আলোর সম্পাদকীয় মন্তব্য
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ড ক ত র ঘটন র জন ত ক ব যবস য় র একজন কর ছ ন হয় ছ ন জ ম মন অপর ধ সরক র আতঙ ক
এছাড়াও পড়ুন:
রাতভর রাজধানীতে যা ঘটলো
ঢাকায় গতকালের রাত অনেকটা আতঙ্কে কেটেছে রাজধানীবাসীর। রোববার রাত ৮টার দিকে ধানমন্ডির শংকরে একদল সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেওয়া সেখানে আতঙ্ক তৈরি হয়। পরে বনশ্রী এলাকায় ব্যবসায়ীকে গুলি করে স্বর্ণালংকার ও টাকা ছিনতাই করে অস্ত্রধারীরা।
গোড়ানে একজনকে কুপিয়ে সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। রাত ১টার দিতে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবিতে ঢাবিতে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এসব ঘটনা নিয়ে রাত ৩টার দিকে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে আসেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।
ধানমন্ডিতে যা ঘটে
রোববার রাত সাড়ে ৮টার দিকে ধানমন্ডির শংকর আলী হোসেন বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে ১০ থেকে ১২ জনের একদল সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয়। এতে ওই এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয়রা মসজিদে মাইকে ঘোষণা দেন যে, মহল্লায় ডাকাতদল প্রবেশ করেছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, দলটি আশপাশের দোকানগুলোতে ভয়ভীতি প্রদর্শন করছিল। আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা দ্রুত দোকান বন্ধ করে দেন এবং সাধারণ মানুষ নিরাপদ স্থানে চলে যান। প্রায় পাঁচ-দশ মিনিট অবস্থান করার পর সশস্ত্র দলটি এলাকা ত্যাগ করে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, এলাকাবাসী নিরাপত্তার জন্য পুলিশের সহযোগিতা চান। তবে এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোন হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
ডিএমপি ধানমন্ডি জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার শাহ মোস্তফা তারিকুজ্জামান বলেন, ধানমন্ডি এলাকায় কয়েকটি মোটরসাইকেলে ১৫-২০ জন তরুণ আসে। তবে তাদের হাতে কোনো অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। এছাড়া ধানমন্ডি এলাকায় কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি।
তিনি আরও বলেন, সন্ধ্যা ৭টার দিকে ১৫-২০ জন তরুণ ধানমন্ডির শংকর এলাকা দিয়ে যাওয়ার সময় হাজী ইউসুফ হাইস্কুলের পাশের গলির মুখে চা খাওয়ার জন্য দাঁড়ান। এ সময় নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। এটা দেখে পাশের কোন ব্যক্তি মসজিদের মুয়াজ্জিনকে বলেন এখানে ডাকাত এসেছে। তারপরে সে নিজের মতো করে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেয়। এরপরই ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়ে আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ যাচাই করে। সেখানে দেখতে পায় এসব তরুণদের হাতে কোন ধরনের অস্ত্র নেই। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে চলে যান।
বনশ্রীতে স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি
রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর রামপুরার বনশ্রী ডি ব্লক ৭ নম্বর রোডের ২০ নম্বর বাড়ির সামনে আনোয়ার হোসেন (৪৩) নামের এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীকে গুলি করেছে দুর্বৃত্তরা। এ সময় তার কাছে থাকা প্রায় ২০০ ভরি স্বর্ণ ও নগদ এক লাখ টাকা ছিনিয়ে নেয় অস্ত্রধারীরা।
পাশের ভবন থেকে ছিনতাই ও গুলির দৃশ্য মোবাইলে ভিডিও করেন বাসিন্দারা। রাতেই তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
ভিডিওতে দেখা গেছে, তিনজন মোটরসাইকেল থেকে নেমে ব্যবসায়ী আনোয়ারের কাছ থেকে ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি ব্যাগ ছাড়ছেন না। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে একজন তাকে গুলি করেন। পরে ব্যাগ ছিনিয়ে মোটরসাইকেলে করে পালিয়ে যায় তারা।
গুলিবিদ্ধ আনোয়ারের স্বজনরা জানান, আনোয়ারের ব্যাগে ২০০ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ এক লাখ টাকা ছিল। তাদের ধারণা দোকান থেকেই তাকে অনুসরণ করেছিল দুর্বৃত্তরা। এরপর বাসার সামনে পৌঁছামাত্র স্বর্ণ ও টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়।
রামপুরা থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মশিউল আলম সমকালকে বলেন, গুলিবিদ্ধ আনোয়ারকে প্রথমে বনশ্রীর ফরাজী হাসপাতালে এবং পরবর্তীতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। ঘটনাস্থল থেকে গুলির খোসা উদ্ধার করা হয়েছে।
আনোয়ারের বন্ধু মজিবুর রহমান সমকালকে জানান, বনশ্রীর সি ব্লকের ৫ নম্বর সড়কে ‘অলংকার জুয়েলার্স’ নামে জুয়েলারির দোকান রয়েছে আনোয়ারের। প্রায় ১৫ বছর ধরে তিনি স্বর্ণের ব্যবসা করছেন। ডি ব্লকের ৭ নম্বর রোডে ২০ নম্বর বাড়িতে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থেকে বাসায় হেঁটে যাতায়াত করেন। প্রতি রাতের মত রোববার রাতেও দোকানে থাকা ২০০ ভরি স্বর্ণের গহনা ব্যাগে নিয়ে হেঁটে বাসায় ফিরছিলেন। ভবনের গেটের কাছে যাওয়া মাত্র তিনটি মোটরসাইকেল তাকে ঘিরে ধরে। তাকে কুপিয়ে ও গুলি করে স্বর্ণের ব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে পালিয়ে যায় তারা। তাতে নগদ এক লাখ টাকাও ছিল।
মজিবুর রহমান আরও বলেন, আনোয়ারের শরীরে চারটি গুলিবিদ্ধ হয়েছে। এছাড়া অন্তত ৬ স্থানে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে তাকে।
ঢাবিতে বিক্ষোভ
বনশ্রী ও মোহাম্মদপুরে দুর্ধর্ষ ছিনতাইয়ের ঘটনায় রাত ১টা ১০ মিনিটে তাৎক্ষণিক হল ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সারা দেশে ধর্ষণ, ছিনতাই ও ডাকাতির প্রতিবাদে রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভ করেন শিক্ষার্থীরা। এসব অপরাধ নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর পদত্যাগের দাবি করেন শিক্ষার্থীরা।
বিক্ষোভে তারা ‘জুলাইয়ের রক্তের দাম চাই, নিরাপদ দেশ চাই’, ‘সারা দেশে অপরাধ কেন, প্রশাসন জবাব চাই’, ‘এক দুই তিন চার, জাহাঙ্গীর গদি ছাড়’, ‘দফা এক দাবি এক, জাহাঙ্গীরের পদত্যাগ’, ‘মা বোনদের নিরাপত্তা দে, নইলে গদি ছাইড়া দে’- ইত্যাদি স্লোগান দিতে থাকেন।
শিক্ষার্থীরা বলেন, গত কয়েকদিন ধরে বেশ কয়েকটি বড় অপরাধের ঘটনা সামজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এগুলো প্রতিরোধে কোনো উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ আমরা দেখিনি। আজও মোহাম্মদপুর, বনশ্রী, ধানমন্ডিতে ছিনতাইকারী ও ডাকাতদের উপদ্রব ছিল। কেউ বাসা থেকে বের হতে নিরাপদবোধ করছেন না, মানুষ আতঙ্কবোধ করছেন। এমন পরিস্থিতিতে ব্যর্থ স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ করতে হবে।
মিছিলে থাকা এক শিক্ষার্থী বলেন, সারা দেশে ছিনতাই ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ব্যর্থতার জন্য আমরা তার পদত্যাগ দাবি করছি।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার জরুরি সংবাদ সম্মেলন
রাত ৩টার দিকে বারিধারার ডিওএইচএসে নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের দোসররা দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করেছে। তারা প্রচুর টাকা দেশ থেকে স্থানান্তর করেছে। এখন সেই টাকা ব্যবহার করে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। আমরা এটা কোনো অবস্থাতেই করতে দেব না। আমরা যেভাবেই হোক এটা প্রতিহত করব। দিনে-রাতে যেখানেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রয়োজন হবে, তারা সেখানে যাবে এবং প্রতিহত করবে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আগামীকাল থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টহল বাড়বে। যেখানেই ঘটনা ঘটবে সেখানেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কারও গাফিলতি পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
জাহাঙ্গীর আলম বলেন, আওয়ামী লীগ দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য প্রচুর টাকা ব্যবহার করছে। তবে আমরা শক্ত হাতে তাদের প্রতিহত করব। আওয়ামী লীগের যারা এসব কাজ করছে, তাদের ঘুম হারাম করে দেব।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ দিনে-রাতে কোথাও জায়গা পাবে না। আমরা টহল টিমকে কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছি। তারা যদি কাজ করতে না পারে, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। আমি দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, এই আওয়ামী দোসর যারা এই কাজগুলো করছে, তাদের ঘুম হারাম করে দেব।
সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, আমি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ডেকেছি। এখন আমরা নির্ধারণ করব কীভাবে কী করা যায়। আগামীকাল থেকে আপনারা সুনির্দিষ্ট উন্নতি দেখবেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবির বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, আমার পদত্যাগের দাবি আজকেই প্রথম না। যে কারণে পদত্যাগের কথা বলা হচ্ছে সেই কারণগুলোর যদি উন্নতি হয়, তাহলে তো পদত্যাগের প্রশ্ন থাকে না। তারা চাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি যেন উন্নতি হয়, আমি সেটা করব।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বাসার সামনে হাসনাত
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার জরুরি সংবাদ সম্মেলনের পরপরই তার বারিধারা ডিওএইচএসের বাসায় সামনে আসেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ।
এ সময় বেশ কয়েকজন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। তবে এ সময় ক্যামেরার সামনে কিছু বলতে রাজি হননি।
একপর্যায়ে কয়েকজন সাংবাদিক লাইভে আছেন বুঝতে পেরে ঘটনাস্থল থেকে সরে যান হাসনাত। তাকে উপদেষ্টার বাসভবনের ফটকের সামনে দেখা গেলেও তিনি বাসার ভেতরে প্রবেশ করতে দেখা যায়নি।